সংখ্যালঘুর মানচিত্র

 

গীতা দাস

 

(১)

 

আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাইরে

কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাইরে

পাহাড় শিখায় তাহার সমান

হই যেন ভাই মৌন মহান

খোলা মাঠের উপদেশে দিল খোলা হই তাই রে।

 

ছোটবেলায় পড়া ও শেখা সুনির্মল বসুর সবার আমি ছাত্র কবিতা কানের ভেতর দিয়েজিহ্বার নীচ দিয়ে  প্রাণের ভেতরে কতটুকু প্রবেশ করেছিল জানি না, তবে নিজেকে উদার– মহান—-  দিল খোলা— সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ভাবতে এক ধরনের সুখ অনুভব করি।  সমসাময়িক অনেক ঘটনা— পারিপার্শ্বিক বহু অসামঞ্জস্যকে নিজের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করে— বিবেচনা করে স্বস্তি পাই।

 

তেমনি পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস এর ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনা যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিশ্লেষণ ও মানবিকবোধ দিয়েই অনুভব করছিলাম। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা, লুটপাট, গণকবরও সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের অসহায়ত্বে মর্মাহত হয়েছি শোকাভিভূত হয়েছি। বি ডি আর সদর দপ্তরে কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের সংখ্যা নিয়ে অনুমান নির্ভর তথ্য ও সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের অদক্ষতা নিয়ে হতাশ হয়েছি। অস্বস্তিতে দুএক রাত ঘুমুতে পর্যন্ত পারিনি। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে শিহরে উঠেছি। বিচলিত হয়েছি।

 

কেউ মরে পাপে আর কেউ মরে তাপে। এখন বি ডি আর পরিবার পরিজনদের হাহাকারও আমাকে সংবেদনশীল করছে বৈ কি। এক যুবক তার নিখোঁজ বাবাকে খুঁজছে যে বি ডি আর এর কর্মকর্তা ছিল, অথচ যুবকটি নিজের পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশ করছে না লজ্জায় ও ভয়ে। ছেলেটি বাবার সাথে পিলখানায়ই ম্যাসে থাকতো। গোলাগুলি শুরুর পর বাবার সাথে মোবাইলে একবার কথা হয়েছিল। বাবা তাকে পিলখানা থেকে বার হয়ে যেতে বলেছিল। নিহত সেনা পরিবারের হাহাকার আর তাপে পোড়া বি ডি আর পরিবারের হাহাকার তো একই তারে বাঁধা।

 

এ নিয়ে  বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েব সাইট এবং বিভিন্ন রেডিও ও টিভি চ্যানেলের সংবাদ পই পই করে পড়েছি, শুনেছি ও দেখেছি। এখন পিলখানার অরাজকতা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য অসহ্য লাগলেও একজন সাধারণ নাগরিক বলে সহ্য না করে পারছি না। এই হলো পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস এর ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় সংক্ষেপে আমার উপলব্ধি।

 

এ নিয়ে বন্ধু বান্ধবের সাথে আলাপ আলোচনাও চলছে ফোনে বা চা-চক্রে। আমার এক বন্ধু এ্যাডভোকেট কামরুন্নাহারের পিলখানায় ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে যে মন্তব্য এবং  আরেক বন্ধু ফরিদার অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছেলে উচ্ছ্বাস মাকে যে প্রশ্ন করেছে তা আমি বললে সাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ বলে গণ্য হতো। আমাকে সংকীর্ণ মনোভাবের বলে ভাবা হতো, তবে তাদের ভাবনা কিন্তু আমার চিন্তার মোড় একটু হলেও ঘুরিয়ে দিয়েছে বৈ কি!

 

যদিও আমি নিজেকে সংখ্যালঘু হিসেবে ভাবতে চাই না। মূলস্রোতের একজন ভাবতে গর্ব অনুভব করি। সংবিধানে বাঙালী ও বাংলা ভাষার উল্লেখে সংখ্যাগুরুর দলে পরি। আবার  জেনারেল জিয়ার আমলে সংবিধানের প্রস্তাবনায় কিছু বাক্যের সংযোজন ও এরশাদের আমলে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর পর হয়ে গেছি সংখ্যালঘু।

 

এ্যাডভোকেট কামরুনের মন্তব্য— নিখোঁজ ও নিহত সেনা কর্মকর্তাদের ও বি ডি আর এর নামের তালিকা প্রমাণ করে সেনা বাহিনীতে ও বি ডি আর এ নিয়োগ পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। কোন হিন্দু সেনা কর্মকর্তা নেই।

 

ফরিদার অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছেলে উচ্ছ্বাস মাকে বলেছে— শুধু নামাজে জানাজা কেন? অন্য কোন ধর্মের কেউ মারা যায়নি বুঝি?

 

অন্য ধর্মের কেঊ সেনাবাহিনীতে বা বাংলাদেশ রাইফেলসে নেই কেন?

হ্যাঁ, জনসংখ্যার আনুপাতিক হিসেব ধরলেও দু-একজন সংখ্যালঘু (হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টান) সেনা কর্মকর্তা থাকার কথা। সাথে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ রাইফেলসেও। এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? তাছাড়া, এর উত্তর আমাদের কারো কারো হয়তো জানা আছে। অথবা নেই।

কোন সংখ্যালঘু (হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টান) সেনা কর্মকর্তা মরেও যদি প্রমাণ করতে পারতো যে সেনাবাহিনীতে নিরপেক্ষ নিয়োগ হয়!

 

গীতা দাস

[email protected] 

৬ চৈত্র ১৪১৫/ ২০ মার্চ, ২০০৯