তখন সবে জাপানিজ শেখা শুরু করেছি। প্রথমেই ‘আমি অমুক’, ‘তুমি তমুক’ ধরনের ছোটখাট কথাবার্তার পাশাপাশি দিনের বিভিন্ন সময়ের শুভেচ্ছাবার্তা ও প্রথাগত সম্ভাষণগুলো শেখালো। তখনই শিখলাম, খাওয়ার আগে বলতে হয়, ‘ইতাদাকিমাস’। এমনিতেই বিদঘুঁটে সব নতুন শব্দের ভিড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত, তাই ‘ইতাদাকিমাস’এর শানে নুযূল নিয়ে এত মাথা ঘামালাম না। অর্থগত দিক দিয়ে ফরাসী ‘বোন অ্যাপেটিট’(bon appétit)এর কাছাকাছি কিছু হবে বলেই ধরে নিলাম।
যারা ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিদেশ-বিভূঁইয়ে পাড়ি জমিয়েছেন, তাদের অনেকেই হয়তো ‘হোস্ট ফ্যামিলি’ কথাটার সাথে পরিচিত। একজন বিদেশি হিসেবে নতুন একটি দেশে গিয়ে সেখানকার অপরিচির সংস্কৃতির সাথে পরিচয়ের ভাল একটা সুযোগ এই ‘হোস্ট ফ্যামিলি সিস্টেম’। ‘হোস্ট ফ্যামিলি’র বাসায় প্রথমদিন রাতের খাবারের দাওয়াতে গিয়েছি। আমার শ্রদ্ধেয় আম্মীজান আগ্রহভরে আমাকে অনেক কিছু শেখাতে লাগলেন। লম্বা চপস্টিক দিয়ে রান্না করে, ছোট চপস্টিক দিয়ে খায় ইত্যাদি ইত্যাদি। খাওয়ার আগে তিনি বললেন, এখন বলতে হবে ‘ইতাদাকিমাস’। এটা জানতাম। তিনি আরো যেটা বললেন এবং যেটা জানতাম না, তা হল, ‘ইতাদাকিমাস’ বলার সাথে সাথে দুই হাতও জোড় করে নিতে হয়। একটু ধাক্কা খেলাম। দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের মাঝে প্রার্থনা বা প্রণাম করার সময় করজোড় করার রীতি প্রচলিত। বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও দেখেছি প্রার্থনা করার সময় দুই হাত জোড় করে রাখতে। আম্মীজান ছিলেন বৌদ্ধ। তাই, ‘ইতাদাকিমাস’ শব্দটা বৌদ্ধ ধর্ম থেকে প্রচলিত এক প্রকার আহারপূর্ব প্রার্থনা কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ জাগল।
ততদিনে জাপানিজ শিক্ষায় বেশ কিছুদূর এগিয়েছি। ‘ইতাদাকিমাস’ শব্দটার অর্থের সাথে পরিচিত হলাম। আহারপূর্ব সম্ভাষণের বাইরেও এর ব্যবহার আছে। শব্দটি একটি ক্রিয়া, অর্থ হচ্ছে গ্রহণ করা। তবে, এখানেও কিছু কথা আছে। বাংলায় বক্তার সাথে শ্রোতার সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সম্মানপ্রদর্শনের সূচকের উঠানামা ঘটে সর্বনামে আর ক্রিয়ার শেষাংশে। জাপানিজে এসূচকটির ঊর্ধ্বগমন কিংবা অধঃপতনের সাথে সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরো ক্রিয়াপদটিই বদলে যায়। যেমন, ‘তোমার কাছ থেকে গ্রহণ করলাম’ আর ‘আপনার কাছ থেকে গ্রহণ করলাম’ – বাক্য দুটি জাপানিজে বলতে গেলে দুইটি আলাদা ক্রিয়াপদ ব্যবহার করতে হবে। ‘তোমার কাছ থেকে গ্রহণ করলাম’ এর গ্রহণ হচ্ছে ‘মোরাইমাস’, আর ‘আপনার কাছ থেকে গ্রহণ করলাম’ এর গ্রহণ হচ্ছে ‘ইতাদাকিমাস’। এটা জানার পর আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না। ‘ইতাদাকিমাস’ বলার মাধ্যমে যার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে তিনি ঈশ্বর বা দেবতা পর্যায়েরই কিছু হবেন বলে ধরে নিলাম। তখনও আমার এক মিনিট জাপানিজ বলতে গেলে তিন মিনিট ভেবে নিতে হয় অবস্থা। তাই কোন জাপানিজের সাথে এব্যাপারে আলোচনার ইচ্ছেটা প্রচ্ছন্নই থেকে গেল।
আমি যেখানে জাপানিজ শিখি, সেখানে জাপানিজ ছাড়াও সপ্তাহে একটা ক্লাস হয় জাপানী সংস্কৃতির উপর। একদিন এক্লাসটা শুরু হলে একটু নড়েচড়ে বসলাম, কারণ ক্লাসটা ছিল ‘ইতাদাকিমাস’ প্রথা সম্পর্কে। ওইদিনকার ক্লাসে আমি এমন কিছু জানলাম, যা আমাকে নতুন করে ভাবাল।
‘ইতাদাকিমাস’ হচ্ছে ‘ইনোচি ও ইতাদাকিমাস’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এর মানে দাঁড়ায়, ‘জীবন গ্রহণ করলাম’। খোলাসা করেই বলি। আমরা খাদ্যের একটা বড় অংশই হয় উদ্ভিজ, নয় প্রাণিজ। উভয়ক্ষেত্রেই খাদ্যের উৎস কিন্তু জীবনের বাহক। সুতরাং, আমরা নিজেদের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে কিছু প্রাণ হত্যা করি। অন্যভাবে বললে, আরো কিছু জীবের জীবনের বিনিময়ে নিজেরা জীবন ধারণ করে চলি। জীবনদানকারী সেইসব জীবনের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মানসিকতা থেকেই খাদ্যগ্রহণের আগে ‘তোমার জীবন গ্রহণ করলাম’ বলার প্রথা জাপানিজদের। এক জাপানিজ বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, সে অন্তর্জাল দেখে জানাল, বৌদ্ধ ধর্ম থেকেই উৎপত্তি এপ্রথার। তাই নাকি? তাহলে পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোতেও কি একই ধরনের কিছু প্রচলিত আছে? চীন, থাইল্যাণ্ড, ভিয়েতনাম, কম্পুচিয়ার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম। না, আহারপূর্বক সম্ভাষণ আছে বটে, কিন্তু কোনটাই সমার্থক নয়। ‘ইতাদাকিমাস’ জাপানের নিজস্ব বৌদ্ধ দর্শন।
আড়াই হাজার বছর আগেকার গৌতম বুদ্ধের জীবনদর্শনের একটি ছিল, ‘জীবহত্যা মহাপাপ’। তবে, তিনি বোধহয় জীব বলতে শুধু প্রাণীকেই বুঝিয়েছেন। কারণ জীবহত্যা না করে কীভাবে মাটি, পানি আর বায়ু ভক্ষণ করে জীবন ধারণ সম্ভব, সে পথ তিনি বাতলে যান নি। আমাদের কলেজের এক শিক্ষক ছিলেন, যিনি মাছ-মাংস খেতেন না; যাকে বলে একেবারে পুরোদস্তুর নিরামিষাশী। একদিন ক্লাসে আমাদের কোন এক সহপাঠী স্যারকে নিরামিষ ভোজের কারণ জিজ্ঞেস করলে, স্যার জানান, তিনি নিজ স্বার্থে অন্য প্রাণীর জীবন হরণে রাজি নন। ক্লাসের কতিপয় দুষ্ট বালক সমস্বরে বলে ওঠল, ‘স্যার, গাছেরও তো জীবন আছে!’ স্যার তখন আরো জানালেন, ধর্মচর্চায় উনি যে পর্যায়ে আছেন, আমরা তার ধারেকাছেও নেই, তাই আমরা যেন তাঁকে এধরনের প্রশ্ন না করি। প্রসংগত, স্যার ছিলেন বৈষ্ণব মতবাদে বিশ্বাসী। উল্টোপিঠ থেকেও একটু ঘুরে আসি। একদিন ঘটনাক্রমে আমার এখনকার সহপাঠী এক ভিয়েতনামী মেয়ের সাথে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। কথাবার্তা অনেক চড়াইউৎরাই পেরিয়ে ভিয়েতনামের লোকদের খাদ্যাভ্যাসে এসে পড়ল। আর যায় কোথা, সে তার খাদ্যাভিজ্ঞতার লম্বা ফিরিস্তি শুরু করল। গরু, ছাগল, ভেড়া থেকে শুরু করে ব্যাঙ, শূকর, কুকুর সবই আছে সেখানে। যে যে প্রাণীর কথা মাথায় এল সবই বললাম একটা একটা করে, দেখা গেল কোনটাই তালিকার বাইরে নয়। শেষে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কুমির?’ সে আকর্ণবিস্তৃত হাসির সাথে জানাল, ‘কুমিরের মাংস অনেক সুস্বাদু।’
শুধু মানুষই যে অন্য প্রাণীদের ধরে ধরে সাবাড় করে ফেলে তা নয়। জীবকুলের মধ্যকার পারস্পারিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে খাদ্য-খাদক সম্পর্কটাই সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। এধরনের সম্পর্কে গড়ে ওঠা খাদ্যশৃংখলগুলোই বাস্তুতন্ত্রের মূল ভিত্তি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যা অপরিহার্য। যেখানে এটাই প্রকৃতির নিয়ম, সেখানে পুষ্টির ভারসাম্য রক্ষা করে প্রাণিজ আমিষ গ্রহণে আমি কোন বাধা দেখি না।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোন প্রান্তে অন্য কোন পরিবেশে অন্য কোন প্রাণের বিকাশ হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে, আমাদের এই একটিমাত্র ছোট পৃথিবীকে কেন্দ্র করে প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারণে এই যে এক সুবিশাল জীবজগত গড়ে ওঠেছে, তার বৈচিত্র্যতায় আমি মুগ্ধ হই। সুবিশাল জড়জগতের মাঝে হঠাৎ একটি ক্ষুদ্র জীবনকণার উৎপত্তির সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। অন্তহীন বিশ্বজগতের কোন এক প্রত্যন্ত প্রান্তে কোন এক বৈশিষ্ট্যহীন গ্রহে জীবনের ভাষায় প্রকৃতির বলা কথাগুলো শুনে আমি বিমোহিত হই। আকাশে ঢেউ খেলে যাওয়া নানান রঙ, পুকুরের পাড়ে অযত্নে বেড়ে ওঠা কচুপাতাটায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুটির হঠাৎ জলপতনে টুপ করে ওঠা নিস্তব্ধতার ভাঙন, বাতাসের সাথে অবিরাম খেলায় রত কাঁচা ধানের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে থাকার গন্ধ – সবই তো শুধুই জড়ে গড়া আমার দেহের আয়নায় জীবনের প্রতিফলন। জীবনের চেয়ে সুন্দর আর কী আছে? আমি এর অপার রহস্যময় সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাই। কিন্তু আমার মাঝের এজীবনটি কি বিচ্ছিন্ন কিছু? একটু আগে যে প্রথম ক্ষুদ্র জীবকণাটির কথা বললাম, তার মাঝে হঠাৎ বেজে ওঠা জীবনের সাড়াই তো কালের স্রোতে ভেসে এসে ডাক দিয়ে যাচ্ছে আমার অন্তরে। আপনার অন্তরে, সকল মানুষের, সকল প্রাণীর, সকল জীবের অন্তরে। পৃথিবীর জীবকুলের জীবন তো একই সূত্রে বাধা, একই মহান সৌন্দর্যের বাহক। উদ্ভিদ এবং প্রাণিকুলের ওই সৌন্দর্যটুকু গ্রহণ করেই আমরা সুন্দর হয়ে ওঠি আরো। সৌন্দর্যের প্রয়োজনেই আমরা সৌন্দর্য হরণ করে যাই। দিনে তিনবার আহারের পূর্বে কোন এক অক্ষম ব্যক্তির উদ্দেশ্যে লক্ষ স্তুতিবাক্য পাঠের চেয়ে একটিবার জীবনের সৌন্দর্য উপলব্ধির তাৎপর্য আমার কাছে অনেক অনেক বেশি।
শেষের প্যারাটা এতটা সুন্দর করে লিখেছেন যে, এক কথায় অসাধারণ ।
আপনি আরও লিখবেন এ প্রত্যাশা করছি ।
@ আনোয়ার জামান
এটা আন্দিজ পর্বতে বিমান দূঘর্টনার যাত্রীদের সম্পর্কে বললেন নিশ্চই। বহুদিন আগে প্রায় ছোটবেলায় একটা সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক’এ পড়েছিলাম বাংলা অনুবাদে দিনপঞ্জী ও ঘটনা বিবরনী মিশিয়ে লেখা গল্প। শুরুতে ধাক্কাতো একটা লাগেই বিশেষত ছোট্টো মনে। কিন্তু শেষ অব্দি সমস্ত কিছু ছাপিয়ে যাত্রীদের বাঁচবার প্রণোদনাই অনেক অনেক বড় ও গল্পের মূল প্রতিপাদ্য হয়ে ওঠে।
বলেন কি! দুটো গিঠঠু ছিলো আঙুলে আমার। একটি খুললাম এই সেদিন যেদিন বঙ্গবন্ধুর খুনীদের একাংশের ফাঁসী হলো। অন্যটি নিয়ে অধীর অপেক্ষায় বসে আছি – কবে আর কবে। দুঃখের ব্যাপার হল ঘৃণ্য রাজাকার আলবদরগুলোর ধোলাই এবং ঝুলাই হয়ও যদিবা তারপরও এদের( গনকবরে গলিত শব ও হাড়গোড় হয়ে পড়ে থাকা শহীদের খুনীদের) দাফন, কাফন, কবরও হবে আমাদেরই মাটিতে মানুষের সম্মান দিয়ে। ফাঁসীর দড়িতে মোম মাখানো হয়েছিল কিনা কিংবা জল্লাদের দেয়া খুঁটিনাটি অন্তিমের বিবরনে অসুস্থ বোধ করলেও এদের মৃত্যুদন্ড না চাইবার তো প্রশ্নই ওঠে না। মানুষ বলেই তো choice থাকে সন্ত কিংবা শয়তান কিংবা ভালোমন্দ মিশিয়ে ভিড়ের একজন হবার। গত মন্তব্যে যাদের নিয়ে হায় হায় করলাম সেই গরু-ছাগল কাটা পড়ে কি কর্মফলে?
আমি কাউকে নিরামিশাষী হতে বলছিনা। শুধু চেতনানাশক ব্যাবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছি।
:-/ না এমনটা চিন্তা করিনি। 🙂
তবে আমি নিশ্চিত যে সৌন্দর্য শব্দটি লেখার সময় আপনিও কোনো চতুষ্পদী’র জবাই হয়ে যাবার দৃশ্যকল্প কল্পনা করেননি। না করলেও দৃশ্যটা কিন্তু পেছনে রয়েই যায়।
একটা লেখার পেছনে একজন লেখকের অনেক মমতা ও প্রত্যাশা থাকে বিশেষত সেটি যদি “ইতাদাকিমাস”‘র মত এমন সুলিখিত একটি লেখা হয়। আশা করি আমার মতামত আপনাকে আহত বা নিরুৎসাহিত করেনি। আসলে এত সুন্দর করে লিখেছেন বলেই বারবার পড়েছি এবং আংশিক দ্বিমত’ও তাই একটু বিতং(বিস্তারিত) করেই জানিয়ে ফেলেছি। এতে আপনার কিছুমাত্র খারাপ লেগে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
আপনার পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম। ভাল থাকুন।
@সুধা, আমি মোটেই আহত হই নি, 🙂 আমার ছোট্ট একটি লেখায় আপনি সময় ও শ্রম ব্যয় করে মন্তব্য করেছেন, তাতে প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম, পরে আনন্দিত হয়েছি, কৃতজ্ঞ হয়েছি। :rose2: :rose2: পাঠকদের সুচিন্তিত মতামতই লেখকদের প্রেরণা।
প্রত্যেক মানুষের চিন্তা চেতনাই একটি দর্শন। গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমেই এদর্শন উত্কর্ষতা লাভ করে চলে। তাই আপনার সাথে আলোচনার মাধ্যমে আমি এবং আমার দর্শন উভয়ই উপকৃত হয়েছি।
মৃত্যুদণ্ড নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু দর্শন আছে, পরবর্তী কোন লেখায় হয়ত বিস্তারিত বলব। ধন্যবাদ। আশা করি ভাল থাকবেন।
দূনিয়াজোড়া অপার সৌন্দর্যের মাঝে এক সৌন্দর্য আরেক সৌন্দর্য-কে কপাৎ করে( অথবা রান্নাবান্না করে) খেয়ে ফেলছে এটা কেন জানি খুব সুন্দর ঠেকছে না। কাকে খেয়ে ফেলা স্বাভাবিক আ্রর কাকে খাওয়া অমানবিক এটা আমরা বিচার করছি বলেই মানুষ খাওয়াটা (নাহ্, তানভী রাজাকার ধরে ধরে ভেজে দিলেও না) এখন ভারি অন্যায়। কিন্তু তারপর’ও একেবারেই যে এলাইনে খাওয়াদাওয়া চলে না তা কিন্তু নয়। সত্তর দশকের শুরুর দিকে বরফঢাকা আন্দিজ পর্বতে ভেঙে পড়া একটি প্লেনের যাত্রীরা বাঁচবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল মৃত সহযাত্রীদের খেয়ে। চায়না-য় দুর্ভিক্ষে প্রতিবেশী শিশুদের খেয়ে ফেলার কথা পড়েছি। বেশ ক’বছর আগে কোরিয়া( উত্তর না দক্ষিণ মনে নেই )-য় মানবভ্রুণ খেতে পাওয়া যাচ্ছিলো অতি উচ্চ মূল্যে। মানুষের মত দেখতে কিছু প্রাণী পরম আহ্লাদে উদরসাৎ করছিলো আমাদের মৃত শিশুদের। উদাহরনগুলো এজন্য দেয়া যে – আমরা আমাদেরকেও খেয়ে ফেলছি কখনও কখনও – কায়দা করে অথবা বেকায়দায় পরে। এসব ঘটে যাবার পর দূনিয়াজোড়া, মিডিয়াভরা আঁতকে ওঠাওঠি থাকলেও এটাতো ঘটনা যে – আমগোর (এই আশরাফুল মুখলুকাত’এর) শঈলডাও আসলে গোশতে্র বস্তা বই নয়।
বাংলাদেশ’এ কুকুর খাই না – সে কি আহ্লাদী এই প্রাণীটির প্রতি মমতাবশতঃ? মনে হয় না। প্রশ্রয় দিলে ছাগল’ও কিন্তু কম ন্যাওটা হয় না। অভ্যাসবশত একটাকে খাবার কথায় আঁতকে উঠি আবার আরেকটাকে দিব্যি খাই। কতবার দেখেছি কোরবানির জন্য কিনে রাখা গরুটার চোখ দিয়ে জল ঝরছে – স্থানান্তরের জন্য না পরিনতি আশংকা করে – কে বলবে! আমার তুমুল আনন্দের উৎসবের দিনে প্রকাশ্যে কাঁদতে পারে এমন একটা প্রাণীকে আরো কাঁদিয়ে টেনে হিচড়ে চেপে ধরে যথেষ্ট যন্ত্রণা দিয়ে জবাই করে ফেলা – কোন মানে হয়! আসলে খাবার জন্যইতো – আসমানী কারু নামেই হোক আর এমনিই – খুবই কি অসম্ভব চেতনানাশকারী কিছু একটা ব্যাবহার করা? Internet ঘাটাঘাঁটি করে দেখছিলাম এখানে বৈদ্যুতিক্ শক্ দিয়ে অচেতন করে নেয়া হয় “to avoid pain and stress” । খ্রিষ্টাণ প্রধান অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোতেও শুনেছি একই অবস্থা। এইসব আমাদের মাথায় আসেনা- আসবেওনা – যতদিন এই রক্তারক্তি মেরেধরে খাওয়ার সাথে ধর্ম জড়িয়ে থাকবে। “অহিংসা পরম ধর্ম”, “জগতের সকল প্রানী সুখি হোক”, “প্রাণী হত্যা মহাপাপ” – এই বাক্যগুলোর শতভাগ প্রয়োগযোগ্যতা( প্রতিবেশী ভারতের জনগোষ্ঠী-র বড় একটা অংশ নিরামিশাষী। বিদ্যা, বুদ্ধি, সুস্থতায় এরা বাকি জনগোষ্ঠীর চেয়ে কোন অংশে কম নয়) নিয়ে সন্দেহ থাকলেও নৈতিকতা ও মানবিকতার বিচারে এগুলোই বৌদ্ধ মতবাদকে অনেকটাই এগিয়ে রাখে – একইভাবে মুসলিমদের সুফীধারা, হিন্দুদের বৈষ্ণবধারা ও ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাউলধারা অনেক বেশি মানবিক দাঁড়ায়। ভালো লাগে যখন দেখি আমাদের মাটির পূরাতন কোন বোধের সাথে পাশ্চাত্যের আধুনিক নৈতিকতার সংবেদনশীল দর্শন একটি মানবিক বিন্দুতে এসে মিলে যায়।
এই প্রসংগে প্রচুর কুতর্ক সম্ভব। যেমন-
– গাছের কি প্রাণ নাই?- গলা ছাইড়া কানতে পারে না বলে?
– মশা ও পিঁপড়ারে মারি যে – তার কি হইবো?
– অসুখ হইলে অসুধ খাইলে ভাইরাস যে মরবো, তার বেলা?
কাটতে গেলে গাছও যদি ডালপালা ছুঁড়ে প্রচুর চেঁচায় এবং রক্তটক্ত বেরিয়ে একশা হয় – তবে দৃশ্যতই বিচলিত হবো। কান্না শুনতে না পেলেও বিশাল কোন গাছ কেটে ফেলতে দেখলে বিশ্রীতো লাগেই। আমার মনে হয়, সরাসরি communicate করতে পারে এমন যেকোন প্রানীকেই মেরে ফেলতে( সে খাবার প্রয়োজনে হলেও) খারাপ লাগার কথা। উদ্ভিদের বেলায় কি সে কথা খাটে? টমেটো আর বেড়াল বুঝি এক হলো? একটিকে ছিঁড়তে আর আরেকটিকে জবাই করতে বুঝি একইরকম লাগবে? অনুভুতি কি বলে?
খ্যাদ্যশৃঙ্খলকে অস্বীকার করছি না – কিন্তু হাত-পা(মানে শুধু পা) ছুঁড়ে চিৎকার করে কাঁদা কিংবা ব্যাথায় ধুঁকতে থাকা একটি প্রাণী-র মরনযন্ত্রনাকেইবা অস্বীকার করি কি করে? ব্যাথার কথাই শুধু বলে গেলাম।সাথে আতংক আর মৃত্যুভয় যোগ করুন, তারপর কল্পনায় ঢুকে পড়ুন প্রাণীটির খোলশে – হরর্ মুভি কোথায় লাগে!
(স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে) ডিসকভারি চ্যানেলে দেখেছিলাম বোধহয় – বিবর্তনের ধারায় মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে প্রাণীজ প্রোটিনের( বিশেষত রেড মিট্ – এর) নাকি বিশাল ভুমিকা আছে—-হুম্— তখন লেগেছিলো মানে কি এখনও লাগবেই? – কি জানি! আসলে কে কি খাবে বা খাবে না এটা অনেকটাই পারিবারিক অভ্যাস ও রুচির ওপর নির্ভরশীল। যার ই্ছছে সে খাবেই। খেতেই পারে। তবে সেই সাথে এই ব্যাপারগুলোও মাথায় রাখলে মন্দ হয় না।
জাপানে পশুহত্যা-র তরিকা কি? অচেতন করা হয় কি? – যদি হয় তবে ইতাদিমাস-এ প্রাণীটির সাথে সাথে ধন্যবাদ জানানো উচিত সংশ্লিষ্ঠ চেতনানাশক আবিষ্কারককে।
কোথাও, কোথাও দ্বিমত থাকলেও আপনার লেখাটা দারুন সুখপাঠ্য। আরো লিখুন। ভালো থাকবেন।
@সুধা,
আপনার সুন্দর চিন্তার জন্য ধন্যবাদ। পশু-পাখির উপর আমরা যেহেতু অতিমাত্রায় নির্ভরশীল তাই আমার চাওয়া ছিলো অতি ছোট – অন্তত কষ্ট না দিয়ে অজ্ঞান করে বা ইলেক্ট্রিক শক পদ্ধতিতে পশু বধ করা আর ধর্মীয় উৎসব বা অন্য কোনো ভাবে অহেতুক প্রাণী হত্যা না করা। গাছ-পালার জীবন আছে আর গাছ-পালা, ফল-মূল আহার ব্যতীত জীবন ধারণ অসম্ভব। বাধ্য হয়ে গাছ পালা ভোজন করেছি বলেই নৃশংস উপায়ে পশু হত্যা করতে হবে? আমরা আরেকটু মানবিক হলে সমস্যা কোথায় অন্তত যেখানে ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই।
আপনার সাথে সহমত পোষণ করে মুক্তমনায় নিয়মিত হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
@সুধা, আপনি নিজের মূল্যবান সময় ব্যয় করে বেশ লম্বা একটা মন্তব্য করেছেন, অশেষ ধন্যবাদ। তবে, আপনি কি মূলত নিরামিশাষের পক্ষে বলতে চাইছেন কিনা, তা বুঝলাম না। এখানকার একটা জাপানিজ বইয়ে পড়েছিলাম, জাপানিজদের গড় আয়ু বৃদ্ধির অন্যতম কারণ নাকি, প্রাচীন বৌদ্ধ নিয়ম ছেড়ে দিয়ে প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ শুরু করা। খাদ্যাভাসের ব্যাপারটি গড়ে ওঠে সামাজিকভাবে, বাংলাদেশেই কিছু মানুষ শুয়োর শুনলে নাক সিঁটকায়, অন্যেরা সিঁটকায় গোমাংসে। এবং নিরামিষাশ কিংবা মাংসাশের ব্যাপারটা ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার। প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের ব্যাপারে আমি আমার নিজ দৃষ্টিভংগি প্রকাশ করেছি মাত্র, আমি মাংসাশী বলে সবাইকেও হতে হবে তা বলি নি।
প্রাণিদের কষ্টদানের বিপক্ষে যে বলেছেন, তাতে পূর্ণ সহমত। তবে, তথাকথিত সুস্থ মানুষেরাই যখন কোন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীকে (যাই করে থাকুক না কেন, মানুষ তো!!) মেরে ফেলে, তখন কি ব্যথা বেদনার কথা চিন্তা করে? সেখানে প্রাণীদের ব্যথা বেদনার কথা চিন্তা তো অনেক দূরের ব্যাপার। আমাদের নৈতিকতাকে কি এখনো সম্পূর্ণরূপে সভ্যতার দাবিদার বলা যায়? তবে, কেন জানি নিজ জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে মৃত মানুষের মাংস ভক্ষণকে আমি অনৈতিক বলতে পারি না।
আপনি যদি কাঁটাচামচ আর ছুরি দিয়ে সৌন্দর্য খাবার দৃশ্যকল্প চিন্তা করেন, তাহলে তো সমস্যায় পড়ে যাব। :-Y আমি শুধু জীবনের রহস্যময়তাকেই সুন্দর বলতে চেয়েছি। তবে, সৌন্দর্যবোধ তো আপেক্ষিক ব্যাপার, তাই নয় কি?
আবারো ধন্যবাদ, ভাল থাকবেন।
@আনোয়ার জামান,
আমি শুধু জীবনের রহস্যময়তাকেই সুন্দর বলতে চেয়েছি। তবে, সৌন্দর্যবোধ তো আপেক্ষিক ব্যাপার, তাই নয় কি? :rose2: :rose2:
একেবারে খাঁটি জব্বর একখান কথা বলেছেন। :yes: :yes: :yes: :
ইতাদাকিমাছের দেশে আছি২৩ বৎসর,আজ জানলাম এর অর্থ।
লেখাটা পড়ে মুগ্ধ হলাম,বুঝলাম লেখকের অন্ত দৃষ্টি প্রখর।এমন
চিন্তাশীল লেখাই আমাদেরকে প্রকৃত মানুষ করতে সহায়ক।
লেখাটি এককথায় দারুণ হয়েছে।
:yes: অসাধারণ!
:yes: :yes:
এবার- ইতাদাকিমাস!!!
জামান ভাই, ধন্যবাদ আরেকটি ভাল লেখার জন্য। গত দুইদিন যাবত খুব ব্যাস্ত আছি। ভাল লাগল এইটুকু বলে রাখি।
কোরবানী ইদের সময় বিভিন্ন ফোরামে জীব হত্যা বিষয়ক তর্ক জমে উঠেছিল, আপনার এই লেখা সামনেরবারের জন্য জমিয়ে রাখেন। অকারন জীবহত্যার বিরুদ্ধে সূস্থ বিবেক জাগ্রত হোক।
আনোয়ার জামান,
আবারও এক নিটোল,প্রানময়,মনোরম মিষ্টি,সহজ,সরল ভাষার মাধূর্যে মেশানো আপনার চিন্তাজাগানিয়া লেখাটা পড়লাম।জীব-জগতের প্রান ও প্রানীর বিশেষ করে মানুষ নামের প্রানীর সৌন্দর্যের বর্ননা স্হান,কাল,পাত্রভেদে ধর্ম,কৃষ্টি,ভাষা বিভিন্ন হলেও চুড়ান্ত অর্থে কিন্তু জীবন ও জীবনের ভিতরের ও বাহিরের রুপের সৌন্দর্য মনে হয় একই।বৌদ্ধ ধর্ম যেভাবে জীবন-জগৎতের লৌকিকতার বিষয় নিয়ে সাধনা করেছে যদি আব্রাহামিক ধর্মগুলো তার ১০% ভাগও চর্চা করত তাহলে হয়ত মানব জাতি সুন্দর ও সৌন্দর্যের সূধা আরো অনেক হাজার, কোটি গুন বেশী এই পৃথিবীতে উপভোগ করতে পারত।অন্যদিকে ক্ষমতার নামে যদি জাতিক ও আন্তর্জাতিক কুৎসিত বিশ্ব আগ্রাসন না থাকত তা হলে তো মানব জাতি এই ধরার সুধা না শুধু অন্য ধরার সূধাও পান করত।
@মাহবুব সাঈদ মামুন, সুন্দর মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আপনার কথাগুলো বোঝার মানসিকতা একদিন মানবজাতির হবে বলে আশা করি।
আমি গৌতম বুদ্ধকে দার্শনিক বলি এবং অনেকেই বলতে চাইবেন। বৌদ্ধ মতবাদকে ধর্মের চেয়ে দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করাই বেশি যুক্তিযুক্ত। তবে, ঈশ্বরের আশীর্বাদহীন ধর্ম যে বাজারে বিকোয় না। একারণেই হয়তোবা বৌদ্ধ দর্শন হয়ে ওঠেছে আজকের বৌদ্ধ ধর্ম। আব্রাহামিক ধর্মের ঈশ্বরগুলোই তো যত নষ্টের গোড়া, স্বর্গসুধার স্বপ্নে বিভোর স্বর্গপথিকেরা জ্ঞানের সুধা, সৌন্দর্যের সুধা থোড়াই কেয়ার করে।
আপনার লেখাগুলো পড়ে আলাদা মজা পাচ্ছি, শেষের প্যারাটা দারুন!! :yes:
@তানভী, অনেক ধন্যবাদ। 🙂