বাংলাদেশে সামরিকীকরণঃ গণতন্ত্রের বিপদ
মুশতাক হোসেন
আজ শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম এর ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সনের এদিনে সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানের স্থপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম-কে জেনারেল জিয়ার সামরিক জান্তা বিচার প্রহসন করে ফাঁসী দিয়ে হত্যা করে। গোপন বিচারে বেআইনীভাবে আবু তাহেরকে হত্যা ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেবার পরে ৩৩ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত ঐ মামলা পর্যালোচনা করা হয়নি। তাহেরকে বেআইনীভাবে ফাঁসী দিয়ে হত্যার ১০ দিন পরে ফাঁসীকে জায়েজ করার জন্য ভূতাপে কার্যকারীতা দিয়ে নতুন সামরিক আইন বিধি জারী করা হয়। গত দু’ যুগেরও বেশী সময় ধরে সকল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক মহল এ বেআইনী ও কলংকজনক মামলার রায় বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। আজ আবার আমরা আহ্বান জানচ্ছি অবিলম্বে এ মামলাকে পর্যালোচনা করে অবৈধ রায় বাতিল করার। সেই সাথে দাবি জানাচিছ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নির্ভীক বিপ্লবী শহীদ আবু তাহেরকে তাঁর প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠার।
রাষ্ট্রের সামরিকীকরণ কেন হয়? কখন হয়?
পুঁজিবাদ হচ্ছে মুনাফাভিত্তিক অর্থনীতি, সেখানে সামরিক খাত একটি মুনাফা অর্জনকারী খাত। এছাড়াও পুঁজিবাদী দেশসমূহের পরস্পর প্রতিযোগিতার কারণে এবং শক্তি দিয়ে গণপ্রতিরোধ দমন ও নতুন বাজার দখলের প্রয়োজনে সামরিক খাতকে বিকশিত ও আধুনিকীকরণ করতে হয়। আমাদের মত ‘তৃতীয় বিশ্বে’র দেশগুলোতে ভারী ও মৌলিক খাতে শিল্পায়ন হয়নি, তাই শিল্প বুর্জোয়া শ্রেণী বেশ দুর্বল। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর শাসক শ্রেণী এসব দেশে আত্মনির্ভর শিল্পায়নের ক্ষেত্রে আগ্রহ না দেখালেও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও সশস্ত্র বাহিনীর টেকসই উন্নয়নে বিপুল আগ্রহ, উদ্যোগ, সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। এর ফলে ‘তৃতীয় বিশ্বে’ শিল্প বুর্জোয়া বা উদ্যোক্তার ভিত্তি দুর্বল হলেও, গড়ে উঠেছে ”অতি বিকশিত” সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র। ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা, নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এদের ভূমিকাই সবসময় থেকেছে নির্ধারক। রাজনৈতিক উত্থান-পতনে, দ্বন্দ্ব সংঘাতে, ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় সামনে থেকেছে রাজনৈতিক দল,ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে তারাই। কিন্তু ক্ষমতাশালী সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র কখনোই ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। এ কারণে এসব দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি বিকশিত হতে পারে নি, বিকশিত হয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র।
সামরিকীকরণ চলে দু’টো সমান্তরাল প্রক্রিয়ায়। একদিকে সামরিক শক্তির বিপুল বৃদ্ধি ঘটে; অন্যদিকে জনগণকে শক্তিহীন করে তোলার জন্য আদর্শিক প্রচার চালানো হয়, যেন বিরুদ্ধ শক্তিকে দমন করার তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণ সহজ হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে সামরিকীকরণের প্রমাণ হচ্ছে আরো পুলিশ, আরো জেলখানা, আরো গুপ্তচর, আরো অস্ত্র, আরো সৈন্য। রাষ্ট্রের সম্পদ সামাজিক খাতগুলো থেকে নিরাপত্তা নামধারী খাতে ক্রমবর্ধমান হারে স্থানান্তরিত হয়।
সামরিকীকরণ কেবলমাত্র মারাত্মক বিধ্বংসী অস্ত্রসজ্জিত বাহিনী নয়। গোটা সমাজের চিন্তা-চেতনার সামরিকীকরণ একে পূর্ণতা দান করে। গোটা সমাজে একটা জেহাদী জিগির তোলা, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ধুয়া তোলা, সকল কাজকে সামরিক কায়দায় সম্পন্ন করার চেষ্টা, সন্ত্রাসকে আইনগত বৈধতা দান (যেমন, ‘ক্রসফায়ার’) প্রভৃতি এর তাত্ত্বিক-ব্যবহারিক দিক। অর্থনীতিতে একচেটিয়াবাদের প্রাধ্যান্য ঘটে। ছোট ছোট পুঁজিকে বড় ও দুর্বৃত্ত পুঁজি গিলে ফেলে। অর্থাৎ সামরিকীকরণ হচ্ছে সামরিকতাবাদের সাথে একটা কাল্পনিক আদর্শের মেলবন্ধন – যা ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর। তাই সামরিকীকরণ হয় বিভিন্নভাবেঃ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভৃতি।
সরাসরি সামরিক স্বৈরশাসন ঝাঁপিয়ে পড়ে কখন?
দেশের পুঁজিপতি-ধনিক শাসক শ্রেণী যখন পোষাকী গণতন্ত্রের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা আর চালাতে পারে না; পুঁজিপতি-ধনিক-বণিক গোষ্ঠীর প্রতিদ্বন্দ্বী অংশসমূহ যখন আত্মঘাতী কলহে লিপ্ত হয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বিপদাপন্ন করে তোলে; শোষণ-বঞ্চনার চরমে পৌঁছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যখন শ্রমিক শ্রেণী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশ বিদ্রোহ করতে উদ্যত হয়; সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ যখন অনুন্নত দেশটিতে পোষাকী গণতান্ত্রিক আবরণে শোষণ-লুন্ঠন চালাতে বাধা ও ঝামেলার সম্মুখীন হয় – তখন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচাইতে শক্তিশালী অঙ্গ সামরিক বাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখল করে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থাকে ‘বিপদ’ থেকে ‘উদ্ধার’ করার জন্য। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার একটা ‘সুরাহা’ করে তারা সরে যায় বা সরে যেতে বাধ্য হয়। কারণ ইতিমধ্যে পুঁজিপতি-ধনিক শ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা তাদের ‘ভুল’ শুধরে আবার ঐক্যবদ্ধ হয়, জনগণের কাছে ‘ভালো’ হয়ে যায় এবং ক্ষমতা ফিরে পায়।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপত্রে পুঁজিবাদ গড়ে তোলার জন্য স্বাধীনতা উত্তর সরকার যখন ‘যথেষ্ট’ অগ্রসর হতে পারছিল না, তখন সামরিক জান্তা সরাসরি ক্ষমতা দখল করে এবং শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশগুলোর অনুগত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে অগ্রসর হয়। এজন্যে দরকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সরাসরি জলাঞ্জলি দেয়া। দরকার ছিল রাজনীতি-অর্থনীতিতে ব্যাপক দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটানো। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক-রাজনৈতিক চেতনাকে ছত্রভঙ্গ ও বিভ্রান্ত করা ছাড়া তা আর সম্ভব হচ্ছিল না। তাই দীর্ঘ দু’ দশকেরও বেশী সময় ধরে চলে সামরিক শাসন।
সামরিকীকরণঃ বিশ্ব পরিস্থিতি
বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী সম্প্রসারণের সঙ্গে সামরিকীকরণ-সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। মহামন্দার মুখে পতিত পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সমরাস্ত্র উৎপাদন এক বিরাট মুনাফা অর্জনের সুযোগ এনে দেয়। নোয়াম চমস্কির ভাষায়, সামরিক খাতে ব্যয় প্রকৃতপক্ষে ধনিক শ্রেণীর জন্য এক বিরাট কল্যাণমূলক ব্যবস্থা এবং বহুজাতিক সংস্থাগুলোর জন্য জনগণের পয়সায় বিরাট ভর্তুকির আরেক নাম। এখন সে ধরণের মহামন্দা আবারও ফিরে এসেছে। ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে’র নামে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দামামাও জোরে সোরে শোনা যাচ্ছে। সে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামরিকীকরণের আগ্রাসন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্বকে একসময় বিশ্বে সমরাস্ত্র প্রস্তুতি, সংঘাত, উত্তেজনার মূলকারণ হিসেবে বর্ণনা করা হত। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর বিশ্বে সামরিক তৎপরতা, সমরাস্ত্র উৎপাদন ইত্যাদি কমেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালে শত্রু দেখানো হত তাকে, এখন আল-কায়দার বাহানা প্রতি মুহুর্তে উচ্চারিত হচ্ছে। জাতিসংঘ বা ন্যাটোর আড়ালে ’শান্তি’, ’নিরাপত্তা’, ’গণতন্ত্র’, ’স্বাধীনতা’ রক্ষার নামে সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও আধিপত্য নিশ্চিত করবার যে সামরিক অভিযানগুলো চালানো হয় তাতে একটি আন্তর্জাতিক চেহারা দেখানো হলেও এগুলো প্রকৃতপক্ষে মার্কিন অভিযানের সম্প্রসারণ হিসেবেই কাজ করে। আন্তর্জাতিক চেহারা দেবার জন্য এসব অভিযানের সামনে রাখা হয় বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশগুলোর সৈন্যদের। সেপ্টেম্বর ২০০৮ এর তথ্য অনুযায়ী জাতিসংঘের শান্তিরা বাহিনীতে বাংলাদেশের ৯,২১১ জন সৈন্য ছিল, যা সদস্য দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। বিশ্বে এখন মোট সামরিক খাতে যে ব্যয় হয় তা পুরো বিশ্বের ৫০% বা ২৬০ কোটি মানুষের মোট আয়ের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সামরিকীকরণঃ বাংলাদেশে
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের তত্ত্বাবধানে ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান প্রতিযোগিতা করে সামরিক ব্যয় বাড়িয়েছে। এ দুটি দেশ দারিদ্র্যের মধ্যে থাকলেও সামরিক খাতে তারা প্রতিযোগিতা করে শিল্পে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গেই। এ উপমহাদেশে শ্রীলংকা, পাকিস্তান, নেপাল ও ভারতের মত বাংলাদেশও সামরিক খাতে ক্রমবর্ধমান ব্যয় বরাদ্দ করছে। শ্রীলংকা তামিল জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমনের অজুহাতে, পাকিস্তান ভারতীয় হুমকি দেখিয়ে, ভারত চীন-পাকিস্তান ও মুসলিম উগ্রপন্থীদের হুমকি দেখিয়ে অব্যাহত সামরিকীকরণ চালাচ্ছে, নেপাল রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে ও মাওবাদী জনযুদ্ধ মোকাবেলার নামে সামরিকীকরণ চালিয়েছে; বাংলাদেশ কোন বিশ্বাসযোগ্য অজুহাতে সামরিকীকরণ বৃদ্ধি করবে? ভারতের হুমকি, না মুসলিম উগ্রপন্থীদের হুমকি দেখিয়ে? নাকি যে সরকারের সময় যেটা বললে গ্রহণযোগ্য হয় সে অজুহাত দেখিয়ে?
তবে পার্থক্য রয়েছে। একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এ যুদ্ধে জনগণের সাথে পুলিশ-বিডিআর-সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যগণ ছিলেন একাত্ম ও অবিচ্ছেদ্য। ১৯৭১ সালে যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল তা ছিল একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ। ব্যাপক জনগণের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল বলে মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জনগণ থেকে উঠে আসা একটি বাহিনীই বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারতো। বাস্তবে তা হয় নি। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা হয় ১৯৫২ সালের পাকিস্তান আর্মি অ্যাক্টের পুরোপুরি অনুসরণের মাধ্যমে, যা ইংরেজ প্রবর্তিত ১৯১১ সালের ইন্ডিয়ান আর্মি অ্যাক্টের উত্তরাধিকার মাত্র। বাংলাদেশ প্রতিরাক্ষ বাহিনীর ক্ষেত্রে কেবল পাকিস্তান শব্দটি বাংলাদেশ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
প্রচলিত এই প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে কেন্দ্রীভূত ব্যারাক আর্মি হিসেবে পরিচিত বিরাট এই বাহিনী দেশের উৎপাদন কর্মের সাথে তেমন জড়িত থাকে না বলে তা প্রতিপালনে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়। গঠন কাঠামোর কারণে প্রতিরক্ষাবাহিনীর নীতি নির্ধারণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বময় কর্তৃত্ব অত্যন্ত ক্ষমতাধর কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। তাদের কাজের সুবিধার জন্য গোপনীয়তা, জবাবদিহিতা, স্তরবিন্যাস এমনভাবে দাঁড় করানো হয় যে, এর মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে এক জটিল আমলাতান্ত্রিক কাঠামো যা কখনো কখনো নিজেই ক্ষমতাধর শক্তিতে পরিণত হতে পারে। বিদেশী শক্তির পক্ষে এরকম কাঠামোতে নিজস্ব প্রভাব তৈরী করা সহজ হয়। অন্যদিকে এ কাঠামো দিয়ে এমনকি ‘সার্বভৌমত্ব’ রকবষা করাও সম্ভব হয় না। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের স্বচ্ছতা থাকে না এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর জবাবদিহিতার কোন ব্যবস্থা নেই।
মুক্তিযুদ্ধ গণশক্তির উrসমুখ খুলে দিয়েছিল, যা অনিবার্যভাবেই রাষ্ট্র ও সমাজের প্রগতিশীল রূপান্তরে পর্যবসিত হত। তাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করবার জন্য তrকালীন শাসকদের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ সাম্রাজ্যবাদী শোষক-ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রের প্রগতিশীল রূপান্তরে একের পর এক বাধার সৃষ্টি করে। তাই মুক্তিযুদ্ধের পরপরই সুযোগ থাকা স্বত্ত্বেও দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তথা গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ন হয়নি।
১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে নৃশংস হত্যা ও সামরিক ক্যু’দেতার মাধ্যমে বাংলাদেশে সরাসরি সামরিকীকরণ শুরু হয়। আমলাতন্ত্র ও সামরিকতাবাদের মেলবন্ধনে দীর্ঘদিন এ সামরিক শাসন চালু ছিল। ১৯৯০ পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সময়ও সামরিকীকরণ থেমে থাকে নি। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এদেশের সামরিক বাহিনীর ঘনিষ্ঠতা ও পরবর্তীতে নির্ভরশীলতা আরও সামরিকীকরণের দিকে এগুতে থাকে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যাবার আকর্ষণ এটাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। যার পরিণতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারীতে ঘটে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ। জরুরী আইন জারীর মাধ্যমে সামরিক বাহিনী রাজনীতি-প্রশাসনে অযাচিত হস্তক্ষেপের সুযোগ পায় ও মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে।
দু’ দশকেরও বেশি সময় ধরে সামরিক শাসন এবং সশস্ত্র বাহিনীকে সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রার নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেভাবে ক্ষুদ্র জাতিস্বত্ত্বাসমূহের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে পাকিস্তানী পুরোনো কাঠামোই আরো শক্তিশালী হয়েছে। এরশাদের নেতৃত্বে বৃহr সামরিক আমলাদের সহযোগিতায় লুন্ঠনকারীদের অবাধ বিকাশের কাজে যেভাবে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হয় তাকে একমাত্র ইন্দোনেশিয়া বা চিলির সঙ্গেই তুলনা করা চলে। এরশাদ জান্তা এ ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী রূপ দেবার চেষ্টা করলেও গণআন্দোলনের তোড়ে তা থমকে দাঁড়ায়।
সামরিকীকরণ প্রক্রিয়াতে যে সংস্থাটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেটি হলো সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। এটি আরেকটি ‘অদৃশ্য’ ক্ষমতাবান স্থায়ী শক্তি। ১৯৭৫ এর পর থেকে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দল গঠন, রাজনৈতিক নির্যাতন-হুমকি, নিয়োগ, অন্যদের ওপর তো বটেই এমনকি সরকারী দলের নেতাদের ওপর খবরদারী ইত্যাদিতে এ সংস্থার ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ সংস্থাটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে হস্তক্ষেপে, ভয়-ভীতি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি, ব্যাপক দুর্নীতি ইত্যাদির অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। ২০০৭-৮ সময়কালে দুর্নীতি দমন টাস্ক ফোর্সের নামে, জাতীয় সমন্বয় কমিটির নামে সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক সরাসরি রাজনীতি ও প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। প্রতিটি জেলা, শহর, ঢাকাসহ বড় মহানগরকে বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে সামরিক বাহিনী অন্য সকল কর্তৃপক্ষের ওপর সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। গণপূর্ত ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, নগর ভবন সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টাস্ক ফোর্সের নামে দুর্নীতি দমনের নামে নিজেরাই বড় ধরণের দুর্নীতিতে জড়ায়, প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করে সশস্ত্র বাহিনী। এমনকি খেলাধুলার কমিটিগুলো পর্যন্ত সামরিক কর্তাগণ দখল করে নেন। সেনানিবাসের গোপন বন্দীশালায় চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। বিচারালয়গুলোতে প্রায় প্রকাশ্যেই সামরিক গোয়েন্দারা সাদা পোষাকে উপস্থিত থেকে অব্যাহত নজরদারী করে বিচার কার্যে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে ও বিচারের রায় দানকে প্রভাবিত করে। টেলিফোনে রাজনীতিবিদ, বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকদের ধমকানো ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এভাবেই সমাজে শোষণ ও বঞ্চনার পাহারাদার হিসেবে বলপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে ব্যবহার করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি সামরিক বাহিনী কর্তৃক ৫-তারকা হোটেল ব্যবসা, শিক্ষার আলাদা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, নিজস্ব ব্যাংক-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন নির্বাচিত সরকারের আমলেই হয়েছে। র্যাব গঠনের মাধ্যমে আইন-শৃংখলা ব্যবস্থায় কর্তৃত্ব ও অবাধ হত্যাকান্ডের লাইসেন্স দেয়া নির্বাচিত সরকারের আমলেই শুরু হয়েছে।
বিডিআর-এর ডাল-ভাত কর্মসূচীর মাধ্যমে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সশস্ত্র বাহিনী ব্যবসায় অনুপ্রবেশ করেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জনগণকে সেবা দেবে; আর্থিক লেন-দেনও হতে পারে ডাক বিভাগ, টেলিফোন বিভাগের মত। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আয় থেকে ব্যক্তি বিশেষকে লভ্যাংশ দেবার সর্বনাশা প্রক্রিয়া অনিবার্যভাবেই রাষ্ট্রের সেবামূলক চরিত্রকে ধবংস করে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের মাঝে বৈষম্য ও ক্ষোভের কারণ ঘটায়। বিডিআর বিদ্রোহ এবং সেনা অফিসারদের নৃশংস হত্যাকান্ড তারই এক ভয়াবহ উদাহরণ। দুর্ভাগ্যজনক হলো এই যে, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতেও এ ধরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এবং কোন কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-ও এ ধরণের ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে।
মায়ানমার ও ইন্দোনেশিয়ার মত রাজনৈতিক ক্ষমতা, সবচাইতে সম্পদশালী ও ব্যবসার মালিকে পরিণত হবার আকাঙ্খায় যেন পেয়ে বসেছিল সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রভাবশালী অংশকে। ২০০৮এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পরে সে আকাঙ্খা কি আদৌ পরিত্যক্ত হয়েছে?
বর্তমান অর্থ বছরে সামরিক খাতে বাজেট বরাদ্দ ৭০৫১ কোটি টাকারও বেশী। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ওয়ার্ল্ড ডেস্ক রেফারেন্স (২০০৪) এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সেনাবাহিনীতে আছে ১,১০,০০০ সৈন্য, ১৮০টি যুদ্ধ ট্যাংক; নৌবাহিনীতে আছে ৯,০০০ সৈন্য, ৫টি ফ্রিগেট ও ৩৩টি প্যাট্রল বোট; বিমান বাহিনীতে আছে ৬,৫০০ সৈন্য, ৮৩টি যুদ্ধ বিমান। ২০০৪ এর হিসাব অনুযায়ী প্রতিরক্ষা বাজেটের ৬৭% খরচ হয় বেতন বাবদ, আর বাকী ৩৩% খরচ হয় নির্মাণ কাজ, যুদ্ধ সরঞ্জামের রক্ষণাবেন ও ক্রয়ে।
বর্তমান অর্থমন্ত্রী (তিনি তখন তrকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন) ১৯৮৮ সালে বলেছিলেন, ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত অসামরিক রাষ্ট্রীয় খাতে খরচ বেড়েছে ৯ গুণ, আর একই সময়কালে সামরিক খাতে খরচ বেড়েছে ২০ গুণ। সামরিক খাতে জিডিপি’র ১•৫% খরচ হত ১৯৮৮ সালে, ১•৮% খরচ হয়েছে ২০০৫ সালে। শুধু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় খাত ধরলে বর্তমান ২০০৯-১০ অর্থ বছরে খরচ হচ্ছে ১•১%, এর সাথে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খরচ ৫৮০১ কোটি টাকা যোগ করলে দাঁড়ায় জিডিপি’র ১•৯%। ২০০৫-৬ সালে প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বেড়েছে পূর্ববর্তী বছরের চাইতে ৪•৪২%, ২০০৭-৮ সালে বেড়েছে ৬•১৬%, ২০০৮-৯ সালে ৭•৬২%, আর এ বছর বেড়েছে ১•১৫%। অর্থাr দিন দিন এ খাতে অন্যান্য খাতের তুলনায় ব্যয় বাড়ছে। এ প্রবণতা কি আরও বর্ধিত সামরিকীকরণ নয়?
বাংলাদেশের সামরিক খাত আজ সরাসরি বৈশ্বিক সামরিক অর্থনীতি ও কৌশলের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। সার্বভৌমত্ব এখন বিশ্ব মোড়লদের কাছে একটি কৌতুকের বিষয়। বাংলাদেশের সামরিক আধাসামরিক ব্যবস্থাকে বিশ্ব ও আঞ্চলিক প্রভুদের সামগ্রিক পরিকল্পনার অধীনস্থ করার প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
সামরিকীকরণের বিপরীতে গণতান্ত্রীকীকরণ
সত্যিকার অর্থে দেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে সচেতন জনগণ। বৃহৎ ও শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারত কর্তৃক তিনদিক থেকে পরিবেষ্টিত বিরাট জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অনুন্নত বাংলাদেশের জন্য তা আরও বেশী সত্য। বাংলাদেশে একটি ছোট আকারের স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন করে তার মূল দায়িত্ব হতে পারে দেশের কর্মক্ষম নর-নারীকে মৌলিক সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। পৃথিবীর বহু দেশে এই ব্যবস্থা চালু আছে। এভাবে সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে উঠতে পারে।
সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও প্রশাসন থেকে স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিবিশেষকে সরিয়ে কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমর্থক ব্যক্তিদের পদায়ন করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়ন ঘটবে না। প্রচলিত ঔপনিবেশিক গণবিরোধী রাষ্ট্রকাঠামোটাকে ভেঙ্গে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে না তুললে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও প্রতিষ্ঠিত হবে না। উপরন্তু ঔপনিবেশিক এ কাঠামো সশস্ত্র্ব বাহিনীর মধ্যেও বৈষম্য ও নিপীড়নের কাঠামোকে লালন করে। বলপ্রযোগকারী সংস্থার মধ্যেও যে শ্রেণীবৈষম্য থাকে, নিপীড়ন থাকে; তার বিপরীতে এসব সংস্থাতেও যে বৈষম্য ও নিপীড়ন বিরোধী চিন্তা দানা বাঁধতে পারে এমনকি তার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে তার অনেক উদাহরণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। বাংলাদেশে ১৯৪৮ সালের পুলিশ বিদ্রোহ, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সৈনিক-বিডিআর-পুলিশের প্রতিরোধ, ১৯৭৫ সনের সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান, ১৯৯৫ সনের আনসার বিদ্রোহ, ২০০৯ সনের বিডিআর বিদ্রোহ এরই কিছু কিছু উদাহরণ।
বাংলাদেশে স্বৈর- সামরিক ও ছদ্ম সামরিক শাসনে যেভাবে অর্থ ব্যবস্থায় দুবৃত্তায়ন হয়েছে, কালো টাকার মালিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চক্র তাদের বিশাল অর্থ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, তার দুষ্ট খপ্পর থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করতে না পারলে রাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়ন সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রব্যবস্থার সামগ্রিক গণতন্ত্রায়নের সাথে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গণতন্ত্রায়নের প্রশ্নটি যুক্ত। সেই সাথে বিশ্বব্যাপী মুক্তিকামী মানুষের বিজয়ের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজদের পরাজিত করাও এ প্রশ্নটির সাথে যুক্ত। শহীদ কর্নেল আবু তাহেরের চেতনাকে ধারণ করে সে লক্ষেই এগিয়ে যাবার প্রেরণা যোগাক আজকের তাহের দিবস। সামরিক আদালতে জবানবন্দিতে দেয়া আবু তাহেরের বক্তব্য দিয়েই শেষ করছিঃ
”স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং ঢাকা ও কুমিল্লা সেনানিবাসে অর্জিত অভিজ্ঞতা আমাকে উrপাদন বিমুখ স্থায়ী সেনাবাহিনীকে একটা বিপ্লবী গণবাহিনীতে পরিণত করতে উদ্বুদ্ধ করে। আমার সৈনিক জীবনে লক্ষ্য করেছি, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে একটা স্থায়ী সেনাবাহিনী জাতীয় অর্থনীতির ওপর একটা বোঝা স্বরূপ। এ ধরণের সেনাবাহিনী সমাজ প্রগতির পথে একটা বিরাট বাধা। জাতীয় উrপাদনে এদের কোন অবদানই থাকে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যে নিষ্ঠা, আনুগত্য ও ত্যাগের মনোভাব লক্ষ্য করেছিলাম, তাতে স্বাধীনতা উত্তরকালে একটা উৎপাদনমুখী বিপ্লবী গণবাহিনী (আরপিএ) গঠন করা অসম্ভব বলে আমার কাছে মনে হয়নি। আর এতে আমি সবচেয়ে বেশী উদ্বুদ্ধ হয়েছি।”
সহায়ক সূত্রসমূহ :১. শহীদ কর্নেল আবু তাহেরের রচনাবলী। http://www.col-taher.com
২. ড. মো. আনোয়ার হোসেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ আয়োজিত কিবরিয়া স্মারক বক্তৃতা; ২৮ জানুয়ারী ২০০৯।
৩.ড. মো আনোয়ার হোসেন। সিএমএম কোর্টে জবানবন্দী। আগামী প্রকাশনী। ফেব্রুয়ারি ২০০৮।
৪.আনু মুহাম্মাদ। রাষ্ট্রের সামরিকীকরণ ও জনগণের নিরাপত্তাঃ সামরিকীকরণের বৈশ্বিক-জাতীয় রূপ এবং জনগণের নিরাপত্তার প্রশ্ন। কর্নেল তাহের স্মারক বক্তৃতা – ৩। কর্নেল তাহের সংসদ। ১৯৯৯।
৫.মুনতাসীর মামুন ও জয়ন্ত কুমার। প্রশাসনের অন্দরমহলে। ভোরের কাগজ প্রকাশনী।
বাংলাদেশ সরকারের বাজেটসমূহ।
===================================================================
লেখক ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক। লেখাটি মুক্তমনায় প্রকাশের জন্য প্রেরিত।
Neither true socialistic structure nor capitalistic structure can give us the democracy. Democracy strictly should not be based on any extreme or already established concepts rather should be based on human needs.
সামরিক বাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা না গেলে গণতন্ত্র হবে একটা প্রহসন। আমরা পাকিস্তানী আমলের ভুত কিছুতেই ছাড়তে পারিনি, অদের দেখে কিছু শিক্ষা যে নেব তাও মনে হচ্ছে না।
সামরিক বাহিনীর মত একটা বিশাল খরচ যে আমাদের মত উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশের জন্য একটা শ্বেতহস্তি এই সরল সত্যটা স্বীকার করার মানুষও এখন মনে হয় আর বেশী নেই। এ নিয়ে কিছু বলতে গেলেই একদল তেড়ে আসেন ভারতের দালাল বলে। তাদের মতে আমাদের উচিত ভারতের সাথে পাল্লা দেবার মত বিশাল বাহিনী গঠন করা। এনাদের উর্বর মাথায় এটা কোনদিন ঢুকে না যে আমাদের জিডিপির ১৫ কেন, ১০০ ভাগ খরচ করলেও আমরা ভারতের সাথে তূলনামুলক কোন বাহিনী করতে পারব না।
আমি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নই, সুইডেন বা সুইজারল্যান্ডের মত আমাদের সামরিক বাহিনী না হলেও চলবে এটাও আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু তার পেছনে যে বাজেট খরচ করা হবে তা হতে হবে যৌক্তিক, এবং সামরিক বাহিনীর আমাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের কোনই এখতিয়ার থাকবে না।
মিঃ অধিকারী
পরম ধনতন্ত্র বলতে কিছু হয় না-সেটা কাল্পনিক। সমাজতান্ত্রিক কাঠামো ছাড়া ধনতন্ত্র বা মার্কেট টেকে না।
গনতন্ত্র স্ট্যাটিক না। প্রতিনিয়ত এর বিবর্তন হবে। মিডিয়াকে ব্যাবসায়ী শ্রেনী কিনে রেখে গণতন্ত্র চালানোর যুগ ছিল আগের দুই দশক। আস্তে আস্তে ইন্টারনেটের যুগে সবই বদলাবে-তখন গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সমাজতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হবে।
ডঃ বিপ্লব পাল,
একটি বিষয়ে এটুকু উল্লেখ না করলেই নয়-
আপনি বলেছেন,
আপনার এই মন্তব্যের সাথে একমত হতে পারলাম না। আসলে আমার মনে হয় প্রকৃত গনতন্ত্র একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতেই বোধকরি সম্ভব। আর সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার সাথে পূঁজিবাদি অর্থব্যবস্থার ব্যবধান বিস্তর। আমরা আসলে যে গনতন্ত্রের চর্চা করি তা হলো ধনীকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় গনতন্ত্রের লেবাসে চাপিয়ে দেয়া স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বামপন্থীরা যাকে বলেন বুর্জোয়া শ্রেণীর গনতন্ত্র। এর ক্যরেকটার হলো ডিসেন্ডিং। মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত গুলো সুচতুরভাবে এবং সন্তর্পনে শ্রমের উপরে চাপিয়ে দেয়া হয়। মুশতাক ভাই এক্ষেত্রে সঠিক ট্র্যাকেই আছেন, তনি এটিকে উল্লেখ করেছেন ‘পোষাকী গনতন্ত্র’ বলে। ভারতের গনতন্ত্রও একধরনের পোষাকী গনতন্ত্র। ভোটের মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচনই গনতন্ত্রের মূল কথা নয়, অর্থনৈতিক সুষম বন্টন মুলতঃ প্রধান। সেই কারনে এ ধরনের ব্যবস্থায় শ্রেণীবৈষম্য একটি অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার মনে হয়।
মোস্তাক ভাই,
প্রথমে ভাবিইনি যে আপনার লেখা, দারুন লিখেছেন! প্রথমেই মুক্তিযোদ্ধা কর্ণোল তাহের এর ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার শ্রদ্ধা রইল। তবে কর্নেল তাহের এর সশশ্রবিপ্লবের উদ্যোগটি সময়োপযোগী ছিলো বলে আমি মনে করিনা। কারন সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার যে প্রাক-পরিস্থিতি দরকার তা তখন ছিলোনা। বাংলাদেশ এখনো সেই ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক কৃষি নির্ভর ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে যদিও তখন কয়েক ঘর ধনিক গোষ্ঠির উত্থান ঘটেছে, কিন্তু এতদ অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রনে এদের তেমন কোন ভুমিকা ছিলোনা। আর আমাদের এই পূর্ববঙ্গে তো পূঁজি বিকাশের কোন সুযোগই ছিলোনা। স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তরকালে তৎকালীন সেনাবাহিনী সহ বিভিন্ন সামাজিক স্তর গুলোকে কিন্তু কিভাবে যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের সার্বিক উন্নয়নে নিয়োজিত রাখা যায় তার একটি প্রকৃয়া স্পষ্টতঃই দৃশ্যমান ছিলো। আমার মতে এই অগ্রযাত্রার অভিপ্রায়ের খেশারত বঙ্গবন্ধুকে দিতে হয়েছিলো চরম মূল্যে। কর্নেল তাহের এঁর গনবাহিনী ভেতরে ভেতরে এতে যোগ করেছিলো নতুন মাত্রা। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের কালে মেজর জিয়াকে ব্যবহার করতে গিয়ে কর্নেল তাহের নিজেই ব্যবহৃত হয়েছিলেন সুচতুর জিয়ার দ্বারা। এগুলো এখন জানা ইতিহাস।
তবে ’৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর যে সামরিকীকরন শুরু হয়েছে বাংলাদেশে তার পেছনের অন্তর্নিহিত আপনার প্রদর্শিত কারন গুলো আমি যথার্থ বলেই ভাবি। তবে ডঃ পালের অভিমতটিও এক্ষেত্রে অতিমাত্রায় প্রযোজ্য। কারন, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি হতদরীদ্র দেশে পূঁজি রক্ষা বা বিকাশের ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ হিসেবে সেনাবাহিনীর মজবুতি করন বা সামরিকীকরনের আসলে আদৌ দরকার নেই। এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পূঁজি প্রটেকশনের জন্যেই বাংলাদেশের মতো দেশ গুলোকে দরকার, যা আবার আপনার ভাষ্যে বেরিয়ে এসেছে। এদিকে প্রকৃত গনতন্ত্রেরতো কোন খবর নেই! বাংলাদেশের মতো দেশে গনতন্ত্রের লেবাসে জাতিয়তাবাদের ধুয়া তোলা হয়েছে। বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদকে অন্ধকূপে ঠেলে দিয়ে উঠিয়ে আনা হয়েছে পড়ন্ত পাকিস্তানের ইসলামী লেবাসের বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদ। রাষ্ট্রের মৌলিক অঙ্গ জনগন, আর তাকে করে রাখা হয়েছে বহুধা বিভক্ত। নামে বেনামে নানান ভাবে। বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদ অথচ পাহাড়ী-বাঙ্গালী দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখা হয়েছে। আর এই সব দ্বন্দ্বের মোকাবেলার নামে হচ্ছে সামরিকীকরন!
শুধু ছোট্ট একটি সেনাবাহিনী নয় মোস্তাক ভাই, অবিকল সেনাবাহিনীকে রেখেই যদি আমাদের দেশে গ্রাজুয়েশনের আগে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর সামরিক শিক্ষাকে বাধ্যতা মূলক করা যায় আর ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করে আনা যায় এর আ্যডমিনিস্ট্রিটিভ ও আমলাতান্ত্রিক কলেবর, এবং সেনাবাহিনীকে যদি তাদের সকল ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে জনগনের সাথে সম্পৃক্ত করা যায় এবং সেনাবাহিনীর ভৌত কলেবর না বাড়িয়ে এই ব্যবস্থাটিকে এগিয়ে নেয়া যায় তাহলেই যথেষ্ট।
মহান মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের এর প্রতি আমাদের যথাযথ সম্মান তখনই প্রদর্শিত হবে যেদিন প্রকৃত গনতন্ত্রের পথে হাঁটবে এদেশ, মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য যাবে টুটে। প্রজন্মান্তরের অপেক্ষায় রইলাম সেই মহেন্দ্রক্ষনটির জন্যে।
পুজিবাদ গণতন্ত্রের বিরোধি কেন হতে যাবে? গণতন্ত্রেই পুঁজিবাদের সুবিধা সব থেকে বেশী! নিজের স্বার্থেই গণতন্ত্র চাইবে পুঁজিবাদ।
বাংলাদেশের সামরিক শাসনের পেছনে সব থেকে বড় ভুমিকা আমেরিকা এবং ইসলামের। আমেরিকা মানেই পুঁজিবাদের স্বার্থ-এমন ভাবা ভুল। আমেরিকা হচ্ছে ইসলামের হরিহর আত্মা-এদের সিমবায়োসিস- একে ওপরকে ছাড়া চলে না। মিলিটারি দিয়ে শুধু ক্ষমতা দখল করে একটা দেশ চালানো যায় না-তার পেছনে একটা আইডিওলজী দাঁড় করাতে হয়। ফলে জেনারেল জিয়া ইসলামিক ন্যাশালিজম, বা ওই জাতীয় সোনার পাথর বাটি দাঁড় করিয়েছিলেন। আমেরিকার হাত ত ছিলই-স্বার্থও ছিল সোভিয়েত ব্লক থেকে বাংলাদেশকে পৃথক করতে।
আবার সেই আমেরিকাই কিন্ত হাসিনাকে আসার পথ পরিস্কার করে দিল। কারন সেই স্বার্থ। বি এন পির নেতারা যেভাবে প্রকাশ্যে আল কায়দা এবং দাউদের সাথে যোগাযোগ ও বৈঠক করা শুরু করেছিল-আমেরিকা আর ওদের টানতে পারত না।
ইসলাম জাতীয়তাবাদ সমর্থন করে না। তাও ওই হাঁসজারু মার্কা বাংলাদেশী ইসলামি জাতিয়তাবাদের বিশ্বাস করে এমন লোকের অভাব বাংলাদেশে আছে কি? যদ্দিন থাকবে, তদ্দিন সেনাবাহিনীর টেক ওভার যেকোন দিন হতে পারে। ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদিরা অতটা শক্তিশালী না-গণতান্ত্রিক জাতিয়তাবাদিই সেখানে মেইন স্ট্রিম। ইসলামিক জাতিয়তাবাদ থেকে গনটান্ত্রিক জাতিয়তাবাদে যাতে দেশটা যেতে পারে, তার জন্যে সেই রকম ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং আধুনিকতার প্রচার বাংলাদেশে দরকার।