লেখক: মাসুদ সজীব
(১)
আচ্ছা, যখন চারজন মৃত্যুদূত চাপাতি হাতে অনন্ত বিজয় কে ঘিরে ধরেছিলা তখন সেকেন্ডেরও কম সময়ের মাঝে প্রথম কোন ভাবনা তাঁর সমস্ত সত্তাকে আচ্ছন্ন করেছিলো? প্রথম কোপটা যখন ঠিক জায়গা মতো পড়েনি তখন কি ভেবেছিলেন কিংবা যখন দৌড়াতে শুরু করলেন তখন-ই বা কি ভাবনা প্রলয়ংকরী ঝড়ের মতো ছুটে বেড়িয়েছিলো অনন্তের মনের অলিতে গলিতে? মা-বাবার প্রিয় মুখগুলো কি ভেসে উঠেছিলো মনের ক্যানভাসে? মনে পড়েছিলো কি অভিজিৎ-ওয়াশিকুরদের পরিণতির কথা? ভয় আর আতংক কি সমস্ত বোধকে তখন গ্রাস করে নিয়েছিলো? নাকি ভাবনা-কল্পনা কিছুই নয়, সর্বশক্তি দিয়ে শুধু ছুটেছেন প্রাণটা কে বাঁচাবেন বলে?
নিজের নামটা যখন থেকেই স্থান পেয়েছিলো ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের তালিকাতে তখন থেকেই রাতের নিকোষ আঁধার কে বড় ভয় পেতেন অনন্ত বিজয় দাশ। জেনেছেন, দেখেছেন, রাতের আঁধারেই অন্ধকারের হায়নারা সক্রিয় থাকে বেশি। সেই অন্ধকারেই মৌলবাদী হায়নাদের হাতে জীবন দিতে হয়েছে আলোর যাত্রী হুমায়ুন আজাদ-অভিজিত রায়দের। আলো কে ভালোবাসতেন, আলোর উপর বিশ্বাস রাখতেন। আর বিশ্বাস রাখতেন বলেই ঘর থেকে সেদিনও বের হয়েছিলেন দিনের আলোতে। বেরিয়ে যখন বুঝে গিয়েছিলেন হিসেবে ভুল ছিলো, তখনও কি তিঁনি বাঁচার আশা করেছিলেন? যতক্ষণ দেহে প্রাণ থাকে ততক্ষন আশাও বেঁচে থাকে। আশাবাদী তিঁনিও নিশ্চয় ভেবেছিলেন এই প্রকাশ্য দিবালোকে নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে কয়েকজন সাহসী মানুষ কিংবা কোন পুলিশের গাড়ি! কিংবা তিঁনি নিজে দৌড়ে কোনো গলিতে ঢুকে এবারের মতো শান্তির যমদূতদের ফাঁকি দিয়ে বাঁচাতে পারবেন নিজেকে!
কিছুদূর দৌড়ে যখন আর পারলেন না, নিজেকে যখন সোপে দিলেন অনুভূতি রক্ষাকারী রামদা আর চাপাতির কাছে ঠিক সেই মুহুর্তে কতটা বেদনাহত বিষন্ন দৃষ্টিতে তিঁনি তাকিয়ে ছিলেন ঘাতকের চোখে? সেই দৃষ্টিতে কতটা ঘৃনা ছিলো, কতটা অসহায়ত্ব ছিলো? আচ্ছা, মায়ের কথা মনে পড়ে কি শ্রাবণের আকাশের মতো কালো মেঘ জমেছিলো মনের ঘরে? হঠাৎ ঘিরে ধরা অসীম শূণ্যতায় গড়িয়েছিলো কি চোখে শ্রাবণ ঢল? একের পর এক আঘাত যখন তাঁর মস্তককে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে যাচ্ছিলো তখন কি ব্যাথায় নীল হচ্ছিলো ধমনী আর ভারী হয়ে যাচ্ছিলো ফুসফুস? পৃথিবীটা যখন অন্ধকার হয়ে আসছিলো অসহ্য ব্যথায় তখন কি মনে ঘরে উঁকি দিয়ছিলো পক্ষাঘাতে পড়ে থাকা বাবার উদাস চাহনি? মনে কি পড়েছিলো ছোটবেলার রঙিন কোনো দিনের কথা? মায়ের বুকনি, বাবার শাসন, বোনের প্রশ্রয়, বড় ভাইয়ের উদারতা কিংবা স্কুল জীবনের মধুর কোন স্মৃতি? যখন টলতে টলতে নুয়ে পড়ছিলেন মাটিতে, রক্তস্রোত যখন বয়ে যাচ্ছে সকালের সিক্ত মাটিতে তখন কি মনে পড়েছিলো নিজের ঘরের চারদেয়ালে আটকে পড়া কোমল বিষন্ন বিছানাটির কথা, যেখানে তিনি জীবনের বত্রিশটি বছর নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় ঘুমিয়েছিলেন আবার জেগে উঠবেন বলে? যেই কক্ষ থেকে তিনি আলো ছড়াতে চেয়েছিলেন অন্ধকারে ঢেকে থাকা এই মানচিত্রে, যে টেবিলে বসে লিখতেন, যে বইগুলো পড়তেন, যাদের সাথে তাঁর আত্নার গভীর সম্পর্ক ছিলো সেই দু:খী জড় সত্তাগুলোর কথা কি মনে পড়েছিলো তখন? মনে কি পড়েছিলো প্রিয় সুরমা নদীর কথা, দিগন্ত জোড়া সবুজ ধানক্ষেতের কথা? প্রিয় কোন মানুষের চোখে গভীর ভালোবাসা কিংবা প্রিয় কোন বন্ধুর মুখোচ্ছবি টা? ফিনকি দিয়ে কানের গোড়ায় যখন রক্ত গড়াতে শুরু করলো তখন নিশ্চয় বুঝে গিয়েছিলেন বিদায়ের ক্ষণ এসে গেছে, সেই বিদায়ের মুহুর্তে শেষবারের মতো চোখ বন্ধ হয়ে আসার আগে কাউকে না বলা অবক্ত্য কোন কথা কি বলতে চেয়েছিলেন?
জানি এ সব প্রশ্নের কোনটার উত্তর-ই আমাদের জানা হবে না কোন কালে। নিরর্থক এই সব প্রশ্ন, তারচেয়েও নিরর্থক তার উত্তর খোঁজা। তারপরও এই আপত অর্থহীন প্রশ্নগুলো আমাকে কে তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। মুক্তচিন্তার প্রতিটি মানুষের মৃত্যু অন্য দশটা মানুষের মতো আমাকে বেদনায় গ্রাস করে, হতাশায় তলিয়ে দেয়, কখনো কখনো অভিমানী করে তুলে আর ভীষন রকম আতংকিত করে তুলে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার সাথে কোন পরিচয় ছিলো না অনন্ত বিজয়, অভিজিত রায়, নিলয় নীল কিংবা ওয়াশিকুরের সাথে। কিন্তু আমি খুব গভীরভাবে অনুভব করি এরা প্রত্যেকে আমার প্রকৃত বন্ধু ছিলো। উনাদের মতো আমিও চাই মু্ক্তচিন্তার অসাম্প্রদায়িক একটা সমাজ, একটা রাষ্ট্র। ধর্ম যেখানে মানুষে-মানুষে ভেদাভেদের পর্দা টানবে না, কুসংস্কার যেখানে কুয়াশার মতো ঢেকে থাকবে না মানুষকে। নিজের জন্মভূমি হবে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে আলোকিত, প্রতিটি মানুষ হবে বিবেক বোধ আর ন্যায় জ্ঞান সম্পন্ন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রতিটি মানুষ হয়ে উঠবে সত্যিকারের বাঙালি।
চিন্তা চেতনা বোধ আর আদর্শে দুটো মানুষের পথ যখন অভিন্ন হয় তখন তাদের মাঝে যে আত্নিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে , সেই সম্পর্কের চেয়ে গভীরতম কোন সম্পর্ক হতে পারে না বলেই আমি বিশ্বাস করি। আর বিশ্বাস করি বলেই অদেখা অনন্ত-অভিজিৎ-ওয়াশিকুর-রাজীব হায়দার সহ মুক্তচিন্তার সকল মানুষ আমার সত্তার সবচেয়ে কাছের আপনজন। এই মানুষগুলোর মৃত্যু মানে আমার নিজের ভেতর প্রিয় একটা অংশের মৃত্যু।
(২)
অনন্ত বিজয় বিখ্যাত কেউ ছিলেন না, মৃত্যুতে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন। এই বঙ্গে মৃত মানুষের দাম জীবিত মানুষের চেয়ে বেশি, যদিও সেই দাম ক্ষণিকের তরে। কিছুদিন সর্বত্র প্রচার পাবে, তারপর মাস না ঘুরতেই অন্য আরেকটি হত্যা উনার নামটি মুছে দিবে, এটাই এই মানচিত্রের নিয়ম। যেমন মুছে দেওয়া হয়েছে অভিজিৎ-ওয়াশিকুর-নীল-তনয়দের নাম। মৃত্যু মানে সবকিছুর পরিসমাপ্তি। চিন্তা-চেতনা, আশা, স্বপ্ন, ভাবনা, কল্পনা সব কিছুই। সব মৃত্যু শুধু শোক জাগায় না, কিছু মৃত্যু শোকের সাথে আতংকগ্রস্থ করে, ভয় জাগিয়ে দেয় মনে। শুধুমাত্র লেখালেখির জন্যে, নিজের চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের অপরাধে একজন মানুষকে হত্যা মানে অন্য শতজনের মাঝে ভয়ের হিংস্র হিমস্রোত ঢুকিয়ে দেওয়া, জানিয়ে দেওয়া থামাও কলম, বন্ধ কর মুক্তচিন্তা। না হলে তোমারও পরিণতি হবে তার মতো অভিন্ন! এর সাথে যদি রাষ্ট্রের নির্লপ্ততা, খুনীদের পক্ষ নেওয়া কিংবা সাবধানে লেখালেখি করার বার্তা দেওয়া হয় তখন ভয় শুধু ব্যক্তিক হয় না, হয় পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক ভয়ের জন্ম। সেই ভয়, সেই আতংক কে জয় করা চারটে খানি কথা নয়। রাজীব-অভিজিৎ-অনন্ত-ওয়াশিকুর দের লিষ্ট যত বড় হয়েছে সেই ভয় দিন দিন তত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশে মৌলবাদ তথা ধর্মান্ধদের প্রকাশ্য শক্তি ততবেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এভাবে চললে সে ভয়ের পথ ধরেই এই দেশ থেকে দিনে দিনে মুক্তচিন্তার মানুষ কমতে থাকবে।
মুক্তচিন্তার প্রগতিশীল মানুষদের হত্যা শুধু ভয় আর আতংক জন্ম দিচ্ছে তা কিন্তু নয়। এর পরিব্যাপ্তি এত ক্ষুদ্র নয়। ভয় আর আতংকের চেয়ে বিষাক্ত বোধ গ্রন্থিত করে দিচ্ছে মননে, মগজে আর ভাবনাতে। যার নাম “অবিশ্বাস”। সবাইকে অবিশ্বাস করতে শিখিয়ে দিচ্ছে এমন মৃত্যুগুলো। বলে দিচ্ছে কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না। রাস্তার নিরীহ পথচারী, চায়ের দোকানদার, গাড়িতে সহযাত্রী, দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি, সবাইকে-সবাইকে অবিশ্বাস করতে শেখাচ্ছে। প্রতিদিন আমিও অফিসে যাই সকাল বেলা, অল্প একটু হেঁটে গাড়িতে উঠতে হয় অথচ সেই সল্প সময়টুকু ও আমার আতংকে কাটে! না জানি কে এসে পেছন থেকে কোপ বসিয়ে দিলো, পেছনে কিংবা পাশে হাঁটা মানুষটিকে ও এখন আমার খুনী মনে হয় অথচ তার ভেতরে থাকতে পারে কোমল একটি হৃদয় এই ভাবনাটি এখন আর আসে না। কখনো কখনো দেখি সামনে জটলা পাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন চারজন উঠতি তরুণ, কি বিষয় নিয়ে যেন কথা বলছে নিজেদের মাঝে। তাদের কেও আমার অবিশ্বাস হয়। না জানি ওরা আলোচনা করছে কে আগে কোপটা বসাবে! বিকেল অফিস শেষে হাঁটতে বের হই মূল সড়ক ধরে। যখনি কোন গাড়ি হঠাৎ করে থেমে যায় পাশে, মনে হয় এই না কজন নেমে এলো মুখোশ পরে! বাড়ি ফিরি রাতের বেলায়, স্টেশান থেকে বাসায় হেঁটে যাই। নিজের পাড়া, নিজের শহরের প্রতিটি ইট-বালু-সিমেন্ট আর মুখ যেখানে আমার পরিচিত সেই শহরে, সেই পাড়াতে ও আমি এখন ভয় পাই। আমি ভয় পেতে থাকি আমার শহর কে, আমি ভয় পেতে আমার শহরের প্রতিটি শব্দ, চিৎকার, নীরবতা কে। আমি ভয় পেতে থাকি প্রতিটি চেনা গলি কে, প্রতিটি চেনা মোড় কে, প্রতিটি অপরিচতি মানুষকে। আমার মানচিত্র, আমার স্বদেশ এখন আমার কাছে এক ভয়ের আশ্রম। ভয় আর অবিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই দিতে পারছেনা আমাকে।
লুঙ্গি পড়া লোকটি, জিন্স টি-শার্ট পরা মানুষটি, দাড়ি-টুপি পরা হুজুরটি, সবাইকে এখন আমার সমান অবিশ্বাস হয়। মনে হয় সবার জামার নিচে একটা করে রামদা আছে, একটা করে চাপাতি আছে। সবাই আমাকে অনুসরণ করছে। অথচ আমি জানি আমি কত তুচ্ছ, এতই তুচ্ছ যে আমার ভয় পাওয়ার কথা ছিলো না। ধর্ম নিয়ে, বিজ্ঞান নিয়েও খুব বেশি কিছু লিখিনি। কিন্তু তারপরও আমি জেনে গেছি ধর্ম নিয়ে না লিখলেও চাপাতির কোপ থেকে বাঁচার নিশ্চয়তা এখন আর নেই। কারণ আমিও তো টুকটাক লেখি ব্লগে। চিন্তা করে যেহেতু আমি সুখ পাই, ভাবতে যেহেতু আমি ভালোবাসি, অনিয়ম, অন্যায়, অবিচার, হত্যা, ধর্ষন যা কিছু ক্ষুদ্ধ করে, ব্যাথিত করে তাই লেখার মাধ্যমে নিজের প্রতিবাদটুকু করতে চেষ্টা করি। জাগিয়ে তুলতে চাই আশে-পাশের মানুষের বিবেক-বোধ আর নৈতিকতা।
নাম না জানা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া মানচিত্রটা কে নিজের আদিম অকৃত্রিম শিকড় জেনেছি বলে দায়বদ্ধতা থেকে, কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে প্রতিটি লেখা মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তচিন্তার মানুষের পক্ষেই যায়। আমি জানি এটিও এখন অপরাধ! যারা ভাবছে ধর্ম নিয়ে না লিখলে সে নিরাপদ তারা আসলে বোকার স্বর্গে বাস করে। যা কিছু মানুষের কল্যানের পক্ষে যায়, যা কিছু অন্ধকারের শক্তির বিপক্ষে যায় তার জন্যেই মৌলবাদীরা আপনাকে মারতে প্রস্তুত। আপনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখেন, আপনি রাজাকারের বিরুদ্ধে ঘৃনার চাষাবাদ করেন, আপনি অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন, আপনি মানুষ হত্যার বিপক্ষে প্রতিবাদী হন, আপনি নারীর অধিকার নিয়ে সেচ্চার থাকেন, আপনি আদিবাসীর অধিকার নিয়ে কথা বলেন….. এমন যে কোন একটি কর্মের (অপরাধের) জন্যে আপনাকে তারা হত্যা করতে পারে।
আপনাকে হত্যার পরে ধর্মান্ধদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কে ভয় পেয়ে যখন একটা রাষ্ট্র সমবেদনা জানাতে পারে না, বিচারের আশ্বাস দিতে পারে না, ভয়ে নিহিত ব্যাক্তিটির পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না তখন আপনাকেও ভয় পেতে হয়। শুধু রাত নয় দিনকেও আপনার ভয় পেতে হবে। একটা বিষয় একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন রাজীব হায়দার কে মারা হলো রাতের আঁধারে। সরকার কঠোর অবস্থানে থাকাতে আসামীরা ধরা পড়লো, ফলে বছর দুয়েক আর কোন মুক্তমনা মানুষ কে মরতে হলো না। তারপর বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা আর ধর্মান্ধদের সাথে ক্ষমতাসীন সরকারের আপোসে ভুলে যাওয়ার সময়ে আবারো রাতের আঁধারে হত্যা করা হলো অভিজিত কে। এবার সরকার তাদের ভাষায় ‘কৌশলী’ হলো, সেই কৌশলের জন্যে আসামি ধরা পড়লো না, হয়তো কোনদিনও পড়বে না। ফলাফল হত্যাকারীরা আরো সাহসী হয়ে উঠলো, তারা আর রাতের আঁধার নয়, প্রকাশ্য দিবালোকে শত মানুষের সামনেই হত্যা করার সাহস অর্জন করলো। এবং পরপর দুজনকে দিনের আলোতেই হত্যা করলো। তারপর রাস্তা থেকে ঘরে ঢুকে হত্যার উৎসব শুরু হলো, নিলয় কিংবা জুলহাস মান্নান-রা সরকারের সেই কৌশলের বলি হলো। সরকারের এই কৌশল মৌলবাদীদের আরও সাহসী করে তুলেছে এ কথা আজ সর্বত্র প্রমাণিত।
কৌশলের নামে মৌলবাদীদরে নীরবে সাহস জুগিয়ে তাদের কে প্রকৃতপক্ষে আরো শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সেই শক্তিতে তে বলীয়ান হয়েই সেই ধর্মান্ধ মৌলবাদী-রা হলি আর্টিজেনে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নকরীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে এবং সারা বিশ্বের বুকেই বাংলাদেশ কে জঙ্গিবাদের এক অভায়াশ্রম আর আতংকের স্থান বলে চিন্থিত করেছে। এমন পরিস্থিতি সত্যি ভয়ের। আমি তাই ভয় পাই, সত্যিই ভয় পাই। আমি জানি, খুব ভালো করে জানি, সবাই ভয় পায়। আর ভয় পায় বলেই ব্লগ জগতে একটা স্থবিরতা নেমে এসেছে গত কয়েক বছরে। কত পরিচিত জনকে দেখছি বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ব্লগ-ফেসবুকে নীরব থাকতে।
সেই ভয়ের জন্যেই আমাদের কে এখন যে কোন কিছু লেখার আগে ভাবতে হচ্ছে এই লেখা কি কারো অনুভূতিতে আঘাত করছে? কেউ কি এই লেখা পড়ে কষ্ট পাবে? সত্য-মিথ্যা, যুক্তি-প্রমাণ তখন আর বড় থাকছে না, বড় হয়ে উঠছে কারও অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টি। সদা ভাবছি আমার লেখাটা পড়ে কেউ না আবার আমাকে হত্যার লিষ্টে ঢুকিয়ে ফেলে! আমরা কেউই চাই না অন্ধকারের মানুষদের হাতে অকালে নিজের প্রিয় প্রাণটা হারাতে। আমাদের ঘিরে অনেক মানুষের স্বপ্ন আছে, ভালোবাসা আছে। সেই স্বপ্নের জন্যে, সেই ভালোবাসার জন্যে আমাদের কে এখন তাই আপোস করতে হচ্ছে, আপোস করতে হচ্ছে নিজের সাথে, নিজের চিন্তার সাথে, বোধের সাথে, আদর্শের সাথে। জীবন একটাই, আর সেখানে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেদিন চাপাতির আঘাতে রাস্তার উপরে মরে পড়ে থাকবেন আর খবরের কাগজের শিরোনাম হবেন, জানি সেদিন সবাই আপনার প্রোফাইলে ঢুকবে আর বলবে মাইরি কি সাহসী লেখা ছিলো, কি অসাধারণ লিখতো ছেলেটা! আপনার লেখা পড়ে কে কি প্রশংসা করলো, কে কতটুকু শোক আর প্রতিবাদ জানালো এগুলো কোনটাই আপনার কাছে তখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি প্রশংসার জন্যে লেখেন না যেমন মুক্তচিন্তার বেশিভাগ মানুষই লিখে না। সবাই নিজের বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকেই লিখে।
ভয় পাচ্ছেন? তা পাওয়ারি কথা। আতংক আপনার মাঝেও আছে? থাকারি কথা। এমন সময়ে, এমন পরিস্থিতে ভয়-আতংক দুটোই থাকবে সবার মাঝে। কিন্তু ভয় আর আতংক কে জয় করতে হবে। ভয় আর আতংক কে সারাটা জীবন নিজের মাঝে ধরে রাখলে আপনি আপনার নিজস্ব সত্তাকে হারাবেন। নিজের সত্তাকে হারিয়ে বেঁচে থাকার মাঝে আত্নসুখ কিছু থাকতে পারে কিন্তু কোনো অর্জন থাকতে পারে না। তাই ভয় কে জয় করতে হবে, ভয় দিয়ে কোনদিন কোনো অন্ধকার কে জয় করা যায়নি, ভয় দিয়ে অন্যায়-অবিচার কে সরিয়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। ক্ষণিকের ভয়, ক্ষণিকের আতংককে ছুঁড়ে ফেলে সংঘবদ্ধ হতে হবে। কবি আসাদ চৌধুরীর বিখ্যাত কবিতা ‘আসাদের খোলা চিঠি’র কিছু অংশ নিজের মাঝে ধারণ করি…
বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি
অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই
জল্লাদের শাণিত অস্ত্র
সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,
দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে
এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।
বেঁচে থাকার জন্যে সময়ের প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে সাবধান হতে হয়, এটা লজ্জার নয় । যুদ্ধে যেমন কৌশল স্বরূপ মাঝে মধ্যে পিছনে সরে আসতে হয় তেমনি জীবন যুদ্ধে, সমাজ পরিবর্তনের যুদ্ধেও কৌশলী হতে হয়। পেছনে আসা মানেই পরাজয় নয়, পেছনে আসা মানেই লক্ষ্য থেকে বিচূত্যি নয়। তাই যা কিছু ভাবায়, যা কিছু তাড়ায়, যা কিছু ক্ষুদ্ধ করে, যা কিছু প্রতিবাদী করে তুলে তার সবটুকুই টুকে রাখুন। বন্ধু নির্বাচনে সাবধান হোন, প্রয়োজনে ছদ্ম নামে লিখুন। তারপরও লিখুন, সত্য বলুন। যারা লেখালেখি করেন বিবেকের দায়ে, যারা লেখালেখি করেন মানুষের কল্যাণে, তাঁরা জানে মৃত্যু ছাড়া তাদের বিচার-বোধ আর বিবেকে কে তালাবদ্ধ করে রাখার কোন উপায় নেই। লেখাই তাদের ভালোথাকার মূল চাবিকাঠি। লেখালেখি বন্ধ করে দিলে চিন্তা-ভাবনা করা বন্ধ করে দিতে হবে, চোখ বুঝে থাকতে হবে। বিবেক-মনুষ্যত্ব আর মানুষের জন্যে যার ভালোবাসা আছে তার পক্ষে সম্ভব না অন্ধ হয়ে যাওয়া। অন্ধকার দেখে সে ভয় পায় না, সেই তো আলোর পথের যাত্রী। আলোর পথে চলাটা কিছুটা কৌশলী হোক, কিন্তু বন্ধ না হোক। কলমই অন্ধকার পৃথিবীতে আলো এনেছে, ‘কলম-ই’ কেবল পারে মানুষকে সকল ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তির পথ দেখাতে। কলম চলছে, কলম চলবে। হুমায়ুন আজাদের উপর কোপ থামাতে পারেনি অভিজিত-রাজীব-ওয়াশিকুর-দ্বীপ-অনন্ত দের, আমাদেরও পারবে না। আলোর পথের সে সব যাত্রীরাই আমাদের সাহস জোগাবে এই নিকোষ কালো এই আধাঁরে, তাদের দেখানো পথ ধরে যেতে হবে আমাদের হেঁটে যেতে হবে আরো বহুদূরের আলোকিত বাংলাদেশে। একদিন নিশ্চয় দূর হবে সব আঁধার, জয় হব মুক্তচিন্তা আর মানবতার। পথের শেষে যেতে না পারি জয়ের পথটুকুই না হয় আমরা শুরু করে দিয়ে যাই।
এ আলো ছড়িয়ে যাবে সবখানে সবপ্রানে 👍👍