শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ এবং তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ অবশ্যই মানবেন যে ‘প্রগতিবিরোধী অথবা স্থিতিশীল রীতিকে ইন্ধন যোগানো শিক্ষা’ আসলে ‘অশিক্ষা’। এই ‘শিক্ষা’র বেশ উপলব্ধি হল, আমার এক আত্মীয়ার বিয়ের সুবাদে বিয়ের বছরখানেক আগে তার ‘বর’-এর বাড়িতে গিয়ে। বিবাহ নামক বস্তুটি প্রেমবর্জিত দলা পাকানো নিয়মের বিশুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে কতটা প্রসিদ্ধ, তা দেখার সুযোগ হল। বাড়ির গল্পটা শোনা যাক –

দেওয়ালে যাদের ছবি দেখছি, মনে হচ্ছে খুব মননশীল বাড়িতে এসে পড়েছি। তাগাবাঁধা বাবুর আবির্ভাব ঘটব-ঘটব করছে। ‘প্রগতিশীল’ বাড়ি। মাসিমা জ্যোতিষে বিশ্বাস করেন। করতেই পারেন। তার ব্যক্তিগত মতামত। আমিও নাছোড়বান্দা। করছি তো সম্মান। তা জ্যোতিষে বিশ্বাস নিয়ে তাঁর কি মত? আমি কিছুই বলিনি এ বিষয়ে, তিনি নিজেই হঠাৎ বললেন, তিনি আসলে এসবে বিশ্বাস রাখেন না। ছেলের বিয়ে তো, তাই একটু দুর্বলতা আর কি! পাঁজি দেখে রক্ষণশীলতাকে সপরিবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে তবেই বিয়ে হবে। এমনি তিনি জ্যোতিষ মানেন না, ছেলের বিয়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আর কি! মুহুর্তের দুর্বলতা। কিন্তু, আদতে প্রগতিশীল।

বেশ ভালো কথা! এবার ধরুন, কোনো এক ভদ্রলোক বলেন তিনি সৎ। ৩৬৪ টি দিন নিজেকে ‘সৎ’ বলে দাবি করার পর বছরের শেষ দিনটিতে দেখলেন তার বন্ধুর পকেট থেকে নোটের তাড়া বন্ধুর অলক্ষ্যেই রাস্তায় পড়ে গেল। আশপাশ দেখে আমাদের ‘সৎ’ ভদ্রলোক নোটের তাড়াটি পকেটস্থ করলেন। আসলে বছরের শেষ দিনের আনন্দ তো। মুহুর্তের দুর্বলতা। আদতে সততা। হতেই পারে। কিন্তু জ্যোতিষে বিশ্বাস রাখার পর-ও নিজেদের ‘কুসংস্কারমুক্ত’ বলে দাবি করাটা সততা, নাকি প্রগতিশীলতা, অধমের মস্তিষ্ক তা বুঝতে পারে না। যেমন পারে না, অসততার নজির পাওয়ার পরেও নিজেকে সৎ বলে দাবি করাটা কোন গ্রহের সততা, সেটা বুঝতে। গ্লাইস-৫৮১-সি নামের গ্রহের? নাকি সংস্কার নামধারী অজ্ঞেয় বিগ্রহের, যার কাজ মস্তিষ্কের grey-cell-কে নিস্তেজ করে রাখা?

বরমশাই হবু বিজ্ঞানী। ‘Casteism’ মানেন, কিন্তু ‘গায়ে মাখেন না’। পুঁজিবাদী-শক্তি ‘সংরক্ষণ’-এর নাটক এমনভাবে সাজায়, যাতে তথাকথিত ‘সাধারণ’-দের ক্ষোভ-টা গিয়ে পড়ে তথাকথিত ‘সংরক্ষিত’-দের উপর, ছক-সাজানো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর উপর নয়। ‘জনদ্বন্দ’ এভাবেই তৈরি হয়। হবু-বিজ্ঞানী যেভাবে এই ‘সংরক্ষিত’-দের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন, তাতে একথা স্পষ্ট যে পুঁজিবাদী-ব্যবস্থার দুর্দান্ত ‘গুল-টি তিনি ভালোই বিশ্বাস করেছেন। বিজ্ঞানীর জ্ঞান যখন বিচারবুদ্ধি-বর্জিত, তখন এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা আশা করা যায়। বরমশাই তো আবার তাঁর ‘হবু-বৌ’-কে ‘জেনারেল’ ভাবতে ভালোবাসেন। আহা! বিজ্ঞানীপ্রবরের কি লজ্জা! যেন তথাকথিত ‘জেনারেল’ নামে পরিচিত না হলে পুঁজিবাদী সমাজে টিকে থাকা যায় না! যে প্রগতিশীল ব্যক্তিরা জাতের ধার ধারেন না, তাঁদের কটাক্ষ করে তির্যক ভঙ্গিতে ‘মডার্ন ফ্যামিলি’ বলে ওঠেন এই হবু-বিজ্ঞানী। তাও ভালো, ‘মডার্ন ফ্যামিলি’ আখ্যা দিয়েছেন – তা সেটা ভালো ভঙ্গিতেই হোক, কিংবা তির্যক ভঙ্গিতে। শুধু তাই নয়, এই বিজ্ঞানী তো আবার গোত্র-টোত্রকে ‘বিজ্ঞানভিত্তিক’ মনে করেন। অর্থাৎ তিনি মনে করেন, “ভরদ্বাজ, জমদগ্নি, কশ্যপ, বশিষ্ঠ, অগস্ত্য, অত্রি, বিশ্বামিত্র এবং গৌতম”-এই ঋষিরাই গোত্রের প্রবর্তক, যা ‘ইতিহাসনির্ভর’। এই প্রবর্তনের সময়কাল? সেটা জানলে বোধ হয় বিজ্ঞানীর কপালে ভাঁজ পড়বে, যদি তিনি এই ‘সময়কাল’টি না জেনেই ব্যাপারটায় বিশ্বাস করে থাকেন।

আমার মোটেই অদ্ভুত লাগছে না। নিজের বিশ্বাস বা আদর্শ আসলে কি, সেটা আমরা অনেকেই বুঝি না। থুড়ি, বুঝি, কিন্তু এইচ জি ওয়েলস-কে আমরা এতটাই শ্রদ্ধা করি, যে রক্ষণশীলতার time-machine তৈরি করে নিয়ানডারথ্যালদের যুগে ফিরে যাওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমাদের জুড়ি মেলা ভার (তথাকথিত বিলুপ্ত ঐ প্রজাতি অন্তত সভ্যতার পথে কিছুটা এগিয়েছিল। সভ্যতাকে পিছিয়ে দিতে চায়নি)। প্রকাশ্যে ‘শ্যালক বরাহনন্দন’ বলে চিৎকার করাটা অশিক্ষা, আর আমাদের এই অসামান্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মহান নীতিগুলো কি অসাধারণ শিক্ষার বহিঃপ্রকাশ। “বাড়ির বউ জিনস-প্যান্ট পরবে, এটা আমাদের পরিবারের নীতিবিরুদ্ধ।”—তথাকথিত শিক্ষিত বাড়ির নিয়মকাঠিন্য। “বাড়ির বউ-এর ম্যাক্সি পড়া চলবে না। অশালীন। আর, নিজের ‘Caste’-ও জনসমক্ষে বলা চলবে না। বলতে হবে, আমি ব্রাহ্মণ। বর যেখানে যাবে, সেখানেই থাকতে হবে। ভোগে যাক পোস্ট-ডক্টরেটের আশা। বর যদি মার্কিন মুলুকে যায়, তাহলেও বউ-ও যেতে বাধ্য।” ‘ভালবাসা’-র স্বার্থে ত্যাগস্বীকার না আপন অস্তিত্ব জলাঞ্জলি দেওয়া, তা ভেবে দেখার সময় অনেক মেয়েই পায় না। নাক কেন গলাচ্ছি? কারণ এইসব নিয়ম তো নিঃসন্দেহে প্রগতির সহায়ক নয়, বরং স্থিতিশীল। কিংবা পশ্চাৎমুখী। এটা তো রক্ষনশীলরাও মানবেন। কিন্তু তবু সেই নিয়মকে জবরদস্তিপূর্বক প্রয়োগ করা চাই। অর্থাৎ, নারী স্বাধীনতা হরণ ও নারীকে sadistic মানসিকতায় ঠেলে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা নয়? ‘Fifty Shades of Grey’-র বিষয়বস্তু আর ভঙ্গি সম্পর্কে শুনে অনেকেই গাল পাড়েন, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলাদের এই sadistic approach-টা বেশ প্রাণবন্ত লাগে! কি ভয়ংকর সুন্দর contradiction, তাহলে বাপু খামোখা ই. এল জেমস-কে গালমন্দ করার কি দরকার! বউ-এর পরিবার যদি এখন দাবি করে বসেন, ধুতি ছাড়া অন্য কোনো পুংবস্ত্র পরিহিত পুরুষকে তাদের কন্যা বিয়ে করবে না, তাহলে? এটিও প্রগতিবিরোধী চিন্তা, কিন্তু এই চিন্তাটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। কারন, এতে নারীর স্বাধীনতা হরণের কোনো অবকাশ নেই। তথাকথিত মনন যে perversion-এ পর্যবসিত, তা মনের অবচেতনে ধরা পড়েছে বলেই কী তাকে ‘রীতি’ বা ‘পারিবারিক-রীতি’ নামে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা? যে চিন্তা স্থিতিশীল, প্রগতির নিরিখে যে চিন্তা বা নিয়ম সামান্যতম গতি আনতেও ব্যর্থ, যে নিয়ম স্রেফ পারিবারিক নিয়মের আস্তাকুঁড়ে পড়ে থেকে ‘হৃদয়ের গভীরতা’-কে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখে ‘শিক্ষাহীন শিক্ষিত মন’-এর বেড়াজালে, কেন সেই নিয়মকে তুলে আছড়ে দিতে এত ভয়? ডিগ্রিধারী ‘প্রগতিশীল’ কেন পারেন না প্রগতিবিরোধী পারিবারিক নিয়মকে যুক্তিবাদের আলোকে প্রত্যাখ্যান করতে? যুক্তি যে আবেগ এবং সম্মপর্কের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী, তা কি তিনি জানেন না? নাকি এটা Social Perversion? কিংবা সামাজিক অশ্লীলতা? নাকি পারিবারিক নিয়মের বেশে নারীর স্বাধীনতা খর্বকারী যুক্তিহীন গোখরোর উদ্যত ফণা? দেওয়ালে মননের উদ্রেককারী মহান ব্যক্তিত্বের ছবির সামনে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে নিশ্চয়ই লজ্জা লাগবে এই বীর শিক্ষিতবর্গের। থাক, আর লজ্জা দিতে চাই না। আপনাদের পরিবারে কার কটা বিয়ে হল, তা নিয়ে আমি চিন্তিত নই। একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে, একবার ভেবে দেখুন মশাই, পণপ্রথাকে যে কারণে আপনারা দূরে সরিয়েছেন, তাকেই কি ইন্ধন যোগাবে না এই প্রচ্ছন্ন নারীবিদ্বেষী আচরণ? নারীবাদী কথা বলছি না। বস্তুবাদী সাম্যবাদী চিন্তাধারার একটি দিক-কেই অনেকে নারীবাদ বলে চিহ্নিত করেন। মেরি উইলস্টোনক্রাফট-এর কাজ কে ‘নারীবাদী’ না বলে ‘প্রগতিশীল’ বলাটাই আমার কাছে শ্রেয়। প্রগতি কিন্তু প্রগতি-ই, পুরুষের স্বার্থেই হোক বা নারীর স্বার্থে। সে নিয়ে তর্ক নয়। কিন্তু বাস্তববাদী চিন্তাধারার মোড়কে যে কূৎসিত দানবকে সেই মান্ধাতার দাদুর আমল থেকে পুষে আসছেন, সেই দানবকে হত্যা করার দায়িত্ব নিতে এত কুণ্ঠা বোধ করা কি তাহলে সেই দানবকেই সমর্থন? তথাকথিত জাতিভেদের বেড়াজাল ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসার মানসিকতা যতটা প্রগতিশীল, উপরোক্ত আচরণ ঠিক ততটাই প্রগতিবিরোধী। মনে মনে অন্তত একবার নিজেদের ভর্ৎসনা করার সাহসটুকু কি একবার-ও দেখাবেন অভিযুক্ত বীরপুঙ্গবেরা, যারা আমাদের সমাজে আদ্যিকাল থেকে বিরাজমান।

সমাজব্যবস্থার শোষকশ্রেণির রূপ বদল হয়েছে, বদলে গেছে পদ্ধতি। সেদিনের ‘মহারাজ’-শোষক আজ পোশাক পালটে সাধু সেজেছে। উদ্দেশ্য বা প্রকৃতি ছিটেফোঁটাও বদলায়নি। আর এই অসাম্যের বীজ ইঞ্জেকশন-সিরিঞ্জের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে পেটি-বুর্জোয়া ও সর্বহারা শ্রেণির একাংশের মধ্যে। শ্রেণিচেতনাকে ধ্বংস করতেই প্রচেষ্টা। এখন অগ্রগতির উপায়? খুব সহজ। শোষণমূলক সমাজব্যবস্থাকে যারা টিকিয়ে রাখতে চান, তাঁদের আবার তাড়া করুক সেই উনিশ শতকের ‘ভূত’ – সেই ‘ভূত’, যা গোটা ইউরোপ ছেয়ে গেছিল। সেই ‘ভূত’-ই পারবে প্রগতি আনতে, আর কেউ নয়।