বলো তো রেডিও কে আবিষ্কার করেছিল?
মার্কনি।
আর শুরু হতো কনুই মারা। যে পর্যন্ত না ‘বুঝেছি’ শব্দটি বলা হতো। ‘বুঝেছি’মানে কনুই মারতে বলা হয়নি।
বুঝেছি মানে ইতালীর মার্কনি। গুগলিয়েলমো মার্কনি। যে খেলার কোন আগামাথা ছিল না—কোন নিয়ম-নীতির ধার ধারাও হতো না। যে কোন উছিলায় একটু হৈ চৈ করতাম। মজা করা বৈ আর কিছু নয়।
আরেকটি খেলা ছিল বানান ধরা। আচ্ছা, বানান করতো খালেক?
উত্তর হতো— মা বলে খা আর বাবা বলে লেক। মানে লেখ। এই হলো খালেক। আঞ্চলিক ভাষায় লেখাকে লেকা বলতাম। এমন ধরণের বহু শব্দের বানানের পরীক্ষা চলতো।
এসব খেলায় মানে বানানের বানানোতে তথা কারসাজিতে থাকতো নিজেদের মনের মতো বিশ্লেষণ।

এখন হৈ চৈ করতে উপলক্ষ্য লাগে। প্রস্তুতি লাগে। যথেষ্ঠ যুক্তি লাগে। আগের মতো শুধুমাত্র আবেগের আহ্বানে — সমর্থনে উদ্ধুদ্ধ হতে পারি না। এতো হিসেব-নিকেশ করে চলতে চলতে প্রায়শঃই হাঁপিয়ে উঠি বৈ কি! তবুও হিসেব।
বসে হিসেবও আবার আগের মতো নেই। আমরা শুধু দুইয়ে দুইয়ে চার বা তিনে একে চার , চারটা এক যোগ করে চার অথবা দু যোগ এক যোগ এক যোগ ও চার হয়। অথবা চার যোগ শুন্য সমান চার শিখেছিলাম। এখন হিসেবের আরও অন্য অনিয়মের নিয়ম রয়েছে। অলিখিত, অনেক ক্ষেত্রে অনৈতিক এবং সর্বজন স্বীকৃত না হলেও বিদিত। ফাঁক — ফাঁকি যা ধরতে পারি না। সেই প্রচলিত গল্পটির মতোই —–
‘কোন বা দেশে আইলাম রে বা
কী বা দেশের গুণ।
এক্কই গাছে পান সুপারি
এক্কই গাছে চুন।’
অর্থাৎ সুপারি গাছে পানের লতা বেয়ে উঠেছে, আর পানের মধ্যে পাখির সাদা পায়খানা চুনের মতো লাগছে।
তা দেখে এক ভিনদেশীর এ মন্তব্য।
হ্যাঁ, আমরাও সে রকম একটি সমাজে, দেশে এবং বিশ্বেই এখন থাকি, যেখানে একের ভেতর তিন রকমের সুযোগ সুবিধা রয়েছে বলে প্রলোভন রয়েছে, তবে এর মধ্যে একটি চুনের মতোই নির্ঘাত ফাঁকি। অন্যটাও পান পাতা কি না পরখ করার প্রয়োজন রয়েছে। যেমনঃ সে ফাঁকিতে পরেই প্রতিদিন ষোল পাতার পত্রিকা কিনি,ছয় পাতা যায় বিজ্ঞাপনের জন্যে বরাদ্ধ। এক পাতা খেলার, দুই পাতা বিনোদনের,এক পাতা যুব পাঠকদের, আরেকটা স্বাস্থ্য পাতা, অন্যটা বাণিজ্য, আরও আছে রূপচর্চা ও ফ্যাসনের পাতা। হাতে রইল কত?

পয়সা দিয়ে প্রতিদিন অপ্রয়োজনীয় কিছু পাতা কিনতেই হয়। সব পাতা সবার জন্য দৈনিক পত্রিকায় তা সম্ভব নয় জানি, কিন্তু পাতাগুলো প্রায়শঃই শুধু ভরাট করা হয় অক্ষর দিয়ে। স্বাস্থ্য বার্তায় আজকে এক বিশেষজ্ঞ যা বলেন কালকে অন্যজন বলেন এর বিপরীত। বিনোদনের পাতায় কোন নায়িকা কী করতে ভালোবাসেন আর কার সাথে কোথায় ঘুরেছেন তা ও পয়সা দিয়ে কিনি।

গণ মাধ্যম, গণতন্ত্র, তথ্য অধিকার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এসবের জোয়ারে হরেক রকম পত্রিকা রয়েছে বাজারে, টিভি চ্যানেলও কম নেই। ই- পত্রিকা এবং ওয়েব পাতা তো আছেই। এক একটা খবর মাথা গুলিয়ে দেয় বৈকি! মাইকেল জ্যাকসন তো মরেও তার মৃতদেহ দিয়ে গোলক ধাঁ ধাঁয় ঘুরাচ্ছে। হায় রে ডিজিটাল পৃথিবী!

বাংলা ও ইংরেজি দুই নববর্ষেই ক্যালেন্ডার সংগ্রহের একটা উদ্যোগ থাকতো। বাংলা ইংরেজি দুই ধরণেরই ক্যালেন্ডার সব ঘরের সব দেয়ালে না হলেও প্রত্যেক ঘরে অন্তত একটা করে ক্যালেন্ডার ঝুলানোই ছিল এ সংগ্রহের লক্ষ্য। আর যে কয়টা ক্যালেন্ডার সংগৃহীত হতো সবগুলোই ঝুলানো হতো। তবে পাওয়াও যেতো খুব কম। এ রেওয়াজ আমাদের গ্রামের প্রায় সবার মধ্যেই ছিল।

আমার বাবা কাকারা আমাদের বাড়িতে অনুমোদন না দিলেও অন্যদের বাড়িতে দেখেছি সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে বাহারী তারা বা বাক্স বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখতো।

একটা মাস শেষ হলে সে মাসের পাতা দিয়ে বইয়ের মলাট লাগাতাম। বছরের প্রথমে লাগানো মলাট ময়লা হয়ে যেতো বা ছিঁড়ে যেতো। কাজেই ভাইবোনদের মাঝে অলিখিত নীরব প্রতিযোগিতাও চলতো মাস শেষে কার আগে কে গত মাসের ক্যালেন্ডারের পাতা দিয়ে মলাট লাগাতে পারে। তবে মাস যেন সহসা ফুরাতে চাইতো না। ত্রিশ বা একত্রিশ দিনকে বড়ো সুদীর্ঘ মনে হতো। কোন কোন ক্যালেন্ডারে আবার এক পাতাতেই বারো মাসও ছিল।

মলাট লাগানো ছাড়া কবে পাতা উল্টিয়ে নতুন ছবির পাতা বের করবো এ আগ্রহও নেহায়েৎ কম ছিল না। ঐ নতুন পাতা কে উল্টাবে এরও প্রতিযোগিতা চলতো। এখন দ্রুত সময় বয়ে যাচ্ছে। ক্যালেন্ডারের পাতা যেন ঘন ঘন উল্টাতে হচ্ছে। ফুরাচ্ছে জীবনের লেন দেন। প্রায়ই দেখি দুই তিন তারিখ হয়ে গেছে অথচ পাতা উল্টানো হয়নি। ক্যালেন্ডারও একটার বেশি ঘরে রাখি না এবং এখনকার ক্যালেন্ডারের ছবি আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি আকর্ষণীয়, তবুও না।

ঢাকার পরিচিতদের বাসায় ক্যালেন্ডার দেখিই না। পাল্টে গেছে এবং যাচ্ছে আমাদের সৌন্দর্যবোধ এবং ঘর সাজানোর রুচি। ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন এখন একট কলা বা আর্ট। অনেকে একে বিজ্ঞানও বলেন।
গ্রামে ঘরে ঘরে কাপড়ে সূতায় ফুল ও লোক প্রবচন সেলাই করে বাঁধিয়ে রাখার রেওয়াজ চলে গেছে। তবে অন্য মোড়কে তা ফিরে আসছে। যেমনঃ আধুনিক চলচ্চিত্রের বাংলা গানে —-
‘যাও পাখি বলো তারে
সে যেন ভোলে না মোরে।’
আমরা যদি তথাকথিত সেকেলে —– মান্ধাতার অনেক কিছু আবার আধুনিকতার মোড়কে ফিরিয়ে আনতে পারতাম!
গীতা দাস
[email protected]
১০ শ্রাবণ ১৪১৬/ ২৫জুলাই, ২০০৯