সর্বগ্রাসী প্রবণতা ও বিপন্ন পরিবেশ

কাজী এস. এম. খসরুল আলম কুদ্দুসী

 

কিছু দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিল এক শিক্ষক কর্তৃক হরিণ ভক্ষণের সংবাদ নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ ত্বরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত একজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে এবং তদন্তের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্থ শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হিসেবে তাকে বিভাগীয় সভাপতির পদ থেকে অপসারণ করেছে।


তবে, এই ব্যাপারটি মুখরোচক হলেও এর মাধ্যমে আমাদের সামনে যা কিছূ পাওয়া যায় তা খেয়ে ফেলার একটি মারাতœক মানসিক প্রবণতার বহি:প্রকাশ ঘটেছে বলে আমার মনে হয় যাকে মানসিক বৈকল্যের পর্যায়ে ফেললে বোধহয় বাড়াবাড়ি হবেনা কেননা একটু অনুধাবন করলেই আমরা আমাদের দেশে এ ধরনের আগ্রাসী এবং সর্বগ্রাসী প্রবণতার উত্তরোত্তর প্রসার লক্ষ্য করবো। আমার বিশ্বাস মনস্তাত্ত্বিকরাও এই ব্যাখ্যা সমর্থন করবেন।
পাহাড় থেকে নেমে আসা আটকে যাওয়া হরিণ, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আসা অতিথি পাখি, সাগরে ঘুরে বেড়ানো ঝাটকা মাছ কিছুই রেহাই পাচ্ছেনা আমাদের রসনা বিলাস থেকে। কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত, কি ধনী, কি দরিদ্র সর্ব শ্রেণীর মানুষের মাঝেই যেন খাই খাই সংস্কৃতির দ্রুত বিকাশ ঘটছে। তবে দরিদ্ররা নেহাত পেটের কারণে এ ধরনের কাজ করলেও শিক্ষিত অথচ সচ্ছলরা এরকমটি করছে নিতান্তই অতি লোভের বশবর্তী হয়ে যা আমাদের পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং প্রকৃতিকে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।


শুধু হরিণ বা পাখি নয় সাপ, ব্যাঙও রক্ষা পাচ্ছেনা আমাদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে। তবে সাপ, ব্যাঙ ধরা হচ্ছে রপ্তানী করে কাড়ি কাড়ি টাকা কামানোর জন্য। অথচ সাপ, ব্যাঙ যে পরিবেশের কত বড় বন্ধু তা কারও অজানা থাকার কথা নয়। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, কিছু দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় তরুণ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হল ব্যতিক্রমধর্মী এক ব্যাঙ মেলা যাকে সারা দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরনের প্রথম মেলা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ মেলার প্রতিপাদ্য ছিল পরিবেশবান্ধব অথচ বিপন্ন ব্যাঙকে বাঁচতে দেয়ার আকুতি।


তবে ব্যাঙ যে শুধু পাচার হওয়ার কারণেই বিপন্ন হয়ে পড়ছে তা নয়, ফসলি জমিতে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণেও ব্যাঙ মারাতœক অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে অথচ ফসলি জমিতে ক্ষতিকারক পোকা বিনাশ এবং উপকারী পোকার বেঁেচ থাকা নিশ্চিতকরণে ব্যাঙের জুড়ি নেই। উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি অতি ফলনের লোভে আবাদী জমিতে মাত্রাতিরিক্ত এবং নিম্নমানের রাসায়নিক সারের বিষক্রিয়ার কারণে ঢাকার অদূরে কয়েকটি শিশুর প্রাণহাণির অভিযোগ পাওয়া গেছে।


এখন পত্রিকা খুললেই দেখা যায় সারা দেশব্যাপী নদী, পুকুর, নালা ইত্যাদি দখলের মাধ্যমে ব্যাবসায়ীক কাজে লাগাবার বিশাল বিশাল ছবি এবং বিবরণ। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোকে এ ধরনের সমাজ-সচেতনতামূলক কাজগুলোর জন্য সাধুবাদ দিতেই হয়। এই ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে এবং সম্প্রতি আমাদের উচ্চতর আদালত থেকে যততত্র নদী ভরাটের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকারকে নদী এবং পরিবেশ সংরক্ষণের কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে।


শুধু দেশব্যাপী নদী, জলাশয়, নালা ইত্যাদি দখল করা হচ্ছে তা নয় বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে চরমভাবে দূষিত করা হচ্ছে নদী এবং সাগরের পানিকে যার কারণে আমাদের মৎস্যরাজি ও জীববৈচিত্র ভয়ানক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য নিষ্কাষণের জন্য সরাসরি নদীর সাথে নালা করে দেয়া এবং চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকায় সাগরের সাথে নালা করে দেয়ারও গুরুতর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকায় অনেক বিদেশী কোম্পানী খুবই লাভজনক ব্যবসায় নিয়োজিত যে লাভের সিংহভাগ তারাই উপভোগ করছে।


তবে এ লাভ করাতে দোষের কিছু নেই এবং আমরাও বিচলিত হচ্ছিনা। কিন্তু, বিদেশী কোম্পানীগুলো তাদের নিজেদের দেশকে ন্যূনতম পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার হতে না দিয়ে আমাদের দেশের সুলভ শ্রম শোষণের সাথে সাথে আমাদের পরিবেশকে যে মারাতœক হুমকির মুখে নিপতিত করছে তা দেখলে হীণমন্যতায় ভোগা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। হায়, কত অসহায় আমরা! ওরা আমাদের দরিদ্র শ্রমিক ও বেকারদের বেকারত্ব সামান্য লাগবের বিনিময়ে আমাদের পরিবেশের সর্বনাশ করবে অথচ আমরা কিছুই বলতে পারবোনা পাছে তারা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে।


তবে তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আসল অপরাধী আমরা। এসব অবস্থ্া দেখলে মনে হয় যেন আমাদের একশ্রেণীর মানুষ পরিবেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। পাহাড় ঘেরা বন্দরনগরী চট্টগ্রামে শত শত পাহাড় কাটার মাধ্যমে অবশ্যাম্ভাক্ষী ভূমিধ্বসের মাধ্যমে শত শত মানুষের জীবন নাশের ব্যবস্থ্া করা এবং চট্টগ্রামকে চরম ভুমিকম্পন-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পরিণত করার কথা অনেকেরই জানা। কিছুদিন আগে ঘুরে এলাম পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, যেখানকার বিপন্ন পরিবেশ যে কতটা সংকটাপন্ন তা দ্বীপখানির আবর্জনাভরা অবয়ব দেখলেই সহজে অনুধাবন করা যায়। কিন্তু কারও কোন মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হয়না।
একথা অনস্বীকার্য যে, নদী, পুকুর, নালা ইত্যাদি দখল করা এবং এগুলোর স্বাভাবিক গতিপথ ব্যাহত করার ক্ষতিকর ফলাফল বহুমাত্রিক। আমাদের তিলোত্তমা ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ অন্যান্য দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোতে একটু বৃষ্টি হলেই যে সড়কপথ নদীপথ এবং নৌকা একমাত্র বাহন হয়ে যায় তার জন্যেও কিন্তু নদী ও নালা দখল করে ভরাট করে ফেলা অন্যতম কারণ। জলাবদ্ধতার কারণে পরিবেশের নানাবিধ ক্ষতির ব্যাপারতো আছেই। আমাদের দেশের বেশ কিছু সচেতন ব্যক্তি এবং পরিবেশবাদী সংগঠন অনেকদিন ধরেই পরিবেশ বিনাশী কর্মকান্ডগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে।


কিন্তু, তারা তেমন একটা সফল হচ্ছেনা সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তার অভাব এবং পরিবেশ বিপর্যয়ে দায়ী ক্ষমতাধর শক্তিগুলোর প্রভাবের কারণে। সম্প্রতি ’মিডিয়া এ্যকটিভিজম’ এর কারণে অবশ্য এ আন্দোলনে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে যাকে অবদমিত হতে দেয়া যাবেনা কিছুতেই। অন্যথায় আমাদের নদী, নালা, পরিবেশ আর জীবকূলই কেবল বিপর্যস্ত হবেনা আমাদের অস্তিত্বও হবে মারাতœকভাবে বিপন্ন হবে যা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই, দুই-এ-দুই-এ চার যোগ করতে জানলেই চলবে।


কাজী এস. এম. খসরুল আলম কুদ্দুসী, সহকারী অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ই-মেইল: [email protected]