আজ ২৩ শে জুন তকালীন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল , বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী (মুসলিম) লীগের জন্মদিন । প্রশ্ন আসতে পারে তাতে হয়েছেটা কি ? যারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার কোন পটভুমি নেই কিংবা ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরে অসহযোগ পর্যন্ত ইতিহাস অস্বীকার করাতেই যাদের লাভ বা মোহ তাদের জন্য জানা জরুরি নাও হতে পারে ।

 

দেশের কিছু দৈনিকে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর খবর আছে বৈকি । কিন্তু অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক ও পরিতাপের বিষয় হলো , কোথাও উল্লেখ করা হয়নি এর উদ্যোক্তা সিংহপুরুষ ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সর্বজনাব শামসুল হকের নাম । এমনকি তার প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটেও  নেই তাঁর নাম । ঐ সময়  যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের অনেকেই আজ আমাদের মাঝে নেই । হাতে গোনা যারা রয়েছেন তারাও এক সময় চলে যাবেন কালের নিয়মে । সে সাথে হারিয়ে যাবে একটি নাম -একটি ইতিহাস ।

 

জয় হবে ক্ষমতা ও কৃতিত্বদখলকারীদের যারা মুছে দিয়েছে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ( বলতে গেলে একক প্রতিষ্ঠাতা ) শামসুল হকের নাম ।

 

তবে সুর্যোদয় হবেই যদিও আকাঁশে জমেছে অনেক মেঘ । এমন একদিন অবশ্যই আসবে যখন কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেন আবেগ-কল্পনা-পুর্বনির্ধারিত ধারণা-দলীয় বা গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গি ও আচ্ছন্নতা- নেতা বা দলের প্রতি অন্ধভক্তিবাদ-আত্মমহিমার মোহ ইত্যাদির উর্দ্ধে উঠে নিরংকুশ সত্যের আলোকে প্রামান্য ইতিহাস লিখতে । প্রতীক্ষিত ঐতিহাসিক -গবেষকের জন্য এই অধমের বিনীত প্রয়াস হিসেবে জেনে নেয়া যাক আওয়ামী (মুসলিম ) লীগের জন্মগাথা ।

 

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে উর্দুভাষী খাজা নাজিম উদ্দিনকে পুর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী (তখন বলা হত প্রধানমন্ত্রী ) নিযুক্ত করা হলে তিনি সোহরাওয়ার্দি সমর্থক সকলকেই বাদ দিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করেন । পুর্ব পাকিস্তানকে ভাল ভাবে কব্জা করার জন্য প্রাদেশিক চীফ সেক্রেটারী নিযুক্ত করা হয় অবাঙ্গালী আজিজ আহমেদ কে । মেজর জেনারেল (পরে ফিল্ড মার্শাল ) আইয়ুব খান আসেন জিওসি হয়ে । পুর্ব পাকিস্তানের সমস্ত উচ্চপদেই বসিয়ে দেয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানী অথবা ভারত থেকে আগত অবাঙ্গালী আমলাদের । কেন্দ্রে তো বাঙ্গালীদের কোন অস্তিত্বই ছিল না । রাজধানীসহ রাষ্ট্র্রের যাবতীয় সদর দফতর স্থাপন করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে । ফলে ভারত থেকে যে সব পুজিপতি পাকিস্তানে চলে এসেছিল তারা স্বভাবই তাদের পুজির স্বার্থে পশ্চিম পাকিস্তানেই স্থিতিলাভ করে । সব মিলিয়ে পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই এটা সুস্পস্ট হয়ে যায় যে , পুর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের সমান মর্যাদা দেয়ার কোন অভিরুচিই পাকিস্তানী শাসিকচক্রের নেই । পুর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভয়াবহ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রথমেই এগিয়ে আসে ছাত্র সমাজ । ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গের সমন্নয়ে গঠিত হয় পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ : আহবায়ক নঈমুদ্দিন আহমেদ ; সদস্য : আবদুর রহমান চোধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান , অলি আহাদ প্রমুখ ।

 

২৫-০২-৪৮ তারিখে ধীরেন দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্র্রভাষা বাংলার দাবী উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী প্রমুখের হাতে নাজেহাল হন । ২৪-৩-৪৮ তারিখে ঢাবি’র সমাবর্তনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একক রাষ্ট্র্র ভাষা করার দৃঢ অঙ্গীকার ঘোষনার করেন এবং বিরুদ্ধবাদীদের কঠোর ভাষায় শাসিয়ে দেন ।

 

ইতিমধ্যে দক্ষিন টাঙ্গাইল নির্বাচনী কেন্দ্রে উপ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাবেক সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সরকারী প্রার্ত্থী খুররম খান পন্নী ও অপর দু’জনকে পরাজিত করে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন । কিন্তু এ কে ফজলুল হক , সোহরাওয়ার্দি বা মওলানা ভাসানীর মত কাউকে ক্ষমতার চৌহদ্দীর মধ্যে ঢুকতে দেয়া হবে না -এই চক্রান্তের বশবর্তী হয়ে নির্বাচনী ক্রটির ধুয়া তুলে নির্বাচনের ফল বাতিল করা হয় এবং ভাসানীকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষনা করা হয় । ওই আসনে ২৬-৪-১৯৪৯ তারিখে পুনঃনির্বাচন দেয়া হয় । এবারে খুররম খান পন্নীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাড়ান তরুন ছাত্রনেতা শামসুল হক । শামসুল হকও বিপুল ভোটাধিক্যে বিজয় লাভ করেন । ভীতসন্ত্রস্ত ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী আর কোন উপনির্বাচন দিতেই সাহস পায় না ।

 

এমতাবস্থায় পুর্ব পাকিস্তানের সকল সচেতন মানুষ এই অঞ্চলের জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য বিকল্প সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং শামসুল হকের উদ্যোগে ২৩ শে জুন ১৯৪৯ তারিখে প্রায় ৩০০ ডেলিগেট ঢাকার রোজ গার্ডেন অডিটোরিয়ামে জমায়েত হন । এ সম্মেলনেই গঠিত হয় পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগ ( ১৯৫৩ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নাম রাখা হয় পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ) । এর কর্মকর্তারা ছিলেন : সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষানী , সহ সভাপতি : আতাউর রহমান খান , আবদুস সালাম খান , আলী আমজাদ খান , আলী আহমদ খান ও শাখাওয়াত হোসেন , সাধারণ সম্পাদক :শামসুল হক , যুগ্ম সম্পাদক : শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মুশতাক আহমদ , সহ সম্পাদক : এ কে এম রফিকুল হোসেন এবং কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খান । উল্লেখ্য শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে থাকায় তার পক্ষে এই উদ্যোগে সামিল হওয়া সম্ভবপর ছিল না । সদ্য কারামুক্ত এক ছাত্র নেতার প্রস্তাবক্রমেই তাকে কমিটিতে রাখা হয় ।

 

পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোন  পরতা বরদাস্ত করতেই শাসকচক্র প্রস্তত ছিল না বিধায়, শামসুল হক ক্ষমতাসীন শাসকচক্রের বিরুদ্ধে সংগঠন করার উদ্যোগ নেয়ায় তাকেও শায়েস্তা করার লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে এক নির্বাচনী ট্রাইবুন্যাল গঠন করা হয় এবং তার নির্বাচনও বাতিল করা হয় । আর আগেই ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে জনসভা শেষে এক মিছিল বের করলে মওলানা ভাসানী ও সামসুল হককে গ্রেফতার করা হয় । ১-১-১৯৫০ তারিখে শেখ মুজিবও পুনরায় গ্রেফতার হন ।

 

 

দুর্ভাগ্যের বিষয় , পুনপৌনিক নির্যাতন ও নিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামীলীগের উদ্যোক্তা সিংহপুরুষ শামসুল হক ১৯৫২ সালে কারাগারে আটক অবস্থায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন । ফলে ১৯৫২ সালেই শেখ মুজিবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয় ।  ১৯৫৩ সালে অত্যন্ত অসুস্থ শরীর ও মানসিক ব্যাধি নিয়ে তিনি কারামুক্তি লাভ করেন। শামসুল হকের চিকিসায় আওয়ামী মুসলিম লীগ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং  তাঁকে  বহিষ্কার করে ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই ঢাকার মুকুল (পরবর্তীতে আজাদ) সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে পুর্নাঙ্গ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয় !

 

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়েও শামসুল হককে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত । অতঃপর  তিনি  কখন , কোথায় , কিভাবে মারা গেছেন -তা কেউই বলতে পারেন না , সম্ভবত তার প্রতিষ্ঠিত দলেরও লোকেরাও না । টাঙ্গাইলের ওয়ার্টারলু বিজয়ী শামসুল হকের মৃত্যু কোথায়, কি অবস্থায় হলো তার কোনো বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। শোকসভাও করেনি কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্যরা। অথচ এই শামসুল হক একদিন ছিলেন বাংলার তরুণ মুসলিম ছাত্রসমাজের প্রিয় নেতা, পাকিস্তানের শাসক-শোষক চক্রের বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠন ‘পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক ইয়ুথলীগ ‘ প্রতিষ্ঠাতা, প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের উদ্যোক্তা সিংহপুরুষ ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক , ভাষা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ও সংগ্রামী ।

 

 

সুত্রঃ

 

১। স্বাধীনতা যুদ্ধের অপর নায়কেরা // নুরুজ্জামান মানিক ,শুদ্ধস্বর ,একুশে বইমেলা ২০০৯।

২। আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’,

৩। আবুল কালাম শামসুদ্দিনের ‘আত্মস্মৃতি : সংগ্রাম ও জয়’ ।