আমাদের নরসিংদী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এস এস সি পরিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান ছিল একটি বাৎসরিক কর্মসসূচি। নবম শ্রেণীর ছাত্রীরা এর অয়োজন করতো। চাঁদা ছিল নামেমাত্র।
আর ঐ অনুষ্ঠানে প্রতি বছরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার ——
‘এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গ মর্ত্য ছেয়ে
সবচেয়ে পুরাতন কথা সবচেয়ে গভীর ক্রন্দন
যেতে নাহি দিব হায়
তবু যেতে দিতে হয় তবু চলে যায়’।
লাইন কয়টির উচ্চারণ আর কাজী নজরুল ইসলামের —— ‘আমার যাবার সময় হলো, দাও বিদায়’ গানটি গাওয়া ছিল অবধারিত।

আমার এক সহকর্মী চাকরি ছেড়ে ইউ এস এ তে পাড়ি দিয়েছেন; গত ৩১ মার্চ, ’০৯ ছিল তার শেষ অফিস। যথারীতি এর আগে চলেছে আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ, খাওয়া-দাওয়া এবং উপহার দেয়ার পালা। শেষ কর্মসূচিটি ছিল আনুষ্ঠানিক। স্মৃতিচারণ। আমাকে কিছু বলতে বলা হয়েছিল। ইচ্ছে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘যেতে নাহি দিব’ থেকে একটু বলে শুনাই, কিন্তু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পাল্টাই।

এর যে আবার ইংরেজী অনুবাদ করতে হবে! কারণ ভিনদেশী – ভিনভাষী সহকর্মীরাও যে আছেন। আমার সীমাবদ্ধ ইংরেজী জ্ঞানে তাৎক্ষণিকভাবে ঐ লাইন কয়টির অনুবাদ ভাবকে অক্ষত রেখে সম্ভব নয়। তা ছাড়া আবেগের প্রকাশ ভিনভাষায় করা দুরূহ ও নিজের বোধের সাথে মশকরাও মনে হচ্ছিল। কাজেই আবেগ সংযত করেছি — নিয়ন্ত্রণ করেছি।

পরে এ দেশীয় দু’জন সহকর্মীর সাথে বিদায়ী সহকর্মীর অনুপস্থিতিতে শূন্যতাবোধ নিয়ে আলাপ করছিলাম। কথা প্রসঙ্গে ছোটবেলার এস এস সি পরিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতা ও কাজী নজরুল ইসলামের —— ‘আমার যাবার সময় হলো, দাও বিদায়’ গান ইত্যাদি বিষয়ও যোগ হয়েছিল। দেখলাম ওই দু’জনের আর আমার একই অভিজ্ঞতা। অথচ একজনের বাড়ি সিরাজগঞ্জ এবং অন্যজনের বাড়ি ফরিদপুর।

তবে কি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ছাড়া বাঙালীর আবেগ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হয় না? অনুভূতি প্রকাশে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল নির্ভরতা! না কি নিজেদের সীমাবদ্ধতার জন্যে বিদায় সম্পৃক্ত আর তেমন কোন প্রাসঙ্গিকতা জানা নেই! অথবা বড্ডো ভালোবাসতাম কবিদ্বয়কে। যে কোন কর্মসূচিতে তাদের উল্লেখে নিজেদের ধন্য মানতাম। এখনো মানি। এ যে প্রথা —- ঐতিহ্য!

এখন স্কুল কলেজে বিদায় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে টি-শার্ট তৈরি করা হয়। টি-শার্টে কয়েকটি শব্দের ইংরেজী কোটেশন ও বিদায়ী বর্ষের সালের নাম লেখা হয়। নিজেরা চাঁদা তুলে টি-শার্ট রাঙিয়ে — লিখিয়ে নিজেদের মধ্যেই বিলি বন্টন।

এমনিতে ছোটবেলার স্মৃতিতে আমার দাদুকে দু’একদিন একটু আধটু বাজারে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন কাজ করতে দেখিনি। দাদুর সাথে আমার শৈশবের বেশ কিছু সমৃদ্ধ স্মৃতি রয়েছে। আমাদের গল্প শুনাতেন। রাম প্রসাদের গান গাইতেন। নদীর পাড়ে হাঁটতে যেতেন। পরে দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরেও যাননি। ঊঠানে, তমালতলা, বারান্দা — এই ছিল গতিবিধি। শুধু আমার দাদুকেই নয় — কোন বুড়াকেই রোজগার করতে দেখিনি ।

ব্যাতিক্রম ছিলেন শুধু বেপারী দাদু। আমরা পাড়ার এবং গ্রামের বুড়োদের দাদু বলেই সম্বোধন করতাম। ছেলেরা রোজগার শুরু করলে বাবা রোজগারসহ সব কাজ ছেড়ে দেবেন — এ রকম একটা রীতির চর্চা দেখেছি আমাদের গ্রামের ঘরে ঘরে। বুড়ো বয়সে বাবা রোজগারের কাজে নিয়োজিত মানে ছেলেদের অপমান। অর্থাৎ অকর্মণ্য ছেলেপেলে। তখন মেয়েদের রোজগেরে কোন ভূমিকা ছিল না বা মা বাবার প্রতি কোন দায়িত্ববোধও ছিল না। মেয়ে মানে পরের বাড়িতে গিয়ে দায়িত্ববোধ — তা ও শুধু ঘরে।

এখন বুড়ো বয়সেও চাকরির সম্প্রসারণ। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। বয়স বাড়ানোর জন্যে চলছে লবিং — এ্যাডভোকেসি। কর্মণ্য বাবাদের কর্মের আগ্রহে ছেলেমেয়েরা চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
তখন বুড়ো বয়সে হরি সভা, বৈষ্ণব সেবা, কৃষ্ণ কথা, রামায়ণ আর মহাভারতে বিভোর থাকা ছিল দৈনন্দিন অভ্যাস। একমাত্র ব্যতিক্রম বেপারী দাদুকে এ নিয়ে আরে ঠারে অনেক রকম কথাও শুনতে হতো। যেমন —-
হরে কৃষ্ণ হরে রাম
রাইত পোহাইলে পইসার কাম।

এতে বেপারীরকে কোন ক্ষোভ বা রাগ প্রকাশ করতে দেখিনি। উপায় কী!রাত পোহালেই খেতে হবে। খাওয়াতে হবে পরিবার পরিজনকে। তাই কাজ করো। ছেলে নেই। একমাত্র মেয়ে পাঁচজন নাতি নাতনি রেখে মারা যাবার পর জামাই আবার বিয়ে করেছে। ভাগিনা তার সাথে থেকে ব্যবসা দেখতেন। সংগ্রামের সময় আগরতলা যাবার পথে পাক আর্মিদের গুলিতে মরেছে। মরে গিয়ে আরেকটা পরিবারের ভার তার উপর দিয়ে গেছে। এখন নিজের মেয়ের ঘরের নাতি ও ভাগিনার ছেলে ব্যবসায় সাহায্য করে। কিন্তু সব তো ছেড়ে দেয়া যায় না।
তিনি পালটা বলতেন —
হাতে করো গৃহ কাজ
মুখে বলো হরি
অনায়াসে দেবে তুমি
ভব সিন্ধু পাড়ি।
এখন ধর্ম করলেও পয়সার কাজ হয়। পয়সা দেয় মধ্যপ্রাচ্য। খাবার নিশ্চয়তা রয়েছে ইসকন থেকে। আমার গ্রামের আশেপাশের অনেককেতো দেখি কৃষ্ণ কথা বলে —- বিলায় আর ইসকন এর মন্দিরে গিয়ে মাগনা খায়। আর যারা এ সব করে বাস্তবিক তাদের এর আগে আয়ের নিশ্চিত কোন উৎস ছিল না।

গীতা দাস
[email protected]
৮ আষাঢ় ১৪১৬/ ২২জুন, ২০০৯