লিখেছেনঃ টেলেমেকাস

প্রকৃতির সাথে মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধের একটি চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে গুটিবসন্তের নির্মূলকরণ । আর এই বিশ্বযুদ্ধের সর্বশেষ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল এই বাংলাদেশেই ।

গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে বিগত শতাব্দীগুলোতে । ধারণা করা হয়, ভারতবর্ষে গুটিবসন্তের জীবাণুর প্রথম আগমন ঘটে খ্রিস্টের জন্মের ও একশত বছর আগে, মিশরীয় বণিকদের হাত ধরে । ধীরে ধীরে এই রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকে । ১৮৬৮ থেকে ১৯০৭ পর্যন্ত এই প্রায় ৪০ টি বছরে ভারতবর্ষের ৪৭ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে এই গুটিবসন্তে । এমনকি লোকজ সংস্কৃতিতে শীতলা দেবী নামের নতুন দেবীর আবির্ভাব ও ঘটে যায়, যিনি তার ভক্তদের রক্ষা করেন গুটিবসন্তের আক্রমণ থেকে ।

Untitled

Figure 1:শীতলা দেবী

এডওয়ার্ড জেনার এর হাতে গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কারের পর মানুষ যেন নতুন এক হাতিয়ার খুঁজে পেল প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের । বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে যখন আমরা পা রাখলাম, উন্নত দেশগুলো নিজেদের গুটিবসন্তের আক্রমণ থেকে একদম নিরাপদ করে ফেলেছে । ধুঁকছে স্রেফ আফ্রিকা আর ভারতবর্ষের দরিদ্র দেশের হতদরিদ্র মানুষেরা ।

১৯৬৬ সালের কথা । বিশ্বব্যাপী এক যুদ্ধের পরিকল্পনা করা হলো । গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ । চিরতরে এই রোগকে নির্মূল করা হবে ধরণীর বুক থেকে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাহায্যে দীর্ঘ পরিকল্পনা করা হলো । প্রথমে সকল নাগরিককে গুটিবসন্তের টিকা প্রদান । এরপর যারা ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়ে গেছে, তাদেরকে আলাদা করে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা ।
বলা যত সহজ, করা ততো সহজ নয়। এই দরিদ্র দেশগুলোর উপর দিয়ে সত্তরের দশকে বয়ে গেছে অজস্র যুদ্ধের ঝড়ঝাপটা ।

এই ফাঁকে বলে নেয়া যাক, গুটিবসন্তের জন্যে দায়ী হচ্ছে দুইটি ভাইরাস । ভেরিওলা মেজর এবং ভেরিওলা মাইনর । এরমধ্যে ভেরিওলা মেজর হচ্ছে সবচেয়ে বেশি সর্বনাশা, প্রাণঘাতী ।

গুটিবসন্ত নির্মূল অভিযান চলছে, আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ও কমছে । শেষে এমন হলো, গুটিবসন্তের রোগী খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর । কিন্তু প্রতিটি রোগীকে চিহ্নিত করা লাগবে, নইলে চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব হবে না । কি উপায়?

১৯৭৫ সালের কথা । বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মিলে এক কৌশল বেছে নিল । সেটা হচ্ছে, গুটিবসন্তের রোগী খুঁজে এনে দিতে পারলেই ৫০ টাকা পুরষ্কার!

Untitled1

Figure 2:সেইসময়ের স্বাস্থ্যসচিব, গুটিবসন্ত নির্মূল অভিযানের পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে । পুরষ্কারের ঘোষণা দেখা যাচ্ছে পেছনে

প্রথম প্রথম রোগীর সংখ্যা বেশি ছিল । এরপর গুটিবসন্ত রোগীরা দুর্লভ হতে শুরু করলো । পুরষ্কারের মূল্যমান ও বাড়তে থাকলো সেই সাথে পাল্লা দিয়ে । বাড়তে বাড়তে একসময় দাঁড়ালো ২৫০ টাকায় ।
Untitled

১৯৭৫ সালের ১৬ অক্টোবর । ভোলার কুড়ালিয়া গ্রামের ৮ বছর বয়সের এক শিশু, বিলকিস উন নাহার , স্বাস্থ্যকর্মীদের খোঁজ দিল এক গুটিবসন্ত রোগীর । রোগীর নাম রহিমা বানু । বয়স আড়াই বছর ।
Untitled4
Figure 3 মায়ের কোলে রহিমা বানু, ১৯৭৫ সাল

ভেরিওলা মেজর জাতীয় ভাইরাস এর কারণে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হওয়া পৃথিবীর সর্বশেষ রোগী ছিল এই রহিমা বানু । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লোকজনের তদারকিতে দ্রুত রহিমা বানু সুস্থ হয়ে ওঠে ।
এইটিই ছিল ভেরিওলা মেজর নামের ভাইরাস দ্বারা মানুষের সংক্রমিত হওয়ার সর্বশেষ ঘটনা । রহিমা বানুকে সুস্থ করে তোলার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এক বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ফ্রন্টের যেন অবসান ঘটলো , আরেকবার ঘোষিত হলো বিজ্ঞানের জয়গান ।

দোসরা জানুয়ারি, ১৯৭৬ সালে সমগ্র বাংলাদেশকে গুটিবসন্ত মুক্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয় । ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ছাপা হলো, “ বাংলাদেশ হইতে গুটিবসন্ত নির্মূল”

Untitled5

রহিমা বানুর পাশাপাশি সেই বিলকিস উন নিসার নাম ও ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেল, ভেরিওলা মেজরের সর্বশেষ গুটিবসন্ত রোগীর সন্ধান দাতা হিসেবে । বিশাল আড়ম্বরের মাধ্যমে তার হাতে ২৫০ টাকার পুরষ্কার তুলে দেয়া হল ।
Untitled6

প্রায় ২৫ বছর পর, সেই রহিমা বানুর সন্ধানে এসেছিলেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জোয়েল ব্রেম্যান । কেমন আছেন এখন রহিমা বানু?

Untitled7

Figure 4:রহিমা বানু(২০০০ সালের ছবি)

ভেরিওলা মেজর দ্বারা আক্রান্ত পৃথিবীর সর্বশেষ গুটিবসন্ত রোগী পরিপূর্ণরূপে সুস্থ জীবন যাপন করছেন। আড়াই বছরের ছোট্ট রহিমা আজ সাতাশ বছরের যুবতী। বিয়ে করেছেন আঠার বছর বয়সে । তার সংসার আলো করে এসেছে চারটি সন্তান ।

Untitled8
Figure 5:রহিমা বানুর পরিবার (২০০০ সাল )

গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে বিশ্বযুদ্ধ এখানেই শেষ হয়নি । আফ্রিকাতে আরেকটি প্রকরণ, ভেরিওলা মাইনরের বিরুদ্ধে আরো কয়েকটি বছর লড়াইয়ের পর ১৯৭৯ সালে বিজ্ঞানীরা ঘোষ্ণা করলেন, এই যুদ্ধে জয় হয়েছে মানুষের, এই যুদ্ধে জয় হয়েছে বিজ্ঞানের, চিরতরে নির্মূল করা গেছে গুটিবসন্তকে!

রেফারেন্সঃ
১) ২রা জানুয়ারি, ১৯৭৬ এর সংখ্যা, ইত্তেফাক
২) Centers for Disease Control and Prevention
৩) Public Health Image Library
৪) Nicolau Barquet, MD; and Pere Domingo, MD, “Smallpox: The Triumph over the Most Terrible of the Ministers of Death”
৫)উইকিপিডিয়া

[সর্বশেষ, ওমর শেহাব ভাইয়ের প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি 😀 ]