মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এবার তো বুঝলেন, আপনার ক্ষমতায় থাকার জন্যে মৌলবাদের চাষাবাদ করার কোনোই প্রয়োজন ছিলনা। আপনার এবং আপনার পুলিশ প্রশাসনের সাহায্য ছাড়াই, এতো বছরের দুধ-কলা দিয়ে পোষা পালা সাপ কুমীরদের এক ধমকেই ছাত্রলীগ আর যুবলীগের তরুণরা গর্তে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আপনি খামোখাই এই সাপ বিচ্ছুদের খুশি করতে গিয়ে আপনকে পর করেছেন, মিত্রকে শত্রু বানিয়েছেন। আপনি ঘুম থেকে উঠেই খুঁজেন কোরান, সংসদেও কোরান, ভাষণে বক্তৃতায়ও কোরান। আমাদের মনে আছে, ২০১২ সালের ১০ আগস্ট আপনিই প্রথম দেশের ডিজিটাল কোরআন শরিফ উদ্বোধন করেছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আলেমদের উদ্দেশ্য করে আপনি রিতিমত ওয়াজ ফরমাইলেন এই বলে:
“ ইসলাম শান্তির ধর্ম। এখানে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। ইসলামকে ব্যবহার করে কেউ যেন অপরাধ ও জঙ্গিবাদ এবং কুৎসা রটনা না করতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আপনারা দয়া করে দেখবেন, কেউ যেন ধর্মের নামে কোনো অপরাধ সংঘটন করতে না পারে; কোনো কুৎসা রটনা করতে না পারে। ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সমর্থন করে না। যারা ইসলামের নাম ভাঙিয়ে একে হেয় প্রতিপন্নের চেষ্টা করে, তারা ইসলামে বিশ্বাস করে না। আমার কষ্ট হয়, কখনো কখনো জঙ্গিবাদ নাম নিয়ে ইসলাম ও জঙ্গিবাদকে এক করে ফেলা হয়। মুষ্টিমেয় লোকদের জন্য আমাদের এত বড় দুর্নাম বয়ে বেড়াতে হয়। কাজেই ইসলামে যে জঙ্গিবাদের স্থান নেই, সন্ত্রাসবাদের স্থান নেই; ইসলাম যে পবিত্র ধর্ম, শান্তির ধর্ম—এ বিশ্বাস মানুষের মধ্যে আনার ব্যাপারে আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি। সরকার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৪৩টি জেলা কার্যালয় ও এর জনশক্তিকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করেছে। ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছে। বায়তুল মোকাররমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ করেছে। মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। দেশব্যাপী ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করেছে”।
সেই অনুষ্ঠানে আপনি দেশব্যাপী একযোগে কোরআন শরিফ বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এ সময় মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোরআন শরিফ বিতরণ করেন। সারা দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে এদিন ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৭৭০টি কোরআন শরিফ বিতরণ করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে আপনার কথাগুলো শুনে আমার মনে হয়েছিল যেন, আমি ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমানের ভাষণ শুনছি। একদিকে দূর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সারা দেশ, অপর দিকে শাসনকার্যে ব্যর্থতা ঢেকে রাখার উদ্দেশ্যে ইসলামের খেদমত আর কোরান নিয়ে ব্যস্ত খলিফা উসমান। কোরান কোরান করতে করতে শেষ পর্যন্ত কোরান বুকে নিয়েই খুন হলেন হজরত উসমান। আপনার এসব কার্যকলাপ দেখে আপনার মন্ত্রী, মেয়র সাংসদরাও নিজের দায়ীত্ব কর্তব্যের পরোয়া না করে ইসলামের খেদমতে পুরোদমে মনোযোগী হয়ে উঠেন। পাইকবাড়ি জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে এক অনুষ্ঠান আয়োজন করে আপনার ৭৪তম জন্মদিন উপলক্ষে এক হাজার মাদ্রাসা ছাত্রের মাঝে কোরআন শরীফ বিতরণ করেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম। সেই অনুষ্ঠানে উপমন্ত্রী তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, “প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরেই কওমি মাদ্রাসা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। তিনি করোনাকালীন দেশের ইমাম মুয়াজ্জিনদের যেভাবে সহায়তা করেছেন তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে যুগের পর যুগ”। একই দিন ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক জিয়ার উদ্যোগে গালাগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গনে আপনার ৭৪ তম জন্মদিন উপলক্ষে দোয়া মাহফিল ও কোরআন শরিফ বিতরণ করা হয়েছে। আপনাদের এই কোরান নিয়ে ব্যস্ততা দেশে দুষ্কৃতিকারী দূর্বৃত্ত ধর্ষক চোর লুটেরা ডাকাত সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ, উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সারা দেশ জুড়ে হাজার হাজার কোরান তো বিতরণ করা হলো, আপনার শাসনামলে বারো বছর যাবত রাতভর ঘুম নিদ্রা ত্যাগ করে ওয়াজ আর ওয়াজ কোরানের বাণীই মানুষ শুনলো। আপনি বা আপনার মন্ত্রীরা ইচ্ছে করলে শিশুদের হাতে বিজ্ঞান তুলে দিতে পারতেন, কিন্তু দেন নি। মসজিদ মাদ্রাসার পরিবর্তে বিজ্ঞানাগার, লাইব্রেরি করতে পারতেন কিন্তু করেন নি। আজ থেকে ঠিক পয়তাল্লিশ বছর পূর্বে একদল ইসলামীমনা লোক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বদলে মুসলিম জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বদলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ধর্মরাজনীতি তথা রাজনৈতিক ইসলামের যে বিষবৃক্ষ রোপন করেছিল, আপনার বারো বছরের জল সার দিয়ে আপনার যোগ্য হাতের পরিচর্যায় সেই বিষবৃক্ষে আজ ফল ধরেছে। প্রমাণ, সেদিন যাদের হাতে হাজার হাজার কোরান তুলে দিয়েছিলেন, আজ বঙ্গবন্ধুর মাথায় যারা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেছে এরা সেই কোরান পড়ুয়া মাদ্রাসা ছাত্র, স্কুল পড়ুয়া কোনো ছাত্র, কোনো অমুসলিম বা নাস্তিক নয়।
কোরান হেফাজতের দায়ীত্ব ঈশ্বর স্বয়ং তার নিজ হাতে নিয়েছেন, এ দায়ীত্ব আপনার নয় আমাদের রাষ্ট্রের নয়। রাষ্ট্রের দায়ীত্ব দেশের মানুষের হেফাজত করা। বেডরুমে-অফিসরু্মে, মাঠে-ঘাটে সর্বত্র মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কাজ। আমরা আশা করবো, আপনি অতি সত্বর ঘোষণা দিবেন, আজ থেকে রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই, রাষ্ট্রীয় কোনো সিদ্ধান্তে ধর্মের কিছু বলার অধিকার নেই। একমাত্র এই পথেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার মানুষ আর সোনার বাংলা গড়া সম্ভব, অন্য কোনো পথে নয়।
মেয়র আতিকুলের ওয়াজ তো শুনলেন, এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালীর বক্তব্য শুনেন –
” ধর্মীয় শিক্ষার বাস্তব প্রতিফলনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে দেশকে এগিয়ে নিতে পারলে বাংলাদেশ পথ হারাবে না। প্রধানমন্ত্রী একজন খাঁটি মুসলমান। তিনি প্রতিদিন নামাজ আদায় ও কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার কাজে হাত দেন।কওমি মাদ্রাসাগুলোর পাঠদান পদ্ধতি, বাস্তবচিত্র আমাদের জানা হয়ে গেছে। এই মাদ্রাসাগুলোতেই আদর্শ, পবিত্র শান্তির ধর্ম ইসলামের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার পাশাপাশি মাতৃভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়। এজন্য কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। ইসলাম মানুষ হত্যা, গণহত্যা ও জঙ্গিবাদ বিশ্বাস করে না। তাই আল্লামা আহমেদ শফীর অনুসারী হিসেবে বাংলাদেশকে জঙ্গিমুক্ত রাখতে ইমাম, মুয়াজ্জিন, মাওলানা ও মুফতিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই “।
– স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, জামালপুর মেলান্দহ বেতমরারি মহিলা কওমি মাদ্রাসা ওয়াজ মাহফিল, ১১ ডিসেম্বর বুধবার ২০১৯।
সকালে সাইক্লিং করতে বের হই প্রতিদিনই। গ্রামগুলাতে গিয়ে দেখি প্রতি কিলোমিটার হিসাবে একটা মাদরাসা আছে। সেই স্ট্যাটিসটিকস থেকে দেখা যায় এইসব এলাকায় তূলনামূলকভাবে সেরকম স্কুল নাই। মানে সরকারি স্কুল তো নাই-ই প্রাইভেট স্কুলও নাই। আর স্কুলের রেপুটেশনও নাই এইসব গ্রামগুলাতে। গ্রাম্যজীবনে ধর্মভিত্তিক এই এডুকেশন সিস্টেম বাঙলাদেশকে কোন সীমানায় নিয়া যাইতেছে তা ভেবে দেখা উচিত। মাদরাসাগুলাতে কীভাবে এক্সট্রিমিস্টদের ইগনাইটেড করা হয় তা তো মোটামুটি প্রগতিশীল মহল বুঝতেই পারতেছে। তারেক মাসুদের ডিরেকশনেে ‘রানওয়ে’ এবং ‘মাটির ময়না’ মুভিগুলাতে আমরা কিছুটা তো ধারণা পাইছি এই এক্সট্রিমিস্ট গ্রুপের কার্যধারা’র। তো এইটাই হাই টাইম, এই ধর্ম ভিত্তিক স্কুলিং সিস্টেমকে স্টেটের কঠোর নজরবন্দী করার। মানে করা উচিত।
ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা মাদ্রাসায় দেয়া ধর্মীয় শিক্ষার ‘সুফল’ তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। অবস্থা এমন যে এখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যেরও অবমাননা হচ্ছে, তাও আবার যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। আসলে ধর্মীয় শিক্ষা না, বরং নৈতিকতা শিক্ষায় জোর দেয়া উচিত, দেশের ইতিহাস আর সংস্কৃতিকে ভালবাসতে শেখানো উচিত আর সবার সমান অধিকারের জ্ঞান দেয়া উচিত। কোন বিশেষ ধর্মের পাঠ না দিলেও একজন সুশিক্ষিত ভাল নাগরিক পাওয়া সম্ভব, তাতে অন্তত গোঁড়ামি আর অন্ধবিশ্বাস প্রসারের ঝুঁকি থাকে না।