[প্রায় ৯ বছর আগে যেভাবে জামাতী ও হিজবুত তাহরীর এর পেইড ব্লগাররা (যেমনঃ ত্রিভুজ, আশরাফ রহমান প্রমুখ) সামহোয়াইনব্লগে “হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের” বিরুদ্ধে নানারকম বিভ্রান্তি, মিথ্যা ইতিহাস, অপপ্রচার চালিয়ে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত পাল্টানোর দাবি তুলতো, এখন এই ফেসবুক ও ওয়াজের যুগে – মাঝেমধ্যেই সেই ত্রিভুজীয় ভাষাতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে নানান হুজুর ওয়াজ গরম করেন, ফেসবুকেও দুদিন পর পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে নানান অপপ্রচার চালিয়ে ঘৃণা উৎপাদন করা হয়। সে কারণেই, ৯ বছর আগে লেখা পোস্টটিকেই নতুন করে কিছুটা পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত রূপে ব্লগে নিয়ে আসলাম।]

তাদের মূল বক্তব্য কী?
“আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির যৌক্তিকতা কতখানি? যেখানে, এর রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশ চেতনার বিরোধী ছিলেন, বা বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গের উন্নতির বিরুদ্ধপক্ষ মানুষ ছিলেন। কেননা-
১। তিনি বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা নিয়েছিলেন।
২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে কলকাতায় আয়োজিত সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৩। আমাদের স্বাধীনতা হরণকারী ব্রিটিশদের তাবেদার ছিলেন। কেননা, তিনি জনগণমন ভাগ্যবিধাতা গানটি রচনা করেছিলেন সাদা চামড়ার স্তুতির উদ্দেশ্যে।

উপরের তিনটি ঘটনাকে একটু বিশ্লেষণ করা যাক-
১। বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকাঃ
বঙ্গভঙ্গের ঘটনার সাথে বাংলাদেশ চেতনার কোন সম্পর্কই নেই, যেমনটি নেই বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনের সাথে বাংলাদেশ চেতনার বিরোধিতার। এটা ঠিক যে, পূর্ববঙ্গের মুসলিম উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণীর তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে ছিল, কেননা- তারা মুসলিমদের আগে থেকেই ইংরেজী শিক্ষার দিকে ঝুকেছিল এবং বণিকী পেশাতেও তারা অগ্রজ ছিল। ফলে, ইংরেজরা যখন ডিভাইড এণ্ড রুল এর নীতিতে বঙ্গভঙ্গ করলো- ঐ হিন্দু বুর্জোয়া অংশ স্বভাবতই তার বিরোধীতা করে। এবং মুসলিম অংশটিকে গোষ্ঠী স্বার্থেই ইংরেজরা পক্ষে পায়। তবে, এই অংশদুটির বাইরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দুই বঙ্গের অনেক উদারমনা ব্যক্তিই এই বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করেছিল এই জায়গা থেকে যে, প্রথমত ইংরেজরা প্রথমবারের মত সাফল্যের সাথে হিন্দু-মুসলিমে বিভেদ টানতে সক্ষম হয়, যা স্পষ্ট হয় পরবর্তি দাঙ্গায়, [যার চুড়ান্ত ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মকেন্দ্রিক পাকিস্তান নামক হাস্যকর রাষ্ট্রটির উদ্ভব]; এবং দ্বিতীয়ত- অবিভক্ত বাংলার স্বপ্নচারী ও অভ্যস্ত মানসিকতায় ইংরেজ কর্তৃক নির্মম আঘাতের কষ্ট।
এটা পরিস্কার যে,
– এই বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনাকারী ইংরেজরা,
– মুসলিম লীগের উৎত্তির পেছনেও তাদের ভূমিকা ছিল
– এ উপমহাদেশে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন ছিল- এবং
– হিন্দু ও মুসলিমকে বিভক্ত করাও প্রয়োজন ছিল; বেশীদিন এখানে তাদের শাসন-নির্যাতনের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদেই।

আমার “বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমান” শীর্ষক পোস্টে বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছিলামঃ

বাঙলাদেশ, বিহার ও উড়িষ্যার একটি প্রদেশ হিসাবে থাকার প্রশাসনিক দিক থেকে অনেক অসুবিধা ছিলো একথা সত্য। কাজেই সেই বিশাল প্রদেশকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুনভাবে গঠন করা কোনো দোষের ব্যাপার ছিলো না। বৃটিশ ভারতীয় সরকার প্রধানত এই কারণটিকেই বঙ্গভঙ্গের মূল যুক্তি হিসাবে উপস্থিত করেছিলো। কিন্তু প্রদেশ পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও সেটাই যে বঙ্গভঙ্গের মূল কারণ ছিলো না তা বৃটিশ সরকার ও বৃটিশ ভারতীয় সরকারের বিভিন্ন নীতি, সরকারী ভাষ্য এবং দলিলপত্র থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়। বঙ্গ বিভাগের আসল কারণ ছিলো রাজনৈতিক। রিজলির নোটে আমরা দেখি, “ঐক্যবদ্ধ বাঙলা একটি শক্তি। …. আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো তাকে বিভক্ত করা এবং এভাবে আমাদের শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদের দুর্বল করে তোলা”। ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরের সময় লর্ড কার্জন খুব পরিস্কারভাবে বলেন, “বাঙালীরা যারা নিজেদেরকে একটি জাতি হিসাবে চিন্তা করতে ভালোবাসে এবং যারা এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যেখানে ইংরেজদেরকে বিতাড়িত করে একজন বাঙালী বাবু কলকাতার গভর্মেন্ট হাউজে অধিষ্ঠিত হবে, তারা অবশ্যই সেই ধরণের যেকোন ভাঙ্গনের বিরুদ্ধে তিক্ত মনোভাব পোষণ করে যা তাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বাঁধাস্বরূপ। এখন তাদের চিতকারের কাছে নতি স্বীকার করার মত দুর্বল হয়ে পড়লে আমরা আর কখনো বাঙলাকে বিভক্ত অথবা ছোট করতে সক্ষম হবো না এবং তার দ্বারা আপনারা ভারতের পূর্বদিকে এমন একটা শক্তিকে জমাটবদ্ধ ও কঠিন করবেন যে শক্তি ইতোমধ্যেই অপ্রতিরোধ্য হয়েছে এবং যা ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলার নিশ্চিত উৎস হিসেবে বিরাজ করবে”

একই পোস্টে আমরা দেখতে পারবো যে- ইংরেজদের এই দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে পূর্ববঙ্গেরও অনেক মুসলমান নেতাও এই বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছেন। বাস্তবে, সেই ১৯০৫-১১ সালে পূর্ববঙ্গ বলে আলাদা কোন রাষ্ট্র ছিল না, এমনকি রাষ্ট্রীয় কোন চেতনাও ছিল না- যেটির সাথে ১৯৭১ এ সৃষ্টি হওয়া বাংলাদেশ এর চেতনার বা ১৯৪৭ সাল থেকেই পাকিস্তানের শাসন শোষণের ফলে জন্ম নেয়া জাতীয়তাবোধের যে উন্মেষ হয়, যে স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত কিংবা স্বাধীন- সার্বভৌম ভূখন্ড কেন্দ্রিক চেতনার উন্মেষ হয়- সেরকম কোন চেতনার মিল পাওয়া যাবে। পূর্ববঙ্গ ভারতবর্ষের একটি অঞ্চলমাত্র ছিল- সেটিকে কেন্দ্র করে চেতনা বলতে বড়জোর আঞ্চলিক সুযোগ সুবিধার সংযোগ থাকতে পারে- উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে- এটি অনেকটা আজকের বগুড়া- রাজশাহী- নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন, অমুক তমুক জেলা বাস্তবায়ন, অমুক তমুক উপজেলা বাস্তবায়নের সাথে মিল পাওয়া যেতে পারে! ফলে, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সাথে পূর্ববঙ্গের অবনতি কামনার যেমন কোন সংযোগ নেই- তেমনি এখানে বাংলাদেশ চেতনার বিরোধিতার কষ্ট কল্পনারও কোন বাস্তবভিত্তি নেই।

এখানে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ এ প্রবলভাবে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন, কলকাতার হিন্দু- মুসলমানদের মিলনের লক্ষে রাখী বন্ধনের আয়োজন করেছিলেন (কেননা, বঙ্গভঙ্গ তার কাছে ইংরেজ কর্তৃক বাংলার হিন্দু মুসলমানে ভেদ তৈরির চক্রান্ত ছাড়া কিছুই ছিল না), সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই কিন্তু পরে একইভাবে সোচ্চার থাকেননি। এমনকি তাঁর এই উপলব্ধিও হয়েছিলো যে, ইংরেজরা যে উদ্দেশ্যেই বঙ্গভঙ্গ করুক- প্রশাসনিক দিক থেকে দুই বাঙলা হলে পূর্ব অংশের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ দুঃখী কৃষক মুসলমানদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর পথ তৈরি হয়। এগিয়ে থাকা হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতা দেখে তাঁর আত্মোপলব্ধিঃ

“মুসলমানরা কেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যোগ দেবে? আমরাইতো তাদের হৃদয়কে এক হতে দেইনি”।

সুতরাং, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের যুক্ত হওয়ার মাঝে কোন সমস্যা দেখি না। এই সময়কালে লেখা ‘আমার সোনার বাংলা” গানটির “বাংলা” আজকের বাংলাদেশ নয় এটা ঠিক, কিন্তু এই “বাংলা” কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয়, কিংবা পূর্ববঙ্গ বিরোধীও নয়। বরং অখণ্ড বাংলা। বাঙালির বাংলা। যে বাঙালির বাংলাকে আমরা আবারো খুজে পেয়েছিলাম পাকিস্তান পর্বে। গানটির ব্যাপারে আরো কিছু আলাপ করার ইচ্ছে রইলো এই পোস্টের শেষাংশে।

২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাঃ
“১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়”- এই অভিযোগ সহজেই উড়িয়ে দেয়া যায় এই তথ্যটি দিয়ে যে- ঐ জনসভায় বস্তুত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপস্থিতই ছিলেন না, তিনি ঐ সময়ে শিলাইদহে অবস্থান করছিলেন, অর্থাৎ অভিযোগটি সর্বৈব মিথ্যা। ১৯১২ সালের ১৯ মার্চ রবীন্দ্রনাথের কলকাতা থেকে ইংল্যান্ড এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করা কথা ছিল, জাহাজের কেবিন পর্যন্ত ভাড়া করা হয়েছিল, কিন্তু যাত্রার দিন সকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার যাত্রা বাতিল করা হয়। ২৪ মার্চ তারিখে তিনি বিশ্রামের উদ্দেশ্যে শিলাইদহে রওনা হন। ২৮ মার্চের গড়ের কথিত জনসভাটি যখন হয়- সে সময়ে তিনি ছিলেন শিলাইদহে। তিনি কলকাতায় ফিরেন ১২ এপ্রিল।

এই মিথ্যা তথ্যটিকে তাই পাশে রেখে দুটো প্রশ্নের সন্ধান করতে চাই। প্রথমত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা যারা করেছেন (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি করেও থাকেন এবং অন্যরা)- তবে সেটি বাংলাদেশ চেতনার পরিপন্থী কি না, এবং আদৌ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন কি না!

প্রথম প্রশ্নের জবাবে এটাই বলবো- ঢাকা কিন্তু তখন বাংলাদেশের রাজধানী নয়, ফলে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধীতার সাথে বাংলাদেশ চেতনার কোন সম্পর্কই থাকতে পারে না। একটি উদাহরণ দেই- ধরেন এই মুহুর্তে পদ্মাসেতুর একটি সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে। এখন কোথায় এই সেতু নির্মিত হবে সেটা নিয়ে দুদল লোক এলাকাগত সুবিধার ভিত্তিতে একদল মাওয়া আরেকদল পাটুরিয়ায় সেতু নির্মাণের দাবি করলো। সে দাবিতে- পাটুরিয়ায় সেতু নির্মিত হলে যারা লাভবান হবেন তারা সমাবেশ করলো- মাওয়ায় সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে। সেক্ষেত্রে কি বলা যেতে পারে? আমরা এটুকুই বলতে পারি পাটুরিয়ার লোকজন দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবতে ব্যর্থ হয়েছে, কেননা মাওয়া সেতু হলেই সবদিক থেকে মঙ্গল। কিন্তু বাংলাদেশ যদি দুটুকরা হয়ে দুটি দেশ হয় যার একদিকে মাওয়া আর দিকে পাটুরিয়া তবে মাওয়ার দিকের লোকজন কি দাবি করবে- অমুক ঐ সমাবেশে মাওয়া সেতুর বিরোধিতা করেছিল- সেজন্য সে আমাদের এই দেশের চেতনা পরিপন্থী?

১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বরে বঙ্গভঙ্গ রদের এবং কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী সরিয়ে দিল্লীতে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে পূর্ববঙ্গের ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও ঘোষণা দেয়া হয়। এই তিনটি ঘোষণায় এমনটি মনে করার যৌক্তিক কারণ ছিল যে, প্রথম ঘোষণা অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ রদের শাস্তি স্বরূপ কলকাতা থেকে দিল্লীতে রাজধানী সরিয়ে নেয়া হলো এবং পূর্ববঙ্গের জনগণকে পুরস্কার (উপঢৌকন) স্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেয়া হলো। বাস্তবে সে সময়ে ঢাকায় বা পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্যে সেভাবে দাবী উত্থাপিত হয়নি, বরং কাশীতে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং আলীগড়ে মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্যে দীর্ঘদিন ধরে দাবী উত্থাপিত হয়ে আসছিলো। ফলে, স্বভাবতই হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্যে যারা কাজ করছিলেন- তারা হঠাৎ করে ঢাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। গড়ের মাঠের প্রতিবাদ সভাটি বাস্তবে তাই যতখানি না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরুদ্ধে- তারও চাইতে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবীতে। বাস্তবে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতার জায়গাটিও ছিল- দাবীকৃত ও প্রত্যাশিত হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে কোন ঘোষণা না এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণার মধ্য দিয়ে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে একটি অনিশ্চিয়তা থেকে। ফেব্রুয়ারি মাসেই ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ বরাবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে স্মারকলিপি দেন। এই রাসবিহারী ঘোষ ছিলেন হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবীর পক্ষের লোক। হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবীতে ১৯১১ সালের দুটো সভায় তিনি সভাপতিত্বও করেন, যার একটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য প্রদান করার কথা ছিল- অসুস্থতার কারণে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। এর বাইরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, সেটিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে আশংকার কারণে, অর্থাৎ বরাদ্দ কমে যাবে- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিপত্তি কমে যাবে (পূর্ববঙ্গের কলেজগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল)। তীব্র বিরোধী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জও তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন,

“কী মূল্যে অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন?”

তিনি চেয়েছিলেন- চারটি নতুন অধ্যাপক পদ। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন বিরোধিতার জায়গাগুলো কি ছিল, কেমন ছিল! বুঝতে না পারলে আরেকটি তথ্য উল্লেখ করা যায়, এই তীব্র বিরোধিতাকারী উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে সহযোগিতা করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপককে ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। এ কাজে তাঁর পাশে কে ছিলেন জানেন? অভিযোগকৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে জনসভার সভাপতি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যে গল্পে পরে আসছি, তার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার আরো কিছু ইতিহাস জেনে নেয়া যাক, যেগুলো নানা সময়েই উহ্য রাখা হয়।

আলীগড়ে প্রস্তাবিত বা দাবীকৃত মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবী যারা করছিলেন- সেই মুসলমান নেতৃত্বও কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিল। তাদের বিরোধিতার কারণও হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবীদার হিন্দু নেতৃত্বের অনুরূপ। বাস্তবে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবী ওঠারও অনেক আগে মুসলমানদের জন্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবী উঠেছিল। স্যার সৈয়দ আহমেদ প্রথম এর পরিকল্পনা করেছিলেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, বৃটিশ সাম্রাজ্যের সকল মুসলমানের শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে একে গড়ে তোলা হবে – এরকম পরিকল্পনা থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে অর্থসংগ্রহও করা হয়। ফলে, ১৯১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা দেয়া হলে- তারাও ভালোভাবে নিতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখলেও- এটি তাদের সেই স্বপ্নের মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয় হবে না। ফলে- তাদের নাখোশ হওয়ার যথেস্ট কারণ ছিল। এছাড়া, খোদ পূর্ববঙ্গের ও পশ্চিমবঙ্গের অনেক শিক্ষানুরাগী মুসলমান, এবং কোন কোন মুসলমান নেতৃত্বও এই ঘোষণায় হকচকিয়ে গিয়ে কিছু আশংকার অর্থে এর বিরোধিতা করেন। তাদের একটা বড় অংশের মত ছিল, পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার হার এতই কম যে- এরকম বিশ্ববিদ্যালয় খুব বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে না, বরং অধিক সংখ্যায় প্রাথমিক শিক্ষা ও হাই স্কুল নির্মাণ করে শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা নেওয়া দরকার।

এবারে, দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবটি খুজা যাক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি আদৌ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও সেসময়ে শান্তিনিকেতন নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা ছিল- সেটা তাঁর বিশেষ স্বপ্ন ছিল। যে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে, সেই একই বছর অর্থাৎ ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েরও যাত্রা শুরু হয়। ফলে, এই বিশ্বভারতীর স্বপ্নের জায়গা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা না চাওয়া, বিরোধিতা করা- খুব বেশি অস্বাভাবিক ছিল না। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কিংবা ড. রাসবিহারী ঘোষের মত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নামলে- খুব বেশি অপরাধ হতো বলে আমি মনে করি না। কিন্তু, অবাক ব্যাপার হচ্ছে- এরকম কোন বিরোধিতার কোন কথা রবীন্দ্রনাথের কোন বক্তব্যে, কোন প্রবন্ধে, কোন চিঠিতে- কোন জায়গাতেই পাই না। স্মারকলিপি দেয়া বা সভা- সমাবেশ করা আন্দোলন করা তো দূরের কথা! অভিযোগকারীরা এক মিথ্যা, কল্পিত জনসভার সভাপতিত্ব করার গল্প করেন- কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঐ জনসভায় কিংবা অন্য কোন সভায় , নিদেন কোন লেখায়- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে একটা বাক্য কখনো হাজির করতে পারেনা; বহুল চর্বিত ও চর্চিত- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বিরোধিতার গল্পটি বিশ্বাস করার লোকের অভাব নাই। এমনকি, ঐ জনসভার সময়ে তিনি কলকাতাতেই ছিলেন না- এটি দেখিয়ে দেয়ার পরেও অনেকে বলেন- হ্যাঁ তিনি জনসভায় থাকেন নি- এটা ভুল তথ্য ঠিক আছে, কিন্তু এটা তো আর মিথ্যা না যে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চাননি। মনে মনে তিনি চেয়েছেন কি চান নি- সেটা আজকে বসে বের করতে বললে মাফ চেয়ে বলবো- তিনি প্রকাশ্য এমন কোন ভূমিকা কি রেখেছেন বা এমন বক্তব্য দিয়েছেন- যেটির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা প্রমাণ করা যায়, কিংবা তিনি যে চাননি- সেটি প্রমাণ হয়? তেমন কিছু যদি না পাওয়া যায়, তবে মনে মনে চাওয়া না চাওয়ার দাবিরই কি মানে আছে? উল্টোদিকে- আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু ভূমিকার কথা, এমন কিছু বক্তব্য জানি- সেখান থেকে নিঃসন্দেহে বলতে পারি- তাঁর পক্ষে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয়েরও বিরোধিতা করা সম্ভব ছিল না, বাস্তবে কোন বিশ্ববিদ্যালয়- কোন বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠারই বিরোধিতা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

১৯১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বরে কাশীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবীতে যে সভা হয়েছিল, সেখানে বক্তা হিসেবে উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। অনেক সময়ে এই সভাটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে জনসভার সাথে অনেকে গুলিয়ে ফেলেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্ব করার কোন কথাই ছিল না, সভাপতিত্ব করেছিলেন ড. রাসবিহারী ঘোষ। ১৯১১ সালের এই সভাটি যখন হয়েছে- তখনো ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কোন ঘোষণা আসেনি, ফলে এই সভা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার কোন প্রাসঙ্গিকতাই ছিল না। হ্যাঁ, সে সময়ে আলিগড়ের মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর্থকদের মাঝে পারষ্পরিক বিরোধিতা ও প্রতিযোগিতা ছিল। সে জায়গা থেকে এই সভার আয়োজকদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সেই মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করা। কিন্তু, এই সভায় উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেয়ার ব্যাপারে সম্মত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতাকারী ছিলেন- এভাবে অনেকে বিবেচনা করেন। কিন্তু, এরকম বিবেচনার কোন রকম কারণই নেই; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে সভায় উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব বক্তব্য ও অবস্থান নিয়েই, যা কোনভাবেই আয়োজকদের বক্তব্য, দাবী ও অবস্থানের সাথে মেলে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসুস্থতার কারণে উপস্থিত থাকতে না পারলেও পরবর্তীতে “হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়” শীর্ষক প্রবন্ধে এ সংক্রান্ত তাঁর চিন্তা বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি খুব শক্তভাবে মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেও কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেনঃ

“আজ আমাদের দেশে মুসলমান স্বতন্ত্র থাকিয়া নিজের উন্নতি সাধনের চেষ্টা করিতেছে। তাহা আমাদের পক্ষে যতই অপ্রিয় এবং আমাদের যতই অসুবিধা হউক, একদিন পরস্পরের যথার্থ মিলন সাধনের ইহাই প্রকৃত উপায়”।

বলেছেন-

“আধুনিক কালের শিক্ষার প্রতি সময় থাকিতে মনোযোগ না করায় ভারতবর্ষের মুসলমান হিন্দুর চেয়ে অনেক বিষয়ে পিছায়ইয়া রহিয়াছে। সেখানে তাহাকে সমান করিয়া লইতে হবে। … এই বৈষম্যটি দূর করিবার জন্য মুসলমান সকল বিষয়েই হিন্দুর চেয়ে বেশি দাবি করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহাদের এই দাবিতে আমাদের আন্তরিক সম্মতি থাকাই উচিত। পদ-মান-শিক্ষায় তাহারা হিন্দুর সমান হইয়া উঠে, ইহা হিন্দুর পক্ষেই মঙ্গল।”

তিনি আশা করেছেন,

“নিজেদের স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রভৃতি উদযোগ লইয়া মুসলমানরা যে উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছেন তাহার মধ্যে প্রতিযোগীতার ভাব যদি কিছু থাকে তবে তাহা স্থায়ী ও সত্য নহে।”

হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্বার্থে মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা প্রসঙ্গে তিনি বলছেন,

“নিজের গুণে ও শক্তিতেই আমরা নিজের স্থায়ী মঙ্গল সাধন করিতে পারি। যোগ্যতালাভ ছাড়া অধিকারলাভের অন্য কোনো পথ নাই। এই কথাটা বুঝিবার সময় যত অবিলম্বে ঘটে ততই শ্রেয়ঃ। অতএব অন্যের আনুকূল্যলাভের যদি কোনো স্বতন্ত্র সিধা রাস্তা মুসলমান আবিষ্কার করিয়া থাকে তবে সে পথে তাহাদের গতি অব্যাহত হউক। সেখানে তাহাদের প্রাপ্যের ভাগ আমাদের চেয়ে পরিমাণে বেশি হইতেছে বলিয়া অহরহ কলহ করিবার ক্ষুদ্রতা যেন আমাদের না থাকে। পদ-মানের রাস্তা মুসলমানের পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে সুগম হওয়া উচিত। সে রাস্তার শেষ গম্যস্থানে পৌঁছাইতে তাহার কোনো বিলম্ব না হয় ইহাই যেন আমরা প্রসন্ন মনে কামনা করি”।

অনেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হিন্দুদের প্রতিনিধি বানিয়ে সাম্প্রদায়িক জায়গা থেকেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষার বিরোধিতা করেছেন- এভাবে উপস্থাপন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে এরকম কোন বিরোধিতা করেননি- সেটি উপরে আলোচনা করেছি, কিন্তু তিনি কিরূপ হিন্দুদের প্রতিনিধি ছিলেন, সেটিও একটু করে বলে রাখি। তিনি এই হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পক্ষে ছিলেন, কেননা তিনি মনে করেন

“আমরা এতদিন পুরোপুরি পাশ্চাত্য শিক্ষা পাইতেছিলাম। এ শিক্ষা যখন এদেশে প্রথম আরম্ভ হইয়াছিল তখন সকল প্রকার প্রাচ্যবিদ্যার প্রতি তাহার অজ্ঞতা ছিল। তাহার পূর্ব মহলের সন্তানেরা পশ্চিম মহলের দিকের জানালা বন্ধ করিয়াছে এবং পশ্চিম মহলেরা পুবের হাওয়াকে জঙ্গলের অস্বাস্থ্যকর হাওয়া জ্ঞান করিয়া তাহার একটু আভাসেই কান পর্যন্ত মুড়ি দিয়া বসিয়াছে”।

ফলে, তিনি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছেন, যেখানে পাশ্চাত্য জ্ঞানের সাথে সাথে আমাদের নিজেদের, অর্থাৎ প্রাচ্যের জ্ঞানও সমান গুরুত্ব পাবে। কিন্তু, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বলতে তিনি কখনো কেবল হিন্দু জাতির জন্যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় চাননি, সেরকম কুপমন্ডুক কোন প্রতিষ্ঠান তিনি চাননি।

“সেটা করা হলে বড়োজোর একটা বড়োসড়ো টোল হবে। সেখানে শাস্ত্রপাঠ ছাড়া আর কিছুই হবে না”।

সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের সমালোচনা করে তিনি বলেছেন,

“তারা পঞ্জিকার পাতায় সংক্রান্তির ছবির মতো স্নান-জপ-ব্রত-উপবাসে কৃশ ও জগতের সবকিছুর সংস্পর্শ পরিহার করে অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে থাকে। এদের জন্য হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হলে বিপদের আশঙ্কা আছে। এই উচ্চমার্গের হিন্দু একটি কূপমন্ডূক সাম্প্রদায়িক হিন্দু। তারা সমুদ্র পার হতে বাধা দেয়, বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে নিরুৎসাহিত করে। তারা অন্য সম্প্রদায়কে গ্রহণ করতে পারে না। মুসলমানের ছোঁয়া দুধ বা খেজুরের রস বা গুড় খেলে সেই হিন্দু অপরাধবোধ করে না, কিন্তু জল খেলেই অপরাধবোধ করে। ইংরেজের প্রস্ত্তত মদ খেলে তাদের জাত যায় না, কিন্তু ভাত খেলেই জাত থাকে না। এ-প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগও তারা দিতে রাজি নয়। যদি কেউ করে বসে, তাহলে তাদের ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দেয়, তাদেরকে সমাজচ্যুত করে। এ-হিন্দু তার প্রতিবেশী মুসলমানদেরকে শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ দিতে আগ্রহী নয়। তাকে কেবল সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার বলে ব্যবহার করতে চায়। নমশূদ্রকে পায়ের ধুলোর সমান গণ্য করে। সুতরাং এই প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুর জন্য আলাদা হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় করার চেষ্টা হলে তা আরো বড়ো ধরনের হিংস্রতার জন্ম দিতে পারে”।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন এমন একটি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় যেটি হিন্দু সম্প্রদায়কে হিন্দু সমাজের দিকে ফিরিয়ে নিতে পারে। তিনি হিন্দু সমাজ বলতে বুঝেছেন- সেই হিন্দু সমাজ যা সকলকে গ্রহণ করতে পারে। তিনি বলেছেন,

“একদিন এই হিন্দু সভ্যতা সজীব ছিল, তখন সে সমুদ্র পার হইয়াছে, উপনিবেশ বাঁধিয়াছে, দিগ্বিজয় করিয়াছে, দিয়াছে এবং নিয়াছে; তখন তাহার শিল্প ছিল, বাণিজ্য ছিল, তাহার কর্মপ্রবাহ ব্যাপক ও বেগবান ছিল, তখন তাহার ইতিহাসে নব নব সত্যের অভ্যুত্থান, সমাজবিপ্লব ও ধর্মবিপ্লবের স্থান ছিল; তখন তাহার স্ত্রীসমাজেও বীরত্ব, বিদ্যা ও তপস্যা ছিল, তখন তাদের আচার-ব্যবহার চিরকালের মতো লোহার ছাঁচে ঢালাই করা ছিল না”।

এই হিন্দু সমাজের ছিল প্রাণের ধর্ম, বিকাশের ধর্ম, পরিবর্তনের ধর্ম, নিয়ত গ্রহণ-বর্জনের ধর্ম। এই হিন্দু সমাজ মুসলমান ও খ্রিষ্টানকেও তাদের সমাজের বাইরে নয়, অঙ্গ বলে নিতে সমর্থ ছিল। সে জায়গা থেকে তিনি প্রস্তাবিত হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান মনীষীদের পাঠও অন্তর্ভূক্ত করার আহবান করেছিলেন।

এ প্রসঙ্গের আলোচনাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতার অভিযোগের বিপরীতে দুটো তথ্য দিয়ে শেষ করছি। ঢাকায় যখন এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়ে যায়, তখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের মত উপযোগী শিক্ষক পাওয়া বড় রকমের সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিল। কলকাতা ছিল কেবল বাংলার কেন্দ্রস্থল নয়- ভারতের সাবেক রাজধানী হিসেবে তখন সমগ্র ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। সেখান থেকে পূর্ববঙ্গের পশ্চাদপদ ঢাকা শহরে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই ছিলেন অনিচ্ছুক। এ ব্যাপারে খুব কার্যকরী ভূমিকা রেখেছিলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে স্মারকলিপি দেয়া উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ১৯১৯-২১ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার নীলরতন সরকার এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ নিজে কলকাতার বিভিন্ন নামীদামী শিক্ষককে অনুরোধ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভার নেয়ার জন্যে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন বসুকে নিজে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন। আরেকটি তথ্যও গুরুত্বপূর্ণ, ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে আসেন এবং বিপুল অভ্যর্থনা লাভ করেন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কারণে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথিত কল্পিত বিরোধিতার অভিযোগে আজ যারা মাতম করছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাংলাদেশ চেতনার বিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করছেন, তাদের উদ্দেশ্যে সেরকম অভ্যর্থনায় পূর্ববঙ্গের হাজার হাজার মানুষের সমাগমের সামনে পঠিত মানপত্রের অংশ বিশেষ উল্লেখ করছি। ঢাকা রেটপেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন মানপত্রে বলেন,

“লর্ড কার্জন বাহাদুরের শাসনকালে বঙ্গবিভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ যখন পশ্চিবঙ্গ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল তখন সেই কূটনীতির বিরুদ্ধে আপনি কাব্যে ও সংগীতে যে ভীষণ সংগ্রাম ঘোষণা করিয়াছিলেন তাহাও আজ স্মরণপথে উদিত হইতেছে”।

আর মুসলিম হল ছাত্রবৃন্দ মানপত্রে বলেন যে,

“বিধাতা বড় দয়া করিয়া, প্রাণহীন ভারতের দুর্দিনে তোমার মতো বিরাট-প্রাণ মহাপুরুষকে দান করিয়াছেন। তোমার প্রাণ মুক্ত, বিশ্বময়। সেখানে হিন্দু নাই, মুসলমান নাই, খৃষ্টান নাই, আছে মানুষ। একদিকে তুমি মানুষকে নানা কর্মধারায় জাগ্রত করিয়াছ, অন্যদিকে সেই অসীম স্রষ্টার দিকে মনকে আকৃষ্ট করিয়াছ। ‘কর্ম ও ধ্যান’ উভয়ের সামঞ্জস্যসাধনই মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ আদর্শ। ইসলামের এই সারবার্তা তোমার ছন্দে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। তোমার এই ছন্দ আমাদিগকে প্রতিদিন বিশ্বের কল্যাণ সাধনে ও মানুষের সেবায় উদ্বেধিত করুক”।

৩। স্বাধীনতা হরণকারী ব্রিটিশদের তাঁবেদারঃ এটা ঠিক যে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের আপোষকামী অংশের প্রতিনিধি। উঠতি বুর্জোয়া, জমিদার শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দল কংগ্রেসও তাই। মুসলি লীগও তাই। সূর্যসেন- ক্ষুধিরাম- ভগত সিং- প্রীতিলতা- পরবর্তীতে সুভাষ বোস – এনাদের বিপ্লবী ধারার বিপরীতে কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল ব্রিটিশদের সাথে আপোষ-লড়াই-সুবিধা আদায়-আপোষ- নীতিতে চলা এক রাজনৈতিক সংগ্রাম। যার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি ব্রিটিশদের দান করা পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র- এ আমাদের লজ্জা যে, আমরা ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে পারিনি- এ লজ্জা আমাদের দান করেছে কংগ্রেস তথা মহাত্মা গান্ধী ও নেহরু- মুসলিম লীগের জিন্নাহরা; যদিও অগ্নিপুরুষ ঐ বিপ্লবীদের কারণেই ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল- তাই এ লজ্জা আমাদের কিছুটা লাঘবও হয়।

যাহোক, যা বলছিলাম- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপোষকামী অংশের প্রতিনিধি- ফলে ওনার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে এই সংগ্রাম ও আপোষ উভয়েরই সংমিশ্রন পাওয়া যায়। কিন্তু, তাকে ব্রিটিশদের তাঁবেদার বলাটা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষজাত। বৃটিশদের কাছ থেকে কখনোই অন্যায় সুবিধে নেন নি, বরং নাইটহুড উপাধি পায়ে ঠেলে দিতে কুন্ঠা তিনি করেননি। মনে রাখবেন, জালিয়ানওয়ালাবাদের ঘটনায় কংগ্রেস তথা গান্ধীও এত তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়নি। “স্যার” নবাব সলিমুল্লাহ যেভাবে উপঢৌকন নিয়ে বঙ্গভঙ্গের বিশাল সমর্থক বনে গিয়েছিলেন- মুসলিম লীগ- কংগ্রেস নেতারা যেভাবে বৃটিশ শাসকদের সাথে নিজ স্বার্থে দেন দরবার করেছেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনো তা করেননি। হ্যাঁ, রাজনৈতিক দিক দিয়ে তিনি কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন, কংগ্রেসীয় পন্থায় বৃটিশদের সাথে আলাপ- আলোচনার মধ্য দিয়ে দাবী উত্থাপন করা, নানা দাবী আদায় করা, এবং এভাবে আপোষের পথে এমনকি স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব বলে মনে করতেন। কিন্তু এমনটা বলা যাবে না যে, তিনি কংগ্রেসের সমস্ত কিছুর সাথে একমত ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি বৃটিশ শাসকদের সরাসরি সমালোচক ছিলেন। এমনকি, স্বদেশী আন্দোলনের বিপ্লবীদের অনেকের সাথে তাঁর যোগাযোগ, সমর্থনের কথাও জানা যায়।

হ্যাঁ, তাঁর সাহিত্যকর্মে আমরা বৃটিশ বিরোধী তীব্র বক্তব্য, পরাধীনতা থেকে মুক্তির তীব্র আকাঙ্খা, স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন, এসবের ছোঁয়া কম পাই। তাঁর সাহিত্যে যে দেশ প্রেম আছে, মানব প্রেম আছে, যে সংবেদনশীলতা আছে- সেখানে বৃটিশ শাসনের অভিঘাতে জনগণের দুর্দশার কথা কম দেখি। ব্যক্তি মানুষের সমস্যা, ভারতের পিছিয়ে থাকা সমাজের নানা সমস্যা সংকটের যে বিবরণ আছে- সে তুলনায় ভারতের রাজনৈতিক জীবন উহ্যই থেকেছে। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে রাজনৈতিক জীবন এসেছে- স্বদেশী আন্দোলনের সমালোচনামূলক দৃষ্টি থেকে। এই সমালোচনায় আপত্তি দেখি না, কিন্তু বৃটিশরাজের বিরুদ্ধে সাহিত্য তিনি রচনা যে করেননি- এটি অস্বীকার করতে পারি না। এ সমালোচনার জায়গাটি স্বীকার করেও বলতে পারি যে, পরাধীন ভারতবর্ষের সামাজিক জীবন তাঁর সাহিত্যে পরম মমতায় প্রতিফলিত হয়েছে, ব্যক্তিমানবের বিকাশে তাঁর সাহিত্যের অবদান অনস্বীকার্য। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষায় বলিঃ

“বাংলাদেশেও ব্যক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে। এবং শক্তসমর্থ ব্যক্তিগঠনে এই গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। রবীন্দ্রনাথের গান মানুষকে বিপ্লবের দিকে উদ্বুদ্ধ করবে না। কিন্তু শক্তসমর্থ ব্যক্তিগঠনে রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষমতা অসাধারণ। শক্ত মানুষের সমবেত শক্তি মানববিরোধী অচলায়তন ভাঙার অন্যতম প্রেরণা তো বটেই”।

বাংলা ভাষা, বাঙালি সংষ্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথঃ
হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলি,

“আকাশে সূর্য ওঠে প্রতিদিন, আমরা সূর্যের স্নেহ পাই সারাক্ষণ। সূর্য ছাড়া আমাদের চলে না। তেমনি আমাদের আছেন একজন, যিনি আমাদের প্রতিদিনের সূর্য। তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮৬১-১৯৪১]। তিনি আমাদের জীবনে সারাক্ষণ আলো দিচ্ছেন। তিনি বাঙলা ভাষার সবার বড় কবি। তাই নয় শুধু, তিনি আমাদের সব। তিনি কবিতা লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, নাটক রচনা করেছেন, গান লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি কি লেখেন নি? তিনি একাই বাঙলা সাহিত্যকে এগিয়ে দিয়ে গেছেন কয়েকশো বছর। আজ যে বাঙলা সাহিত্য বেশ ধনী- তার বড় কারণ তিনি”।

কিন্তু তিনি শুধু বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি নন, বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানীও। তিনি তাঁর সৃষ্টির মাঝে বাংলাকে যেন নবপ্রাণ দান করেন। ভাষাকেই করে তুলেন সমৃদ্ধ।

সংক্ষেপে ইতিহাসটা একটু বলি। চর্যাপদ এর কালে বাঙলা ভাষা ছিল খুবই অবিকশিত। ১৮০১ সালে শুরু হয় আধুনিক বাঙালির বাংলা গদ্যের ধারা। কেরি, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামমোহন রায়, অক্ষয়কুমার দত্ত এবং আরো অনেকের শ্রমে ক্রম বিকশিত হয় সাধুভাষা। ১৮৬০ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষায় সাধুরীতি স্থির মানরূপ লাভ করে। এরপরে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও আরো অনেকে সাধুরীতির বাংলায় নিয়ে আসেন আরো অনেক বৈচিত্র। তবে রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব অন্যখানে। তা হলো চলতি বাংলা। প্যারীচাঁদ মিত্র ও প্রমথ চৌধুরীর পথ ধরে যখন রবীন্দ্রনাথ গদ্যরীতি হিসাবে চলতি রীতিতে লেখা আরম্ভ করেন- তখন থেকেই কিন্তু চলতি রীতিই মান ভাষা, বাংলা ভাষা। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁর ভাষাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে। তাই তিনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সন্তান।

শুধু সাহিত্য ও ভাষার ক্ষেত্রেই নয়- রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রভৃতির মাধ্যমে বাঙালির মনন, রুচি, সংস্কৃতিও তৈরি করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। ফলে, আমাদের ভাষা কেন্দ্রিক যে জাতীয়তা বোধ- সেই বাঙালি জাতিয়তাবোধই অসম্পূর্ণ থেকে যায় রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে।

কেন ও কিভাবে সোনার বাংলা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত?
পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা থেকে যায়- মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা নেতা জিন্নাহর হাত ধরে। যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব- সেখানে পূর্ব ও পশ্চিম দুটি অংশের মধ্যে একমাত্র মিল ধর্ম- ইসলাম।

পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই আঘাত হানে আমাদের বাংলা ভাষার উপর। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেয়ার চেস্টা করা হলো। মূল কারণ ঐ ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সৃষ্টি। ভারতের এক বড় অংশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা, এই ভাষার উৎপত্তি- বিকাশে বড় ভূমিকা বিভিন্ন হিন্দু কবি- সাহিত্যিকদের, তদুপরি পূর্ববঙ্গের মানুষদের সাথে সমস্ত দিক দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের সাথে আত্মিক যোগাযোগ যুগযুগ ধরেই অনেক ভালো ছিল। ফলে, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী প্রথম থেকে এখানকার লোকদের ভাষা, কৃষ্টি- কালচারকে ভালো নজরে দেখতে পারেনি- যা তাদের চোখে হয়ে দাঁড়ায় হিন্দুয়ানি। বাংলাকে তারা দেখেছিল হিন্দুর ভাষা হিসাবে। ফলে খড়গ নেমে আসে ভাষার উপরে- তৈরি হয় বায়ান্নো।

এই ভাষার লড়াই করতে গিয়ে অনন্য এক অভিজ্ঞতা হয় বাংলার। আগের বাংলা থেকে তার একটি পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়। এবারে বাংলা পায় একটি লড়াই এর চেতনা। ভাষার জন্য লড়াই- পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলা হয়ে ওঠে তেজোদ্দীপ্ত বাংলা। আর, এর মধ্য দিয়ে আরেকটি ঘটনা ঘটে, সেটা হলো বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ। এই ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য এখানেই অনন্য যে, এর মধ্য দিয়ে আমরা পাকিস্তানী ধর্মভিত্তিক জাতিসত্তার অন্তসারশূণ্যতা উপলব্ধি করি এবং একই সাথে- আবহমান অবিভক্ত বাংলার যে বাঙালি জাতিসত্তা তার সাথেও একটা সীমারেখা তৈরি হয়ে যায় আমাদের এই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া বাঙালি জাতিসত্তার। ফলে, স্বভাবতই এই বাঙালি জাতীয়তাবোধের সাথে আছে লড়াইয়ের তেজ, আছে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা এবং ভাষার সাথে গাটছাড়া এক সম্পর্ক।

এদিকে ভাষার লড়াইয়ে হেরে গিয়ে শাসক গোষ্ঠী শুরু করে দেয় সাংস্কৃতিক দমন, পীড়ন, নির্যাতন। অন্যান্য অর্থনৈতিক শোষণের সাথে সমান তালে এসবও চলতে থাকে। ফলে, একে কেন্দ্র করে লড়াইও চলতে থাকে সমান তালে। সবচেয়ে বেশী আক্রমণ আসে, রবীন্দ্রচর্চার উপর। কেননা, আগেই বলেছি- রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে বাঙালিত্বের আর কিছু থাকে। খুঁজে-ফিরে আমদানি করা হয় মুসলমান কবি-সাহিত্যিককে। এককালের কাফের উপাধী পাওয়া নজরুলকে মুখোমুখি করাতে চাইলো রবীন্দ্রনাথের। আমরা দুজনকেই আকড়ে ধরলাম, কাউকে কারো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নয়, দুজনকেই পরম বন্ধু হিসাবে। ফলে, আমরা প্রতিবাদী জলসায় কারার ঐ লৌহ কপাট বা চল চল চল এর সাথে সাথে আমার সোনার বাংলাও গাইলাম।

তারপর তো, সবই ইতিহাস। রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী। রবীন্দ্র চর্চার উপর নিষেধাজ্ঞা- জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনে বাঁধা, আর অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে লড়াই- এবং রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলাকে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় অভিষিক্ত করা। এভাবে শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথকে যতই আমাদের কাছ থেকে দূরে সরাতে চেয়েছে- ততই রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেছেন বাঙালি চেতনারই অংশ-বিশেষ।

আর আমার সোনার বাংলা গানটিও অন্য চেতনা, অন্য দ্যোতনা নিয়ে হাজির হয়! ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অবিভক্ত বাংলাকে ধারণ করতে রবীন্দ্রনাথ যখন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমাকে ভালোবাসি- চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি” গানটি লিখেছেন, গাইছেন, বাংলার মানুষ যখন শুনছে, সুর মিলিয়ে গাইছে- তখন অবিভক্ত বাংলার আকাশ বাতাস, ফাগুনের আমের বনের ঘ্রাণ, অঘ্রাণের ভরা ক্ষেতের হাসি, বটের মূলের- নদীর কূলের শোভা, স্নেহ, মায়া তুলে ধরেছেন- একদম প্রাণের ভেতরে টান দিয়ে এই গান ভাবায়- এই বাংলাকে ভাগ করা হলেই কি এর আকাশ, বাতাসকে – আমের বনের ঘ্রাণ, নদীর কূলের- বটের মূলের শোভা- স্নেহ – মায়া কি ভাগ করা যায়! সেই একই গান আমরা যখন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর আক্রমণের মুখে গাইলাম- সেটির আবেদন প্রেক্ষিত, দ্যোতনা, আবেদন সবই কিন্তু ভিন্ন। এই সোনার বাংলা কিন্তু আর অবিভক্ত বাংলা নয়, পাকিস্তান নামক ধর্মের ভিত্তিতে গড়া রাষ্ট্রের বাংলা ভাষী, বাংলা সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীর বাংলা। এই পূর্ব পাকিস্তান। বাংলা ভাষার, বাংলা সংস্কৃতির বাংলা। ১৯৪১ এ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়া থেকে ১৯৪৭ এ ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান হওয়া পর্যন্ত- আমরা পাকিস্তানকে চেয়েছিলাম, আমাদের আসল পরিচয় ভুলে ধর্মের পরিচয়কে মাথায় তুলে আমরা পাকিস্তানী হয়েছিলাম। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের বোধোদয় হলো, আমরা যেন আমাদের খুজে পেলাম। সেই খুজে পাওয়ার মূল জায়গাটিই হচ্ছে- আমাদের বাংলা, বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি- এবং সেটিই আমরা আমার সোনার বাংলা গানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করলাম। এখানে বাংলা যেমন একটি ভূখন্ড- যে ভূখন্ড পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অন্তর্গত- কিন্তু পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তেমনি এই গানের বাংলা হচ্ছে বাংলা ভাষা, এই গানের বাংলা হচ্ছে সংস্কৃতি।

বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ, জাতীয় সঙ্গীতের বিরোধীতা একই সূত্রে গ্রোথিতঃ
বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ ও জাতীয় সঙ্গীতের বিরোধীতার মূলে আছে- সাম্প্রদায়িকতা, উপরের আলোচনায় তা নিশ্চয় এতক্ষণে পরিস্কার হয়েছে। ত্রিভুজ সেনাপতি আশরাফও তার এক পোস্টে এরকম একটি কথা লিখেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাহ্ম হলেও তিনি হিন্দুত্ববাদের প্রচার করে গেছেন!

এরা আজ যেসব যুক্তি(!!) করছে- একই কথা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী আমাদের এখানে প্রচারের চেস্টা চালাতো। তাদের হয়ে এ প্রচারকার্যের মূল দায়িত্ব পালন করতো এখানকার রাজাকার ও মুসলিম লীগের দালালরা। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, সে সময়ে চেতনার জায়গা বা লেভেলটা এমন জায়গায় ছিল যে, যখনই কেউ রবীন্দ্রনাথ বা হিন্দুত্ব নিয়ে কথা বলতে আসত- সাথে সাথেই তাকে দালাল হিসাবে প্রতিরোধ করতো। ফলে, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কোন চক্রান্তই হালে পানি পায়নি।

আজও, দালালরা, মানে রাজাকার-রাজাকারপুত্র-নব্যরাজাকাররা একই ধরণের যুক্তি করতে চায়- জাতীয় সঙ্গীত পাল্টানোর কথা বলে – এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যার অপরনাম বাঙালিত্বের চেতনার মূল যে চেতনা সেই অসাম্প্রদায়িক সেক্যুলার চেতনাকে আঘাত করা।

আরেকটি চমৎকার(!) যুক্তি আজকাল প্রায়ই শোনা যায়ঃ এই জাতীয় সঙ্গীত আমাদের বাংলাদেশকে ধারণ করে না; বা আরো ভালো কোন সঙ্গীত যদি বাংলাদেশকে ধারণ করতে পারে তবে- সেটিকে জাতীয় সঙ্গীত করা উচিত। অনেকে নানাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের উদাহরণ টেনে বলেন, একবার জাতীয় সঙ্গীত ঠিক করা হলে যে- কোনদিন সেটাকে পাল্টানো যাবে না- এমন তো কোন কথা নেই। আজ জাতীয় সঙ্গীতকে কেন্দ্র করে যিনিই এসব কথা বলছেন- বুঝতে হবে চিন্তায়-মানসিকতায় সকলেই ‘একই গোয়ালের গরু’ প্রকৃতির। সেদিনের মত আজও তাদের দালাল- রাজাকার হিসাবে প্রতিরোধই কাম্য।

আর, বাংলাদেশকে ধারণ করা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করি- এই গানের মত বাংলাদেশকে ধারণ করে, বাঙালির আবেগকে ধারণ করতে পারে আর একটি গানও কি আছে বাংলায়? এমনকি অন্যান্য দেশের জাতীয় সঙ্গীতগুলোর সাথে তুলনা করলেও আমাদের জাতীয় সঙ্গীতকে বিশিষ্ট বলা যায় – কেননা আমাদেরটি একই সাথে দেশকে ও দেশের প্রতি আবেগকে তুলে ধরে। আর, যদি এই গানটির কথায়- সুরে তা এমন মাটিছোয়া- হৃদয়গ্রাহী না-ও হতো, তারপরেও এই গানটিকেই জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে রাখতে হবে এ কারণে যে, এর সাথে একটি ইতিহাস আছে, তাকে ছাপিয়ে আছে একটি চেতনা- যে চেতনাটি হলো অসাম্প্রদায়িক – সেক্যুলার বাংলার চেতনা।

তথ্যসূত্রঃ
১/ “হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়”- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২/ “হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রনাথ” – কালি ও কলম, কুলদা রায়, এম এম আর জালাল
৩/ “বাঙালীর জাতীয়তাবাদ”- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
৪/ লাল নীল দীপাবলী ও কত নদী সরোবরে- হুমায়ুন আজাদ
৫/ বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন- শতবর্ষ স্মারক সংগ্রহ,
৬/ উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্র (অষ্টম খণ্ড)- মুনতাসীর মামুন সংকলিত,
৭/ Swadeshi Movement in Bengal- Sumit Sarkar,
৮/ উপনিবেশপূর্ব বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি – গোলাম রব্বানী
৯/ বাংলাদেশে রবীন্দ্র- সংবর্ধনা, বাংলা একাডেমি

জানুয়ারি, ২০০৮
সামুব্লগে পূর্ব প্রকাশিত

(ঈষৎ পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত)