লিখেছেন: সাত্যকি দত্ত

রবীন্দ্রনাথ তখনও ভানুদাদা হয়ে ওঠেনি , রাণু তাঁকে সম্বোধন করে রবিবাবু বলে । সারা সকাল ধরে রবিবাবুর জন্য সুন্দর নকশা করা বাসন্তী রঙের কাগজে চিঠি লিখত রাণু । চিঠিতে তাঁর প্রিয় রবিবাবুকে কত করে সে বলে , ” এ চিঠির উত্তর শিগগির দেবেন যেন “। কিন্তু রবিবাবু সে কথা রাখতে ভুলে যায় । এদিকে সারাদুপুর ধরে রাণু যে পথ দিয়ে ডাকহরকরা আসে সেই পথের ধারের জানলা খুলে বসে থাকে , এই বুঝি তাঁর রবিবাবুর পত্র এলো । যেদিন সত্যি সত্যি পত্র আসে , সেদিন সারাবিকাল সে পত্রখানি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় , আর নয় ত অনেক আনন্দে ছবি আঁকে তাঁর ভানুদাদাকে পরের চিঠিতে পাঠাবে বলে , রাজপুত্র রাজকন্যা কিংবা পরীদের ছবি । তিনচারদিন যায় , আবার রবিবাবুর পত্র আসতে দেরী হয় , অনেক প্রতীক্ষার শেষে সেদিনের মতো যখন সকল সম্ভাবনা ফুরায় , রাণু অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে ছাদে শুয়ে থাকে , কারো সাথে কথা বলে না । অপেক্ষার সেদিন গুলোতে রাণু ছবিআঁকা ভুলে যায় , ভুলে যায় চুল বাঁধতে , খেলাধূলাও ছেড়ে দেয় । বিমর্ষ কন্যাকে দেখে বাবা-মা চিন্তিত হয় এই বুঝি মেয়ে কোন কঠিন রোগে পড়ে । দোল লাগে রবীন্দ্রনাথের হৃদয়েও , আর কেনই বা লাগবে না , তাঁর যে এমনই একখানি মেয়ে ছিল – রেণুকা , আদর করে যাকে ডাকতেন রাণু । মৃত্যু যদিও তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বহুদূর , তবুও পিতার হৃদয়ের স্নেহ যে অক্ষয় । রেণুকা যখন মারা যায় তখন তাঁর বয়স বারো , আর রাণু যখন তাঁর রবিবাবুর হৃদয়ে একটু একটু করে স্নেহের সবটুকু জায়গা অধিকার করে নিচ্ছে তখনও তাঁর বয়স প্রায় বারো , কি ঐতিহাসিক সমাপতন । কন্যাসমা রাণুকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য লিখলেন –

” কল্যাণীয়াসু,

রাণু, আমার একদিন ছিল যখন আমি ছোট ছিলুম— তখন আমি ঘন ঘন এবং বড় বড় চিঠি লিখতুম। তুমি যদি তার আগে জন্মাতে— যদি অনর্থক এত দেরী না করতে, তাহলে আমার চিঠির উত্তরের জন্যে একদিনও সবুর করতে হতনা। আজ আর চিঠি লেখবার সময় পাই নে — সময় আমার একেবারে চুরমার হয়ে গেছে। কি করে হল বলি। মানুষের বদনাম হলেই শাস্তি পায়, কিন্তু আমার হল তার উল্টো। হঠাৎ বিলেতে আমার সুনাম বেরল । বোধ হয় খবরের কাগজে পড়েছ আজকাল এমন সব বড় বড় কামান বেরিয়েচে যার গোলা অনেক দূর পর্যন্ত যায়। সমুদ্রপার থেকে সেই রকম সব গোলা আমার সময়ের উপর এসে পড়চে । এই গোলাগুলি আসে চিঠির বেশ ধরে— কত যে তার ঠিকানা নেই। তাই আমার অবকাশ টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তোমার বয়স আমার যখন ছিল তখন নিজের ইচ্ছেয় চিঠি লিখতুম, এখন অন্যের ইচ্ছেয় এত বেশি লিখতে হয় যে, নিজের ইচ্ছেটা মারাই গেল। তার পরে আবার ভয়ানক কুঁড়ে হয়ে গেছি। যত বেশি কাজ করতে হচ্চে ততই কুঁড়েমি আরো বেড়ে যাচ্চে। তুমি যদি আমাদের কাছাকাছি কোথাও থাকতে তাহলে গাড়িভাড়া করে ছুটে গিয়ে মোকাবিলায় তোমাকে জবাব দিয়ে আসতুম তবু কলম ধরতুম না। যখন আমার বয়স সাত, তখন থেকে কেবলি কলম চালিয়ে আসচি এখন ষাট বছরে পড়বার উদ্যোগ করচি, এখনও সেই কলম চলচে। এই জন্যে ঐ কলমটার উপরে আমার অত্যন্ত বিরক্ত ধরে গেছে। এখন লিখে যাওয়ার চেয়ে বকে যাওয়া ঢের বেশি সহজ মনে হয়। যদি তেমন সুবিধে হত ত দেখিয়ে দিতুম বকুনিতে তুমি কখনো আমার সঙ্গে পেরে উঠতে না। সেটা তোমার ভাল লাগত কিনা বলতে পারি নে। কেননা তোমার যতগুলি পুতুল আছে তারা কেউ তোমার কথার জবাব করেনা, তুমি যা বল তাই তারা চুপ করে শুনে যায়— আমার দ্বারা কিন্তু সেটা হবার জো নেই— অন্যের কথা শোনার চেয়ে অন্যকে কথা শোনানো আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। আমার বড় মেয়ে যখন ছোট ছিল তখন বকুনিতে তার সঙ্গে পারতুম না কিন্তু এখন সে বড় হয়ে শ্বশুর বাড়িতে চলে গেছে তার পর থেকে আমার সমকক্ষ কাউকে পাইনি। তোমাকে পরীক্ষা করে দেখতে আমার খুব ইচ্ছা রইল। … ”

কোন বার আবার রাণুর চিঠি লিখতে দেরী হয় , যদি রবিবাবু অভিমান করে বসে তাই আগে থাকতে সে লেখে – ” প্রিয় রবিবাবু, আমি এতদিন চিঠি দিইনি বলে রাগ করবেন না। আমার খুব অসুখ করেছিল কিন্তু এখন ভাল আছি। লক্ষীটী রাগ করবেন না। ” এমন কথা পড়লেই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি কি বিপুল স্নেহ মিশ্রিত একটা ভালোবাসা প্রথম থেকেই কাজ করছিল রাণুর মধ্যে । রবীন্দ্রনাথ সে চিঠির উত্তরে লিখলেন একটি বড় চিঠি , এর আগে রাণুর অভিযোগ ছিল রবিবাবু তাঁকে বড় অবহেলা করে ছোট চিঠি দেন –

কল্যাণীয়াসু

তুমি দেরি করে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছিলে এতে আমার রাগ করাই উচিত ছিল কিন্তু রাগ করতে সাহস হয় না— কেননা আমার স্বভাবে অনেক দোষ আছে, দেরী করে চিঠির উত্তর দেওয়া তার মধ্যে একটি। আমি জানি তুমি লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি অনেক সহ্য করতে পার, যতরকম শৈথিল্য সব তোমাকে সহ্য করতে হবে। আমার মত অন্যমনস্ক অকেজো মানুষের সঙ্গে ভাব রাখতে হলে খুব সহিষ্ণুতা থাকা চাই— চিঠির উত্তর যত পাবে তার চেয়ে বেশি চিঠি লেখবার মত শক্তি যদি তোমার না থাকে, দেনাপাওনা সম্বন্ধে তোমার হিসাব যদি খুব বেশি কড়াক্কড় হয় তাহলে একদিন আমার সঙ্গে হয়ত বা তোমার ঝগড়া হতেও পারে— সেই কথা মনে করে ভয়ে ভয়ে আছি। কিন্তু একথা আমি জোর করে বলচি যে, ঝগড়া যদি কোনোদিন বাধে তার অপরাধটা আমার দিকে ঘটতে পারে কিন্তু রাগটা তোমার দিকেই হবে। আর যাই হোক আমি রাগী নই। তার কারণ এ নয় যে আমি খুব ভাল মানুষ, তার কারণ এই যে, আমার স্মরণশক্তি ভারি কম, রাগ করবার কারণ কি ঘটেচে সে আমি কিছুতে মনে রাখতে পারি নে। তুমি মনে কোরোনা কেবল পরের সম্বন্ধেই আমার এই দশা, নিজের দোষের কথা আমি আরো বেশি ভুলি। চিঠির জবাব দিতে যখন ভুলে যাই তখন মনেও থাকে না যে ভুলে গেচি। কৰ্ত্তব্য করতেও ভুলি, ভুল সংশোধন করতেও ভুলি, সংশোধন করতে ভুলেচি তাও ভুলি। এমন অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব কর এবং সে বন্ধুত্ব যদি স্থায়ী রাখতে চাও তাহলে তোমাকেও অনেক ভুলতে হবে, বিশেষত চিঠির হিসাবটা। কিন্তু একটা কারণে আমার বিস্মরণশক্তি সম্বন্ধে তোমার অবিশ্বাস হতে পারে— তোমার ঠিকানা আমি ভুলি নি। না ভোলবার একটা কারণ এই যে, দুই তিনে যে পাঁচ (২+৩=৫) হয় এ কথাটা গুরুমশায়ের অনেক মার খেয়ে মনের মধ্যে বসে গেছে। আমার বিশ্বাস আর দশ বছর বাদে আমার বয়স যখন ৬৭ হবে তখনো ওটা ভুলবনা। আর অগস্তাকুণ্ড মনে রাখা খুব সহজ। কেননা পুরাণে পড়েচি অগস্তা এক গণ্ডষে সমুদ্র শুষে খেয়েছিলেন, সেই অগস্ত্য যে আজ কুণ্ড নিয়েই সস্তুষ্ট আছেন সেটা আমাদের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে খুব মেলে। ওর মধ্যে একটু সান্ধনার কথা হচ্চে এই যে তোমাদের নম্বরটা নিতান্ত ছোট নয় ।
পদ্মার ধারের হাসেদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হল কি করে জিজ্ঞাসা করেচ। বোধহয় তার কারণ এই যে বোবার শত্রু নেই। ওরা যখন খুব দল বেঁধে চেচামেচি করে আমি চুপ করে শুনি, একটিও জবাব দিই নে। আমি এত বেশি শাস্ত হয়ে থাকি যে, ওরা আমাকে মানুষ বলে গণ্যই করে না— আমাকে বোধহয় পাখীর অধম বলেই জানে— কেন না আমার দুই পা আছে বটে কিন্তু ডানা নেই। আর যাই হোক ওদের সঙ্গে আমার চিঠিপত্র চলে না— যদি চলত তা হলে আমাকেই হার মানতে হত— কেননা ওদের ডানভিরা কলম আছে, আর ওদের সময়ের টানাটানি খুব কম।
তোমাকে যে এত বড় চিঠি লিখলুম আমার ভয় হচ্চে পাছে বিশ্বাস না কর যে আমার সময় কম। অনেক কাজ পড়ে আছে— কাজ ফাকি দিয়েই তোমাকে চিঠি লিখচি – কাজ যদি না থাকত তাহলে কাজ ফাকি দেওয়াও চলত না। তোমার কাছে আমার অনেক দোষ ধরা পড়চে– আমি যে কাজ ফাকি দিয়ে থাকি এ কথাটাও ফাস হয়ে গেল। এ জন্য তুমি যদি আমাকে তিরস্কার কর তাহলে ভবিষ্যতে তোমাকে খুব ছোট ছোট চিঠি লিখতে হবে, হয় ত তারও সময় পাবনা। অতএব আমাকে যদি শাসন করতে হয় তাহলে বুঝে সুঝে কোরো। বেলা অনেক হয়ে গেচে– অনেক আগে স্নান করতে যাওয়া উচিত ছিল— হাঁসেদের কথায় হঠাৎ স্নানের কথাটা মনে পড়ে গেল— তাহলে আজ চলুম। আজ রাত্রে বোলপুর যেতে হবে। ইতি

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবিবাবু যে বললে তাঁর অনেক কাজ বা ছোট চিঠি দেবেন এতে অভিমানী রাণু আদেশের সুরে লিখে ফেলল – ” আপনি যে লিখেচেন আপনার সময় কম তো কি কাজ ? এবারে লিখবেন যে কি কাজ ! আপনি আমাকে ছোট চিঠি লিখতে পাবেন না । ” উপেক্ষা করতে পারলেন না রবীন্দ্রনাথ , কৌতুকের সুরেই লিখলেন –

কল্যাণীয়াসু

শরীরটা অনেকদিনের পুরাণো হয়ে গেচে বলে তাকে খাটাতে আর সাহস হয় না। এখনো সে চলচে কিন্তু পুরাণো গরুর গাড়ির চাকা যেমন চলতে চলতে ক্যা কো করে কাদতে থাকে এরও সেই দশা। এ দেহটা কাজ করতে করতে অ্যা ও করচেই আর আমি তাকে ছুটি দিই নে বলে আমার উপর রাগ করচে। এই সকল কারণে, মন যখন চিঠির জবাব দিতে চায় মগজ তখন সাড়া দেয় না। কিন্তু তোমার মত ছোট মেয়ের সঙ্গে চিঠি লেখায় হার মানব এটা আমার সহ্য হয় না বলেই এখনো চিঠির জবাব পাচ্চ— কিন্তু মাঝে মাঝে লম্বা ফাক পড়ে যাচ্চে। তুমি জিজ্ঞাসা করেচ আমার এত কি কাজ। আমি তার একটা ফৰ্দ্দ দিই।

১।চিঠি , ২। চিঠি , ৩। চিঠি , ৪। চিঠি , ৫। চিঠি , ৬। চিঠি , ৭। চিঠি , ৮। চিঠি , ৯। চিঠি , ১০। জানালার কাছে বসে থাকা , ১১। জানালার কাছে বসে থাকা , ১২ । জানালার কাছে বসে থাকা , ১৩। জানালার কাছে বসে থাকা , ১৪। জানালার কাছে বসে থাকা , ১৫। ছাতের উপর বসে থাকা , ১৬। ছাতের উপর বসে থাকা , ১৭। ছাতের উপর বসে থাকা , ১৮। ছাতের উপর বসে থাকা , ১৯।চিঠি ছাড়া অন্য কিছু লেখা , ২০। সেই লেখা সংশোধন ২১। সেই লেখা পড়ে শোনানো ২২। সেই লেখা কাগজে মোড়া ২৩। সেই লেখা ডাকে পাঠানো ২৪। সেই লেখা ছাপার অক্ষরে পড়া ২৫। সেই লেখার সমালোচনা পড়া ২৬। আরো সমালোচনা পড়া ২৭। সেই লেখা সম্বন্ধে অনুতাপ করা ।

এই ত সাতাশ দফা ফৰ্দ্দ দিলুম। শুনেচি তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে অঙ্ক কষতে পার। তুমি হয়ত হিসাব মিলিয়ে ঐ ২৭ থেকে ২টা রেখে ৭টা বাদ দিয়ে বলবে আমি কেবল লিখি আর কুঁড়েমি করি। অর্থাৎ কাজ আর অকাজ এই দুটি মাত্র ভাগে আমার দিন বিভক্ত। আর এটাও তুমি নিশ্চয় সন্দেহ করবে, কাজের চেয়ে অকাজের অংশই বেশি– পৃথিবীতে যেমন স্থলের চেয়ে জল। কিন্তু আমার কুঁড়েমিটাকে তুমি যে তুচ্ছ বলে কাজের চেয়ে ছোট করে দেখবে এটা আমার সহ্য হবে না। রাত্রিতে পৃথিবী দেখা যায় না কিন্তু তবু পৃথিবীটা থাকে তেমনি আমার কুঁড়েমির মধ্যে আমার কাজটা অদৃশ্য হয়ে যায় কিন্তু তবু সে থাকে। যা হোক এ সব কথা নিয়ে তোমার সঙ্গে তর্ক করব না। কেননা তর্ক করার চেয়ে তর্ক না করাতে অনেক পরিশ্রম বাচে– এই পরিশ্রম বাচানোর উপায় বের করাই আমার এখনকার সবর্ণপ্রধান ভাবনা। আজ এই পৰ্য্যস্ত। নীচের ঘরে বিত্তর লোক এসে জমেচে— তাদের প্রধান কাজ হচ্চে আমাকে কাজ করতে না দেওয়া এবং কুঁড়েমি করতেও বাধা দেওয়া। ইতি ২রা অগ্রহায়ণ ১৩২৪

শুভানুধ্যায়ী
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই চিঠিটি পাঠাতে দেরী হয়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের , রাণু উত্তরে লিখেছিল –

” প্রিয় রবিবাবু,

অনেকদিন হোলো আপনার চিঠি পেয়েছি। কিন্তু দুটো কারনের জন্য উত্তর দেওয়া হইনি। প্রথম তো আপনি যেমন দেরী করে দিয়েছিলেন আমিও তেমনি দিচ্চি। দ্বিতিয় তো আমার Half yearly এগজামিন হচ্চিল। এখন এগজামিন শেষ হয়ে গেছে। আমাদের বড় দিনের ছুটি হয়েছে। আমার ছুটি ভাল লাগেনা। আপনি তো আগের চিঠি কেবল লিষ্টেই ভরে দিয়েছিলেন। প্রায় বলতে গেলে কোন কথাই লেখেন নি। আবার একটা কথা যেমন জানলায় বসে থাকা তিন চার বার করে কেন লিখেছেন। একবারেই তো অনেকক্ষণ বসে থাকেন না একবার ওঠেন আর একবার বসেন। এবারে নিশ্চয় খুব বড় চিঠি লিখবেন। আপনি লিখেছেন আমার সময় হয়না। কিন্তু আপনার ছিন্নপত্রয় তো সব বড় ২ চিঠি। আমাকে চিঠি দিতেই যেন সময় থাকেনা। তখন কি করে সময় পেতেন? আপনার বইটার নাম ছিন্নপত্র কেন? সে চিঠিগুলো কি সব ছেড়া ? ”

পরবর্তীকালে এই সাতাশ দফা ফর্দ দেখেই বুঝি রাণু রবীন্দ্রনাথের বয়স সাতাশে বেঁধে দিয়েছিল । 1918 এর 12ই জুলাই রবীন্দ্রনাথকে প্রায় হুকুম করে রাণু লিখেছে: ” হ্যাঁ শুনুনু কেউ বয়েস জিজ্ঞেস করলে বলবেন সাতাশ ৷” রবীন্দ্রনাথ যে বয়সের এই পরিবর্তন স্বীকার করে নিয়েছেন তার প্রমাণ 28শে আগষ্ট , 1918 সালে রাণুকে লেখা চিঠি –
“….. কিন্তু যখন থেকে তোমার পঞ্জিকা অনুসার আমার ‘সাতাশ’ বছর বয়স হয়েছে তখন থেকেই বয়সের মানে আপনি ধরা দিয়ে কেটে বেড়াবার আর পথ পাইনি৷ ”

রাণু যে খালি তাঁর রবিবাবুকে শাসন করে আর বড় চিঠি লেখার দাবি জানায় তা কিন্তু নয় , রবিবাবুর কোন লেখা কেমন হয়েছে তার সমালোচনাও পাঠায় । যেমন রাণু লিখেছে , ” হৈমন্তী আর শেষের রাত্রির শেষটা বড় দুঃখের । ” , ” বানয়ারীলাল নামটা ভারী বিচ্ছিরি । আপনি কোথায় এই নামটা পেলেন বলুন তো ? ” , ” আপনি সবুজ পত্রে তোতাকাহিনী বলে যে গল্পটা লিখেছেন , সেটার শেষটা বড় দুঃখের । শেষটা দুঃখের করলেন কেন । পাখিটা একমাস দুমাস কাগজ খেয়ে বেঁচেছিল কি করে । আপনি এবার একটা সুখের গল্প লিখবেন । ” ইত্যাদি । এগুলো ছাড়া প্রথম দিকের প্রায় প্রতিটি চিঠিতেই আছে জন্মগত আড়ি করে দেওয়ার ভয় দেখানো আর কাশীতে আসার জন্য রবীন্দ্রনাথকে বারবার অনুরোধ , শেষে গঙ্গার পরপারে ভ্রমণের একটি বিবরণ দিয়ে প্রলোভন দেখিয়েছে রাণু , ” আপনি যখন আসবেন তখন আপনাকেও নিয়ে যাব । কিন্তু আপনি আসেন কই । ” রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি তখন সারা পৃথিবী জুরে , কত মানুষ তাঁর সঙ্গ পেতে চায় , সংবর্ধনা দিতে চায় , সেখানে রাণুর অনুরোধে কাশীতে আসার সময় কই । পাছে যদি কন্যাসমা মেয়েটি দুঃখ পায় তাই লিখলেন রাণুকে , ” তোমার ওখানে যাব মনে করি— কিন্তু যেতে হলে, শুধু কেবল মনে করা ছাড়াও আরো অনেক কিছু করতে হয়— এই জন্যেই পৃথিবীতে যেটুকু করা হয় তার চেয়ে করা হয় না অনেক বেশি। তোমার কাছে বসে গল্প শুনব সেটাও হয়ত আমার জীবনে সেই অসংখ্য না-হওয়ার ফদের মধ্যে পড়ল। কিন্তু বলা যায় না— কোনদিন হয়ত তোমাদের বাড়ির দরজায় দমাদম ঘা মেরে চীৎকার করে বলব— “রাণু, রাণু, রবিবাবু এসেচে।” ”

এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া সফরের কথা ছিল , রাণুকে লিখেছিলেন , ” আমি এই বৈশাখ মাসের শেষ দিকে জাহাজে চড়ে প্রশান্ত মহাসাগরে পাড়ি দেব বলে আয়োজন করচি। যদি কোনো বাধা না ঘটে তাহলে বেরিয়ে পড়ব। ” রবিবাবু অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে জানতে পেরে অভিমানী রাণু লিখেছিল – ” আপনার কি হয়েছে। হটাৎ অস্টেলিয়াতেই বা যাচ্চেন কেন? আপনি নিশ্চয় ওখানের লোকদের বেশী ভাল বাসেন। কেননা তারা যেই ডাকল অমনি সেখানে গেলেন। আমি যে ডাক্‌চি তা আসাই হয়না। আপনি ভারী অকৃতজ্ঞ । ”

রবীন্দ্রনাথের সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পিছনে একটা ইতিহাস আছে । ইংরেজ উপনিবেশ ফিজিতে চুক্তিদাস-প্রথার পীড়নে ভারতীয়রা যে অবর্ণনীয় দুর্দশা ভোগ করছিল, তার অবসান ঘটানোর জন্য ও পিয়র্সন সেখানে গিয়েছিলেন ১৯১৫ সালে। এর পরেও অ্যান্ড্রুজ আবার ফিজিতে যান ১৯১৭ সালে। এই যাত্রায় তিনি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে সেখানকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা-সফরের ব্যবস্থা করে আসেন। ভারতীয় তথা এশীয়দের সম্বন্ধে অস্ট্রেলিয়া গবর্মেন্ট যে অভিবাসন নীতি গ্রহণ করেছিল, তার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ এক সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন ও ঠিক করেন এই যাত্রাতেই তিনি পুনরায় জাপান ও আমেরিকা ভ্রমণ করে আসবেন। তিনি ইংরেজবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন, কিছু সংখ্যক অস্ট্রেলিয়াবাসী এইরূপ অভিযোগ করছেন জেনে রবীন্দ্রনাথ সেখানকার সফর বাতিল করেন; একই সঙ্গে আমেরিকা সফর বাতিল হয় ক্যালিফোরনিয়ার হিন্দু – জার্মান ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর নাম যুক্ত করায়।

ইতিমধ্যে রাণুর পিতা ফণীভূষণ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে চিকিৎসার জন্য সপরিবারে কলকাতায় আসতে হয় । রাণু তাঁর রবিবাবুর সফর বাতিল হয়েছে খবর পেয়ে , রবীন্দ্রনাথকে আদেশের ভঙ্গিতে লেখে – ” আপনার বেশ হয়েছে। যেমন আমার সঙ্গে না দেখা করে যাচ্ছিলেন তেমনি যাওয়া হল না। আপনি মঙ্গলবার দিন সন্ধ্যাবেলা নিশ্চয় আমাদের বাড়ী আসবেন। নয়ত জন্মের মতন আড়ি। ” রাণুর কথা রাখতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ । কন্যা মাধুরীলতার অসুস্থতার জন্য মঙ্গলবার ( ১৪ ই মে , ১৯১৮ ) রাণুদের ভবানীপুরের বাসায় আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি । পরদিন পনেরই মে সন্ধায় , ‘ রবিবাবুকে হারিয়ে দিয়ে ‘ পিতা ফণিভূষণের সাথে রাণু এসেছিল জোড়াসাঁকোতে । রবীন্দ্রনাথের ছবি কত করে দেখেছে রাণু , তাঁদের শোয়ার ঘরেই যে আছে একটা , যে ছবিটা তাঁর মা পত্রিকার পাতা থেকে কেটে বাঁধাই করে রেখেছিল । তাই তো একটুও চিনতে ভুল হয়নি রাণুর । ছুটে এসে রবিবাবুর হাতের উপর হাত দিল রাণু । এই মুহূর্তটার বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালের রাণুকে লেখা চিঠিতে করেছেন –
” আমি যখন তোমাকে লিখেছিলুম যে , আমাকে তুমি নারদ মুনি মনে করে হয়ত ভয় করবে , তখন আমি কত বড় ভুলই করেছিলুম – আমি যে ছফুট লম্বা মানুষ , এত বড় গফ-দাড়িওয়ালা কিম্ভূতকিমাকার লোক , আমাকে দেখে তোমার মুখশ্রী একটুও বিবর্ণ হল না , এসে যখন আমার হাত ধরলে , তোমার হাত একটুও কাঁপল না , অনায়াসে কথাবার্তা আরম্ভ করে দিলে , কণ্ঠস্বরে একটুও জড়িমা প্রকাশ হল না – কী কাণ্ড বলো দেখি ?”

আর সেদিন রাতে শোয়ার আগে রবীন্দ্রনাথ নিজের ডায়ারিতে লিখেছিলেন – ” Ranu , the little girl of eleven , with whom father has had such an interesting correspondence , came this evening with her family . She is such a bright girl . But she felt shy before such a company here . She asked father to go to her tomorrow or the day after . ”
পরের দিন অর্থাৎ ১৬-ই মে কবির জীবনে ঘনিয়ে আসে একটি শোকসন্তপ্ত প্রহর । সকাল সাতটায় কবির প্রথম সন্তান বেলার মৃত্যু হয় সেদিন । এখানে বেলার কথা বলাটা খুব জরুরি কারণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-কেন্দ্রিক জীবন , এক প্রিয় মানুষ জীবন থেকে চলে যাবে ঠিক সেইক্ষণে আর একটি মানুষ তার জায়গা নেবে ।

রবীন্দ্রনাথ পঁচিশ বছর বয়সে বাবা হলেন। তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী তখন তেরো। এই সন্তানটির নাম মাধুরীলতা দেবী। ডাকনাম ছিল তার বেলা। ২৫ অক্টোবর ১৮৮৬ তার জন্ম। রবীন্দ্রনাথ তাকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন। আর এই বেশি ভালোবাসার ব্যাপারটা তাঁর দ্বিতীয় সন্তান রথীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ আমরা সেটা খুবই জানতুম। কিন্তু তার জন্যে কোনোদিন ঈর্ষা বোধ করিনি, কেননা আমরাও সকলে দিদিকে অত্যন্ত ভালো বাসতুম এবং মানতুম। দিদির বুদ্ধি যে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি, তা মানতে আমাদের লজ্জাবোধ হতো না। তিনি অপরূপ সুন্দরী ছিলেন, ছেলেবেলা থেকেই সেই জন্য বাড়ির সকলের কাছ থেকে প্রচুর আদর পেতেন, সকলের প্রিয় ছিলেন।’

মাধুরীলতা কোনদিন স্কুলে না গেলেও রবীন্দ্রনাথ মেয়ের জন্য ইংরেজ শিক্ষক রেখে দিয়েছিলেন ; মেয়ে বাবার ব্যয়িত অর্থের অমর্যাদা করেনি, তেরো বছর বয়সেই চমৎকার ইংরেজি কবিতা লিখেছে সে। সেই মেয়ের বয়স ১৪ বছর না হতেই রবীন্দ্রনাথ তাকে পাত্রস্থ করার জন্য ব্যস্ত হলেন। ওদিকে তাঁর বন্ধুর কন্যাদের বিয়ে হচ্ছে, বেলাকে পিছিয়ে পড়লে চলবে কেন। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে শরৎকুমার চক্রবর্তী উপযুক্ত পাত্র হিসেবে বিবেচিত হলেন। বিহারীলাল চক্রবর্তীর বিধবা পত্নী কাদম্বরী চক্রবর্তী ছেলের জন্য ২০হাজার টাকা যৌতুক চাইলেন। বিয়ের ঘটক কবির বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে ১৯০১ সালের ২৩ মার্চ রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন যে , ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চেষ্টা করা যাবে। তার সবটাই আবার নগদে নয়, আংশিক দেওয়া হবে কিস্তিতে। তা ছাড়া ‘সাধারণত বাবা মশাই (রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর) বিবাহের পরদিন চার-পাঁচ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে আশীর্বাদ করে থাকেন সে জন্য কাউকে কিছু বলতে হয় না। ২০ হাজার টাকার প্রস্তাব আমি তাঁর কাছে উত্থাপন করতেই পারব না।’

প্রিয়নাথকে আরও লিখেছিলেন , ‘আমাদের পরিসরে বিবাহ অনেক হইয়া গেছে , আমার কন্যার বিবাহেই প্রত্যেক কথা লইয়া দরদস্তুর হইল । ইতঃপূর্বে এমন ব্যাপার আর হয় নাই। এ ক্ষোভ আমার থাকিবে। দশ হাজারের উপর আবার আরো দুই হাজার চাপাইয়া ব্যাপারটাকে কুৎসিত করা হইয়াছে। পরমাত্মীয়কে প্রসন্নমান দান করিবার সুখ যে আমার আর রহিল না, আমাকে পাক দিয়া মোচড় দিয়া নিঙড়াইয়া লওয়া হইল। ‘
পাত্রপক্ষের এত সব দরাদরির পর রবীন্দ্রনাথ ব্যথিত হলেও পাত্র হাতছাড়া করতে চাইলেন না। ১১ জুন ১৯০১ মাধুরীলতা ও শরৎকুমার চক্রবর্তীর বিয়ে হয়। তাঁদের সংসার-জীবন ১৭ বছরের। ১৬ মে, ১৯১৮ মাধুরীলতার ক্ষয়রোগে মৃত্যু হয়।

প্রতিদিনের মতো সেদিনও রবীন্দ্রনাথ ডঃ সুবোধ বসুকে সঙ্গে নিয়ে দেখতে আসছিলেন বেলাকে । মেয়ের বাড়ির গেটটি যখন তিনি খুলছেন ডঃ নন্দী দৌরে এসে তাঁকে খবর দিলেন কিছুক্ষণ আগেই বেলার মৃত্যু হয়েছে । ডঃ বসু কবিকে বললেন , ” আমরা কি ভীতরে যাব ? বেলাকে শেষ দেখা দেখবেন না ? ”

তখন কবি স্থাণুবৎ হয়ে গেছেন । নিজের কানে শোনা দুঃসংবাদ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না তাঁর । অনেক্ষন নতমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন , তারপর বললেন , ” না , এ দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারবো না । বরং চোখ বন্ধ করলে বেলার সুন্দর মুখখানি মনে পড়বে আমার । চলুন ডাক্তার , এখানে থাকতে আর এক মুহূর্ত ভালো লাগছে না আমার । ”
চলে এলেন জোড়াসাঁকোতে । সবাই মিলে কতোবার বললে মেয়ের অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দিতে , কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সব কিছুই উপেক্ষা করলেন । এখানে আমরা কোথাও না লেখা থাকলেও বেশ অনুমান করে নিতে পারি , তখন তাঁর সমস্ত শরীরে শোক বিহ্বলতা আক্রমণ করেছিল । পিতা হয়ে প্রিয়তমা কন্যার মৃত্যু সংবাদ শুনেছেন তিনি , এই পৃথিবীতে তিনি তখন বড্ড অসহায় এবং নিঃসঙ্গ ।

সেদিনই বিকালে রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন ল্যান্সডাউন রোডে রাণুর আমন্ত্রণ রাখতে – সেও এক ঐতিহাসিক সমাপতন । রবীন্দ্রনাথ দরাজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকলেন ,”রাণু ” তারপর কি ঘটেছিলো ? সে ঘটনা রাণুর কাছ থেকেই শোনা যাক –

” সেই অবর্ণনীয়ক্ষণে , আমাকে একেবারে ঘরোয়া নামে ডাকা , কি সুরে বেজেছিল আমার কানেপ্রাণে- বোঝাতে পারবো না । কেমন করে বরণ করব এমন অতিথিকে , ওই মুহূর্তে কোন আচরণ শোভন জানতাম না । পোশাক পরার তর সয়নি আমারও তাঁর কাছে । বলা যায় , একেবারে অনাবরণ রূপেই প্রথম দর্শন । ”

হ্যাঁ , সেদিন কবির ডাকশুনে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে স্নানঘর থেকে চলে এসেছিল ছুটতে ছুটতে – বিন্দু মাত্র পোশাক যে তার গায়ে নেই তা খেয়ালই ছিল না।
একটুবাদে পোশাক পরে সামনে এসে দাঁড়ালো রাণু । তখন তাঁকে দেখে কবি বুঝতে পারলেন , এই মেয়েটি এখন তাঁকে শাসন করবে কন্যার মতো । তিনি হবেন এই মেয়েটির ইচ্ছার ক্রীতদাস । তর্জনী তুলে এখন যা আদেশ করবে , তাই নতশিরে মানতে হবে তাঁকে । তার মানে ? পৃথিবীতে সব কিছুই কি শেষ পর্যন্ত পূর্ণ হয়ে যায় ?
সহসা মনে হল শোকস্তব্ধ পিতার , রাণু বুঝি তাঁর বেলার স্থান পূরণ করতেই এই পৃথিবীতে এসেছে ।

২৭ শে জুলাই রবীন্দ্রনাথ রাণুকে লিখলেন –

” … আমার খুব দুঃখের সময়েই তুমি আমার কাছে এসেছিলে— আমার যে মেয়েটি সংসার থেকে চলে গেছে সে আমার বড় মেয়ে, শিশু কালে তাকে নিজের হাতে মানুষ করেছি ; তার মত সুন্দর দেখতে মেয়ে পৃথিবীতে খুব অল্প দেখা যায়। কিন্তু সে যে মুহূর্তে আমার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল সেই মুহূর্তেই তুমি আমার কাছে এলে— আমার মনে হল যেন এক স্নেহের আলো নেবার সময় আর এক স্নেহের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।’ আমার কেবল নয়, সেদিন যে তোমাকে আমার ঘরে আমার কোলের কাছে দেখেচে তারই ঐ কথা মনে হয়েচে । তাকে আমরা বেলা বলে ডাকতুম, তার চেয়ে ছোট আর এক মেয়ে আমার ছিল তার নাম ছিল রাণু, সে অনেকদিন হল গেছে। কিন্তু দুঃখের আঘাতে যে অবসাদ আসে তা নিয়ে মান হতাশ্বাস হয়ে দিন কাটালে ত আমার চলবে না। কেননা আমার উপরে যে কাজের ভার আছে ; তাই আমাকে দুঃখ ভোগ করে দুঃখের উপরে উঠতেই হবে। নিজের শোকের মধ্যে বদ্ধ হয়ে এক মুহুৰ্ত্ত বৃথা কাটাবার হুকুম আমার নেই। সেই জন্যেই খুব বেদনার সময় তুমি যখন তোমার সরল এবং সরস জীবনটি নিয়ে খুব সহজে আমার কাছে এলে এবং এক মুহুৰ্ত্তে আমার স্নেহ অধিকার করলে তখন আমার জীবন আপন কাজে বল পেলে— আমি প্রসন্ন চিত্তে আমার ঠাকুরের সেবায় লেগে গেলুম। কিন্তু তোমার প্রতি এই স্নেহে যদি আমাকে আমার প্রভুর কাছে আমি তার কি জবাব দিতুম ? আমি এই বিদ্যালয়ে যে সেবার মধ্যে তার সেবার ভার নিয়েচি সে এবার আমার পক্ষে আগেকার চেয়ে আরো অনেক সহজ হয়েচে— আমার হৃদয়ের গ্রন্থি আরো অনেক আলগা হয়েচে– তাই আমি দ্বিগুণ স্নেহে এবং আনন্দে এবার আমার বিদ্যালয়ের কাজে লেগেছি। তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে আমার ঠাকুর আমাকে আরো বেশি বল দিয়েচেন । তুমিও তেমনি বল পাও আমি কেবল এই কামনা করচি।— তোমার ভালবাসা তোমার চারদিকে সুন্দর হয়ে বাঁধামুক্ত হয়ে ছড়িয়ে যাক— তোমার মন ফুলের মত মাধুর্য্যে পবিত্রতায় পূর্ণ বিকশিত হয়ে তোমার চতুৰ্দ্দিককে আনন্দিত করে তুলুক্‌। নিজেকে অকারণে পীড়িত করো না এবং অন্যকে পীড়িত কোরোনা— নিজেকে নম্রতার রসে পরিপূর্ণ করে সেবার কাজে সুমধুর করে তোলো। আমি তোমাকে যখন পারব চিঠি লিখব— কিন্তু চিঠি যদি লিখতে দেরি হয়, লিখতে যদি নাও পারি তাতেই বা এমন কি দুঃখ। তোমাকে যখন স্নেহ করি তখন চিঠির চেয়েও আমার মন তোমার ঢের বেশি কাছে আছে— আমার আশীৰ্ব্বাদ তোমাকে নিয়ত সঙ্গ দিচ্চে। তোমাকে স্নেহ করি বলে আশা শান্তি ভক্তিকে যদি আমি স্নেহ করতে না পারতুম তাহলে তোমার প্রতি স্নেহ আমার পক্ষে বড় লজ্জার কারণ হত। তাদের আমার অস্তরের আশীৰ্ব্বাদ জানিয়ো। আজও কথায় কথায় চিঠিটা বড় হয়ে উঠল। কিন্তু আর সময় নেই, কাগজে জায়গাও বেশি নেই, তাই এইখানে শেষ করি। আজ ছবি আঁকব ভেবেছিলুম কিন্তু চিঠি লিখতে লিখতে সময় ফুরিয়ে এল। ইতি ১১ই শ্রাবণ ১৩২৫

দুটি শূন্য স্থান পূর্ণ করেছে রাণু – কিন্তু সাতান্ন বছরের পুরুষের কাছে এগারো বছরের বালিকা মেয়ের ভূমিকা নিতে পারেন না , তাই রাণুর সম্বোধন রবিবাবুকে পরিবর্তিত করে রবিদাদা সম্বোধনে পরিণত করার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ । সাতাশে জুলাইয়ের এই চিঠিটির তলায় লিখলেন – তোমার রবিদাদা ।

রাণুর হস্তাক্ষর

বোন শান্তির সাথে রাণু

ফণীভূষণ সেবার যতদিন কলকাতায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই এসেছেন তাঁর বাড়িতে । এরপর কলকাতার চিকিৎসা সম্পূর্ণ হলে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ ফণীভূষণকে শান্তিনিকেতনে আহ্বান করেন । এ কথা বললে ভুল হবে না , রাণুর সান্নিধ্য পাওয়ার স্বার্থবুদ্ধিও তাঁর আমন্ত্রণের পিছনে কাজ করেছিল । মাসাধিক কাল রাণু শান্তিনিকেতনে ছিল , এই পর্বে সে আরও কাছে এসেছে তাঁর ভানুদাদার । শান্তিনিকেতন পর্বের সেই সব সুখস্মৃতি নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করা যাবে ।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – চিঠিপত্র , পৃথ্বীরাজ সেন , প্রশান্ত কুমার পাল , এবং বরুণ চট্টোপাধ্যায়