গানে প্রতিবাদ, গানে প্রতিরোধ
বাসা থেকে মিনিট খানেকের পথ যেখানে মেলাটা হচ্ছে।। বেশ কিছু দিনের প্রস্তুতি, বাংলা চ্যানেল গুলো অনেক দিন ধরেই বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল যে এখানে একটা মেলা হবার কথা সাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ১২ টায় শুরু হবার কথা , তাই”বাঙ্গালী সময়” আড়াইটা নাগাদ গেলাম, বলাবাহুল্য অনুষ্ঠান শুরু হয় নি। আমরা ফের ছটার হাজির হলাম। শুনেছি বাংলা দেশ থেকে তারকা নক্ষত্র ধুমকেতু সব ই আসছেন।।
বিশাল মাঠে টিম টিম করে হ্যাজাকের মত আলো জ্বলছে। মঞ্চের দিকে গিয়ে দেখি জনা ছয়েক বঙ্গ সন্তান কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট, সাদা টাই আর সাদা গ্লভস পরে তান্ডব নৃত্য করছে। হিন্দী গানের সাথে মাইকেল জ্যাকসান তার সাথে হাবীবের গান সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক কম্পোসিশন। দর্শকের আনন্দের কমতি নেই। যা বুঝলাম ওদের শরীরে হাড়ের বদলে কিছুটা জেলো জাতীয় বস্তু দেয়া হয়েছে। শিরদাঁড়ায় তো অবশ্যিই।
মাঝখানে কর্মকর্তারা এলেন, ইংরেজীতে বললেন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। বললেন “ ইউ লিটল পিপল কাম টুডে।” মানে বলতে চাইছেন, আজকে কম সংখ্যার মানুষ এসেছেন।
এর পরে বাংলাদেশের এক নাম করা শিল্পী মঞ্চে এলেন। । ইনি তারকা , কক্ষচ্যুত বলে মনে হলো না কারন দেখলাম হাব ভাবে বেশ বিশাল। ভয়ানক হাততালির মাঝখান থেকে নামটা উদ্ধার করতে পারলাম না। তিনি হ্যামিলনের বাঁশীওয়ালার মত লাল সবুজ জোড়া তালির জামা পড়া , বুঝলাম ওই সাজ বিজয় দিবসের কারণে। আয়োজকরা বোধহয় এই বলেই এনেছেন। মঞ্চে উঠেই তিনি ক্রমাগত ছুটতে থাকলেন, যেনো ফুটবল খেলোয়াড়। পরণে জিন্স পায়ে স্নিকারস, এসেই “দোলে জেনো প্রজাপতি দংশনে মৌ্মাছি” হয়ে আলী সুলভ চালে মুষ্টিযুদ্ধের নানা ভঙ্গীমা করতে থাকলেন। চুল গুলো উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা।। এবারে তিনি গান ধরলেন” মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”.. গানটার ব্যবচ্ছেদ হোল। ব্যান্ডের সুরে , বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গী করে তিনি গেয়ে চললেন। লোক জন বিরক্ত , কিসের মধ্যে কি। ভালই নাচানাচি হচ্ছিলো হিন্দীর সাথে “জেলী নৃ্ত্য”, এর মাঝে এই দেশপ্রেমে তারা বিরক্ত। আর ১৬ র কাছাকাছি বলেই কি দেশের গান গাইতে হবে? না হয় নাই ই হোল দক্ষিন ফ্লোরিডায় কোন বিজয়ের অনুষ্ঠান, তাই বলে সুযোগ নেবে? শিল্পী গান শেষ করলেন , শেষ লাইনটা গাইলেন “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে প্রবাসে আসি । আমরা একটি বাংলাদেশকে বাঁচাবো বলে বিদেশে আসি”। আমি এর মর্মাথ কিছুতেই বুঝলাম না।
ঘরে ফেরার পথে শুধু আওড়াচ্ছিলাম গোবিন্দ হালদারের কথা আর আপেল মাহামুদের সুরে গান”
মোরা একটি ফুলকে বাচাঁবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।
বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলেনের সাথে গণসঙ্গীত জড়িয়ে আছে সে গোড়া থেকেই। আঁধার রাতে গাঢ়তম তন্দ্রার ভেতরে জেগে উঠে মুক্তি পাগল মানুষের হাতকে যোদ্ধার শাণিত হাতে মিলিয়ে দিতে শেখ লুৎফর রহমান, আব্দুল লতিফ , শমসুদ্দিন আহমেদ, নিজামুল হক, আলতাফ মাহামুদ, মোমিনুল হক সহ অনেকেই প্রতিবাদের গান গেয়েছিলেন, আন্দোলন কে করেছিলেন বেগবান । দেশ ভাগের পর শুধু বড় শহরগুলো তেই নয় বরং নেত্রকোনা পাবনা, রাজশাহী , সিলেট, বরিশাল, খুলনা, কুমিল্লায় কৃ্ষক সংগ্রামের পটভুমিতে বহু গণসঙ্গীত রচিত এবং গীত হয়।
১৯৫৪ সালে মুসলীম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের জনসভায় পল্টন এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় গর্জনে ভাঙ্গা গণসংগীতের উত্তাল ধ্বনি তে লোক জমায়েত করতেন বাদ্য যন্ত্র ছাড়াই আব্দুল হাকিম যিনি ” হাকিম ভাই” নামে পরিচিত।।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আয়ুব রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করলে, সাধারণ মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক কর্মীরা নেমে আসে রাজপথে।। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নাটকের ওপর নেমে আসে খড়গসম নিষেধাজ্ঞা।। সারা দেশে শুরু হয় রবীন্দ্র শতবার্ষীকির আয়োজন । দুঃস্বপ্নের ঘোরে ধোয়াঁচ্ছন্ন আধাঁরে বার বার যে আশ্রয়ে আমারা ফিরে যাই তার নাম ই তো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত। প্রতিরোধ কে সামনে রেখেই ১৯৬১ তে জন্ম নেয় ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যানিকেতন, ১৯৬৭ তে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠি, ১৯৬৮ তে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী।, ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ভারতীয় গণনাট্য সংঘের পুরোন গান গুলো কে আবার নতুন করে গাইতে শুরু করে।
অসহায় ক্রোধের ভেতরে একসময় প্রচুর গণসঙ্গীত রচিত হয়েছে , খুলনা থেকে আবু বকর সিদ্দিকী লিখতেন গণসঙ্গীত, রাজশাহী থেকে ইংরেজীর অধ্যাপক নাজিম মাহামুদ। চট্টগ্রামের প্রান্তিক শিল্পী গোষ্ঠীর হরি প্রসন্ন পাল কে বলা হোত বাংলার পল রবসন। কাগমারী কনফারেন্সে তার গণসঙ্গীত মানুষকে সোচ্চার হতে অনুপ্রেরণা যোগায় । বোধ করি সে সময়ে শিল্প চর্চা শুধু মাত্র ঢাকা কেন্দ্রিক ছিলো না। সিরাজগঞ্জের অসুস্থ কৃষক কমরেড বাবর আলীর কাছ থেকে “ বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা” গানটি জোগাড় করা হয়।
গীতিকার সিকান্দার আবু জাফর ইত্তেফাকের উপসম্পাদকীয়তে লিখলেন একটি কবিতা “ জনতার সংগ্রাম চলবে, আমাদের সংগ্রাম চলবে । লুৎফর রহমান এই কবিতায় সুর দিতে গিয়ে রসিকতা করে বলেছিলেন “ ডিকশানারী টা নিয়ে আয়। সুর করে দেই”। গানটা গাওয়া হোল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংসদের বার্ষিক সম্মেলনে। । শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানীর মুখে শোনা অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রণ জানান সিকান্দর আবু জাফর কে। এতো মানুষের মাঝে এলেন কিনা বুঝতে না পেরে পরদিন ফোন করেছিলেন, জানতে চেয়েছিলেন কেমন লাগলো সুর ? সিকান্দার আবু জাফর বললেন “ আমার কাছে এক্কেবারে ভালো লাগে নি, এ কি সুর করেছে, ল্যাংড়া কে বলে দিস” লুৎফর রহমান একটা পা টেনে হাঁটতেন।
কামাল লোহানীর ভাষ্য এমন “চমৎকার উদ্দীপনা মুলক সুর কেনো ভাল লাগলো না , বুঝলাম না। এর পর একদিন শুনলাম সিকান্দর আবু জাফর লুৎফর ভাইকে বাসায় ডেকে ওই সুরের প্রশাংসা তো করছেন ই , উপরি একটা হুইস্কির বোতল হাতে ধরিয়ে বলেছিলেন” যা বাড়ীতে আজ খাবি।” আমাকে যা বলেছিলেন এ যে তার একেবারেই উল্টোটা ।
এরকম গানের জন্মের সাথে কতই না ইতিহাস , কতই না আবেগ জড়িত।কখনো আবেগ ছাপিয়ে গেছে শিল্প মাত্রা কে কখনো সাথে নিয়েই এগিয়েছে।
সময়ের চাতালে সব আক্রোশ , সব না পাওয়া , সব অক্ষমতা জড়ো হয় আর গণশিল্পী রা তা দিয়ে গেথেঁ চলেন অপুর্ব সব প্রেম গাথাঁ। তবুও বুনে চলেন স্বপ্ন বীজ, নতুন দিনের আশ্বাসে।
কবিয়াল রমেশ শীল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস , ফনী বড়ুয়া, জ্যোতিরিন্দ্রমৈত্রী, সাধন দাশ গুপ্ত, হরি পদ কুশারী সলিল চৌধুরী, কানু ঘোষ , প্রেম ধর, প্রেম ধাওয়ান, মখদুম মহিউদ্দীন , নিবারন পন্ডিত , পারভেজ শাহেদি, সজল চট্টোপাধ্যায়, ভুপেন হাজারিকা, নির্মলেন্দু চৌধু্রী, অমর শেখ, প্রতুল মুখোপাধ্যায় , হলরাজী , মোহিনী চৌধুরী , দিলীপ সেনগুপ্ত, অজিত পান্ডে, শুভেন্দু মাইতি,আলতাফ মহামুদ , হাফিজ উদ্দিন, ধির আলি প্রমুখের গণসঙ্গীত সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বিশেষ ভুমিকা রাখে।
পল রবসন, নাজিম হিকমাত, ইউজিন পাতিয়ের, পিয়ের দেক্তার, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের গান ভিন্ন ভাষায় রচিত হলেও বাংলায় অনুদিত হয়ে গীত হতো ।
এমনি কত গুলো ক্রান্তিকালের গান এখনো গীত হয় ।
অতো রেনে কস্তিয়ের এই গান টি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় অনুবাদ করেন , সুর করেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়
তোমার আছে বন্দুক আর আমার আছে ক্ষুধা
তোমার আছে বন্দুক কারন আমার আছে ক্ষুধা
তোমার আছে বন্দুক তাই আমার আছে ক্ষুধা
ইউজিন পতিয়ের সেই বিখ্যাত গান , সুর করেন পিয়ের দেগতার ,যার সফল অনুবাদ করেন মোহিত বন্দোপাধ্যায়
জাগো জাগো জাগো সর্বহারা অনশন বন্দী ক্রীতদাস
শ্রমিক দিয়াছে আজ সারা উঠিয়াছে মুক্তির আশ্বাস
নাজিম হিকমতের কথায়, অনুবাদ আর সুর বসালেন কমল সরকার। জন্ম নিলো বাংলার গনসঙ্গীতের বলিষ্ঠ সংযোজন
ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না
নিগ্রো ভাই আমার পল রবসেন
আমারা আমাদের গান গাই ওরা চায় না ওরা চায় না
বজ্রপাতের ঝলকানিতে চমকে ওঠা সমবেত স্পর্ধার প্রতিটা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে, ঘটনা কে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিলো যুগান্তকারী সব গান । ১৯৪৫ নেত্রকোণায় সারা ভারত কৃষক সভার সম্মেলনে পতাকা তোলা হয়েছিল এই গান টা গেয়ে।
চাষী দে তোর লাল সেলাম তোর লাল নিশান রে
আন্ধার পথে আলো দেয় সে মুশকিল আসান করে
আমরা মাটির মানুষ ভাই মাটির জয়গান গাই
তমসাচ্ছন্ন ব্যথিত ক্রন্দনের সময় সেই পঞ্চাশের মন্বান্তরে অনল চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন এবং সুর দিয়েছিলেন ,
আজ বাংলার বুকে দারুন হাহাকার
চাষের জমি পড়ে আছে চাষীর ঘরে অনাহার
গ্রামে গ্রামে নেমে এলো মহামারীর ছায়া
পেটের জ্বালায় পাগল মানুষ ভোলে স্নেহ মায়া
মজার কথা হচ্ছে ১৯৮৮ সালের বন্যায় এই গান গেয়ে আমরা অর্থ সংগ্রহ করেছি।
বলছিলাম যে তখন রাজনৈতিক সামাজিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিত্য নতুন গান রচিত হত। যেমন সেই যে ভীষন কষ্টের গান । শোকের তিলক পড়ে পরেশ ধর এর কথা আর সুরে ইতিহাস কে আঁকড়ে ধরে আছে আজো সেই গান
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি
আমি হাসি হাসি পরব ফাসি দেখবে ভারত বাসী
সকরুণ আর্তনাদে ছোট ভাই নিজামুল হক সুর করলেন বড় ভাই গাজীউল হকের কথায়, রচিত হল একুশের বিখ্যাত গণসঙ্গীত,
ভুলব না ভুলব না এ একুশে ফেব্রুয়ারী ভুলব না
লাঠি গুলি আর টিয়ার গ্যাস মিলিটারী ভুলব না
রাস্ত্র ভাষা বাংলা চাই এ দাবিতে ধর্মঘট
বরকত সালামের খুনে লাল ঢাকার রাজপথ
এই লেখায় স্বাধীন বাংলা বেতারের ভুমিকার কথা না বললেই নয়।এখান থেকে জন্ম নিয়েছে গনসংগীতের আরেক ধারার। লড়াইয়ের মাঠ থেকে যেনো উঠে এসেছে এই সব গান আর সুর। ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর তরুন অফিসার, শিল্পী স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র গঠন করেন। ২৭ মার্চ বিপ্লবী নামটা বাদ দেয়া হয়।
চট্টগ্রামের এই কেন্দ্র চিহ্নিত হয়ে পড়লে কালুরঘাট বেতার প্রক্ষেপণ কেন্দ্রে সরে যাওয়া হয়। এটিও যখন পাকিস্তানীদের নজরে চলে আসে তখন ১০ কিলো ওয়াটের ট্রান্সমিটার টি অকেজো করে শিল্পী কলা কুশলীরা চলে যান ত্রিপুরার আগরতলায়। আরেকটি দল চলে যায় বগাফায়। ২৫ মে ১৯৭১ কলকাতার বালিগঞ্জে সারকুলার রোডের দোতলা বাসায় স্থাপিত হয় বেতার কেন্দ্র, উদ্বোধনের দিন হিসেবে বেছে নেয়া হয় নজরুলের জন্মদিন ১১ জৈষ্ঠ্য। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর সুকান্তের গানে ই তো রয়েছে জনমানুষের আকুতি, তাই এই গান গুলো ও গীত হয় এবং হয়েছে গণসঙ্গীত হিসেবে, প্রতিরোধের ভাষা হিসেবে।
স্বজন হারানো ব্যাথা , শস্যের জন্যে ভালবাসা, বুনো ঘাসের কচি ডগা, প্রার্থিত উজ্জ্বলতা কি ছিলো না সেদিনের গানে?
শুরু হোল কেন্দ্রটির যাত্রা, ভারতের দেয়া রেকর্ডিং মেশিন ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করে নি নাকি সেদিনের সেই স্টেশনটি।
অপুর্ব সব গনসঙ্গীতের জন্মস্থান এই কেন্দ্র। “মুক্তির গান” গেয়ে যুদ্ধের সময়ে জনমত তৈ্রীর প্রামান্য চিত্রে বেশ কিছু গণসঙ্গীত আমরা শুনতে পাই। ।
আমার খুব প্রিয় একটা গান শোনাবার ইচ্ছে ছিল, খুঁজে পেলাম না। অপরেশ লাহিড়ীর সুরে আর শ্যামল গুপ্তের কথায়
হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে বাংলার বুকে আছি দাঁড়িয়ে
টেনেছে দুদিক থেকে বুক ভরা ভালবাসা আবার দুহাত যেন বাড়িয়ে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ৭১ একটি মহাকাব্যের অপেক্ষা করছে অথবা সেই মহাকাব্য আরো একটি যুদ্ধের। তাই সংস্কৃতি কর্মীদের আজো পথে নামতে হয়, মানুষকে শোষনের বিরুদ্ধে জাগাতে হয়। যে চোখে অশ্রু বয় সেই চোখে স্বপ্ন দেখাবার তাগিদ দিতে , আগুন ঝড়াবার ইঙ্গিত দিতে আজো তাদের কন্ঠে ধ্বনিত হয় সেই সব জাগানিয়া গান।
তাই তো এই গান গুলো অন্য কারণে রচিত হলেও ইদানিং কালেও গীত হয়েছে । যেমন রাহাত খানের এই গান টি উনসত্তুর এর হলেও আবার নতুন করে ডাঃ মিলনের মৃত্যুর পর অথবা নুর হোসেনের মৃত্যুর পর অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়েছে
মাগো তোমার সোনা মানিক ছুটি হলেও ফিরবে না
সকাল হবে দুপুর হবে দিন ফুরুলে সন্ধ্যা হবে
নীড়ের পাখি ফিরবে নীড়ে, তোমার জাদু ফিরবে না
শামসুদ্দিন আহমেদের কথা আর সুরে
রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন করিলে রে বাঙ্গালী,তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি।
এই গানের একটি লাইন ছিলো
ইংরেজ যুগে হাটুর নিচে চালাইত গুলি
স্বাধীন দেশে ভাইয়ে ভাইয়ে উড়ায় মাথার খুলি
এরশাদ আমলে মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দেবার পর গীত হয়েছে –
স্বাধীন দেশে ট্রাকের চাকায় গুড়ায় মাথার খুলি
আজো মার্কীনি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গীত হয় শিবদাস বন্দোপাধ্যাএর লেখা আর ভি বালসারার সুরে
আজ যত যুদ্ধবাজ দেয় হানা হামলা বাজ
আমাদের শান্তি সুখ করতে চায় লুট তরাজ
জোট বাধো তৈরী হও যুদ্ধ নয় তোল আওয়াজ
হরলাল রায়ের কথা আর সুরে আঞ্চলিক ভাষায় গাওয়া হয়েছে
ফান্দে পড়িয়া ইয়াহিয়া কান্দে রে
ফান্দ বসাইছে মুক্তি সেনা ডিনামাইট দিয়া
৯০ এর আন্দোলনে এখানেও জুড়ে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের স্বৈরাচারী শাসকদের নাম।
মকসুদ আলী খার সুরে আর কথায় এই গানটিও কথা পালটে ব্যাবহার হয়েছে, পৃথিবীর জায়গায় ইয়াহিয়া, পরবর্তিতে এরশাদ নামটি জুড়ে গাওয়া হয়েছে।
সোনায় মোড়ান বাংলা মোদের শ্মশান করেছে কে
পৃথিবী তোমায় আসামীর মত জবাব দিতে হবে
গনসঙ্গীতের ধারা যেমন আমাদের রাজনৈ্তিক আন্দোলনকে সাহায্য করেছে এগিয়ে যেতে আবার রাজনৈ্তিক ঘটনাও গণসংগীতকে কে করেছে সমৃদ্ধ ।
বাংলাদেশে এখনো বিভিন্ন সংগঠন নিয়মিত গণসংগীতের চুর্চা করে, বই বেরুচ্ছে, সিডি বেরুছে। আমি প্রচন্ড আশাবাদী যে এই ধারা কে টিকিয়ে রাখবে শিল্পীরা। আর ছিঁটে ফোঁটা যা ব্যাত্যয় তা আমরা মেনে নেবো কালের দাবীতে।
যখন এই লেখাটি লিখতে বসি একরাশ হতাশা ভীড় করেছিলো কিন্তু লিখতে লিখতে মনে হলো এই যে ঐতিহ্য তা চির কালের , দু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় এই জোয়ার থামার নয়।
লেখাটির জন্য আমি কামাল লোহানীর লড়াইয়ের গান বইটির তথ্য ব্যাবহার করেছি। সলিল চৌধুরীর গানের একটা লিঙ্ক দিলাম , মুক্তির গান আর স্বাধীন বাংলা বেতারের ও একটা লিঙ্ক জুড়ে দিলাম।
http://www.swadhinbangla-betar.org/
আমার একটি প্রিয় গান “পথে এবার নামো সাথী” এখানে রয়েছে।
চমৎকার পোস্ট, কেয়া!!! ইরতিশাদকেও ধন্যবাদ সলিল চৌধুরীর গানের ভিডিওটার জন্য – অনেকদিন পর আবার পছন্দের গানটা শোনা হলো
কেয়ার এই লেখাটা আমাকে নিয়ে গেলো ঊনসত্তর-সত্তরের সেই আগুনঝরা দিনগুলোতে। এই গানগুলো তখন কি যে উত্তেজনা আর উদ্দীপনার উৎস ছিল আমাদের কাছে বলে বোঝানো যাবে না। গণসঙ্গীতের প্রাণপুরুষ সলিল চৌধুরীর গান বাংলা সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। ইন্টারনেটে (ইউটিউব) ভিডিও খুব একটা খুঁজে পেলাম না। আমার প্রিয় দুটো গান মুক্তমনার পাঠকেদের জন্য তুলে দিলাম, প্রথমটা ভিডিওসহ।
হেই সামালো ধান হো
httpv://www.youtube.com/watch?v=IKatUETX2cs
হেই সামালো ধান হো
কাস্তেটা দাও শাণ হো
জান কবুল আর মান কবুল
আর দেবনা আর দেবনা
রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।।
চিনি তোমায় চিনি গো
জানি তোমায় জানি গো,
সাদা হাতির কালা মাহুত তুমি নও।।
পঞ্চাশে লাখ প্রাণ দিসি
মা-বোনেদের মান দিসি,
কালোবাজার আলো কর তুমি না।।
মোরা তুলবনা ধান পরের গোলায়
মরবনা আর ক্ষুধার জ্বালায় মরবনা
ধার জমিতে লাঙ্গল চালাই
ঢের সয়েসি আর তো মোরা সইবনা
এই লাঙ্গল ধরা কড়া হাতের শপথ ভুলবনা।।
কথা ও সুর: সলিল চৌধুরী
ঢেউ উঠেছে কারা টুটেছে
ঢেউ উঠেছে কারা টুটছে আলো ফুটছে প্রাণ জাগছে
ঢেউ উঠেছে কারা টুটেছে আলো ফুটেছে প্রাণ জাগছে জাগছে জাগছে
গুরু গুরু গুরু গুরু ডম্বর পিনাকী বেজেছে বেজেছে বেজেছে
মরা বন্দরে আজ জোয়ার জাগানো ঢেউ তরণী ভাসানো ঢেউ উঠেছে।
শোষণের চাকা আর ঘুরবে না ঘুরবে না
চিমনীতে কালো ধোঁয়া উঠবে না উঠবে না।
বয়লারে চিতা আর জ্বলবে না জ্বলবে না
চাকা ঘুরবে না, চিতা জ্বলবে না, ধোঁয়া উঠবে না
লাখে লাখ করতাল হরতাল হেঁকেছে, হরতাল, হরতাল, হরতাল।
আজ হরতাল, আজ চাকা বন্ধ।।
আর পারবে ভোলাতে মধুমাখা ছুরিতে
জনতাকে পারবে না ভোলাতে।
আর পারবে না দোলাতে মরীচিকা মায়াতে
বিভেদের ছলনায় ছলিতে
মিছিলের গর্জন, দুর্জয় শপথে গরজে ঐ গরজে
আজ হরতাল, আজ চাকা বন্ধ।।
(কথা: সলিল চৌধুরী, ১৯৪৬ সালের নৌ বিদ্রোহের সময় রচিত গান)
@ইরতিশাদ ভাই,
এই যে, ঢেউ উঠছে কারা টুটছে গানটা
@ফরিদ আহমেদ,
অসংখ্য ধন্যবাদ, ফরিদ। আমার এই প্রিয় গানটাও এখন একক্লিকেই শুনতে পাচ্ছি।
এরকম একটি তথ্যপূর্ণ অসাধারণ লেখার জন্য ক্যাথেরীনাকে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ।
আমাদের অযত্নে হারিয়ে যাওয়া গণসঙ্গীত সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। এ ধরনের লেখা আরো আরো লিখবেন সেই প্রত্যাশা রইলো।
এই হাকিম ভাই সম্পর্কে কী আরেকটু আলোকপাত করা যায়?
গণসঙ্গীতকে রাজনৈতিক আন্দোলনে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানীর অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন। এখানেই মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে এই বিশেষ অধিবেশনে সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। যা সেই সময় প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, লোকজনের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছিল। মানুষের নন্দনতাত্তিক বিকাশের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল এই টুপি দাড়ি ওয়ালা মওলানার।
সেই সম্মেলনে খ্যাতনামা দ্রোহী কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-গায়করা উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাদের দেশের লোককবি, বাউল ও গণসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে রমেশ শীল, পরিমল দাশগুপ্ত এবং শাহ আবদুল করিমসহ উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদী শিল্পীদের সমাবেশ ঘটে। ফলে কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে লালনগীতি পরিবেশিত হয়েছে, ঢাকার মুলুক চাঁদের যাত্রাদল ‘সৎমা’ পালা অভিনয় করেছে। লাঠি, রামদা ও তলোয়ারের মেলা হয়েছে বঙ্গ-সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে। খোলা মঞ্চে পরিবেশিত হয়েছে রমেশ শীলের কবিগান, তসর আলীর জারি ও ‘কাঞ্চন পালা’ গাওয়া হয়েছে।
কাগমারী সম্মেলনে উপস্থিত বিশিষ্ট কৃষক নেতা কমরেড আব্দুল মালিক জানান যে, বানিয়াচংয়ের গণশিল্পী পরিমল দাশগুপ্ত পায়ে হেঁটে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে সম্মেলনস্থলে উপস্থিত হন। তখন প্রায় শেষ রাত। এই শেষ রাতে শিল্পী মাইলখানেক দূর থেকে সুর করে গান ধরেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বিখ্যাত মাউন্টব্যাটন মঙ্গল কাব্য থেকে, ‘মাউন্টব্যাটন সাহেব, তোমার সাধের ব্যাটন কার হাতে থুইয়া গেলায়ও৷’
ফরিদের লেখার পর কেয়ার এ লেখাটি সময়োপযোগী
ধন্যবাদ কেয়া, ঐতিহাসিক কিছু গণসঙ্গীত রচয়িতাদের তাদের গানের প্রেক্ষ¡পট ও উদাহরণসহ তুলে ধরার জন্যে।
এভাবেই আমাদের হাতে রচিত হবে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস।