তখন ও এখন
গীতা দাস
পর্ব ২৩
আমাদের সময়ের লেখাপড়ার জন্যে কালির কলম ছিল অপরিহার্য অংশ। কালির দুই রকমের কলম ব্যবহৃত হত। ড্রপার দিয়ে দোয়াত থেকে কলমে কালি ভরা আর পাইলট কলমেই ড্রপার লাগানো। কলমে কালি ভরা ছিল এক মজার খেলা। এ নিয়ে অহেতুক সময় ক্ষেপণ করতাম। মাঝে মাঝে কলম গরম জলে ধুয়ে নিপের ময়লা পরিস্কার করে কালি ভরতাম। কালি ভরতে গিয়ে হাতে মুখে লেগে যেত। কালো আর ব্লু এ দুই রঙের কালি ব্যবহার করতাম।
ধাঁ ধাঁয় পরতাম — কালি বললে সাধারণত কালো রঙই বুঝতাম। তোর গালে কালি ভরেছে মানে কালো কিছু লেগেছে। আবার লাল কালি, নীল কালি, সবুজকালি ও কালো কালি তো আছেই।
বেশ বড় হয়ে — পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে — দাবী করে তবে ড্রপার লাগানো অর্থাৎ পাইলট কলম ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছি। নাইলন জামাও ছিল অনেকের কাছে আকাঙ্ক্ষিত পোষাক। মুখে মুখে শোনা যেত —-
‘নাইলন জামা আর পাইলট পেন
উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেন ।’
বার্ষিক শেষ পরীক্ষার পর কালি খেলা চলত। কলমের কালির শেষ ফোঁটা পর্যন্ত ছিটিয়ে দিতাম সহপাঠিদের জামায়। নিজের জামাও রাঙিয়ে (আসলে কালিয়ে) বাড়ি ফিরিতাম। জামার পেছনে মন্তব্য লেখা হত।
এ নিয়ে প্রতিবারই সোনা কাকার কানমলা খেতাম আবার পরের বার ইচ্ছে করেই ভুলে যেতাম।
আমার স্মৃতি বিজড়িত ঐসব জামা কাপড় না থাকলেও আমার ছেলের সেন্ট যোসেফ স্কুলের শেষ দিনের তার বন্ধুদের মন্তব্য সম্বলিত ও কালি মাখানো স্কুলের ইউনিফর্মটি আমি সযতনে সংরক্ষণ করছি। মেয়ের হলিক্রস স্কুলের জামাটি স্মৃতি বিজড়িত হয়ে সাজানো আছে ওয়ার ড্রবের কোণায়। এখানেই আমার ছোটবেলার বড়দের সাথে আমার বড়বেলার ছোটদের সম্পর্কের পার্থক্য।
ছোটবেলায় দেখতাম মাথায় তেল দেয়া মা কাকীমাদের জন্যে এক ধরণের বিনোদন —- সুখকর অনুভূতি — গাল গল্পের সুযোগ। বিলিয়ে বিলিয়ে একজন আরেকজনকে তেল দিয়ে দিতেন।
তেলের মধ্যে বাবা হিম কবরী ব্যবহার করতেন। মা ও তাই দিতেন। আমাদের মাথায় আমাদের বোন (ঠাকুমার বোন) নারকেল তেল বিলিয়ে বিলিয়ে দিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে হিমকবরী। আমরা অবাক হতাম নরসিংদীতে হিমকবরী তেলের কারখানা প্রতিষ্ঠিত জেনে। কোন পণ্যের কারখানা মানেই দূরে কোথাও হবে অর্থাৎ নাগালের বাইরে।
কোন বউ বাপের বাড়ি যাবার সময় বা কোন মেয়ে শ্বশুর বাড়ি যাবার সময় অবশ্যই মাথায় তেল দিয়ে যেত। তা না হলে যে বাড়ি থেকে গেল সে বাড়ির দৈন্যতা প্রকাশ পায় বলে ধারণা করা হত।
গ্রামের কোন মহিলার উড়া মাথা মানে তেল বিহীন মাথা আর্থিক অস্বচ্ছলতার নির্দেশক ছিল। এখনও হয়তো আছে।
বোতলের ক্যাপ দিয়ে ( আমরা বলতাম বোতলের মুটকি) মেপে নারকেল তেল ধার নিয়ে মাথায় দিত। সুদৃশ্য কৌটা বা বোতলে নয় — টিনের তেল খুচরা কিনে আনা হত।
আমার বিয়ের পর পর শ্যাম্পু ধোয়া মাথা নিয়ে আমি নরসিংদী যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি। আমার শ্বশুর বাড়ির পাশের এক মহিলা বললেন —– মাথায় তেল দিয়ে যাও, নইলে তোমার বাপ মায় ভাববে তোমার শ্বশুরের তেল কেনার পয়সা নেই।
একটু হেসে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিলাম।
কেউ জবজবে করে মাথায় তেল দিলে বলতাম – বাজনাদারদের মত তেল দিয়েছিস।
বাজনাদার বলতে বিয়ে বা পূজায় যারা ঢাক, ঢোল, বাঁশি, সানাই বাজাত। বাজনাদাররা সাধারণত আমাদের বাড়িতে বাজাতে আসলে ইচ্ছে মত মাথায় তেল দিয়ে স্নানে যেত।
এখন অফিস আদালত, স্কুল কলেজে তেলে মাথা দেখি না। নিজেও দেই না। তেলে মাথায় তেল দেয়ার চর্চা বাড়লেও আক্ষরিক অর্থে তেলা মাথা কিন্তু দেখা যায় না।
প্রত্যেকের জীবনে এমন কিছু স্মৃতি থাকে বা আমরা এমন কিছু কাজ করি যার মাধ্যমে নিজে ঠকি বা অন্যকে ঠকাই। তবে তা অন্যের সাথে কখনো বলি, কখনো বলি না বা বলতে পারি না। আমার জীবনের এমনি একটি ঘটনা। জিয়াউর রহমানের শাসনামল। নরসিংদী মহিলা কলেজ থেকে এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছি। সে বছর এইচ এস সি পরীক্ষার্থীদের দায়িত্ব ছিল যে কোন দুই বা একজন নিরক্ষরকে সাক্ষর বানানো। এজন্য একটা নির্দিষ্ট নম্বরও ছিল। আমি কোন নিরক্ষরকে সাক্ষর করিনি। এ কার্যক্রম পরিবীক্ষণের কোন প্রক্রিয়া ছিল না বলে আমি শুধু সাক্ষর নয়, বাংলা ভাল মত পড়তে জানা আমার এক কাকীমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম সদ্য সাক্ষর সাজিয়ে। এই যে ফাঁকি দিয়েছিলাম তা আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। পরবর্তীতে যদিও আমার এক গৃহকর্মীকে আমার মেয়ের সাথে শুধু সাক্ষর নয়, বাংলা ভাল মত পড়তে শিখিয়েছিলাম। তবুও কী প্রায়শ্চিত করা হয়েছে!
আমার এ জবাবদিহিতা কোন ঈশ্বরের কাছে নয় বা তাঁর ভয়েও নয়, আমার এ জবাবদিহিতা আমার নিজের কাছে — নিজের বোধের কাছে — বিবেচনার কাছে। আমি কাকীমাকে সদ্য সাক্ষর সাজিয়ে কাকে ঠকিয়েছিলাম? আমার শিক্ষককে? সমাজকে? দেশকে? না। পরবর্তীতে আমার উপলদ্ধি বলেছে নিজেকেই ঠকিয়েছিলাম। বাধ্যতামূলক একটি ভাল কাজ করার সুযোগ হারিয়েছিলাম। আমার পাশের একজনকে আলো থেকে বঞ্চিত করেছিলাম। সরকারী সাক্ষরতার পরিসংখ্যানে ভুল তথ্য সংযোজন করেছিলাম।
‘এই মানুষকে ছাড়া আর কাউকে কখনো আমি
এতো অসহায় হতে দেখিনি
শীতে ভিজে প্রাণীকূল, পাখিরাও কাঁপে
কিন্তু মনস্তাপে শুধু জ্বলে ভগবান, তোমার মানুষ!’
মহাদেব সাহার ভগবানের মানূষ — এই আমি এতদিন যাবৎ মনস্তাপে পুড়ছি। আজকে বলে ফেলার পর কিছুটা কী লাঘব হবে?এমনি করে মনস্তাপের ঘটনা আমার আরও আছে এবং সবারই কী আছে?
গীতা দাস
৫ অগ্রহায়ণ, ১৪১৫/ ১৯ নভেম্বর, ২০০৮
hi Gita di,
When I was reading it,I was then in my childhood.
Surely,every person should recall and remember their childhood.Many thanks and great wishes for you.
তাই কি? আমিতো মোটামুটি ভালই দেখছি এই কমেন্ট লেখার সময়। এনিওয়ে, আপনি বরং ওয়ার্ড এ ফন্ট সাইজ ১৪ দিয়ে কমেন্ট লিখে কপি করে এখানে এনে পেস্ট করে দিন। ছোট দেখালেও সমস্যা নেই। যখন আপনার কমেন্ট মডারেটেড হয়ে রিলিজ হবে তখন ঠিকই বড় দেখাবে। আমাদের কমেন্টসের ফন্ট সাইজ ডিফল্ট করা আছে।
Farid vai,, ami to avro keyboard download korechi. But avro diye ekhane banglae comment likhle letter gula khuuuuub chotto chotto ashe. font boro korar upae ki?
I always read Gita dasher lekha.
Her write up back to me in my child hood.
In my boy hood I wrote in Banana Leaf.Still I could remember.
Thanks to Gita.Please keep going and we need more write up in your past experience please.
Harun Chowdhury
USA
লুনা,
আপনি অভ্রু কীবোর্ড ডাউনলোড করে নিন। তাহলেই বাংলায় কমেন্ট করতে পারবেন। ডাউনলোডের লিংক এই পাতাতেই দেওয়া আছে। অভ্রু ব্যবহার করাও খুব সোজা। ফোনেটিক হওয়ার কারণে বিজয়ের মতো কীবোর্ড মুখস্ত করার দরকার নেই।
Gita Di
Farid eabong Avijit kamon kore eay comment er gore bangla lekhe eata amar motto olop budhir manush janbe na, kintu ami o apnake bangla tey likhte cheasilma. Apnar lekha poresi o porbo, pisu fele asha somoy er golpo mone hoy amar jiboner sombchey prio bishoy r apni shekhaney kolom chalieasen, abeg chara ki manush hoy? sottota rokha korte holeo abeg lage, apnar lehka porle boja jay apni kotto basi sundor kore jibon ke jaopn koren. sundor thakun.
luna shirin
হ্যা, গীতা দাসের লেখা খুবই মজার। কালি নিয়ে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা আমারো অনেকটা ফরিদ ভাইয়ের মতই।
ধন্যবাদ গীতা দাসকে সিরিজটি লেখার জন্য।
গীতা দি,
আপনার লেখা পড়লে শৈশব কৈশোর একেবারে জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে চলে আসে। আহা! কী সব দিনই না ফেলে এসেছি আমরা। হাজার মাথা কুটে মরলেও ফিরে পাওয়া যাবে না সেগুলো আর। এখনো বুকের মধ্যে নিরন্তন হাহাকার শুনতে পাই ফেলে আসা সেই সব দিনের জন্য।
কতদিন পর সেই পাইলট কলম নিয়ে মজার ঘটনাগুলো মনে পড়লো। স্কুল পড়ুয়া সব ভাইবোন মিলে রীতিমত অনুষ্ঠান করে কলম ধোয়া, নিবের মাঝখানের ফাড়াটা ব্লেড দিয়ে পরিষ্কার করা, অতি যত্নে ড্রপারে কালি ভরা। অসম্ভব বেখেয়ালী ছিলাম বলে হাফ শার্ট বা হাফ প্যান্ট এ কালি লেপ্টানো ছিল আমার নিয়মিত ঘটনা। আর এ কারণে আম্মার হাতের ধুরুম ধারুম পিটুনিও কম জোটেনি আমার পিঠে।
তারপরতো এলো ইকোনোর যুগ। কালি ভরার কোন ঝামেলা নেই। ব্যবহার শেষ হলেই ছুড়ে ফেলে দেয়া যায় প্লাস্টিকের কলমটা। তবে সেই যুগে এসেও আমার রক্ষা নেই । প্যান্টের পকেটে প্রায়শই সোজা করে কলম রাখতাম আমি। তারপর তালপাকা ঢাকার গরমে সেই কালি গলে পকেটসহ প্যান্টের দফারফা। আর কী ভয়ংকর হারকিউলিসের মত শক্তিশালী সেই কালি। নিরালা বল সাবান বা জেট গুড়া সাবান দিয়ে যুদ্ধ করেও হটানো যেত না তাকে।
শৈশব কৈশোরের ফেলে আসা মধুময় স্মৃতি জাগানিয়া অসাধারণ এই সিরিজটা লেখার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।