বিশ্বাসের ভাইরাস এবং আনুষঙ্গিক

দিগন্ত সরকার

 

 

অভিজিতদার বিশ্বাসের ভাইরাস লেখাটা মন দিয়ে পড়লাম। লেখার শেষে আলোচনাও পড়লাম। মূল দুটো পয়েন্ট উঠে আসে, একটা সামাজিক অবিচারের কথা – আরেকটা ধর্মান্ধতার কথা। আমার মনে পড়ে গেল, অনেককাল আগে আমি ভারত-পাকিস্তান ফ্রেন্ডশিপ ফোরামে অনেক কাল ধরে আমি হিংসার কারণ খুঁজেছি। অনেক খুঁজে আমি কিছুটা হলেও নিজের মত একটা তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছি। সেই তত্ত্ব নিয়েই লেখা।

শুরু করা যাক ভারতীয় হিন্দু দক্ষিণপন্থার উত্থান দিয়েই। হিন্দু দক্ষিণপন্থীরা সবসময়েই ভারতে একটা বড় শক্তি হিসাবে ছিল, কিন্তু বামপন্থী আর দেশপ্রেমিক ধর্মনিরপেক্ষদের সংখ্যাও কম ছিল না। তাই ১৯৯১ এর ভোটের আগে পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে এদের ততটা অস্তিত্ব ছিলই না। কিন্তু গত কুড়ি বছরে এরা দ্রুত সারা ভারতে এদের দক্ষিণপন্থী মতবাদ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। কি ছিল সেই অস্ত্র যা দিয়ে এরা এদের এজেন্ডা সবার কাছে পৌঁছে দিয়েছে? এরাও কিন্তু সেই সামাজিক অবিচারের কথা শুনিয়েই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে।

এই অবিচারের প্রচারের নিদর্শন পাওয়া যায় ভারতে আর এস এস পরিচালিত স্কুলগুলোতে। বিদ্যা ভারতী নামের এই স্কুল সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে – সংখ্যায় প্রায় ২০,০০০। প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী এতে পড়াশোনা করে – যাদের অধিকাংশই গরিব বা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের। পড়াশোনা চলে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী অবধি। তিস্তা সেতালবাদের লেখায় পাওয়া যায় কিভাবে এদের মগজ ধোলাই করা হয়। সংস্কৃত পাঠে পাওয়া যায় –

“হোমার বাল্মীকির রামায়ণের একটা ভাবানুবাদ করেছিলেন – যার নাম ইলিয়াড।”
“প্লেটো ও হেরোডোটাসের মতে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ভারতীয় ভাবধারার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।”
“গরু আমাদের সকলের মাতৃস্থানীয়, গরুর শরীরে ভগবান বিরাজ করেন।”
একই স্কুলের ভারতের ম্যাপে ভারতকে দেখানো হয় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, তিব্বত এমনকি মায়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে। বলা হয় অশোকের অহিংস নীতির ফলে তার সেনাবাহিনী যুদ্ধে উৎসাহ হারিয়েছিল। আলেক্সান্ডার পুরুর কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন।
মধ্যযুগের ইতিহাস আসতেই আসল রূপ বেরিয়ে আসে। সমগ্র ইতিহাস শিক্ষায় মুসলিমদের বিদেশী শক্তি হিসাবে দেখানো হয়েছে।
“ভারতে বিদেশী মুসলিম শাসন …”
“ভারতে তরোয়াল ধরে ইসলামের প্রচার হয়েছিল। মুসলিমেরা এক হাতে কোরাণ আরেক হাতে তরবারি নিয়েই এসেছিল এদেশে … আমরা তাদের পরে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি, কিন্তু আমাদের যে ভাইয়েরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তাদের হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করতে ব্যর্থ হয়েছি।”
“হিন্দুরা চরম অপমানের সাথে তুর্কী শাসন মেনে নিয়েছিল।”
“বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, পর্দাপ্রথা সহ আরো অনেক কুসংষ্কার মুসলিম রাজত্বের প্রতিক্রিয়া হিসাবে হিন্দুসমাজে স্থান করে নিয়েছে।”
“শিবাজী আর রাণা প্রতাপ ছিলেন প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী। তারা মুসলিমদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্যই লড়াই করেছিলেন।”


এছাড়াও আছে বিন কাসিম, ঘৌরী বা গজনীর মামুদ বা তৈমুল লঙ্গ কিভাবে হিন্দুদের হত্যা করেছিলেন তার বিস্তারিত বর্ণনা। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে এলেও অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটে না। খ্রীষ্টানদের এবার বিদেশী শক্তি হিসাবে দেখানো শুরু হয় – ব্রিটিশদের নয়। দেশ বিভাগের জন্য একতরফা ভাবে মুসলিমদের দায়ী দেখানো হয়। আর এস এস-কে প্রকৃত স্বাধীনতাকামী একটি সংগঠন হিসাবে তুলে ধরা হয়। সবথেকে মজার কথা, মহাত্মা গান্ধী যে এই সংগঠনের একজনের হাতেই মারা গিয়েছিলেন, সেকথাও বেমালুম চেপে যাওয়া হয়।

সামগ্রিকভাবে, পাঠক্রম এমনভাবে সাজানো যাতে সবার মধ্যে ভাব সৃষ্টি হয় যে তাদের পূর্বপুরুষেরা মুসলিম ও খ্রীষ্টানদের হাতে অত্যাচারিত। তাদের ঘাড়ে দায়িত্ব বর্তায় তার প্রতিশোধ নেবার। নিউ ইয়র্ক টাইমস রিপোর্টার কাই ফ্রাইস এরকম একটি স্কুলে গিয়েছিলেন। ওনার বক্তব্য


“৮ থেকে ১১ বছর বয়সী কিছু ছাত্রের সাথে দেখা করলাম। তারা সবাই ডাক্তার বা পাইলট হতে চায়। … তোমরা ধর্ম সম্বন্ধে কি শেখ? হিন্দু বা খ্রীষ্টান ধর্ম সম্পর্কে? … একজন বাচ্চা উঠে দাঁড়িয়ে বলে – ‘খ্রীষ্টানরা হিন্দুদের ঘরদোর ভেঙে ঢুকে তাদের হয় ভয় দেখিয়ে নাহলে লভ দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করে’। … হয়ত এরা এই শেখে তাদের সমাজবিজ্ঞান ক্লাসে।”

যাদের পাঠক্রমই এরকম, তাদের ছোটোবেলা থেকেই কি শিক্ষায় খিক্ষিত করা হচ্ছে সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। মজার কথা, এই সামাজিক অবিচারের ছবিই কিন্তু তুলে ধরা হচ্ছে এদের সামনে।

সমস্যার ব্যাপার এখন এই বই কিছু কিছু রাজ্য শিক্ষা পর্ষদও অনুমোদন করতে শুরু করেছে। রাজস্থানে ও গুজরাটে এ নিয়ে এর মধ্যেই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে – এর শেষ কোথায় তা কেউ জানে না।

ভারতে যা কিছু হিন্দু উগ্রবাদী স্কুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে, পাকিস্তানে তা ছড়িয়ে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেই। জাতিসংঘ পরিচালিত সাস্টেইনেবল পলিসি ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল পাকিস্তানের জাতীয় ও রাজ্য বোর্ডগুলোর পাঠক্রমের সমালোচনা করে। তাদের আলোচনায় চার ধরনের মূল সমস্যা তারা তুলে ধরেন –
১) পাকিস্তান শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য
২) সব ধর্মের ছাত্রদের জন্য কোরাণ ও ইসলামিয়ত শিক্ষা
৩) হিন্দু ও ভারতের প্রতি ঘৃণা
৪) ছাত্রদের জেহাদ ও শাহাদাতের পথে উদ্বুদ্ধ করা
একে একে সবগুলোর কিছু কিছু উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক।

১) পাকিস্তান শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য
চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের উর্দু শিক্ষার পাঠক্রমে বলা হয়েছে
“ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম রাষ্ট্রের বোধ আনতে হবে। ইসলামি শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে সবাইকে সৎ, দেশপ্রেমিক ও মুজাহিদ হতে হবে।”
একইভাবে পাঠ্যবইও লেখে –
“আমাদের দেশ হল পাকিস্তান। …পাকিস্তান একটি ইসলামি দেশ। এখানে মুসলিমেরা বাস করে। মুসলিমেরা এক আল্লহ-এ বিশ্বাসী।”
সরাসরিভাবে এ যেন জানিয়ে দেওয়া হয় যে পাকিস্তানী মাত্রেই মুসলিম, দেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে কোনো মাথাব্যাথাই রাখা উচিত নয়।


২) সব ধর্মের ছাত্রদের জন্য কোরাণ ও ইসলামিয়ত শিক্ষা
১৯৯৫ সালের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম থেকে দেখা যায় যে সকলের মধ্যেই ইসলামের শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশ। পাঠ্যক্রমের নির্দেশ –
“সবার ইসলামিক জীবনযাপনের পথ বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।”
“ইসলাম নিয়ে আলোচনার আয়োজন করতে হবে।”
“ইসলামের ভাবধারাকে শ্রদ্ধা করা শিখতে হবে।”
শুধু তাই নয়, উর্দু ও সমাজবিজ্ঞানের ২৫-৩০% শিক্ষাক্রম শুধু ইসলামের আলোচনা করেই কাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। মজার কথা, পাকিস্তানের সংবিধান অনুসারে শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক কোরাণ শিক্ষার নির্দেশ আছে, অমুসলিমদের ইসলামি শিক্ষায় বাধ্য করা সংবিধান-বিরোধীও বটে।


৩) হিন্দু ও ভারতের প্রতি ঘৃণা
প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম অনুসারে ছাত্রদের বোঝাতে হবে –
“হিন্দু-মুসলিম সংষ্কৃতির পার্থক্য ও পাকিস্তানের প্রয়োজন।”

এ বিষয়ে স্বাভাবিকভাবেই পাঠ্যবইও কড়া ভাষা ব্যবহার করে। পাঞ্জাব বোর্ডের উর্দু ও সমাজবিজ্ঞানের পাঠ্যবই অনুসারে –
“হিন্দুরা সবসময়েই ইসলামের শত্রু।”
“হিন্দুধর্ম ভাল কিছু শেখায় না, হিন্দুরা মেয়েদের সম্মান দেয় না।”
“হিন্দুরা ভাবত ভারত ছাড়া আর কোনো দেশের লোকেরা কিছু জানে না।”
“হিন্দুরা সবসময়েই সুযোগসন্ধানী ছিল আর ইংরেজদের সাথে সহযোগিতাও করেছিল।”
“মুসলিম সংষ্কৃতি ধ্বংসের অনেক প্রচেষ্টাই হিন্দুরা চালিয়েছে।”
“দেশভাগের পরে পাকিস্তানের হিন্দুদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে সব সহযোগিতা করা হয়েছিল, কিন্তু ভারতীয়রা মুসলিমদের ওপর আক্রমণ চালায়।”
“১৯৬৫-র যুদ্ধের পরে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের সাথে ষড়যন্ত্র করে পূর্বের মুসলিমদের মধ্যে পশ্চিম সস্পর্কে ঘৃণা সঞ্চার করে। সবশেষে ভারত ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে পাকিস্তানকে দুভাগে ভেঙে দেয়।”
অন্যান্য পাঠ্যবই থেকেও পাই –
“ব্রিটিশরা মুসলিমদের কাছ থেকে সব জমিজমা কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বিতরণ করেছিল।”
“ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় হিন্দুরা ভোট দিতে পারত, মুসলিমেরা পারত না।”
“ব্রিটিশেরা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল – হিন্দুদের সাহায্যে।”
“কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের হাত থেকে হিন্দুদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।”

এভাবে সব ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানই ধর্মের মারফ শেখানো হয়েছে – এর মধ্যে কোনো সাংষ্কৃতিক বা অর্থনৈতিক প্রভাব পরিবর্তনের চিহ্নমাত্র নেই।


৪) ছাত্রদের জেহাদ ও শাহাদাতের পথে উদ্বুদ্ধ করা
পাঠ্যবইতে অসংখ্য স্থানে জেহাদ ও শাহাদাতের গুরুত্বের কথা বলা আছে। জেহাদের জন্য বক্তৃতা দেওয়া অভ্যাস করার কথাও ছাত্রদের পাঠক্রমে আছে। কিছু বক্তৃতার নমুনাও দেওয়া আছে, যার কিছু আছে বিন কাশিম বা গজনীর মাহমুদের প্রশস্তি আর কিছু আছে ভারতবিরোধী।

সবমিলে, জেনারেল জিয়ার আমলে পাকিস্তানী পাঠ্যবই-এর যে ইসলামীকরণ শুরু হয়েছিল, তা আজও বহাল তবিয়তে পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে জড়িয়ে আছে। ভারত ও হিন্দুবিরোধী পাঠক্রমের ধারাও সেই একই রকম – সামাজিক অবিচারের কথা শোনানো। ভাবখানা এই, হিন্দুদের অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করাই হল পাকিস্তানের মুসলিমদের একমাত্র জীবনের লক্ষ্য।

পৃথিবীতে সামাজিক অবিচার যেমন আছে, তেমন আছে সামাজিক অবিচারের প্রচার। সাধারণভাবে, অবিচারমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব নয়, কারণ সাম্য বা সুবিচার – সবই এক একটি ধারণার ওপর বশবর্তী হয়েই তৈরী। সাম্প্রতিককালে একটা ঘটনা পড়লাম ইন্দোনেশিয়ায় তিন জঙ্গীর মৃত্যুদণ্ড হওয়া নিয়ে। এদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হবার পরে একজনের মায়ের সাথে সাক্ষাকারও দেখলাম। সেই জঙ্গীর মা দাবী জানালেন যে তার ছেলে কিছু ভুল কাজ করে নি। পশ্চিমা নাইটক্লাবের বাঁধনছাড়া উদ্দামতা একটা সামাজিক ব্যাধি যা গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই তা রুখতে সবার সংঘবদ্ধ হওয়া দরকার। ধর্মই যদি দৃষ্টিভঙ্গীকে নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে তাদের দৃষ্টিতে সামাজিক সুবিচারের এই রূপ কি কোনোদিনও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব?


দিগন্ত সরকার, কম্পিউটার প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞান লেখক।  ইনেইল – [email protected]