প্রথম পর্বের পর…

“হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে – “বাহবা কি ফুর্তি!
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।”……
সিংহের শিং নেই, এই তার কষ্ট –
হরিণের সাথে মিলে শিং হল পষ্ট।“

আর্ডি নিয়ে পড়তে শুরু করার পর থেকেই খালি সুকুমার রায়ের খিচুড়ি কবিতাটা মনে পড়ছে। কেন যে পড়ছে তা আর্ডির খিচুড়ি মার্কা বৈশিষ্ট্যগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন। কি যে এক অদ্ভুত জিনিষ এই আর্ডি, যত পড়ছি ততই বুঝতে পারছি, কেন এতজন বিজ্ঞানী মিলে ১৪-১৫ বছর ধরে এই ফসিলগুলো নিয়ে রাত নেই দিন নেই কাজ করলেন। আর্ডির এই জগাখিচুড়ি সব বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে নিশ্চয়ই তাদের বিস্ময়ের সীমা পরিসীমা ছিল না। শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাননি তারা। এই না বানর-না শিম্পঞ্জী- না শিম্পানুষ-না মানুষ ধরণের অদ্ভুতুড়ে প্রজাতিটাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বলে কি বিপদে পড়বেন নাকি?

সে যাক এবার তাহলে আসল লেখায় ঢোকা যাক, আগেই বলে নেই, এবারের লেখাটা আগেরটার চেয়ে আরো অনেক ক্লান্তিকর, ফসিলের হাড্ডিগুড্ডি নিয়ে মজার কিইবা লেখার আছে! নিতান্তই আগের লেখাটা লিখে ফেলেছিলাম বলে, আর রায়হান কিংবা ফরিদ ভাইদের মত মানুষদের মিথ্যা প্রপাগান্ডা ভুল প্রমাণ করার জন্যও বাকিটা লিখতেই হল :)।

হ্যা, ঠিক, আর্ডি মানব বিবর্তনের কতগুলো খুব মৌলিক প্রকল্পকে চুরমার করে দিয়েছে…আর এখানেই বোধ হয় বিজ্ঞানের সার্থকতা। মানুষের ইতিহাসের বই-এর ক’টা পাতা আবার নতুন করে লিখতে হচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা দুঃখে ভেঙ্গে পড়ছেন না। বরং অত্যন্ত গৌরবের সাথে পৃথিবী জোড়া বিজ্ঞানীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এই নতুন আবিষ্কারের আলোকে পুরনো ভুল ধারণাগুলোকে ঝেরে ফেলে দিয়ে সঠিক তথ্যকে সামনে নিয়ে আসার কাজে। বেশ কয়েকটা পুরনো ধারণার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে আর্ডি, তবে আমার মতে এর মধ্যে দু’টো বিষয় বিশেষভাবে আলোচনার দাবী রাখে। আর্ডির এই প্রজেক্টের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী, ফসিলবিদ সি ওয়েন লাভজয় এর ভাষায়…

১) সাভানা বা তৃণভূমির কারণে মানুষ দ্বিপদী হয়ে উঠেছিল – আর্ডির আবিষ্কার এই প্রকল্পটিকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দিচ্ছে… এবং

২) এতদিন যে ধারণা করা হত, মানুষ শিম্পাঞ্জীর মত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোন সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে আজ এখানে এসে পৌঁছেছে তাও সম্পূর্ণভাবে গ্রহনযোগ্যতা হারাচ্ছে।[1]

প্রথমে দ্বিতীয় প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা করা যাক। আর্ডির আবিষ্কারের ফলে নতুন কি প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন বিজ্ঞানীরা এবং কেন তা করেছেন, সেটা ভালো করে বুঝলে প্রথম বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে যাবে।
আগের পর্বেই উল্লেখ করেছিলাম, সেই ডারউইনের সময় থেকেই ( বিশেষ করে হাক্সলীর বিভিন্ন লেখা থেকে) ভেবে আসা হচ্ছিল যে, মানুষ, শিম্পাঞ্জী এবং বনবোর সাধারণ পূর্বপুরুষদের মধ্যে আজকের বনমানুষদের মত বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান ছিল। তারপর ধীরে ধীরে ৬০-৭০ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফলশ্রুতিতে আজকের আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটছে। কেন এটা ভাবা হত তা নিয়েও আগে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু এখন পিছন ফিরে তাকালে (যদিও পিছনে ফিরে অতীতের ভুল বা সংশয়গুলো নিয়ে সমালোচনা করাটা সব সময়ই খুব সোজা একটা কাজ :)) ) বোঝা যায়, গুটিসংখ্যক বিজ্ঞানী যে এটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেননি তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে লুসির (Australopithecus afarensis) সম্পূর্ন দ্বিপদী বৈশিষ্ট্য অনেককেই অবাক করেছিল, ৩৭ লক্ষ বছর আগেই যদি মানুষের পূর্বপুরুষেরা দিব্যি খাড়া হয়ে হাটতে, চলতে শিখে গিয়ে থাকে তাহলে এই বিবর্তন ঘটল কবে ? ৬০ লক্ষ বছর আগে আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষরা যদি গরিলা, শিম্পাঞ্জীদের মত আঙ্গুলের গাটের উপর ভর করে হাটতো, (নাকল ওয়াকিং) তাহলে এত বড় পরিবর্তনটার সূচনা হয়েছিল কবে? তারা আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হলেও, এই ধরণের চলাফেরার জন্য আধুনিক বনমানুষদের শারীরিক গঠনে এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে যার সাথে আমাদের পার্থক্যটা কিন্তু চোখে পড়া মত। আমরা কি কখনই মধ্যবর্তী কোন ফসিল খুঁজে পাবো যা থেকে আমাদের বিবর্তনের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টির পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো বুঝতে পারবো?

হ্যা, আর্ডি সে কাজটাই অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে। কি যে হযবরল টাইপের একটা প্রাণী এই আর্ডি – না-শিম্পাঞ্জী, না-বানর, না-মানুষ – লুসি যদি ফসিলবিদদের জন্য একটা বিশাল পাওয়া হয়ে থাকে, আর্ডি হচ্ছে তাদের বহুকালের স্বপ্নের ফসল। এক শতাব্দীর চেয়েও বেশী সময় ধরে অপেক্ষা করেছেন তারা এরকম একটা ফসিলের জন্য! পেনসেলভিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্ম-নৃতত্ত্ববিদ আ্যলেন ওয়াকার লস এঞ্জেলেস টাইমসের সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, এই ফসিলগুলো লুসির ফসিলের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। কারণ, সত্তরের দশকে লুসি যখন পাওয়া যায় তার অনেক আগেই এই প্রজাতির (Astrolopithecus aferensis)আরও অনেক টুকরো টুকরো ফসিল পাওয়া গিয়েছিল, যেগুলো থেকে আমরা এদের প্রধাণ বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে ইতোমধ্যেই মোটামুটিভাবে ওয়াকিবহাল ছিলাম। কিন্তু আর্ডি এবং তার সাথে পাওয়া ফসিলগুলো এক্কেবারে নতুন এবং অজানা এক জীব, লুসিদের চেয়েও অনেক বেশি অদ্ভুতুড়ে এবং আদিম (১)। শুধু তো তাই নয়, মানুষের বিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে এখন পর্যন্ত খুব কমই এরকম পূর্নাঙ্গ ফসিল
পাওয়া গেছে, আসলে বিভিন্ন কারণেই মানুষের পূর্বসুরীদের ফসিল খুঁজে পাওয়া কিন্তু খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির বেশ কিছু পূর্ণাঙ্গ ফসিল পাওয়া গেলেও তার আগের বিভিন্ন আদি-মানব প্রজাতির হাতে গোনা ৩-৪ টা ফসিল ছাড়া তেমন কোন পুরো ফসিল পাওয়া যায়নি বললেই চলে (১)।

 ইথিওপিয়ার আফার অঞ্চলে জীবাশ্ম-নৃতত্ত্ববিদ টিম হোয়াইটের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী আর্ডির এই ফসিল আবিষ্কার করেন ১৯৯৪ সালে। আর্ডিরটা একমাত্র প্রায়- পূর্নাঙ্গ ফসিল হলেও, এই একই প্রজাতির আরও ৩৬ টি স্বতন্ত্র ব্যাক্তির দেহের বিভিন্ন অংশের শতাধিক হাড় গোড় পাওয়া গেছে। এর সাথে আরও পাওয়া গেছে, ২৯ প্রজাতির পাখী, ২০ রকমের প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং বিভিন্ন ধরণের গাছ এবং বীজের ফসিল। এগুলো নিয়ে গত ১৫ বছর ধরে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিভিন্ন শাখার বিজ্ঞানীরা কাজ করে আসছেন। ‘সাইন্স’ জারনালটিতে যে ১১টা বৈজ্ঞানিক পেপার বের হয়েছে তা লিখতে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার ৪৭ জন বিজ্ঞানী অংশগ্রহণ করেছেন। জীববিদ্যা বা ফসিলবিদ্যায় এতজন বিজ্ঞানীর এত বছর ধরে সম্মিলিতভাবে কাজ করার এরকম নজির মনে হয় খুব কমই দেখা গেছে।

1_ardi_fossil
ছবি ১. আর্ডির ফসিলের বিভিন্ন অংশ [2]

আর্ডির শিম্পাঞ্জী, বানর, মানুষে একাকার হয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যগুলোঃ

আর্ডি নিয়ে লেখাটার সবচেয়ে বিরক্তিকর অংশ হচ্ছে এটি, এখানে আর্ডির হাড়গোড়ের বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ‘এ আলোচনা করতেই হবে এমন কোন দিব্যি কেউ আমাকে দেয়নি, সেটা ঠিক, কিন্তু ৪৩ লক্ষ বছরের পুরনো একটা ফসিল নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এছাড়া আর কোন উপায় আছে বলেও আমার জানা নেই। অগত্যা কি আর করা… । তবে, আমি আমার নিজের এবং পাঠকের বিরক্তির কথা মাথায় রেখে, আলোচনাটাকে যথা সম্ভব সাধারণ বাংলায় সংক্ষিপ্তভাবে করার চেষ্টা করবো (আমি এখানে বাংলায় আর কোন টেকনিকাল কথাবার্তা উল্লেখ করলাম না, তবে ছবির ক্যাপশানের সাথে যুক্ত ইংরেজিটুকু রেখে দিলাম, কেউ যদি আরেকটু বিস্তারিত বুঝতে চান তাহলে সেটা পড়ে নিতে পারেন)।

আর্ডির যে বৈশিষ্ট্যটা বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বেশী অবাক করেছে সেটা দিয়েই শুরু করি। প্রায় ৪৩ বছর আগের মানুষের কোন সম্ভাব্য পূর্বপুরুষের মধ্যে আর যাই তারা প্রত্যাশা করে থাকুন না কেন, এর মধ্যে কোন মতেই দু’পায়ের উপর খাড়া হয়ে চলাফেরা করার ক্ষমতা যে অন্তর্ভুক্ত ছিল না তা হলফ করে বলা যায়।

এতদিন পর্যন্ত ফসিল রেকর্ডগুলো থেকে আমরা দ্বিপদী বৈশিষ্ট্যের বিবর্তনের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাই পাইনি। লুসির শ্রোণীচক্রের গঠন অনেকাংশে আমাদের মতই, তাদের মধ্যে ইতোমধ্যেই, অর্থাৎ ৩৭ লক্ষ বছর আগেই, অত্যন্ত অগ্রসর দ্বিপদী বৈশিষ্ট্যাবলীর অভিযোজন ঘটে গিয়েছিল। এ থেকে আমরা ঠিক কখন এবং কিভাবে সেই দ্বিপদী যাত্রা শুরু করেছিলাম তার প্রাথমিক স্তরগুলো সম্পর্কে কোন ধারণা পাই না। সে হিসেবে, আর্ডির প্রজাতি, Ardipithecus ramidus কিন্তু প্রথম প্রজাতি যার মধ্যে দ্বিপদী বৈশিষ্ট্যের বিবর্তনের প্রাথমিক ধাপগুলো দেখা যাচ্ছে।

আর্ডির শ্রোণীচক্র, পায়ের হাড় (ফিমার) এবং বুকের গঠণ থেকে শিম্পাঞ্জি ও মানুষের মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যের এক অদ্ভুত সমন্বয় দেখা যাচ্ছে। প্রাইমেটদের মধ্যে হোমিনিডের শ্রোণীচক্রের গঠন সবচেয়ে জটিল এবং বনমানুষদের থেকে তা আবার বেশ কিছুটা অন্যরকম। শ্রোণীচক্রের এই বিশেষ গঠনই তাকে দুপায়ের উপর হেটে চলে বেড়ানোর সময় প্রয়োজনীয় ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। আর্ডির সাথে শিম্পাঞ্জীর শ্রোণীচক্রের অমিলগুলো কিন্তু বেশ প্রকট, আবার অন্যদিকে তা লুসির শ্রোণীচক্রের তুলনায় অনেক বেশী আদিম। আর্ডির ইলিয়ামের (ছবিতে দেখুন, শ্রোণীচক্রের এই বড় হাড়টাকেই ইলিয়াম বলে) উপরের অংশে এমন কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে যা দু’পায়ের উপর ভর করে চলার সময় ভারসাম্য রক্ষার জন্য

The Ar. ramidus pelvis has a mosaic of characters for both bipedality and climbing. Left to right: Human, Au. afarensis (“Lucy”), Ar. ramidus, Pan (chimpanzee). The ischial surface is angled near its midpoint to face upward in Lucy and the human (blue double arrows), showing that their hamstrings have undergone transformation for advanced bipedality, whereas they are primitive in the chimpanzee and Ar. ramidus (blue arrows). All three hominid ilia are vertically short and horizontally broad, forming a greater sciatic notch (white arrows) that is absent in Pan. A novel growth site [the anterior inferior iliac spine (yellow arrows)] is also lacking in Pan.

ছবি ২.মানুষ, লুসি এবং আর্ডির শ্রোণীচক্রের হাড় ইলিয়ামের তুলনামূলক গঠণ (ছবিতে ক্লিক করে বড় করে দেখুন) [3]

অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এর কোনটাই কিন্তু শিম্পাঞ্জি বা অন্য কোন আধুনিক বনমানুষের মধ্যে দেখা যায় না। ইলিয়ামের উপরের অংশের এই বিবর্তনের কারণে আর্ডি দু’পায়ে খাড়া হয়ে দিব্যি হেটে চলে বেড়াতে পারলেও খুব জোড়ে দৌড়াতে, বোধ হয়, সক্ষম ছিল না। দৌড়ে বেড়ানোর জন্য শ্রোণীচক্রের যে অগ্রসর গঠন দরকার তার বিবর্তন এই প্রজাতির মধ্যে তখনও কিন্তু ঘটেনি। আবার ইলিয়ামের নিচের অংশের গড়ণটা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বনমানুষের ইলিয়ামের নিচের অংশের সাথে মিলে যাচ্ছে, যা কিনা আবার গাছে চড়ার জন্য অপরিহার্য ছিল। ওদিকে লুসির ফসিলের সাথে তুলনা করলে বোঝা যায় আর্ডি্র গঠন আসলে কতটা আদিমতর ছিল। লুসির ইলিয়ামের শুধু উপড়ের অংশই নয়, নীচের অংশটাও সম্পূর্ণভাবে দৌড়ানোর উপযোগী হয়ে উঠেছিল। লুসির শ্রোণীচক্র, হাত ও পায়ের গঠণ থেকে এটাও পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয় যে বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় তারা যে শুধু ৩৭ লক্ষ বছর আগে বেশ অগ্রসর দ্বিপদী বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল তাইই নয়, গাছে চড়ে বেড়ানোর ক্ষমতাও কিন্তু তারা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল।
আর্ডির হাতের গঠন দেখলে তাকে শিম্পাঞ্জীর চেয়ে বরং আদিম এক বানর প্রজাতি প্রকোনসুলের কাছাকাছি প্রাণী বলেই মনে হবে। বনমানুষদের হাতের তালু এবং আঙ্গুলের সন্ধিস্থল বা জোড়াগুলো তুলনামুলকভাবে অনেক শক্ত, গাছের ডালে ডালে চলাফেরার সময় হাতের উপর এত বড় শরীরের ভার বইতে হয় বলেই হয়ত এই

Two views of the left hand of Ar. ramidus showing primitive features absent in specialized apes. (A) Short metacarpals; (B) lack of knucklewalking grooves; (C) extended joint surface on fifth digit; (D) thumb more robust than in apes; (E) insertion gable for long flexor tendon (sometimes absent in apes); (F) hamate allows palm to flex; (G) simple wrist joints; (H) capitate head promotes strong palm flexion. Inset: lateral view of capitates of Pan, Ar. ramidus, and human (left to right). Dashed lines reflect a more palmar capitate head location for Ar. ramidus and humans, which allows a more flexible wrist in hominids
ছবি ৩.মানুষ, লুসি এবং আর্ডির হাতের তুলনামূলক গঠণ।[4]

অভিযোজনের প্রয়োজন পড়েছিল । তাদের হাতের তালু যতখানি লম্বাটে, বুড়ো আঙ্গুলটা ততখানিই খাটো। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই বনমানুষদের মাটিতে হাটার সময় আঙ্গুলের গাঁটে ভর করে চার হাত পায়ের সাহায্যে হাটতে হয়। প্রাইমেটদের মধ্যে শুধুমাত্র আফ্রিকান বনমানুষেরাই এভাবে চলাফেরা করে, বিভিন্ন প্রজাতির বানর কিন্তু আঙ্গুলের উপর নয় বরং হাতের তালুর উপর ভর করেই মাটিতে চলাফেরা করে থাকে। অন্যদিকে, মানুষের হাতের তালু তুলনামুলকভাবে বেশ ছোট এবং কব্জির গঠন অনেক নমণীয়। একারণেই আমরা খুব শক্ত করে জিনিষপত্র আঁকড়ে ধরতে পারি এবং তাতে চাপ প্রয়োগ করতে পারি। কব্জি থেকে যতই হাতের উপরের দিকে যাওয়া যায় ততই বনমানুষদের সাথে আমাদের পার্থক্য কমতে থাকে।

এ তো গেল বনমানুষ আর মানুষের হাতের গড়ণ। এখন তাহলে আর্ডির হাতের গঠনের দিকে চোখ ফেরান যাক। আর্ডির হাতের সবগুলো হাড় প্রায়-অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। সে যে কোনভাবেই নাকল ওয়াকিং করতো না সেটা খুবই স্পষ্ট, এর জন্য হাত এবং আঙ্গুলের গঠনে যে অভিযোজনগুলোর প্রয়োজন তার কোনটাই আর্ডির মধ্যে নেই। শুধু তাই নয়, তার কব্জি এবং হাতের আঙ্গুলের জোড়াগুলোও অত্যন্ত নমনীয়, এমনকি আমাদের চেয়েও আরও বেশী নমনীয় ছিল বলেই মনে হয়। আর্ডির হাতের গঠন থেকে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, তার হাতের গঠন আধুনিক বনমানুষদের চেয়ে অন্যরকম ছিল। তাদের হাতের সাথে আমাদের হাতের মিলই বরং অনেক বেশী। অর্থাৎ, মানুষের পূর্বপুরুষেরা নাকল ওয়াকিং থেকে অভিযোজিত হয়ে এখানে আসেনি, আসলে ব্যাপারটা ঠিক তার উলটো। আধুনিক বনমানুষেরাই বরং ধীরে ধীরে নাকল ওয়াকিং এ অভিযোজিত হয়েছে আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার পরে। তাহলে ব্যাপারটা কি দাড়াচ্ছে? আর কিছুই নয়, আমাদের হাতের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো, যা দিয়ে আমরা খুব সহজেই হাতিয়ারের ব্যাবহার করতে শিখেছি, তার অর্জন করার জন্য আমাদের খুব বেশি কাঠ খড় পোড়াতে হয়নি। এই হাত আমরা অনেকাংশেই সরাসরি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকেই পেয়েছি, এর জন্য বুড়ো আঙ্গুলের আকার কিছুটা বড় হওয়া এবং আঙ্গুল্গুলো অপেক্ষাকৃত ছোট হয়ে যাওয়ার মত ছোট কিছু অভিযোজন ছাড়া আর তেমন কোন বড় পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়েনি।

 আর্ডির পায়ে বনমানুষের মত বড় আঙ্গুল (বনমানুষদের গাছে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার সময় ডাল-পালায় পায়ের ঠেক দেয়ার জন্য বা গাছের ডাল আঁকড়ে ধরার জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত oppsable thumb বা বৃদ্ধাঙ্গুলী) দেখা গেলেও বাকি হাড়ের গড়ণগুলো কিন্তু আবার এক্কেবারে অন্য কাহিনী বলছে। তার পায়ের পাতায় একটি ছোট্ট হাড় আছে (os peroneum) যা আবার বনমানুষদের মধ্যে নেই, শুধুমাত্র বানর এবং গিবনদের মধ্যে আছে, আর আছে আমাদের পায়ের পাতায়, সেই হাড়ের অবশিষ্টাংশ হিসেবে। এই হাড়টা না থাকার কারণে বনমানুষেদের পা বানরের পায়ের থেকে অনেক বেশী নমনীয় যা দিয়ে তারা বড় শরীর নিয়ে চলাফেরার সময় বা সোজা হয়ে গাছে ওঠার সময় শক্ত করে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরতে পারে। আর্ডির পায়ের পাতায় যে শুধু এই হাড়টি আছে তাই নয়, এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোও তার মধ্যে রয়ে গিয়েছিল। শিম্পাঞ্জী, গরিলা তে এই হাড়টি না-থাকা আর বানর এবং আমাদের মধ্যে এর অস্তিত্ব থেকে যাওয়া থেকে এটুকু অন্তত বলা যায় যে, আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষের মধ্যেও এর অস্তিত্ব ছিল। পরবর্তীতে বিবর্তনের প্রক্রিয়ার বনমানুষদের মধ্যে তা লুপ্ত হয়ে গেছে।

Foot skeleton of Ar. ramidus (bottom; reconstruction based on computed tomography rendering shown) lacked many features that have evolved for advanced vertical climbing and suspension
in extant chimpanzees (Pan, top left). Chimpanzees have a highly flexible midfoot and other adaptations that improve their ability to grasp substrates. These are absent in Ar. ramidus.

ছবি ৪. শিম্পাঞ্জী, মানুষ, আর্ডির পায়ের তুলনামূলক গঠণ।[5]

আর্ডির বাকি চারটা আঙ্গুলের বিশেষভাবে অভিযোজিত শক্ত গঠন থেকে একদিকে যেমন বেশ পরিষ্কারভাবে তার দেখা যাচ্ছে যে সে দুপায়ের উপর ভর করে হাটতে সক্ষম ছিল, অন্যদিকে তার বাঁকানো বুড়ো আঙ্গুল প্রমাণ করে যে, সে তখনো গাছে গাছে চড়ে বেড়াতেও বেশ অভ্যস্ত ছিল। এ যেন সেই বাংলা প্রবাদের মত অবস্থা – গাছেরটাও খাবো, তলারটাও কুড়াবো। কি যে এক অদ্ভুত ‘খিচুড়ি’ মার্কা বৈশিষ্ট্যের সমাহার এই আর্ডি! বানর, মানুষ, বনমানুষ আর তাদের সাধারণ পূর্বপুরুষদের এক অভুতপূর্ব মিশ্রণ। কে ভাবতে পেরেছিল, আমাদের ‘মানুষ হয়ে’ দু’পায়ের উপর ভর করে উঠে দাঁড়ানোর জন্য এরকম সব অদ্ভুত স্তর পার হয়ে আসতে হয়েছিল! তাই লাভজয় এবং তার সহকর্মীদের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, এরকম ধরণের শংকরায়িত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে দিয়ে পার হয়ে না আসলে আমাদের হয়তো কোনদিনও দু’পায়ের উপর ভর করে দাঁড়ানোই হয়ে উঠতো না।

আজ এ পর্যন্তই থাক, এত কাটছাট করে লেখার পড়েও লেখাটা আবারও অনিচ্ছাকৃতভাবেই বড় হয়ে যাচ্ছে… কাহাতক আর এই হাড্ডিগুড্ডির আলোচনা চালানো যায়… এর পরের পর্বে সাভানা প্রকল্প এবং আরও দুএকটা নতুন প্রকল্প (যেগুলো নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে বেশ ভালোই বিতর্ক শুরু হয়েছে) নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে রইলো। সেই সাথে টিম হোয়াইট, ওয়েন লাভজয় এবং সাইন্স জারনালে প্রকাশিত বিভিন্ন বিজ্ঞানীর লেখাগুলোকে কিভাবে বিকৃত করা হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করে লেখাটা শেষ করবো, যদি এই লেখার ইচ্ছাটা ততদিন বেঁচে থাকে……

নোটঃ এই লেখাটার বিভিন্ন জায়গায় বানর, বনমানুষ বা মানুষের সাথে আর্ডির বৈশিষ্ট্যের মিলগুলো দেখাতে গিয়ে ‘হযবরল’, ‘খিচুড়ি’ বা ‘জগাখিচুড়ি’ ধরণের কিছু শব্দ ব্যবহার করেছি। লেখাটাকে খুব বড় বড় বৈজ্ঞানিক শব্দের হাতে হাইজ্যাক হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য ইচ্ছেকরেই এরকম শব্দগুলোর অবতারণা করেছি। পিছন ফিরে তাকালে এরকম মনে হলেও, আসলে তো, কালের গর্ভে যে কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে, একটা প্রজাতি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুণেই একক বা স্বাধীন প্রজাতি হিসেবে বিরাজ করে, এখানে মিশাল বা খিচুড়ির কোন ব্যাপার নেই। যে কোন প্রজাতির উপরেই অবিরাম বিবর্তনের প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে। যেমন ধরুন, আমাদের এই আধুনিক মানুষের প্রজাতি homo sapiens ও অনবরত বিবর্তিত হচ্ছে। এক বা একাধিক প্রজন্মের সময়ের বেষ্টনীতে তা দেখা না গেলেও ফসিলগুলো দেখলে বা ডিএনএ রেকর্ড থেকে তা খুব সহজেই বোঝা যায়। যেমন ধরুন, আজ থেকে কয়েক লক্ষ বছর পরে মানুষের এখনকার প্রজাতির ফসিল বা ছবি দেখে মনে হতে পারে, আমরা আমাদের আগের, পরের কিংবা আশেপাশের নিকটাত্মীয় প্রজাতিগুলোর এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ বৈ আর কিছুই ছিলাম না।

তথ্যসূত্রঃ

[1] http://www.latimes.com/news/nationworld/nation/la-sci-fossils2-2009oct02,0,3420742.story

[2] Light on the Origin of Man, Introduction, VOL 326 SCIENCE www.sciencemag.org, Published by AAAS

[3] The Pelvis and Femur of Ardipithecus ramidus: The Emergence of Upright Walking, DOI: 10.1126/science.1175831, Science 326, 71 (2009), C. Owen Lovejoy, et al.

[4] Careful Climbing in the Miocene: The Forelimbs of Ardipithecus ramidus and Humans Are Primitive, DOI: 10.1126/science.1175827, Science 326, 70 (2009); C. Owen Lovejoy, et al.

[5] Combining Prehension and Propulsion: The Foot of Ardipithecus ramidus, DOI: 10.1126/science.1175832, Science 326, 72 (2009); C. Owen Lovejoy, et al.

চলবে…