দুটো তীর্থস্থান ভ্রমনের পরিকল্পনা ছিল ২০০৮ এর ডিসেম্বর মাসে। স্থান গুলোর নাম উচ্চারণ করাটা বেশী বেশী মনে হবে। কারন এগুলো এখনও তীর্থস্থানের পর্যায়ে পড়েনা। কারো জীবদ্দশায় তাঁর জন্মস্থান তীর্থকেন্দ্র হয়না। লালন শাহের সমসাময়িক কেউ কি ভেবেছিল তাঁর সমাধিস্থল একদিন তীর্থস্থান হবে? বেগম রোকেয়াও একদিন উপেক্ষিত-অবহেলিত ছিলেন। তাঁকেও কিছুনা কিছু সামাজিক বাধাবন্ধন অতিক্রম করতে হয়েছে। আজ তাঁকে একজন মহীয়ষী মহিলা হিসেবে শ্রদ্ধা করা হয়। তাঁর লেখা স্কুল-কলেজে পড়ানো হয়। তাঁকে নিয়ে গবেষনা হয়। এখন তাঁর সময়ের পৃষ্ঠপোষকরা বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন – ‘বিলম্বে হলেও সুমতি হয়েছে তাহলে…।’

বরিশালের লামচরি যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। আরজ আলী মাতুব্বরের জন্মস্থান। তিনি একাধিক বিষয়ে পন্ডিত ছিলেন। কিন্তু সবিনয়ে নিজেকে একজন কৃষক হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেশী স্বচ্ছন্দ অনুভব করতেন। এবারে যেতে পারিনি। অত্যন্ত সাহসী এই মহান ব্যক্তিটি যে জায়গা দিয়ে একসময় হাটাচলা করেছেন, সেই জায়গাটির আলো-বাতাস-গন্ধ অনুভব করতে পারব আমার পরবর্তী সফরে। মুক্তমনার একটি বিশেষ অবদান ই-বই, প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিজ্ঞানীদের মুক্তচিন্তা ও যুক্তিনির্ভর সঙ্কলন – “বিজ্ঞান ও ধর্মঃ সংঘাত নাকি সমন্বয়?” ভাবতে পারিনা – লামচরি গ্রামের একজন কৃষক প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে কিভাবে বললেন, “ধর্মজগতে এরূপ কতগুলি নীতি, প্রথা, সংস্কার ইত্যাদি এবং ঘটনার বিবরণ প্রচলিত আছে, যাহা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নহে, এবং ওগুলি দর্শন ও বিজ্ঞানের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নহে এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বিপরীতও বটে।” তিনি কল্পনাতীত দূরদর্শী ছিলেন। তাঁর তিনটি বইয়ের উতসর্গে লিখে গেছেন, “মুক্তচিন্তা চর্চা ও প্রসারে উতসাহী এবং যুক্তিপ্রবণ পাঠকের উদ্দেশে।” একজন কৃষক কারও বিদ্যা ধার না করে যা ভাবতে পেরেছেন, এত বছর পরেও সামান্য সংখ্যক শিক্ষিত লোকই তা ভাবতে পারছেন। ১৮৬ পৃষ্ঠা লম্বা “সৃষ্টি রহস্য” তাঁর একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি। অত্যন্ত সহজ ভাষায় বিবর্তনবাদ বুঝতে গেলে, আরজ আলী মাতুব্বরের “সৃষ্টি রহস্য” পাঠের বিকল্প নেই। যাদের মগজ কোন বিশেষ মতবাদের বেস্টনীতে আটকা পড়ে আছে তাদের জন্য “সৃষ্টি রহস্য” অবশ্য পঠনীয়। মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদীদের জীবনের ঝুকি আসে। মাতুব্বর সাহেবেরও হাজতবাস হয়েছে। হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের দুর্বল বিষয় গুলো তুলে ধরাতে জনতা নাখোশ হয়েছে। হিন্দুরা মেনে নিলেও সব মুসলমানরা মানতে পারেনি। চুয়াত্তুরের কোন এক সময় মাদ্রাসার ছাত্র দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। এরকম একাধিক ঘটনা ঘটেছে (আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র – ৩, পৃষ্ঠা ১৪-২১)।

একদিন হয়তো ঢাকার রমনা পার্কের নাম আবার পরিবর্তন হবে। নাম হবে আরজ আলী উদ্যান। হবে একদিন। আমি দেখে যেতে পারব না।

আজকে মুক্তমনা মুক্তবুদ্ধি চর্চার অগ্রপথিক। আরজ আলী মাতুব্বরের জন্ম ও মৃত্যু তিথিতে তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংকলন বের করলে মুক্তমনার হাত আরও শক্তিশালী হবে বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশে বেগম রোকেয়ার পর দ্বিতীয় মহিয়সী মহিলা তসলিমা নাসরিণ। তিনি হাজত বাস করেননি। তবে মাথায় মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে অহর্নিশি দিন কাটাচ্ছেন। “নির্বাচিত কলাম” লিখে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিলেন। মুসলিম নারীদের বৈষম্যের কারণ খুজতে গিয়ে কোরানের আয়াত টুকতে গিয়ে ফেঁসে গেলেন।

ডিসেম্বর ৬, ১৯৯২। হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ভাংগল ভারতে। বাংলাদেশে মুসলমানরা বাংলাদেশী হিন্দুদের উপর অমানবিক অত্যাচার শুরু করল। উদোর পিন্ডি গিয়ে পড়ল বুদোর ঘাড়ে। তসলিমা নাসরিণ চুপ থাকতে পারলেন না। সেই দৃশ্যগুলো অবিকল বর্ননা করলেন “লজ্জা” নামক বইতে। মুসলমান হয়ে অমুসলমানের পক্ষে কথা বলা তো বরদাস্ত করা যায় না! নারীর সমান অধিকার কোরান দেয়নি সেটা কে তোকে খুঁচিয়ে বের করতে বলেছে? হাবিবুর রহমান তসলিমা নাসরিণের মাথায় পঞ্চাশ হাজার ডলার বসিয়ে দিল। রাতারাতি তাঁর সমস্ত লেখা গুলো অখাদ্য হয়ে গেল। এটা হল সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

এক মা তাঁর মেয়ের জন্মদিনে “নির্বাচিত কলাম” উপহার দিয়েছিলেন। সেই মেয়েটি আগ্রহভরে আমাকে বইটি পড়তে দেয়। অনেকদিন পরে তার তার বাড়িতে গিয়ে দেখি তার বুক শেলফে বইটি নেই। নেই কেন? “ওটি” এখন আর পড়ার যোগ্য বই নয়। লেখিকা পঁচা, তার লেখাও পঁচা। মা তাকে একটি পঁচা বই উপহার দিয়েছিলেন!

বাইশ বছর ময়মনসিংহে কাটিয়েছি। কিন্তু অবকাশ চোখে পড়েনি। আমেরিকাতে বসে তসলিমা নাসরিণের স্মৃতিচারণ পড়তে পড়তে মনে মনে ময়মনসিংহের কত অলিগলি ঘুরেছি। কোথাও খুজে পাইনি। শেষ পর্যন্ত ৩১শে ডিসেম্বর ২০০৮ “অবকাশ” খুজে পেলাম। অবাক! এই বাডীটির সামনে দিয়ে সপ্তাহে অন্তত একবার করে হেটে গেছি ১৯৭৬ সনে। তসলিমা নাসরিণ তখনো বিখ্যাত হননি। তাই অন্য দশটা বাড়ীর নামের মত এটিও চোখে পড়েনি।

বাংলাদেশ ও ভারতে রাতের আঁধারে খোলা আকাশের ছবি তুললেও বিপদ। কেউ না কেউ এসে বলবে – এখানে ছবি তোলা নিষেধ, আপনি জানেন না? অবকাশের ছবি তুলতে পারব কিনা তা নিয়ে আমি অনিশ্চিত ছিলাম। আমার সহায়ক ছিলেন সিটি কলেজিয়েট স্কুলের অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক শচীন আইচ। বাড়িটি দেখানোর সাথে সাথেই কেউ দেখে ফেলার আগেই দুরু দুরু বক্ষে নাসরিণের প্রিয় নারিকেল গাছ ঘেরা বাড়ীটির কয়েকটি ছবি তুলে ফেললাম।

শুভ তসলিমা নাসরিণের ভাইপো, অত্যন্ত প্রিয়। আমদেরকে লিভিং রূমে নিয়ে গেল। ফুপুর স্মৃতি জড়ানো জিনিষপত্র ঘুরে ঘুরে দেখালো। আবেগে অনেক কথাই বলল (ভিডিও ক্লিপ সংযোজন করা গেল না)। ২৬সে ডিসেম্বর ২০০৮ ছোট্ট শুভ বিয়ে করল, কিন্তু আদরের ফুপু নেই।

dsc010771
অবকাশ। প্রতিটি নারকেল গাছ তসলিমার এক একটি কবিতা।

dsc010801
২৬শে ডিসেম্বর ২০০৮। শুভর বিয়ে। ৩১শে ডিসেম্বরেও অবকাশ বৈদ্যুতিক আলোকমালায় আলোকিত।

dsc010861
অবকাশের সামনে শুভ

dsc010871
ফুপিদের সাথে বাবার ছবি

dsc010921 শুভ ও নব বধু সীমরণ।

নৃপেন্দ্র সরকার, ৮ই জানুয়ারী ২০১০