নীল জলে জলদস্যুতা

 

ফরিদ আহমেদ

 

হঠাৎ করেই ভারত মহাসাগরের নীল জলে জমে উঠেছে রুদ্ধশ্বাস নাটক। সোমালি জলদস্যুদের সাথে আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে গভীর সমুদ্রে। কোথায় এবং কখন এর শেষ হবে কেউ তা জানে না।

 

এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল গত সোমবারে। কেনিয়ান বন্দর মোম্বাসার উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে মাঝ সমুদ্রে একদল  সোমালি জলদস্যু দখল নেওয়ার চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ আলাবামাকে। জাহজের ক্রুরা এতে বাধা দেয় এবং একজন জলদস্যুকে পরাস্ত করতেও সক্ষম হয়। কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন রিচার্ড ফিলিপস ক্রুদের নিরাপত্তার স্বার্থে নিজেকে সমর্পন করেন জলদস্যুদের কাছে। তাকে নিয়ে একটি ছোট্ট লাইফ বোটে করে মাঝসমুদ্রে নেমে যায় চার জলদস্যু। এর মধ্যেই জ্বালানী শেষ হয়ে গেছে লাইফবোটের। প্রাণহীন হয়ে তা এখন ভারত মহাসাগরের বুকে দুলছে ঢেউয়ের অনিশ্চিত দোলায়। ওই চার জলদস্যু ইউএস নেভীর যে কোন আঘাত মোকাবেলা করার দৃপ্ত শপথ নিয়ে নিয়েছে এর মধ্যেই। আর এই লাইফবোটকেই কেন্দ্র করে জমে উঠেছে শ্বাসরুদ্ধকর নাটক। লাইফবোটের কাছে অবস্থান নিয়েছে ইউএস নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস বেইনব্রিজ। ইউএসএস বেইনব্রিজের সাথে যুক্ত হয়েছে গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট ইউএসএস হ্যালিবাটনও। আগামি কাল এদের  সাথে যুক্ত হবে আরেকটি যুদ্ধ জাহাজ ইউএসএস বক্সার। ইউরোপিয়ান আরো কিছু দেশের যুদ্ধজাহাজও রয়েছে আশেপাশেই।

 

 

এর মধ্যে গতকাল রাতে ক্যাপ্টেন রিচার্ড বাটন লাইফবোট থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সাগরে। কিন্তু দূর্ভাগ্য তার। সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। পূনরায় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়েছেন তিনি। লাইফবোটের চার জলদস্যুর সাহায্যের জন্য তাদের বন্ধুরাও বসে নেই। সোমালিয়ার বন্দরগুলো থেকে দখল করা তিনটি জাহাজ এবং একটি মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে লাইফবোটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জলদস্যুরাও। ওই জাহাজগুলোর একটা হচ্ছে জার্মান কার্গো জাহাজ হানসা স্টাভাংগার। ২৪ জন জিম্মি রয়েছে সেখানে জলদস্যুদের হাতে। তারা যে আমেরিকানদের ভয়ে ভীত নয় তা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে। আক্রান্ত হলে নিজেদেরকে রক্ষা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে তারা।

 

জলদস্যুতে মোড়া জলপথ

 

সুয়েজ খাল পাড়ি দেবার পর দক্ষিন অভিমুখি সব জাহাজকেই ব্যর্থ রাষ্ট্র সোমালিয়া এবং আভ্যন্তরীন কোন্দলে আক্রান্ত ইয়েমেনের  উপকূল বেয়ে যেতে হয়। এই অঞ্চলটাই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল জলপথ। দুর্ধর্ষ সোমালি জলদস্যুরা শিপিং কোম্পানিগুলোর নাভিশ্বাস তুলে দিচ্ছে এখানে বেশ কয়েক বছর ধরেই।

 

১৯৯১ সালে সোমালিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরু হবার পরপরই কিছু সোমালি মাছ ধরার নৌকা চুরি করা শুরু করে। আজকে সেই ছিচকে জলদস্যুরাই অনেক বেশি সংগঠিত, আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত ভীতি জন্মানো ভয়ংকর জলদস্যুতে পরিণত। গভীর সাগরে মাদারশিপ এবং সেখান থেকে পরিচালিত স্পিডবোট, ভারী যন্ত্রপাতি, স্যাটেলাইট ইকুইপমেন্ট, এবং মুক্তিপণের জন্য বিদেশে মধ্যস্থতাকারী নিয়ে কায়কারবার এখন তাদের। রাতের বেলা বড় বড় জাহাজগুলোকে বেপরোয়াভাবে আক্রমণ করে তারা। হেভি মেশিনগান এবং রকেট প্রপেলড গ্রেনেড দিয়ে সূত্রপাত হয় সেই সব আক্রমণের।

 

 

ইন্টারন্যাশনাল ম্যারিটাইম ব্যুরো সব জাহাজকেই সোমালিয়ার উপকূল থেকে কমপক্ষে ২০০ নটিক্যাল মাইল দূর দিয়ে চলাচলের পরামর্শ দিয়েছে। তবে এই দূরত্বও যে নিরাপদ নয় তা সাম্প্রতিক আক্রমনসমূহ থেকেই পরিষ্কার। সৌদি সুপার ট্যাংকার সিরিয়াস স্টারকে সোমালিয়ার উপকূল থেকে ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূর থেকে কব্জা করেছিল জলদস্যুরা। এর মানে হচ্ছে, সুয়েজ ক্যানাল ব্যবহার করে এরাবিয়ান গালফের দিকে যাওয়া বা গালফ থেকে আসা যে কোন জাহাজই জলদস্যুদের আওতার মধ্যে। তা সে যত দূরের ঘুর পথই ধরুক না কেন।

 

জলদস্যুদের এড়ানোটা প্রচণ্ড রকমের ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে শিপিং কোম্পানীগুলোর জন্য। মোম্বাসা বন্দরের হারবার মাস্টার তালিব খামিস বলেন যে, জলদস্যুদের এড়ানোর জন্য গালফ অব এডেন থেকে মোম্বাসা যাওয়ার জন্য সব জাহাজকেই অতিরিক্ত দুই দিন সময় নিতে হচ্ছে ঘুরপথে আসার জন্য। এছাড়া এই এলাকায় চলাচলকারী জাহাজের ইনশিওরেন্সের প্রিমিয়ামও হয়ে উঠেছে অনেক উচ্চ। বেশির ভাগ ক্রুজ জাহজগুলোই পূর্ব আফ্রিকার উপকূল থেকে সরে গেছে এর মধ্যেই।

 

তবে এই জলদস্যু সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সোমালিয়া নিজেই। সোমালিয়ার আট মিলিয়ন লোকের মধ্যে আড়াই মিলিওন লোকই সাগর দিয়ে আসা খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। মোম্বাসা থেকে মোগাদিসু পর্যন্ত জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের খাদ্যবাহী জাহাজগুলোকে ফরাসী, ডেনিশ এবং ডাচ যুদ্ধজাহাজগুলো এসকোর্ট দিচ্ছে অনেকদিন ধরেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সাপ্লাই লাইন সবসময়ই বিপদজনক এবং ভঙ্গুর রয়ে গেছে। গত বছরের মে মাসে চিনি বয়ে নিয়ে যাওয়া জর্ডানিয়ান জাহাজ ভিক্টোরিয়াকে মোগাদিসুর ৩৫ মাইল দূর থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। একসপ্তাহ পরে ছাড়া পায় সেই জাহাজ। জাতিসংঘের পক্ষে এখন সশস্ত্র পাহারা ছাড়া কোন শিপিং লাইনকে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে তাদের জাহাজ ভাড়া দেওয়ার জন্য রাজি করানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

 

সাগর থেকে সরাও তাদের

 

গত বছরের জুন মাসে মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর জলদস্যুদের সোমালিয়ান নৌ সীমানায় ধাওয়া করা এবং জলদস্যুদের জাহাজগুলোকে ডুবিয়ে দেয়ার আইন পাশ করা হয়। তবে জলদস্যুরা শুধু সোমালিয়া থেকেই তাদের কার্যক্রম চালায় না। ইয়েমেনেও তাদের ঘাটি রয়েছে। এই দুই দেশের জলদস্যুদের আবার সখ্যতা রয়েছে আফ্রিকার হাতি ও গণ্ডারের দাঁত এবং হীরার চোরাকারাবারিদের সাথে।

 

তবে এখন পর্যন্ত বিদেশী নৌবাহিনীর সাফল্য হাতে গোনা। গত বছর জলদস্যুরা দখল করে নিয়েছিল ফ্রেঞ্চ ইয়ট লা পোনান্ট, তিরিশ জন ক্রুসহ। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি জিবুতি ভিত্তিক ফরাসী কমান্ডোদেরকে একশনে যাওয়ার নির্দেশ দেন। দু মিলিওন মুক্তিপণ দেওয়া হয়। জলদস্যুরা ইয়টকে মুক্ত করে দিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর একটা গ্রুপ সোমালিয়ান ডেজার্ট দিয়ে পালাচ্ছিল জিপে করে। ফরাসী সামরিক হেলিকপ্টার সেটাকে আক্রমণ করে এবং জলদস্যুদেরকে আটকে ফ্রান্সে পাঠায় বিচারের জন্য। নভেম্বরে গালফ অব এডেনে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয় জলদস্যুদের একটি মাদারশিপকে।

 

তবে আফ্রিকার উপকূলের দেশগুলির সরকার এখনো এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি। এখানকার কোন দেশেরই নৌবাহিনী সমৃদ্ধ নয়। তাঞ্জানিয়ার নৌ প্রধানের ভাষ্য অনুযায়ী তার দেশের যুদ্ধ জাহাজ বড় জোর সমুদ্রে বিশ মাইল গভীরে যেতে পারে। বুঝুন ঠেলা!  

 

নতুন কৌশল

 

গালফ অব এডেনে জাহাজগুলোকে নিরাপত্তা দেবার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে জলদস্যুরাও নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। যুদ্ধ জাহাজগুলোকে এড়ানোর জন্য তারা তাদের অপারেশনের ক্ষেত্রকে সরিয়ে নিয়ে গেছে আরো দক্ষিণে। হয়ে উঠেছে আগের চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক এবং মরিয়া। আগে যেখানে নাবিকরা জানতো যে আটকা পড়লেও জানে বেঁচে যাবে তারা মুক্তিপণ আসলেই। কাজেই জলদস্যুদের আতিথেয়তায় তাদের ঘাটিতে ব্যাপক খান পিনা করে বেশ ভালই সময় কাটতো তাদের। এখন আর সেই নিশ্চয়তা নেই। যেহেতু জলদস্যুরা এখন প্রতিনিয়ত যুদ্ধ জাহাজের মুখোমুখি হচ্ছে, কখনো বন্দী হচ্ছে, কখনো বা নিহত হচ্ছে, সেহেতু তারাও এখন আগের চেয়ে জোর খাটাচ্ছে বেশি, বেশি ভায়োলেন্ট হচ্ছে। ফলে, তাদের জিম্মিদেরকে আরো বিপন্ন করে তুলছে তারা। জলদস্যুদের জন্য এখন বাঁচি কি মরি পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আগেকার সেই পিকিনিক পিকনিক পরিবেশ এখন আর নেই।

 

দস্যুদের দস্যিপনা

 

মাত্রই যখন শিপিং কোম্পানিগুলো ভাবতে শুরু করেছিল যে, পূর্ব আফ্রিকার উপকূল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হয় উঠেছে, ঠিক তখনই সক্রিয় হয়ে উঠেছে জলদস্যুরা। পশ্চিমা এবং আরো কিছু শক্তিশালী দেশের নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজের উপস্থিতি সত্ত্বেও গত সপ্তাহে সোমালি জলদস্যুরা মাত্র ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে দখল করে নিয়েছিল দুটো কেমিক্যাল ট্যাংকার। এই আক্রমণগুলোও হয়েছে সোমালিয়ান উপকূল থেকে ৩৮০ থেকে ৪৯০ মাইল দূরে। এ থেকে পরিষ্কার যে, জলদস্যুরা তাদের ঘঁটি থেকে বহুদূরেও তাদের কার্যক্রম চালাতে সক্ষম। গত কয়েকমাসে বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীসমূহের টহলদারিরি কারণে যে সাফল্য জমা হয়েছিল সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহে তা ম্লান হয়ে যাওয়ার পথে।

 

জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী গত বছর গালফ অব এডেন এর করিডোরে ১১১টি আক্রমণ হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২০০ গুণ বেশি। ইন্টারন্যাশনাল ম্যারিটাইম ব্যুরো জানাচ্ছে যে, বিশটারও বেশি দেশের নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজের উপস্থিতি সত্ত্বেও গালফ অব এডেনে গত তিনমাসে আক্রমণের সংখ্যা হচ্ছে ৫১। ইন্টারন্যাশনাল শিপিং এসোসিয়েশন বিমকো বলছে যে, এই আক্রমণ এখন আর শুধু গালফ অব এডেনেই সীমাবদ্ধ নেই। ভারত মহাসাগরের বিস্তির্ণ অঞ্চলে এখন জলদস্যুতা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

তবে এর মধ্যেও কেউ কেউ আশার বাণী দেখতে পাচ্ছেন। তাদের নতে যদিও আক্রমণের সংখ্যা বেড়েছে, তথাপি জলদস্যুদের সাফল্যের হার কমে গেছে বেশ ভালভাবেই। ডিসেম্বরে যেখানে প্রতি পাঁচটা আক্রমণের একটাতেই জলদস্যুরা সফল ছিল এখন সেই হার নেমে এসেছে প্রতি দশটায় একটা মাত্র।

 

এর জন্য কেউ কেউ যুদ্ধ জাহাজের উপস্থিতিকে দায়ী করেন। আবার কারো কারো মতে এটা মূলত হয়েছে খারাপ আবহাওয়ার কারণে। বছরের প্রথম তিনমাস এই অঞ্চলের আবহাওয়া প্রচণ্ড রকমের খারাপ থাকে। পরের তিন মাস আবহাওয়া ভাল হওয়ার সাথে সাথে আক্রমণের হারও বেড়ে যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

 

আক্রমণের পরিমান বেড়ে যাওয়া থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, জলদস্যুরা দিনে দিনে শক্তিশালী এবং সাহসী হচ্ছে। সৌদী তেল ট্যাংকার সিরিয়াস স্টার এবং জাহাজ এমভি ফায়নার থেকে বিপুল পরিমাণে মুক্তিপণ পাওয়ার পর থেকে তাদের সাহস এবং দৃঢ়তা বেড়ে গেছে অনেকগুণ বেশি। 

 

লাভের গুড় খাচ্ছে কারা

 

জলদস্যুতা এখন বিশাল বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। দুবাই এবং অন্যান্য দেশে থাকা সোমালিরা বিনিয়োগ করছে এই ব্যবসায় বিপুল পরিমাণে। সোমালি জলদস্যুদের বন্দর ঈলে বিশাল বিশাল ভিলা এবং হোটেল তৈরি হয়ে গেছে। এক সময়কার গরীব জেলেরা এখন মার্সিডিজ বেঞ্জ হাকাচ্ছে। শুধুমাত্র ২০০৮ সালেই সোমালিয়ান জলদস্যুরা আয় করেছে একশ পঁচিশ মিলিওন ডলার। বিশাল মুনাফার কারণে সোমালিয়ার অনেক যুদ্ধবাজ গোত্র নেতারাই সুসংগঠিত উপায়ে শুরু করেছে জলদস্যু ব্যবসাকে। দলে দলে দরিদ্র জেলে ছেলেরা জলদস্যু দলে নাম লেখানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে এখন।

 

মুক্তিপণের এই বিশাল টাকা পায় কে? জানবাজি রেখে যে জলদস্যুরা জিম্মিদেরকে আটকে রাখে তারা? না, সেটা যদি ভেবে থাকেন তবে ভুল ভাবছেন। এই ব্যবসার আসল লোকজনেরা রয়েছে পর্দার অন্তরালে। অন্যসব ব্যবসার মতই সম্মুখসারির জলদস্যুদের হাতে টাকার খুব সামান্য অংশই যায়। বেশিরভাগ অংশটাই চলে যায় নেপথ্যের হোমড়া চোমড়াদের কাছে।

 

ইউক্রেনিয়ান ফ্রেইটার এমভি ফায়নাকে যখন জলদস্যুরা দখল করে নেয়, তখন শিপিং কোম্পানী খুব দ্রুতই মুক্তিপণ হিসাবে তিন মিলিওন ডলার দিতে রাজী হয়ে যায়। কিন্তু, তারপরও কয়েক সপ্তাহ লেগে যায় জাহাজটির মুক্তি পেতে। এর অন্যতম কারণ ছিল যে, এই মুক্তিপণের টাকার ভাগ নেবার জন্য অসংখ্য লোক যুক্ত ছিল। এর মধ্যে যেমন ছিল জলদস্যুদের নেতারা, তেমনি ছিল যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সোমালিয়ান সরকারের লোকজন এবং তাদের শত্রু ইসলামী জঙ্গী সংগঠন শাবাব

 

বৃহৎ সমস্যার ক্ষুদ্র অংশ

 

জলদস্যুদের বর্তমান দুঃসাহসের অন্যতম কারণ হচ্ছে সোমালিয়ার পতন, একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রতে পরিণত হওয়া। সরকারবিহীন বিশাল উপকূলীয় এলাকা জলদস্যুদের জন্য শুধু যে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে পরিণত হয়েছে তা নয়, এই অরাজকতা সুদান থেকে কঙ্গো পর্যন্ত সব নাজুক দেশগুলিতেও সমস্যার সূত্রপাত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের বিবাদকে সামলানোর জন্য পূর্ব এবং মধ্য আফ্রিকায় জাতিসংঘের অধীনে পঁঞ্চাশ হাজার শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। ২০০৬ সালে সোমালিয়াতে বুশ প্রশাসন ভিন্ন জিনিস আমদানী করে। প্রক্সি যুদ্ধ। বুশ প্রশাসন ইথিওপিয়াকে সবুজ সংকেত দেয় সোমালিয়াকে আক্রমণ করার জন্য। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সোমালিয়ার ইসলামিক কোর্ট মুভমেন্ট নির্মূল করা এবং বিশাল এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা সোমালিয়ান সরকারকে পূনঃস্থাপন করা।

 

দুই বছর পরে সেই পরিকল্পনাই বুমেরাং হয়ে গেছে এখন। সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহি আহমেদ স্বীকার করেছেন যে, বিভিন্ন ধরনের ইসলামী জঙ্গী বাহিনী দিয়ে ভরে গেছে সারা দেশ। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দল শাবাব, ইসালামিক কোর্ট মুভমেন্টের চেয়েও অনেক বেশী মৌলবাদী সংগঠন। নিরাপত্তা দেবার অজুহাতে জলদস্যুদের মুক্তিপণের টাকার ভাগ শাবাব পায় সে ব্যাপারে অনেকেই দৃঢ় মত পোষণ করে থাকে। শাবাব এর আদর্শিক মিল রয়েছে আল-কায়দার সাথে। 

 

সমাধানের উপায়ঃ জলে নয় স্থলে

 

সোমালিয়ার উপকূলের গালফ অব এডেন এবং ভারত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় যে জলদস্যুতা শুরু হয়েছে তার সমাধান জলে হবে না। স্থলেই করতে হবে এর সমাধান। শুধুমাত্র নৌবাহিনীর গুটি কয়েক যুদ্ধজাহাজ দিয়ে এই বিশাল এলাকাকে নিরাপদ করা কোনভাবেই সম্ভবপর নয়। স্বল্প সময়ের জন্য হয়তো সম্ভব, কিন্তু দীর্ঘকালের জন্য সম্ভব নয়। জলদস্যুতার মূল যেখানে সেখানে গিয়েই সমস্যার সমাধান করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। সোমালিয়ার ভিতরে শক্তিশালী সরকারের অভাবে যে অরাজকতা চলছে গত দেড় যুগ ধরে তা দূর করতে হবে অবিলম্বেই। দেশের ভিতরে স্থায়িত্ব আসলেই জলদস্যুদের নিরাপদ আশ্রয় আর থাকবে না। জিহাদি ইসলামিস্টরাও যাতে সোমালিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে আশে পাশের দেশে ছড়াতে না পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। যেহেতু ওয়ারলর্ড এবং ইসলামিক জিহাদিষ্টদেরকে পরাজিত করার মত শক্তিশালী কোন সশস্ত্র বাহিনী নেই সোমালিয়ায়, কাজে এর জন্য সবচেয়ে জরুরী কাজ হচ্ছে দেশের রাজনীতিকে পুনর্বিন্যাস করা এবং তেমন উগ্র নয় সেই সব ইসলামিষ্ট সংগঠনগুলোর সাথে চুক্তিতে আসা। খুব একটা শক্ত কাজ এটা হয়তো নয়। তা না হলে জলের এই সমস্যা কোনদিনই মিটবে না। তা সে যতই দাপাদাপি করা হোক না কেন উত্তাল নীল জলে।

 

মায়ামি, ফ্লোরিডা

[email protected]

____________________________________________________

ফরিদ আহমেদ, মুক্তমনার মডারেটর, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে গ্রন্থের লেখক