আমরা না দেখেই বিশ্বাস করি তিনি আছেন। আমার এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে যখন আমরা সৃষ্টিকর্তার নিদর্শন দেখি। তার নিদর্শনের মাঝে তার বক্তব্যের/ অস্তিত্বের প্রমাণ পাই নানা ভাবে।

এটা মোটামুটি সব বিশ্বাসী/আস্তিকদের ক্ষেত্রেই কমন, আমি নিজে যখন আস্তিক ছিলাম- আমার ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে। মুসলমান বাপ-মা’র কারণে জন্মের পরেই মুসলমান হয়ে তারপরে- এমন যুক্তি- নিদর্শন খুজেছি- খুজে পেয়েছি। ক্লাস থ্রি/ফোরের ক্লাসের ধর্মের বই এ পরিষ্কার যুক্তি ছিল- “আল্লাহ যে আছেন এটার নিদর্শন আমাদের চারপাশে অসংখ্য আছে”। সবকিছু এত নিয়মমাফিক চলে- এ থেকেই প্রমাণ হয় যে, একজন নিশ্চয়ই আছেন যিনি সবকিছু সুচারু ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন- আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তা যে একজনই কারণ একাধিক হলে তো তাদের মধ্যে মতবিরোধ হতো- বিশ্বজগৎ সুচারুরূপে চলতে পারতো না…… ইত্যাদি। আমি নিশ্চিত- অন্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে। আগে বিশ্বাস করে নেয়া- তারপরে যুক্তি খোজা- নিদর্শন খুজে পাওয়া…..।

যাহোক- এটা নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই, যে বিষয়টি নিয়ে বলতে চাই- আপনি যেসব নিদর্শন বা যুক্তি দেখে আপনার বিশ্বাসকে পাকাপোক্ত করেছেন- সেগুলো নিয়ে আমার যথেষ্ট কথা আছে। সেগুলোকে যদি, আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হয়- তবে আমার আগের বিশ্বাসের ভিত্তিটি কি একটু দুর্বল হতে পারে না????

“কখনো দেখি , ১৪০০ বছর আগে আদর্শ, নীতি বা ন্যায় পরায়নতা ভিত্তিক যে সমাজ গঠন করেছিলেন অস্বাভাবিক সামাজিক পংকিলতার মধ্য থেকে যা বিশ্ব ইতিহাসের যে কোন সময়ে যে কোন স্থানে বিরল।
মনে পড়ে ওমর (আঃ) আর তার ভৃত্য একটা উঠে বিশাল মরুভুমির ৫০% -৫০% পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। কখন মনে পড়ে হযরত ওমর (আঃ) এর দুর্ভিক্ষ কালিন বক্তব্য “আজ যদি ফোরাতের তীরে একটা কুকুর যদি না খেয়ে মারা যায়, তবে তার জন্য আমি দ্বায়ী।” মানব ইতিহাসে এর তুলনা কোথায়?”

১৪০০ বছর আগে মুহম্মদ সা আরব সমাজে যে অবদান রেখেছেন- তা আমি স্বীকার করি- এবং একজন মানুষ হিসাবে তার প্রতি আমার প্রচণ্ড শ্রদ্ধাও আছে। কিন্তু যুগে যুগে আরো অসংখ্য মানুষকেই তো আমরা পাই। তাদেরো প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু যখন বলা হয় ১৪০০ বছর আগে আরবভূমিতে মুহম্মদ সা এর এই ভূমিকা বিশ্ব ইতিহাসে যেকোন স্থানে বিরল- তখন বুঝতে পারি – এমন দাবিদারের বিশ্ব ইতিহাস সম্পর্কে জানা-বুঝা নিতান্তই কম। বুঝতে পারি এ হলো চোখ বন্ধ করে ভক্তিতে গদগদ হওয়া, এ এমনই ভক্তি যে- একজন রক্তমানুষের মানুষকে ঐশ্বরিক পর্যায়ে কল্পনা করে নেয়া, সেই মানুষটি যে একটি নির্দিষ্ট সময়কালে- একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট সমাজ ব্যবস্থায় এসেছিলেন- তা ভুলে তার সমস্ত ক্রিয়া-কর্মকেই সমস্ত যুগের জন্য সমস্ত অঞ্চলের জন্যই সমস্ত সমাজব্যবস্থার জন্যই চুড়ান্ত বলে ঘোষণা দেয়া। তখন বিনীতভাবে প্রশ্ন না করে পারি না যে, এই মানুষটি বিদায় হজ্জে দাসদের প্রতি সুব্যবহার করার আহবান জানাতে পারলেন কিন্তু কৃতদাস প্রথা উচ্ছেদের ডাক দিলেন না কেন? পুরুষের জন্য চার বিবাহের বিধান কেন রাখলেন? হিল্লা বিয়ে প্রথা কেন রাখলেন? দাসীদের সাথে বিবাহ বহির্ভুত যৌন সম্পর্ক কেন জায়েজ রাখলেন?….. ইত্যাদি।

বিশ্ব ইতিহাসের কথা টেনে যখন এই মানুষটিকে মহামানব হিসাবে দেখানো হয়, সরাসরি আল্লাহর বন্ধু বা রাসুল হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়- তখন বিনীত ভাবে প্রশ্ন করি- ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পরে কেন তার একের পর এক নারীর প্রতি ঝুঁকতে হয়? কেন একের পর এক যুদ্ধ/জেহাদে লিপ্ত হতে হয়? কেন বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা ছড়াতে হয়? কেন অন্য ধর্মাবলম্বী প্যাগানদের ধর্মী উপাসকদের মূর্তিগুলো ধ্বংস করে দিতে হয়?…. ইত্যাদি।

এসবের জন্য একজন মানুষ মুহম্মদ সা এর প্রতি কোন অশ্রদ্ধা নেই- কারণ আমি জানি একজন মানুষের যুগগত, সমাজ ব্যবস্থাগত সীমাবদ্ধতা কি হতে পারে। কিন্তু অবশ্যই একজন রাসুলুল্লাহ মুহম্মদ সা এর প্রতি আমার হাজারো প্রশ্ন আছে। তাই কেউ যদি- যুগের কথা বলে নবীজী হিসাবে তার নারী লিপ্সাকে অনুমোদন দিতে চান- সোলায়মান…….. সহ বহুত রাজা বাদশার আরো চরম নারী লিপ্সার সাথে তুলনা দেখিয়ে রাসুল মুহম্মদ সা এর চরিত্রকে অনুকরণীয় দেখাতে চান- তাদের আমি বিনীতভাবে যীশু-গৌতম বুদ্ধ- সক্রেটিস থেকে শুরু করে মুহম্মদ সা এর আরো অনেক আগের অসংখ্য মানুষের তুলনা আনি, এনে জানাই এ ব্যাপারে অনুকরণ- অনুসরণ করতে চাইলে তাদেরই তো করা উচিৎ।

ওমরেরও অনেক কাহিনী, অনেক গল্প আমাদের এখনো উদ্দিপ্ত করে- ইতিহাসে এমন অসংখ্য চরিত্রই আমাদের মাঝে এমন করেই বেচে থাকেন যুগ যুগ ধরে। কিন্তু সেই সব রক্ত মাংসের মানুষের অনবদ্য গল্পগুলোকে কেন্দ্র করে যখন অন্য সব যোগসূত্র বের করে, মানুষের মহিমার চেয়ে কিচ্ছাকাহিনী/গালগল্পের মাহাত্ম্য প্রচারের চেষ্টা হয়- তখন বিনীতভাবে প্রশ্ন করি- ইসলামের চার খলীফার কয় খলীফা খুন হয়েছেন? কাদের হাতে খুন হয়েছেন? কি কারণে খুন হয়েছেন?

মুহম্মদ সা এর শবদেহ দাফনে কেনই বা দেরী হলো? ওনার কাছের মানুষেরা কি নিসন্দেহ ছিলেন না- যে তিনি আল্লাহর রাসুল? নিসন্দেহ কি ছিলেন না যে- আল্লাহর রাসুলের শবদেহ অবহেলায় ফেলে রেখে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হতে পারেন?
“যখন দেখি, আল-কুরআনের বাণী গুলো এত বেশি অলংকৃত, শব্দের যে অপরুপ বিন্যাস যার তুলনীয় কাব্যগ্রন্থ আজও সম্ভব হয় নি, (অবশ্য এটা আপনাকে ভালভাবে বুঝতে হলে আপনাকে আরবি সাহিত্য বা আরবি ভাষা অনেক ভাল জানতে হবে বা আপ্নকে সাহিত্য বিশারদ হতে হবে; আমরা আপাতত যারা সাহিত্য বিশারদ আছেন তাদের কথায় বিশ্বাস করে নিচ্ছি)।”

আল-কুরআনের বাণীগুলো এত বেশী অলংকৃত, শব্দের যে অপরূপ বিন্যাস- তা একজন বিশ্বাসী মাত্রই আরবী ভাষা না জেনে- না বুঝেই অন্ধভাবে বিশ্বাস করে। আর এমন অন্ধভক্তিজনিত অবস্থান থেকেই এরকম ঘোষণা: “কোরআনের সমতুল্য কাব্যগ্রন্থ আজও সম্ভব হয়নি”!!!!!!!!
সুতরাং- খুব সহজেই এক বাক্যে জবাব দেয়া যায়: এমন ঘোষণাকারীর কাব্য সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই।

সেই সাথে এরকম বিশ্বাসীদের অবগতির জন্য জানিয়ে দেই: বিশ্ব সাহিত্যে আল-কোরআনের অবস্থান বলতে গেলে শূণ্যের কোঠায়। ইতিহাস গ্রন্থ- দর্শন গ্রন্থ হিসাবে এই গ্রন্থের যথেষ্ট ভূমিকা অবশ্যই আছে- একটা পুরো যুগকে বুঝতে গেলে- কোরআন-হাদীসের শরণাপন্ন অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে কোরআন না থাকলেও চলবে। এমনকি আমাদের এই অঞ্চলের মহাভারত-রামায়নকেও মহাকাব্য আখ্যা দেয়া যায়, প্রাচীণ সাহিত্যের কোঠায় আমরা চর্যাচর্যবিনশ্চয় বা চর্যাপদকে বুকে পিঠে ধরে রাখি- বিশ্বসাহিত্যকে হোমারের দুই প্রাচীণ মহাকাব্য অনেক ধনী করে- সেগুলোর তুলনায় আল-কোরআন নিতান্তই শিশু। সাহিত্য বিশারদদের কথা আপনি এনেছেন- কিন্তু দুনিয়ার সাহিত্য বিশারদরাই কিন্তু প্রাচীণ কোন গ্রন্থের মধ্যে কোনটির সাহিত্যমান কেমন- কোনটিকে মহাকাব্য বলা যাবে- কোনটিকে বলা যাবে না- তা নির্ধারণ করেছেন।

এবারে সরাসরি আল-কোরআনের কাব্যগুন কেমন তা একটু বিচার করি। কাব্যের বিভিন্ন অঙ্গগুলো হচ্ছে: রূপক-উপমা- ছন্দ ইত্যাদি। একটা ভাবকে রূপক-উপমা দিয়ে তুলে ধরতে পারাটা কাব্যের বিশেষত্ব- এটা কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে আছে, এটা স্বীকার করছি। কিন্তু এর পরিমাণ খুব কম ও এগুলো আমার মতে ততখানি বুদ্ধিদীপ্ত নয়- মানে অনেকটা ফ্লাট টাইপের। উপরন্তু আমাদের এখানকার প্রাচীণ গাঁথা-কবিতায় সাধারণ মানুষ যেসমস্ত উপমা-রূপক দিয়ে মানুষের মনের ভাবকে প্রকাশ করে গিয়েছে- অনেক আগে থেকেই দেহবাদী গানগুলোতে যে উপমার ছড়াছড়ি- তা থেকেই বুঝা যায়- এগুলো মানুষের দ্বারাই খুব সম্ভব।

আর, ছন্দের কথা বললে- কোরআনকে অনেক পেছনে রাখতে হবে। রামায়ন-মহাভারতের শ্লোক- আমাদের চর্যাপদের পদগুলোর ছন্দ অনেক সুললিত, পরিমিত। কোরআনের বেশীরভাগ কবিতা তথা সুরাই আসলে ছন্দ মেইনটেইন করেনি। তবে কিছু কিছু সুরা- অনেক সুরার মাঝের বিভিন্ন ধারাবাহিক আয়াতে আমরা ছন্দের খেলা দেখতে পাই। কিন্তু সাথে এটাও বলতে হবে যে- যেকোন প্রাচীণ ছন্দের মত এগুলো একঘেয়ে অনুপ্রাসের সমাহার।

যেমন:
আলাম তারা কাইফা ফায়ালা রাব্বুকা বি আসহাবিল ফিল
আলাম ইয়াজয়াল কাইদাহুম ফি তাদলিল
ওয়া আরসালা আলাইহিম তয়রান আবাবিল
তারমিহিম বিহিজারাতিম মিন সিজ্জিল
ফাজায়ালাহু কা’য়াসফিমমাকুল…..
এটা ১০৫ নং সুরা ফিল। সব বাক্যের শেষেই আছে ইল (যদিও পঞ্চম বাক্যে আছে উল)। তেমনি সুরা ফাতেহায় সব বাক্যের শেষে আছে- ইন/ইম। সুরা নাসে সব বাক্যের শেষে পাওয়া যাবে নাস….. ইত্যাদি।

এধরণের ছন্দ প্রাচীণ কবিতাগুলোতে পাওয়া যায়। সে সময়ে আসলে ছন্দগুলো তৈরি হতো মুখে মুখে- প্রচারিত হতো মুখে মুখে, ফলে এরকম অন্তমিল রেখে তৈরি করাটা ছিল সহজ, এরকম অন্তমিল দেয়া ছন্দ মনে রাখাটাও ছিল সহজ। দেখুন চেষ্টা করলে আপনি এরকম ছন্দ তৈরি করতে পারবেন- যেমন:
আলো আমার আলো
আমি আছি ভালো
যতই তুমি কালো
প্রেমের সুধা ঢালো
….. বা
কলকল
ছলছল
ঢলঢল
ঝলমল
হলহল
কোলাহল……. ইত্যাদি।
চেষ্টা করে দেখুন, আমার মত কেউ পারলে আপনিও পারবেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছড়াগুলো পড়ে দেখতে পারেন- তাহলে বুঝবেন এরকম ছন্দ মানুষ কি দারুন তৈরি করতে পারে।

আর প্রাচীণকালের দোহাই পাড়লে বলবো- চর্যাপদ, রামায়ন-মহাভারত এসবের দিকে চোখ রাখুন। চর্যাপদের ছন্দগুলো- রামায়ন মহাভারতের শ্লোকগুলোও এরকম অন্তমিল ছন্দ দিয়ে তৈরি। এবং পড়লেই বুঝতে পারবেন ওগুলোর চেয়ে কত নিম্নমানের ছন্দ আল-কোরআনে। নিম্নমানের বলছি এই কারণে যে, কোরআনেরটা অনেক বেশী একঘেয়ে, এবং কোরআনে এইরকম মিল দেখাতে গিয়ে একই শব্দ, একই বাক্য বারবার ব্যবহার করা হয়েছে।

আর, আপনার ঐ বাক্যটিতে তো মনে হলো- বর্তমানের কাব্যগুলোকেও চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে!!!! বর্তমানের কাব্যগুলোর দিকে তাকানো আসলে ঠিক হবে না, তাহলে কোরআনকে আরো ন্যাংটো হতে হবে। আজকে ছন্দের যত বৈচিত্র, যত শক্তি তা ঐ আমলের কোন গ্রন্থের কাছ থেকে আশা করি না- তুলনাটাও ঠিক নয়; তবে আপনারা যদি সেই রকম চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসেন তবে বিনীতভাবে জানাতেই হয় যে- বিশ্ব সাহিত্যে আল-কোরআনকে কেউ কোনদিন মহাকাব্য/কাব্য বলেনি বলেই আমি জানি।

 

কাব্যগুণকে সময় এবং প্রেক্ষিতে আলোচনা করাই ভালো। এবং কাব্যগুণে রবীন্দ্রনাথ আর কোরআনের তুলনা চলে না-এও ঠিক। কিন্তু কাব্যগুণ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। মুহাম্মদ ভেবেছেন-এও অনেক-তিনি যে দৃশ্যকল্প তৈরি করেছেন-তা কম কিসে-আমার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হয় কিছু কিছু অংশ।

আমিও মনে করি- কাব্যগুণ তথা যেকোন সাহিত্য বিচার সময় ও প্রেক্ষিতেই করা উচিৎ।

আমি চর্যাপদ- রামায়ন-মহাভারত-ওডিসি-ইলিয়ড প্রভৃতিতে অবশ্যই আজকের যুগের ছন্দের বৈচিত্র্য ও শক্তি খুঁজতে যাই না- এটাই স্বাভাবিক যে- ঐ আমলের কাব্যে পয়ার-চতুর্দ্দশপদী বা অমিত্রাক্ষর পাবো না। কিন্তু সমস্যা হয় যে- যখন কেউ কোন এক আমলের এক কাব্যকে সমস্ত যুগের জন্য সেরার রায় দিয়ে দেয় তখন। সে জায়গা থেকেই উপরের আলোচনাটি টানা- রবীন্দ্রনাথ, … প্রমুখের নাম আনা। আরেকটি উদ্দেশ্য আছে- সেটা হলো দেখানো যে- মানুষের পক্ষেই কি অসাধারণ সব সৃষ্টি সম্ভব।

উপরন্তু আমার কাছে কোরআনের কাব্যমান সে আমলের এবং তারও আগের আমলের কাব্যের সাথে তুলনাতেও খুব নিম্নমানের মনে হয়। কেননা- বাস্তবে কোরআন তো কোন কাব্যগ্রন্থ নয়- মুহম্মদ সা এর কোন উদ্দেশ্যও ছিল না- কোরআনের মাধ্যমে কাব্যচর্চা করার। তারপরেও একদল ধর্মান্ধ লোক এর কিছু কবিতার উদাহরণ টেনে একে সমস্ত যুগের সেরা কাব্য বলে দাবি করে- এতে আসলে কোরআনকেই তারা তামাশার বস্তু হিসাবে উপস্থাপন করেন। এবং এটা মনে করি জন্যই আমি- চর্যাপদ-রামায়ন-মহাভারত প্রভৃতি যেগুলো আসলেই কাব্য এবং অসংখ্য কবির কাব্য প্রচেষ্টারই ফল- সেগুলোর সাথে কোরআনের তুলনাটাও আমার কাছে সঠিক মনে হয় না (এ যেন মেঘনাদবধ কাব্যের কাব্যময়তার সাথে বিষাদ সিন্ধুর কাব্যময়তার তুলনামূলক আলোচনা!!)। তারপরেও সেরকম তুলনামূলক আলোচনা টানা- কারণ, বিশেষ সেই দাবি।

আপনি দৃশ্যকল্প সৃষ্টির কথা বলেছেন। হুম, সেটা আমিও স্বীকার করি, এবং কোরআন যতই পড়ি- ততই মুহম্মদ সা এর প্রতিভায় বিস্মিত হয়ে যাই। তার কল্পনাশক্তি খুবই অসাধারণ। মেরাজের কাহিনীটিও ধরুন। বা বেহেশত-দোযখের ডিটেইলিং গুলো দেখুন। সে সময়ের বিধর্মী- স্বধর্মী সকলের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব তিনি যেভাবে দিয়েছেন- খুব উচ্চমাপের কল্পনাশক্তির লোক না হলে তা সম্ভব নয়। একবার সাহাবীরা জিজ্ঞেস করছেন- সন্ধা নামলে সূর্য কোথায় যায়? সাথে সাথে জবাব- সূর্য গিয়ে আল্লাহর আরশের নীচে অবস্থান করে- ঠিক সুবেসাদিকের সময় সূর্য আবার চলে আসে… ইত্যাদি। এই যে- জবাবটি দিলেন, এখানেও কিন্তু দারুন কল্পনাশক্তির মিশেল আছে। এরকম- অসংখ্য বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন- কোরআনে ও হাদীসে পাওয়া যায়- এবং এত অসাধারণ ভঙ্গীতে, সবই অনবদ্য। ধরেন, আল্লাহর যে ৯৯ টি নাম, মানুষেরই বিভিন্ন ভালো গুন সব আল্লাহর নাম হিসাবে দিয়েছেন- কিন্তু এমন খুটে খুটে মানুষের ৯৯ টি গুন বের করাও কিন্তু কম না।

এটা ঠিক যে- ইসলাম হিসাবে মুহম্মদ সা যা প্রচার করেছেন তার বড় অংশই তার নিজের আবিষ্কার নয়। সেখানকার বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা অলরেডিই এগুলোর বড় অংশ বিশ্বাস করতো ও মানতো, নানা মিথ আগে থেকেই আরব অঞ্চলে প্রচলিত ছিল- কিন্তু সেগুলোকে নিজের মত রিমেক করা, সংকলন করাও আমার মনে হয় অসাধারণ ধীশক্তি ছাড়া সম্ভব নয়। এবং মাঝে মধ্যেই কোরআনে নানারকম দৃশ্যকল্প তৈরী হয়েছে। কিন্তু এসবকেই কি কাব্য বলা যায়? একটা রূপকথা গল্পে- ঠাকুরমার ঝুলি টাইপের বই এও চমৎকার সব দৃশ্যকল্প পাবেন- সেটাতে কি শুধু এটুকুই বলতে পারি না যে- এসবের রচয়িতার কল্পনাশক্তি খুব প্রখর ছিল (উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী পশুপাখির মুখে ভাষা দিয়ে গল্পগুলো পড়লে তো আমি এখনো মুগ্ধ হই- বা ঈশপের গল্প গুলোও লেখকের কল্নাশক্তির বহিপ্রকাশ ঘটায়)- কিন্তু কাব্য বা কবিতা হতে গেলে তো আরো কিছু লাগে!!

বাকারা- নিসা…… এসব সুরাকে কিকরে আপনি কবিতা বলবেন? কোনদিক থেকে এগুলোর কাব্যগুণ খুঁজে পাবেন?

আবার নাস-ফাতেহা-ফিল এরকম কিছু কবিতার ব্যাপারেও আগেই বলেছি- এগুলোর ছন্দ সেই প্রাচীণ আমলের কবিতাগুলোর সাথে তুলনা করেও নিম্নমানের মনে হয়েছে। কেননা- এগুলো একটু বেশী মাত্রায় একঘেয়ে- যেমন দেখুন:

রহিমের কলম আছে,
জব্বারের মলম আছে,
আবুলের বই আছে,
মিহিরের মই আছে,
কাদিরের কলস আছে,
নাদের খুব অলস আছে…..

সবগুলোর শেষে আছে….. এমনটি চললে- সেটি কি খুব ভালো লাগে? সুরা নাসে সব বাক্যের শেষেই নাস। অধিকাংশ কবিতার বেলাতেই ফর্মটা এই একই রকম। অথচ অন্তমিল রেখেই যদি কবিতার ছন্দ এমন হয়-

রহিমের কলম আছে,
জব্বারের মলম কাছে,
আবুলের আছে বই,
মিহিরের মই,
কাদিরের কলস,
নাদের খুব অলস…..

অন্তমিল থাকলেও কিন্তু ততোটা একঘেয়ে নয়। চর্যাপদ- রামায়ন-মহাভারতের ছন্দগুলো তাই আমার কাছে বেশী ভালো লাগে।

“বা যখন দেখি কুরআন ১৪০০ বছরের মাঝে বিন্দুমাত্র চেঞ্জ হয়নি যেখানে বাইবেল বা অন্যান্য ধর্মগুলি শত শত বার চেঞ্জ হয়েছে*। রাজা বা পাদ্রিরা নিজেদের মনের মত পরিবর্তন করেছেন। এর মধ্যে আমরা আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পাই। …..
…… অন্যান্য অনেক ধর্ম প্রকৃতপক্ষে ঈস্বরের কাছ থেকে আসলেও তা সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তন/ বিকৃত হয়ে গেছে এবং সময়ের পরিবর্তনের জন্য ধর্ম গ্রন্থ গুলির লেটেস্ট বা ফাইনাল ভারসন প্রয়োজন। এটাই যে ফাইনাল ভারসন এর প্রমাণ হচ্ছে, দেড় হাজার বছরেও এটার বিন্দুমাত্র অবিকৃতি। (আল্লাহ তায়ালা কুরআনে নিজেই কুরআনের সংরক্ষন করবেন বলেছেন বা অবশ্যই তা অবিকৃত আছে।)”

কোরআন অবিকৃত হয়নি মানে কি বুঝাতে চেয়েছেন? এবং তার দ্বারা কি প্রমাণ হয়?

আজকে মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের পরে- লাখ লাখ কোটি কোটি বই আপনি যুগ যুগ অবিকৃত পাবেন। শেক্সপীয়রের নাটক, সনেটগুলো সব একই ফর্মে আপনি পাবেন- সামান্য দাড়ি-কমারও কমবেশ পাবেন না। চর্যাপদের পদগুলোও তো আপনি ঠিক আগের ফর্মেই পাচ্ছেন। এখনতো আমরা দুই/ আড়াই হাজার বছর আগের শিলালিপিও পাই- সেগুলোও তো অবিকৃত। এতে কি প্রমানিত হয়?

হুম, একটা সময়ে মুখে মুখে যখন জ্ঞান, সাহিত্য… প্রভৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বা যুগ থেকে যুগে বিচরণ করতো – তখন সেগুলোর ক্ষেত্রে বিকৃতির সম্ভাবনা থেকেই যেত। এবং আমরা জানি আল-কোরআন পুরোটা এক সাথে লিপিবদ্ধ অবস্থায় মুহম্মদ সা মানুষের সামনে হাজির করেননি। প্রাথমিক অবস্থায় এটা খণ্ড খণ্ড ভাবে মুখে মুখে প্রচারিত ও বিচ্ছিন্নভাবে লিখিত অবস্থায় ছিল। ফলে- এটার বিশুদ্ধতা নিয়ে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছিল, এবং সেকারণেই সে ব্যাপারে সকলকে নিশ্চিন্ত করার দায় কোরআনের ছিল। সেকারণেই আমরা কোরআনে আল্লাহকে বলতে দেখি- তিনিই এর সংরক্ষণকারী!!!
নিশ্চিৎভাবেই মেঘনাদবদকাব্য বা কিং লীয়র বা ওয়ার এণ্ড পীস এর ক্ষেত্রে এরকম অবিকৃতির ঘোষণা দেয়ার কোন প্রয়োজনই কেউ বোধ করেননি।

এবারে আসি- অন্যান্য প্রাচীণ গ্রন্থ সমূহের সাথে তুলনার বিষয়টিতে। অন্য ধর্মগ্রন্থসমূহ বিকৃত হয়েছে, কোরআন হয়নি!! এ কথাটির ফাঁক একটু দেখলেই বুঝা যাবে।

যেসমস্ত গ্রন্থ সমূহ লেখকের (আপনাদের ভাষায় যার উপর নাজিল হয়েছে তার) জীবদ্দশাতেই প্রামান্যরুপে উপস্থিত হয়েছে- সেগুলো নিয়ে বিকৃতির অভিযোগ আনাটা কি সম্ভব? এটা আনা হয়, লেখকের বা নাযেল হওয়া ব্যক্তির মৃত্যুর পরে সংকলিত হওয়ার ক্ষেত্রে। যেমন ধরেন- সক্রেটিস কোন কিছু লিখে যাননি। লিখেছেন, তার দুই শিষ্য। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে- শিষ্য দুজন যা লিখেছেন- তার হুবাহু কি সক্রটিসের চিন্তা-দর্শনকে রিপ্রেজেন্ট করে? কিন্তু এটাও ঠিক যে- প্লেটো যখন প্রামান্যরূপে বা লিখিতরূপে প্লেটোর সংলাপ বা সক্রেটিসের জবানবন্দী লিখলেন- সেটা কিন্তু অবিকৃত হিসাবেই এবং অবশ্যই প্লেটোর লেখা হিসাবেই আমরা পাই।

একইভাবে, যেশাস ও মুহম্মদ সা দুজনের কেউই নিজে বাইবেল-কোরআনের এরকম প্রামান্য রূপে হাজির করতে পারেন নি। পরবর্তীতে তাদের অনুসারীরা এগুলো সংকলিত করেন। এখন প্রশ্ন উঠাটাই স্বাভাবিক যে, এখানে যা আছে তা আসলে ওনাদের প্রচারিত ধর্মমতকে হুবাহু ধারণ করে কি না? যেশাসের মৃত্যুর বেশ পরে যেহেতু এগুলো সংকলনের উদ্যোগ নেয়া হয়- সেহেতু বিচ্যুতির সম্ভাবনা একটু বেশি- সে তুলনায় কোরআনে একটু কম। কিন্তু একবার সংকলিত বা প্রামান্য রূপে পাওয়া গেলে- সেটা ঠিক ঠিক ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে অবিকৃতরূপেই রাখা সম্ভব। আমরা তো এই উপমহাদেশেরই খৃস্টপপুর্ব আমলের বেশ কিছু গ্রন্থের সন্ধান পেয়েছি- এবং যেহেতু সেটা ঐ আমলের লিপিবদ্ধ- এবং সহজেই দাবি করা যায়- সেগুলো লেখক যেমন লিখেছেন- তেমনই আছে।

এরপরে আসে, একটি ধর্মগ্রন্থ প্রামান্য অবস্থায় পাবার পরেও সেটার ব্যাখ্যা নিয়ে নানামত। মূলত এটাকে কেন্দ্র করেই বাইবেলের পরবর্তি সংষ্করণ বের হয়েছে। পরবর্তীগুলোকে যেকেউ বিকৃত বলতে পারে- কিন্তু পুরানটাকে তো সেই অর্থে বিকৃত বলা যাবে কি? আর- এমন তো কোরআনের ক্ষেত্রেও পাওয়া যায়। কোরআন সংকলনের সময়ই সাহাবীদের মধ্যে মতভেদের কথা বিভিন্ন হাদীসেই আছে। আলী রা এর আপত্তির কথা আমরা জানি। বিভিন্ন ভাষারীতি নিয়ে ঝামেলার কথাও আমরা জানি। ওসমান কর্তৃক কোরআনের অন্য সব কপি ধ্বংস করার কথা আমরা জানি। হাফস ও ওয়ালস এর কোরআনের ভিন্নতার কথা আমরা জানি। শিয়াদের আলাদা কোরআনের কথা আমরা জানি। সর্বশেষ রাশাদ খলীফার সংশোধিত কোরআনের কথাও আমরা জানি। এসমস্তই নির্দেশ করে যে- কোরআনও বিভিন্ন সময়ে বিকৃত হয়েছে এবং এক গ্রুপের কাছে আরেক গ্রুপের কোরআন অবশ্যই বিকৃত কোরআন।

সুতরাং কোরআন অবিকৃত হলেই যে সেটা আল্লাহর লেখা এমনটা যেমন বলা যাবে না তেমনি- কোরআনও বিভিন্ন সময়ে বিকৃত হয়েছে, কোরআনকে বিকৃত করা হয়েছে এটা যখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে- তখন কি আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ তৈরী হওয়া উচিৎ নয়?

“বা যখন দেখি কূরআনে এক টা আয়াত নেই যা প্রতিষ্টিত বিজ্ঞান দ্বারা ভুল প্রমাণ করা যায়। তার বিপরিতে অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলিতে অসংখ্য ভুল তথ্য, বা অসামনজন্য তথ্যে ভরপুর।
বা যখন দেখি কুরআনে বিজ্ঞানে অধুনা প্রমানিত অনেক বিষয় নির্ভুল ভাবে বর্নণা দেয়া হয়েছে।”

কোরআনের একটা আয়াত নেই যা প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান দ্বারা ভুল প্রমান করা যায়- এটা যে বলে তার সম্পর্কে দুটো কথা অনায়াসেই বলা যায়: এক- হয় তিনি কোরআনের সব আয়াত পড়েননি, পড়ে বুঝেননি, নয় দুই- তিনি বিজ্ঞান সম্পর্কে নিতান্তই অজ্ঞ।
প্রাচীণ গ্রন্থসমূহের, তা সে ধর্মগ্রন্থই হোক- আর জ্ঞান-দর্শনের গ্রন্থই হোক, সেগুলোর মধ্যে অসংখ্য অসামঞ্জস্যতা আজকের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান যেমন খুজে পায়- একইভাবে কোরআনের আয়াতে আয়াতে বিজ্ঞান বিরোধী অসত্য অসামঞ্জস্য উদ্ভট কথাবার্তা পাওয়া যায়। আবার সেই সমস্ত প্রাচীণ গ্রন্থ সমূহে অনেক কিছুই পাবেন যেগুলো এখনও বিজ্ঞান গ্রহণ করে (এর দ্বারা এতটুকুই প্রমানিত হয় যে- ঐ বিষয়গুলোতে সে সময়েই মানুষ সঠিক জ্ঞানের সন্ধান পেয়েছিল!!)- তেমনি হয়তো কোরআনেরও কিছি কিছু বিষয় আজকের দিনের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান দ্বারা সঠিক বলা যাবে। কিন্তু তারমানে এই নয় যে- কোরআনের সমস্ত কিছুই আজকের বিজ্ঞান অনুমোদন করে!!! আদমের গল্প- ফেরেশতা-জ্বিন এর গালগল্প, যাদুবিদ্যা-তুকতাকের গল্প, নবীদের অলৌকিক ক্ষমতার গল্প…. এগুলো সবই আজকের বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নেহায়েত গালগল্পই। আসমান-যমিন নিয়ে যেসব কথাবার্তা আছে, প্রাণীর-মানুষের সৃষ্টি, মানুষের জন্ম-ভ্রূণের বিকাশ এসব নিয়ে কথাবার্তা আজকের বিজ্ঞানের চোখে ভ্রান্ত। এমন অনেক কিছুই আছে। আপনি নিজে আরেকটু পড়াশুনা করুন, চোখ কান খোলা রাখুন- মনের জানালা খুলে দিন- নিজেও বুঝতে পারবেন।

আর, অধুনা প্রমানিত অনেক বিষয় কোরআনে নির্ভুলভাবে বর্ণনা দেয়া আছে- এমন দাবী আসলে একরকমের মিথ্যাচারের ফসল। বর্তমানের বিজ্ঞানের যুগে – সব ধর্মই নিজেদের একটু জাতে তোলার জন্য এ কাজটি করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আমার একটি পোস্ট ছিল- তাই নতুন করে কিছু বলছি না- সেটিই আবার পড়ার আহবান জানাই।
“যখন মনে হয় যে, মহানবী (সাঃ), যিনি ছিলেন একজন নিরক্ষর ব্যক্তি, তিনি কিভাবে মনগড়া ভাবে ২৩ বছর ধরে অসামঞ্জস্যহীন গ্রন্থ রচনা করলেন যা একইসাথে ১) মানব জাতির জন্য পথ প্রদর্শক, ২) যা তথ্যের অসামঞ্জস্যতা নেই, ৩) যাতে প্রদত্ত কোন তথ্যের বৈজ্ঞানিক ভুল নেই, ৪) অধুনা বিজ্ঞান প্রমান করছে/ খুজে বের করছে এমন তথ্য ও দেয়া আছে, ৬) যা অস্বাধারণ কাব্যে ভরপুর ৫) যা দেড় হাজার বছরেও চেঞ্জ হয়নি। ৬) এটিই একমাত্র গ্রন্থ যা অধিকাংশ মানুষ পুরোপুরি মুখস্ত রাখতে পারে, ৭) এটিই একমাত্র গ্রন্থ যা বিশ্বের হাজার হাজার লোক মুখস্ত রেখেছে। ফলে কুরআনের সমস্ত কপি পুড়িয়ে ফেললেও কুরআনকে ধংশ করা সম্ভব না।”

০) মুহম্মদ সা আদৌ নিরক্ষর ছিলেন কি না- তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে। তার প্রতি প্রথম ওহী- পড়ো। প্রাথমিক জীবনে তিনি সফল বনিক ছিলেন- সেগুলোর হিসাবাদি তাঁকেই করতে হতো। তিনি বিভিন্ন শাসকদের উদ্দেশ্যে লিখিত পত্র পড়ে সংশোধন করে দিয়েছেন এরকম হাদীসও মিলে। যাহোক তারপরে ধরে নিচ্ছি যে- তিনি নিরক্ষর ছিলেন। কিন্তু লেখতে – পড়তে না জানা মানেই কি বুদ্ধিহীন? বা মুহম্মদ সা নিরক্ষর মানে কি কেউ বলবেন যে তিনি অসাধারণ ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন না?

প্রাচীণ আমলের অসংখ্য গুনী মানুষের কথা আমরা জানি যারা ক-অক্ষর গোমাংস ছিলেন, শুধু মাথার মধ্যেই মুখে মুখেই তারা তাদের অনবদ্য সব সৃষ্টি করে গেছেন। ফলে- মুহম্মদ সা লেখতে পড়তে না জানলেই যে- তার নেতৃত্ব ক্ষমতা, দারুন অনুসন্ধিৎসু মন, গভীরে চিন্তা করার ক্ষমতা, দূর দৃষ্টি থাকবে না- এমনটি কেউ নিশ্চিৎভাবে বলতে পারবে না। আর এসমস্ত গুনের অধিকারী হলে, এবং সাথে আরো কিছু চৌকশ মানুষ থাকলে কোরআনের মত গ্রন্থটি রচনা করা অসম্ভব মনে হয় না।

আরেকটি বিষয় এখানে বলতে হবে- আজকের কোরআনটি আমরা পাই- ওসমানের হাত ধরে- তারও আগে আবু বকরের আমলে কোরআন সংকলন কমিটি প্রথম উদ্যোগটি নেয়। এই কমিটিতে যারা ছিলেন- তাদের মধ্যেও চৌকশ সাহাবী, কবি প্রতিভার সাহাবিরা ছিলেন। ফলে- আজকের কোরআনকে আমরা যে ফর্মে দেখি- সেটি একা মুহম্মদ সা এর অবদান এমনটি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যে কারণে আলী রা কে প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে দেখা যায়।

১) মানব জাতির পথ প্রদর্শক- একথাটি ভুল। আজকের দুনিয়ার অমুসলিম অংশ কোরআনকে ছাড়াই ভালো চলতে পারছে, ফলে তাদের জন্য এটা কোনমতেই পথ প্রদর্শক নয়; উপরন্তু মুসলিম বিশ্বও আজ যতই তাদের বিশ্বাসে আল্লাহকে রাসুলকে- কোরআনকে উচ্চে স্থান দেক না কেন- কোরআনের সবকিছুই তারা নিজেরাও পালন করে না বা পালন করা সম্ভব না জন্যেই পালন করে না।

নিজে পুরো কোরআন অর্থসহ এবং শানে নুযুল সহ নিজে একটু খুটিয়ে পড়লেই বুঝতে পারবেন কোরআন টা পুরো মানব জাতির পথ প্রদর্শক নয়। দেখতে পারবেন এখানে কিভাবে নবীজীর বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে একেকটা আয়াত/সুরা অবতীর্ণ হয়েছে। এমনকি তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে যখন মনোমালিন্য তৈরী হয়েছিল- সেটাকে সামাল দিতে গিয়েও আয়াত নাযেল হয়েছে- বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাহাবীরা বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে নবীজীর কাছে আসলে আয়াত নাযেল হয়েছে, বিধর্মীরা প্রশ্ন করতে আসলে আয়াত নাযেল হয়েছে- সাহাবীদের উদ্দীপ্ত করার জন্য আয়াত নাযেল হয়েছে… এসবের মধ্যে সহজেই বুঝতে পারবেন একটা বড় অংশই একদম স্পেসিফিক কিছু ঘটনা, কিছু মানুষকে নিয়ে সুরা আছে- সেগুলো কোনভাবেই সমগ্র মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক বলতে পারবেন না। একজন ব্যক্তির নামে (বিধর্মী) পর্যন্ত একটা সুরা আছে- এবং সেখানে এমন ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে- দেখলে বুঝতে পারবেন – এটা মানব জাতির জন্য পথ প্রদর্শক কিনা!!!!!

২) অনেক তথ্যেরই অসামঞ্জস্যতা আছে। আগের কমেন্টে কিছু বলেছি। এছাড়া বিভিন্ন অসামঞ্জস্যের জন্যই মুসলিমদের মধ্যে এত ভাগ- এতগুলো মাযহাবের সৃষ্টি।

৩) বৈজ্ঞানিক তথ্যের হাজারো ভুল আছে- তা আগেই বলেছি, আমার উপরের দেয়া পোস্টের লিংক দ্রষ্টব্য।

৪) অধুনা বিজ্ঞান বের করেছে এমন অসংখ্য কিছু কোরআনে নেই- এবং এমন অসংখ্য কিছু কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক। আর, কোরআনেই এমন জিনিস পত্র আছে- এরকম দাবি নির্ভেজাল মিথ্যাচার ও ধাপ্পাবাজি সেটাও আগে বলেছি।

৫) দেড় হাজার বছরে চেঞ্জ হয়েছে- সেটা তো বলেইছি। আর- আরো এমন অনেক গ্রন্থ পাবেন যা আরো অধিক সময় ধরে অবিকৃত অবস্থায় আছে।

৬) এটার কাব্যগুন নিয়েও উপরে বলেছি। যতখানি আছে- সেটার ব্যাপারে মুহম্মদ সা এর কিছু কবি সাহাবীর নাম শোনা যায়। ধরলাম- সেগুলো সাহাবীদের কাজ নয়, তারপরেও এ সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে- মুহম্মদ সা এর কাব্য প্রতিভাও ছিল। কিন্তু সেটাকে যদি আল্লাহর সৃষ্টি হিসাবে মানতেই হয় তবে আজকের যুগে এসে বলতেই হবে- আল্লাহর কাব্য প্রতিভা ইয়েটস- ইলিয়ট- জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপীয়র, মধুসুদন প্রমুখের তুলনায় অতি নিম্নমানের।

৭) এটা ঠিক যে- কোরআন মুখস্থকারীর সংখ্যা অনেক। এককালে হয়তো অন্য অনেক গ্রন্থই মানুষ মুখস্থ করে রাখতো- কিন্তু বর্তমানে এই অপ্রয়োজনীয় কাজটি কিছু ধর্মান্ধ ব্যক্তিই করে রাখে। ভগবৎগীতা, এমনকি বাইবেল মুখস্থ করা লোকও দুনিয়ায় আছে। সেই গ্রন্থগুলো আরো প্রাচীণ- এতে কিছু প্রমাণ হয় না। আর এটাও ঠিক যে- কোন গ্রন্থের সমস্ত কপি পুড়িয়ে ফেলা হলে- তার মুখস্থকারী একজনও জীবিত থাকলে সে গ্রন্থকে পুনরিজ্জীবিত করা যাবে। সেটা কোরআন কেন- যেকোন গ্রন্থের জন্য সত্য।

তবে- আমাকে যদি বলা হয়- দুনিয়ার সমস্ত কিছু ধ্বংস করা হবে- শুধু একটা বই রক্ষা করা যাবে- এমন শর্তের মুখে আমি কোরআন নয়- একটা সায়েন্স এনস্লাইকোপিডিয়া নিতাম। সেরকম সুযোগ না পাওয়া গেলে- আমি বিজ্ঞানের লেটেস্ট সমস্ত সূত্রগুলো লিপিবদ্ধ করে একটা বই বানিয়ে সেটি রক্ষা করতাম। কেননা একমাত্র সেটা হাতে নিয়েই মানুষ সবচেয়ে অল্প সময়ে সভ্যতাকে আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবে। কোরআনকে নিয়ে যেটা কখনো সম্ভব নয়।