বিখ্যাত ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়াইনবি বলেছিলেন, শহরকে কেউ হত্যা করে না। শহর নিজেই আত্মহননের মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে যায়। আমরা মনে রাখি না সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদারো নগরী ছেড়ে মানুষ কেন চলে গিয়েছিল। রোমান নগরী ধ্বংসের একমাত্র কারণ শুধু ভূমিকম্প নয়, লাগামহীন ভোগ ও স্বেচ্ছাচারও বটে। গত ৪০ বছরের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা, স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রক্রিয়ার কারণে সে রকম পরিস্থিতির মধ্যে চলে গেছে ঢাকা। সম্প্রতি এবং ২০০৮-এর আগস্টে পর্যায়ক্রমে ১৫-১৬ বার ভূমিকম্প যে খবরটিকে স্পষ্টভাবে জানান দিচ্ছে, আর তাহলো নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধাবমান ঢাকা নগরী। এক রাতের বৃষ্টিতে পানি জমার পরিমাণ আর নিয়মিত যানজট বলে দিচ্ছে ঢাকার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কত দুর্বল হয়ে পড়েছে! ঢাকা শহরকে মূলত ভূমিকম্প, ভূমিধস এবং ওয়াসার পানির কারণে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে মহামারীর আশঙ্কা ঘিরে ফেলেছে।
ভূকম্পন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘ইন্দো-বার্মা-হিমালয়ান টেকটোনিক পেল্গটের সঞ্চালনের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প বলয়ে আছে।’ আর পেল্গটের ফাটলের কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট এ তিন অঞ্চলে আরও বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। এদিকে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ঢাকার অভ্যন্তর ও চারপাশ দিয়ে যে খালবিল, নদীনালা রক্তনালির মতো প্রবাহিত হতো তা সমূলে গত ৪০ বছরে একের পর এক দখল, স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে ভরাট করে চিহ্নমাত্র মুছে ফেলেছে। এদিকে নানাভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন অব্যাহত আছে এবং তা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে ঢাকা শহরের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ৬১.১৮ মিটার বা ১৮৬ ফুট নেমে গেছে। বিএডিসি বা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থা থেকে জানা গেছে, গত ১১ বছরেই নেমেছে ৩৫ মিটার এবং প্রতি বছরই তা বাড়ছে। গড়ে প্রায় ৩ মিটার বা ৯ ফুট করে নেমে যাচ্ছে। কারণ ঢাকার সব মাটি কংক্রিটে ঢেকে যাওয়ায় এ আর পানি শোষণ করতে পারে না। এমনকি ১৯৯৮ সালে দেশে যখন বন্যায় ৮৫ শতাংশ অঞ্চল ডুবে গিয়েছিল তখনও ঢাকার পানির স্তর নামা অব্যাহত থেকেছে বলে সংশিল্গষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অনেক নিম্নাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে পলিথিন, পল্গাস্টিক জাতীয় পদার্থে। নদীতেও তা ফেলার কারণে নদীর তল পল্গাস্টিকের আবরণে ঢেকে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. এসএম মাকসুদ কামাল তার এক গবেষণায় জানিয়েছেন, ‘নগরীর পশ্চিম পাশে যেসব আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে, সেখানে মাটির পুরুত্ব ২৫ ফুটের বেশি নয়। আবার নগরীর পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নেমে যাওয়ার ফলে ভূমিধসের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ ফলে স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্প বা ভূমিধসেও ঢাকা শহর দেবে যেতে পারে।
ঢাকা মহানগর ও আশপাশ এলাকার ভূমির গঠন অস্থিতিশীল এবং ভূ-আলোড়নজনিত। মহানগরের পাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি অস্থিতিশীল ভূ-তাত্তি্বক অঞ্চল। উত্তরে সিলেট অববাহিকা বেশ দ্রুত ভূ-অভ্যন্তরে ঢুকে যাচ্ছে। কয়েক দশকে ওই অঞ্চলটি ১১ মিলিমিটারের মতো দেবে গেছে। পশ্চিমে যমুনা উপত্যকা অঞ্চলটি ক্রমেই ধাক্কা দিচ্ছে। দক্ষিণে বৃহত্তর ঢাকা সাল্ফপ্রতিক বছরগুলোয় ১.৮২ মিলিলিটার হারে দেবে যাচ্ছে। এসব অস্থিতিশীল ভূ-তাত্তি্বক অঞ্চলের প্রভাব মহানগরের ওপর গিয়ে পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আরও ভয়াবহ তথ্য, নগরীর বেশিরভাগ স্থাপনা নরম মাটির ওপর। মূলত এসব নিম্নাঞ্চল, জলাশয়, প্যালিও চ্যানেল যে মাটি দিয়ে ভরাট করে নগরায়ণ করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে সেই মাটির গুণাগুণ অত্যন্ত খারাপ। ভূমিকম্প হলে লালমাটির তুলনায় পলিমাটি ও জলাশয় এবং নিম্নাঞ্চলের মাটিতে অবস্থিত যেকোনো অবকাঠামো ধসে পড়বে তাড়াতাড়ি। এ শহরের অবকাঠামো যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে ভূমিকম্প হলে উদ্ধার কাজ অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে ওয়াসা ও স্যুয়ারেজের লাইন জড়াজড়ি করে গিয়েছে। স্যুয়ারেজ বা পয়ঃপ্রণালী ও ওয়াসার পানির লাইনে বিভিন্ন জায়গায় লিকেজ বা ছিদ্র থাকার কারণে মানুষের মলমূত্রের সঙ্গে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি প্রতিটি বাসাবাড়িতে মাঝে মধ্যে ঢুকে পড়ছে। বর্তমানে আমরা যে মাছগুলো খাই সেগুলোর বেশিরভাগের পেটে থাকে নীলাভ সবুজ শৈবাল। আর এই শৈবালে থাকে কনিফার্ম নামের ব্যাকটেরিয়া। মাঝে মাঝে যে তাপদাহ শুরু হয় তাতে এই ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় এবং প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে কখনও কখনও কলেরা, রক্ত আমাশয়, পেটের পীড়াবাহিত রোগ_ যেমন ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস ‘এ’, টাইফয়েড জীবাণু এবং ভাইরাসের কারণে জন্ডিস মারাত্মভাবে মানবজীবনের ওপর আঘাত হানে। পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, এ বছর কলেরা, ডায়রিয়ার হার সর্বোচ্চ বেশি। আমরা কি সব ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে জানি? এছাড়াও ঢাকা শহরে এখন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বসবাস করে। আর ৬৫ লাখ লোক এখানে কাজকর্ম সেরে আবার ফিরে যায়। পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে মাত্র ২০ লাখ মানুষের। তাহলে বাকি অংশ কোথায় যায়? এ সব তথ্য ইঙ্গিত দেয় যেকোনো সময় অশনাক্তকরণ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়তে পারে, ঘটিয়ে দিতে পারে মহামারীর আকারে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতারের মতে, ডাওকি ফল্টে ভূ-কম্পনের পর অতিবাহিত হয়েছে ১১২ বছর, মধুপুর ফল্টে ১২৪ এবং টেকনাফ সাবডাক ফল্টে ২৪৭ বছর। একই জায়গা আবার একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে সময় লাগে গড় হিসেবে ১০০ থেকে ৫০০ বছর। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে। বিখ্যাত হাইড্রোলজিস্ট ড. কাজী মতিনের মতে, অত্যন্ত দেরিতে হলেও অপ্রতুল ভূমিকম্পন ডাটা ও মাটির গুণাগুণ বিবেচনা করে সরকার ১৯৯৭ সালে প্রস্তাবিত বিল্ডিং কোড বিধিমালা আইন পাস করে ২০০৬ সালে। কিন্তু ভূমিকম্পন ডাটা ও প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তিতে এই বিধিমালা প্রয়োগ করা হয়নি। ভারত পেল্গট এবং দেশের পশ্চিম-দক্ষিণ সীমান্ত ঘেঁষে গেছে বার্মা পেল্গটের মাঝে অবস্থিত বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী শহর ঢাকা অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে আছে। ফলে রিখটার স্কেলে ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকা শহরকে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করার জন্য যথেষ্ট|
+++ ++++ ++++
এসব লেখা পড়লে বাংলাদেশ সম্পর্কে মনটা ক্রমেই বিষিয়ে উঠে।খুবেই আশাহত হই।দিনে দিনে এই ভুমি দুস্যু রাজনৈতিক দস্যু ধর্মের ফতোয়াবাজ মৌলবী ব্যাবসায়ী যে যে ভাবে পারছে বাংলাদেশটাকে লুটে পুটে খাচ্ছে।
তবে কি একদিন বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে না যেয়ে বাংলাদেশ একটি ভাঙ্গা দেশে পরিনত হবে?
অমি সত্যিই বিশ্বাস করি যে সেই ভয়ঙ্কর সময় বুঝি সমাসীন! কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে কি পরিত্রানের কোন উপায় অবশিষ্ট আছে? এখনো কি ব্যবস্থা নিলে কোন উপকার হবে? রোধ কি করা যাবে শতকরা ৬৫ ভাগ আশংকা জনক স্থাপনাকে ধ্বংসের হাত থেকে? যদি থাকে আসুন সে ব্যপারে সংশ্লিষ্ট মহলকে মুক্তমনার মাধ্যমে অবহিত করি, আমি খুবই জরুরী মনেকরি বিষয়টি।
আর যদি তা সম্ভব কোন কারণে না হয় তাহলে প্রাণ এবং সম্পদ হানি কমিয়ে আনা যায় কি করে সে বিষয়ে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহনের পরামর্শ সরকারের সামনে তুলে ধরা যেতে পারে। এব্যপারে সচেতন অভিঞ্জ পাঠক কুলের এবং লেখক বৃন্দের কাছে আরো বেশী বেশী তথ্য এবং পরামর্শ প্রত্যাশা করি। আমি ভাবতে পারিনা যে এরকম একটি পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের অসহায় মানুষ গুলো কোন রকম সহযোগীতা, উদ্ধার তৎপরতা, কিংবা চিকিৎসা ব্যাতিরেকেই তিলে তিলে যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য হবে।
অত্যন্ত বেদনাদায়ক সত্য।করেছেন কি ?শিগগিরই দেশদ্রোহী আখ্যা পাবেন দেখছি! 😉
ক্ষমতায় গেলে চাদা আর কমিশনের টাকা ভাগাভাগি ছাড়া আর কিছুতে মনযোগ দেবার মত সময় কই ? এরশাদ সৈ্রাচারী থাকাতে খানা-দানার ব্যাপারে তার যেটুকু লাজ-সরম ছিলো গনতন্ত্রীদেরতো সে বালাই নাই। তারা জনগনের অনুমতি নিয়েই খাচ্ছেন। এত এত বাদসাহী খানার আয়োজনের ভীড়ে দেশ, জনগন এসব নিয়ে ভাবার সুজোগ কই ?
এ বিষয় নিয়ে বহু লেখা মনে হয় গত ১৫ বছর ধরে দেখে যাচ্ছি, কিন্তু কাজের কাজ কি হচ্ছে? অবস্থা তো খারাপ ছাড়া ভাল কিছুই হচ্ছে না।
জনসংখ্যার ঘনত্ব অত মারাত্মক রকমের হলে তেমন কিছু আসলে করা যায় বলে মনে হয় না। তার সাথে বোনাস হিসেবে নদী খাদক, ভূমি দস্যু এনারা তো প্রকাশ্য দিনের আলোয় নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আইন কানুন সব হল কাগজে।
ঢাকামূখী জনসংখ্যাকে নিরুতসাহিত করা উচিত ছিল অনেক বছর আগেই।
নদী মরে গেলে নাকি সভ্যতাও মরে যায় ! বুড়িগঙ্গা মৃতের চাইতেও ভয়ঙ্কর পঁচনে মৃত্যুর বিষ ছড়াচ্ছে। এটাই ঢাকার আগাম লক্ষণ ! যেভাবে এককালে হরপ্পা নামের সভ্যতাই হারিয়ে গেছে।
পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
বাঁচবে কি ঢাকা? হ্যা এটা আমারো প্রশ্ন।
Good article. All the South Asian cities are facing the same sets of problems-Dhaka being no exception.
Basically population explosion is the main cause. This subcontinent has 3-5 times more population that it can sustain without harming environment.
Many people think ( even for a long I was one among them) green revolution was great-why? because it saved India and Bangladesh from tragic feminine which could have killed 1/2 of the population.
But I was wrong. Green revolution was unsustainable and achived at a very high environmental cost. No matter how rude I may sound, green revolution stopped the nature’s own way of controlling population and thus now we have to live with this danger of total devastation that will kill and eliminate more people than that would have occured without green revolution. It was a revolution for destroying mother earth.
ঢাকার অবস্থা সত্যই করুণ। প্রতিবার দেশে দিয়ে কালো ধোঁয়ায় ঢাকায় দম নিতেই কষ্ট হয়, আর সেই সাথে গিজ গিজ করা মানুষ, অপরিচ্ছন্নতা আর পরিকল্পনাহীন ভাবে গড়ে ওঠা আকাশ ছোয়া দালানের সাড়ি। দেখে সত্যই শঙ্কা বাড়ে। বড় সড় ভূমিকম্প হলে পুরো শহরই ধ্বসে পড়বে।
আসিফকে ধন্যবাদ সময়োপযোগী বিষয়টা নিয়ে লিখবার জন্য।