লেখাটির একটি ভুমিকা আছে। সাপ্তাহিক একতা – বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র এই লেখাটি ছাপাতে অস্বীকার করে। কারণ এটি নাকি তাদের ‘পলিসি’র বাইরে। যা হোক লেখাটি মুক্তমনায় পাঠালাম। ছাপালে খুশী হবো।

যিনাতুল ইসলাম জুঁই

:line:

বিপ্লব, নারী ও কিছু প্রসঙ্গ
* যিনাতুল ইসলাম

এই রচনায় আমি কোন ঐতিহাসিক আন্দোলন ও তার ধারাবাহিকতার বর্ণনা তুলে ধরবো না কিংবা বিপ্লবের পথে নারী অংশগ্রহণের ও নারী আন্দোলনের পথিকৃৎদের স্তুতি গাইবো না। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণের জন্য আমাদের তথাকথিত নারীনেত্রীদের মতো কোন মেয়েকে তাঁদের ভাষায় সজাগ ও সমঅধিকারের দাবিতে সোচ্চার হবার আহবান জানাবো না। যা সবার কাছে তুলে ধরতে চাই, তা হলো কিছু প্রাথমিক প্রস্তুতি যা একজন নারী তা সে মেয়ে, কিশোরী কিংবা যুবতী যেই হোক না কেন, তার জন্য হওয়া উচিত বিপ্লবের পা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে প্রথম সোপান। বিপ্লব মানে সামাজিক আন্দোলন, সমাজের কাঠামোর পরিবর্তন যা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চরিত্রকে পুরোনো জরাজীর্ণ রোগ থেকে মুক্তি দেবে। সেইসাথে নিশ্চিত করবে মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার। অর্থাৎ বিপ্লব মানুষের জীবনে বয়ে আনবে শুদ্ধ শোষণহীন সাংস্কৃতিক চর্চা। বিপ্লবের অন্যতম অংশ হলো সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নারীকে নিজের মানসিক, মামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে অর্থাৎ সর্বোপরি তাকে ‘মেয়েমানুষ’ থেকে ‘মানুষ’ হতে হলে সর্বাগ্রে হতেহবে একজন বলিষ্ঠ বিপ্লবী। মানসিক দুর্বলতা, সামাজিক শৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতা ও রাজনৈতিক অসচেতনতা নারীর বর্তমান বৈশিষ্ট্য। জন্ম হতে শুরুকরে কৈশোর পেরিয়ে পূর্ণবয়ষ্ক নারী হওয়ার সময়টিতে বিবিধ উপায়ে তাকে শান্ত, স্থির, ধীর, কোমল হিসেবে গড়ে তোলার নামে তাকে দুর্বল, পরাধীন, ভীতু ও গৃহী করে রাখার সর্বাত্বক প্রচেষ্টা, অপপ্রয়াস চালানো হয়। প্রচলিত বিবাহ ব্যবস্থার নামে তার অভিভাবক পরিবর্তন কর্মসূচীর জন্যই তাকে উপযুক্তকরে গড়ে তোলা সমাজের অন্যতম দায়িত্ব মনে করে সমাজপতিরা। এইসব সমাজপতি ও পতœীবৃন্দ এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারক ও সমাজের নিয়মনীতিমালার বাহক। বিভিন্ন ধর্মীয় বিধিনিষেধ যা মতবাদ নামে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান, এইপুরো প্রক্রিয়ায় আগুনে ঘি ঢালার কাজটি করে যায়। এঙ্গেলসের মতে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা নারীকে কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে পরিগনিত করে থাকে। এই কারণে আমরা সবাই তথা নারী-পুরুষ, ছাত্র-পেশাজীবী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বাবা-মা-সন্তান-আত্মীয়-বন্ধু-বান্ধব নির্বিশেষে নারীকে একজন আদর্শ বাধ্যগত মেয়ে সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রী এবং সবশেষে একজন আদর্শ মা হিসেবে দেখতেই বেশি স্বাচ্ছন্ধ্য বোধ করি। এই নারীই যখন নিজেকে সবল, আত্মনির্ভরশীল, শৃঙ্খলমুক্ত, সমাজ-দেশ-জাতির স্বার্থ সচেতন এবং শোষণ ও অন্যায় তা সে নিজের কিংবা অন্য কারও ক্ষেত্রেই হোক না কেন- এসবের বিরুদ্ধে সজাগ, সোচ্চার ও দৃপ্ত হতে চায় তখনই সমাজ উঠেপড়ে লাগে তার দৃঢ়তাকে ভেঙ্গেচূড়ে দিতে। বিভিন্ন ধর্মীয় বিধিনিষেধ মনে করিয়ে দিয়ে, শ্লীলতা ও অশ্লীলতার প্যাঁচে আবদ্ধ করে রেখে সমাজব্যবস্থা তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে নারীকে কেবল মেয়েমানুষে আবদ্ধ করে রাখে। নারী সময়ের প্রয়োজনে, পরিবারের প্রয়োজনে, স্বামী-সন্তানের প্রয়োজনে, বাবা-মা’র প্রয়োজনে, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে মাঠে নেমে এসেছে। কিন্তু এখন সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিপ্লবী নারী যে লড়াই করবে নিজের জন্য, নিজের ব্যক্তিত্ব তৈরি করার জন্য, নিজেকে সবল ও আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার জন্য যাতে সে শোষণ ও বঞ্চনাকে ক্ষীপ্রহস্তে দমন করতে পারে অন্য কারও সাহায্য ছাড়াই।

পত্রিকার পাতায়, বইপত্রে, দল বা সংগঠনভিত্তিক রাজনীতির ভাষায় নারীকে আমরা খুঁজে পাই সর্বহারা শোষিত-বঞ্চিতদের মাঝে। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দৌরাত্বের কারণে নারী আন্দোলন জিম্মি হয়ে পড়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে। নারী হয়েগেছে এখন উত্তর-আধুনিকতার পণ্য। নতুন নতুন পথ্য আবিষ্কৃত হচ্ছে নিয়মিত যাতে নারীকে কাবু ও পঙ্গু করে রাখা সহজ থেকে সহজতর হয়। বস্তুবাদ ও ভাববাদকে মিশিয়ে একাকার করে ফেলা হয় এই নিমিত্তে। আমাদের নারীনেত্রীবৃন্দ ও সুশীলসমাজের মানুষজন নারী-পুরুষ বৈষম্যে কারণ হিসেবে দাঁড় করান ধর্মীয় কুসংস্কারকে। এখানেই যত গণ্ডগোটি ঘটে। ধর্ম (ঐশ্বরিক বিশ্বাসভিত্তিক মতবাদ) হলো বস্তুবাদী স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ভাববাদী নিয়মাবলী প্রচলনের অন্যতম একটি কৌশল যা শোষণকে সমাজে সর্বদা বিরাজমান করে রাখার রণকৌশল। এই কৌশল অবলম্বন করে পুঁজিপতিরা নিজেদের হৃষ্টপুষ্ট করে চলেছে। নারী-পুরুষ বৈষম্য, নির্যাতন, পুরুষের কর্তৃত্ব ইত্যাদিকে সমস্যা মনে করে নারী আন্দোলনের এই নেত্রীরা যারা অন্যদিকে নিজেদের মুসলিম হিসেবেই পরিচয় দিয়ে থাকেন। কুরআনে পরিষ্কার বলা আছে, ‘… নারীর যেমন পুরুষের উপর ন্যায়সঙ্গত অধিকার, পুরুষেরও তেমনি নারীর উপর। তবে নারীর উপর পুরুষের মর্যাদা বেশি।’(-সুরা বাকারা, আয়াত: ২২৮)। এবং ‘তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র। সুতরাং যেভাবে ইচ্ছা তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যাও।’(-সুরা বাকার, আয়াত: ২২৩)। এছাড়া আরও রয়েছে- ‘পুরুষ নারীর কর্তা, আল্লাহ্ই তাদের একজনকে অন্যের উপর মর্যাদা দিয়েছেন। কারণ পুরুষ তাদের জন্য অর্থব্যয় করে। সুতরাং সতী নারীরা তাদের অনুগত হবে, তাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা করলে সদুপদেশ দাও, বিছানা ভিন্ন করো এবং তাদের মার দাও।’(-সুরা নিসা, আয়াত: ৩৪)। এতোকিছুর পরও মুসলিম নারীনেত্রীবৃন্দ ও অন্যান্য সুশীল সমাজের সদস্যরা নারী-পুরুষের সমঅধিকারের কথা বলেন কীভাবে আমি বুঝি না। বুঝি না কীভাবে তারা মুসলিম হয়েও আল্লাহ্র বিধানকে ধর্মীয় গোড়ামি ও কুসংস্কার বলে গালমন্দ করার সাহস করেন। পরিস্কারভাবে, এহেন স্ববিরোধী আদর্শের কারণে, ভাববাদী বস্তুবাদ প্রচলিত হবার কারণে অত্যন্ত ক্ষতিকর, মুমূর্ষু ও প্রতিক্রিয়াশীল এই পরিবেশ তৈরি হচ্ছে নারীর জন্য। আমার বক্তব্য হলো হয় আল্লাহ্র বিধান মেনে চলুন অথবা নারীকে মানুষ হতে দিন। মানুষ সামাজিক জীব, কিন্তু নারী এখনও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীব রয়ে গেছে।

 নারী ঘর-সংসার সব মিলিয়ে টেলিভিশনে দেশের খবর দেখেন, সুখে পুলকিত হন, দুঃখে হা-হুতাশ করেন, পেশাজীবীরা অবশ্য কিছুটা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ পান, কিন্তু এখনও তারা নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, মনুষত্বের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন নি। পারেন নি যোগ্যতা অনুযায়ী সুযোগকে নিজের বশে আনতে, নিজেকে যোগ্য করে তুলতে। এখনও দেরি হয় নি। আসুন, সত্য সুন্দর ও ন্যায়ের পথে সোচ্চার হতে নারীকে সাহস দিন। নিজেকে বিকশিত করার অনুপ্রেরণা দিন। আর নারী, আপনি বস্তুবাদী হোন। #

* গবেষক
সদস্য, চলচ্চিত্র ও চারুকলা বিভাগ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
সাবেক শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ
০১৭৩০৩৫১১৫৬