বাসুনকে, মা
পর্ব ৪৩
বাসুন,
পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো বরফ দিয়ে টরোন্টো শহরের আকাশ ভরে আছে, ঘর সংসারী মানুষ তো নয়ই বরং যারা দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা বাইরে থেকে অভ্যস্ত তারাও এই অবহাওয়াতে বের হবার আগে তিনবার ভাববে। আমার আর তোর ছুটির দিনের প্রথম বেলা শুরু। সকাল থেকে আমরা মা বেটা কাজ করেছি, আমি হেড বুয়া আর তুই যোগালী— বাবু — পাপোশ তোল, ডাস্টার আন, চেয়ারটা সরা, ম্যাট বিছা, ময়লা ফেলে আয়–এরকম শতেক কাজে তুই আমার ডান/ বাম হাত সোনা। সারা সপ্তাহের রান্না সেরে আমি আর তুই একটু আগে নিজেদের টেবিলে বসেছি। জানিস বাবু, এই লেখা যারা পড়েন তারা অনেকেই হয়তো ভাবেন তুই ভীষন ভালো আর লক্ষী ছেলে, এই মুহুর্ত পর্যন্ত এব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু আগামী কালের কথা কি তুই আমি কেউ বলতে পারি?
অন্য একটি গল্প বলে তোকে আমার মনের ভিতরটা একটু মেলে ধরি। তুই তো জানিস তোর মা কমিউনিটিতে ঘুরে ঘুরে মানুষের সুঃখ দুখের ভাগীদার হয়, এই-ই তোর মায়ের নেশা ও পেশা গত ১৫ বছরের।
”রিনা কাগজপত্রবীহিন আমেরিকা হয়ে কানাডায় আছে প্রায় ১৪ বছর। আমার সাথে দেখা হবার কয়েকদিন পরেই ও বলল আপা আমাকে একটু সময় দেবেন আমি কথা বলবো। রিনার ছেলের বয়স ১৭, যখন কানাডায় এসেছে তখন ছেলে ছিলো ৮ বছরের। ছেলের বাবা স্বভাবতই কানাডায় আসার পর পরই নিজের জীবন গড়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো আর ঘরের ভাত কাপড়ের যোগান দিতে হয়েছে রিনাকে। রিনার উক্তিতে, ”আপা আমার স্বামী মানুষ না পশু”। গল্পের মাঝামাঝি সময় রিনা এরকম উক্তি করলো তাই পশুত্বের মাত্রাটা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। রিনা আবার শুরু করে—- আপা ছেলে মানুষ করা, ঘর সামলানো, কফির দোকানে কাজ সবটাই আমার হাতে, আর এই ফাঁকে ওই বদমাইশ অন্য মেয়ের সাথে শোয়াশুয়ি, এ নতুন কথা না আপা এই অভ্যাস ওর আমেরিকাতেই ছিলো (বাংলাদেশের নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, আমেরিকা আসার স্বপ্নকে সঙ্গি করে বাব/মা মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলো তাই রিনার কথায়, আচরণে, ভাষায় গ্রামীণ অভ্যাস পুরোটা যায়নি), বিয়ের পরেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু ওই যে, বাবা/ মা বলেছে স্বামী সংসার নিয়ে থাকতে হবে তাই আমি কোথাও কোন সাপোর্ট পাইনি, এছাড়াতো তো আপা কাগজ ছিলো না সবসময় ওর হুমকি আর ধমকের উপরেই থাকতে হয়েছে (রিনার গলায় আবার ঝড়, আমি বলি ঠিক আছে বলেন তারপর কি হলো বলুন?) ওর পড়াশুনা শেষ হবার সাথে সাথেই কানাডাতে ভালো জব পায় আর আমার যেহেতু তখনো কাগজ নেই তাই আমি কলুর বলদের মতো খাটতে থাকি। এতদিন সব মেনে নিয়েই ছিলাম আপা ভেবেছি আমার ছেলে আছে করুক ও যা ইচ্ছে তাই, কিন্ত এবার আর তাও থাকতে দিলো না, আমাকে বলল আমাকে ডির্ভোস করতে হবে, ও অন্য মেয়ে বিয়ে করবে। মারখাওয়া, অপমান এসব তো ছিলো নিত্য দিনের ঘটনা কিন্ত এবার চুড়ান্ত, একদিকে ঢাকাতে আমার মা হসপিটালে অন্যদিকে ওকে এখুনি পেপার্সএ সাইন করে দিতে হবে । বলেন আপা, কি করা? আমার মা মৃত্যুর মুহুর্তে শুনে গেলো আমার জীবনের এই পরিনতি।
সব জেনেও কেন চুপচাপ ছিলেন? আমি গৎবাধা প্রশ্ন করি।
বাবা বলেছে , আমাদের বংশে কোন ডিভোর্স নেই তাই আমিও কিছু করতে পারবো না।
আপনার ছেলে কেমন? আমি প্রশ্ন করি।
আপা, ছেলে তো এই দেশে বড় হযেছে, খুব অন্যরকম। ওর বাবা সপ্তাহে দুদিন ওকে নিয়ে যায় বাইরে ঘোরা ফেরা করায়, খাওয়ায়, আবার দিয়ে যায়।
ছেলে বাবাকে পছন্দ করে? আমি জানতে চাই ।
ছেলে তো (রিনার মুখটা একটু অন্ধকার দেখায়) খুব চালাক আপা আমাকে বলে ”যতদিন বাবা কিছু টাকা দেবে, বাইরে খাওয়াবে ততদিন বাবাকে কিছু বলবো না আমার তো লাভই তাই না মা”।
আমি সেদিনের মতো রিনার এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে আসি, রাস্তার মুখেই এক জোয়ান তাগড়া ছেলে হাতে হ্যামবার্গার, কানাডায় আমরা বাংগালীরা এরকম ছেলেদের কে বলি ”এই ছেলে তো কাল্লুদের মতোই বদ হবে ” ফিরতি পথে শুধু ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়েই আমি বুঝতে পারি এটাই রিনার সন্তান।
বাবু, জীবনের পথে পথে হেটে কুড়িয়ে পাওয়া যে গল্প তোকে করলাম তার শেষ আপডেটটা ঘটল একটু আগে। রিনা ফোন করেছিলো, জানালো সত্যিই ওর ছেলেটা নিজের স্বার্থের বাইরে এক সেকেন্ডও ভাবে না, আগামী মাসে ছেলের বয়স ১৮ হবে, ছেলে এখন থেকেই নাকি মাকে নোটিশ করে সেকথা। রিনা জানতে চায় ও কি করবে?
বাবু , হার মেনে যাবার জন্য আমি এই জীবন শুরু করিনি। তুই পাশের ঘরে খেলছিস, আমি জানি আমি সব চেষ্টা করার পরও জীবন আমার বিপক্ষে যেতেও পারে বা নাও যেতে পারে তাই প্রস্তুত রাখবো নিজেকে। আমার পায়ের নিচে শক্ত মাটির আসন গড়ে তুলেই তোর সামনে উদহারণ তৈরী করবো আমি, আগেই বলেছি কারো জন্য উৎসর্গিত না এই জীবন। মানুষ শক্তের ভক্ত নরমের যম, তাই রিনাকে বলেছি আপনি আজকে এই মুহুর্ত থেকে শুধু নিজেকে ভালোবাসুন, আমি জানি বাবু তোরা সেই প্রজন্ম যারা ব্যক্তির ভালোমন্দকেই বড় করে দেখবি তাহলে এই বেলা সেই বুঝটা থাকাই কি ভালো না সোনা? তোর পথেই একদিন তুই চলবি আমার পথে আমি। আমার এক শিক্ষক বলতেন ” আশা থাকলেই নিরাশ হবার ভয় থাকে ” কথাটা রিনার জন্য খুব দেরী হবে তাই ওকে বলিনি। আজ আর না সোনা, এই যে দুপুর গড়িয়ে এলো তোকে এখুনি খেতে দেবো।
আদর, তোর মা,
৬ই নভেম্বর ২০০৮
Leave A Comment