বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান

মানব প্রকৃতির জৈববিজ্ঞানীয় ভাবনা -১

 

অভিজিৎ রায়

 

 

 

বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান মনের নতুন বিজ্ঞান :

লেখাটা শুরু করতে গিয়ে ছোট বেলায় শোনা একটা  বড়দের জোক্ মানে প্রাপ্তবয়স্ক কৌতুক মনে পড়ল। কৌতুকটা এইরকম।

 

এক আধ-পাগলা ব্যাটা (ধরা যাক তার নাম মন্টু মিয়া) সারাদিন পাড়ায় ঘুরে ঘুরে গুলতি দিয়ে জানালার কাঁচ ভাঙ্গত। এইটাই তার নেশা। কিন্তু বাপ, তুই নেশা করবি কর তোর নেশার চোটে তো পাড়া-পড়শীর ঘুম হারাম। আর তা হবে নাই বা কেন! কাশেম সাহেব হয়তো  ভরপেট খেয়ে দেয়ে টিভির সামনে বসেছেন, কিংবা হয়ত বিছানায় যাওয়ার পায়তারা করছেন, ওমনি দেখা গেল হরাম করে বেডরুমের কাঁচ ভেঙ্গে পড়লো।  শান্ত কখনো বা সকালে উঠে প্রাতঃকৃত্য সারার নাম করে বাবা-মার কাছ থেকে লুকিয়ে চাপিয়ে বাথরুমে গিয়ে কমোডে উপবেশনপূর্বক একটা বিড়ি ধরিয়ে একখান সুখটান দেবার উপক্রম করেছে ওমনি গুলতির চোটে বাথরুমের কাঁচ ছত্রখান।  নরেন্দ্রবাবু  সকালে উঠে এক রৌদ্রস্নাত দিন দেখে আজি এ প্রভাতে রবির কর… কবিতার চরণ আবৃত্তি করতে করতে জানালা দিয়ে চাঁদমুখখানি বাড়িয়ে দিয়েছেন, ওমনি এক ক্ষুদ্র ইস্টকখন্ড আসিয়া জানালা তো ভাঙিলোই, তদুপরি কপালখানিও বেঢপ আকৃতিতে ফুলিয়া উঠিলো।

 

কাহাতক আর পারা যায়। পাড়া পড়শীরা একদিন জোট বেঁধে শলাপরামর্শ করে মন্টু মিয়াকে বগলদাবা করে শহরের পাশের পাগলা গারদে দিয়ে আসলো।

 

সে এক হিসেবে ভালই হল। এখন আর বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে কারো জানালার কাঁচ ভেঙ্গে পড়ে না।  কাশেম সাহেব ভরপেট খেয়ে টিভির সামনে বসতে পারেন,  শান্ত বাবাজি হাগনকুঠিতে গিয়ে নিবিষ্ট মনে গিয়ে বিড়ি টানতে পারে, আর নরেন্দ্রবাবুও রবিঠাকুরের কবিতা শেষ করে জীবনানন্দ দাসেও সেঁদিয়ে যেতে পারেন, কোন রকমের বাধা বিপত্তি ছাড়াই।  জীবন জীবনের মত চলতে থাকে নিরপদ্রুপে।

 

আর অন্য দিকে মন্টু মিয়ার চিকিৎসাও ভালই চলছে। প্রতিদিন নিয়ম করে তাকে ঔষধ পথ্য খাওয়ানো হচ্ছে,  রেগুলার সাইকো থেরাপি দেওয়া হচ্ছে,  সমাজ জীবন নিয়ে এন্তার জ্ঞানও দেয়া হচ্ছে।  মানুষ সম্পর্কে আর সমাজ সম্পর্কে দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা হচ্ছে।  আর মন্টু মিয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন দেশের বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ ডঃ আজিম।  তো এই উন্নত চিকিৎসা আর পরিবেশ পেয়ে মন্টু মিয়ার মনও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে উঠলো। এখন আর জানালার কাঁচ দেখলেই মন্টু মিয়ার হাত আগের মত নিশপিশ করে না।  জব্দ করা গুলতির জন্য মন কেমন কেমন করে উঠে না। নিয়ম করে খায় দায়, বই পড়ে, ব্যায়াম করে আর সমাজ আর জীবন নিয়ে উচ্চমার্গীয় চিন্তা করে।  অসুস্থতার কোন লক্ষণই আর মন্টু মিয়ার মধ্যে নেই!  দিন, যায়, মাস যায়, বছর যায় …

 

বহুদিন ধরে চিকিৎসার পর একদিন সুবে সাদিকে ডাক্তার সাহেব মন্টুমিয়ার কেবিনে এসে বললেন,

 

মন্টু মিয়া, তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ

 

তাই ? এইটা তো খুবই ভাল সংবাদ দিলেন স্যার। আমি তো ভাবতেছিলাম এই পাগলা গারদ থেকে কোনদিন ছাড়াই পামু না আর। মন্টু মিয়ার চোখে বিস্ময়।

 

কি যে বলো!  আমাদের চিকিৎসার একটা ফল থাকবে না! –  ডাক্তার সাহেবের ভরাট গলায় একধরনের আত্মপ্রসাদের ছাপ।

 

তা তো বটেই। আপনাগো অনেক ধন্যবাদ  ডাক্তার সাহেব। আপনারা সবাই মিল্লা আমার জন্য যা করলেন…

 

না না কি যে বলেন। আপনার নিজের প্রচেষ্টা ছাড়া কি আর এ অসাধ্য সম্ভব হত নাকি! বিনয়ের অবতার সেজে গেলেন ডাক্তার সাহেব।  তারপর  হাতের স্টেটসকোপ দিয়ে নাড়ী দেখলেন, রক্তের চাপ পেলেন স্বাভাবিক মাত্রায়। জিব বের করিয়ে চোখের পাতা টেনে ধরে নীচে উপর করলেন কোন অস্বাভাবিকতাই পেলেন না। আরো কিছু ছোট খাট পরীক্ষা সেরে নিলেন। একজন স্বাভাবিক মানুষের যা যা লক্ষণ পাওয়া উচিৎ তাই পেলেন ডাক্তার সাহেব। ডাক্তার আজীম বুঝলেন তার চিকিৎসায় মন্টু এখন পুরোপুরি সুস্থ।  অযথা আর হাসপাতালে আটকে রাখার কোন মানে হয় না। তাকে রিলিজ করে দেওয়ার যাবাতীয় কাগজ পত্র হাতে নিলেন সই করবেন বলে।  এই কাজটা একদমই ভাল লাগে না ডঃ আজিমের। সামান্য একটা রিলিজ, অথচ  হাজারটা কগজপত্র, হাজার জায়গায় সই। কাগজগুলোতে চোখ বুলিয়ে একটা একটা করে সই-এর দায়িত্ব সেড়ে নিচ্ছেন ডাক্তার সাহেব।  ফাঁকে ফাঁকে মন্টু মিয়ার সাথে কথোপকথন চালাচ্ছেন, যাতে যতদূর সম্ভব বিরক্তি  থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।

 

– তা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে কি করবে মন্টু মিয়া? সোজা বাসায় চলে যাবে?

 

– না ডাক্তার সাব।  ভাবতেছি সামনের ওই নিষাদ হোটেলটায় আগে যামু।

 

– হোটেলে? কেন? ভাল করে খাওয়া দাওয়া করবে বুঝি?  তা করতেই পার। হাসপাতালের ঘাষ পাতা খেতে খেতে অরুচি ধরে গেছে নিশ্চয়।

 

– হোটেলটায় নাকি মদ টদ আর সাথে আরো কিছু  জিনিস পাওয়া যায় সস্তায়।  ভাবতেছি অনেকদিন …

 

– হ্যা হ্যা তা তো বটেই। আরে এত লজ্জা পাচ্ছ কেন। ফুর্তি করার এটাই তো বয়স। হ্যা, ওখানে শুধু মদই পাওয়া যায় না, সাথে নাকি সুন্দর সুন্দর মেয়েও পাওয়া যায়… মানে এই আমি শুনেছি আর কি  …

(ডঃ আজীম যে সে সব উদ্ভিন্নযৌবনা মধুমক্ষিকার লোভে প্রায়শঃই বাসার নাম করে নিষাদে সেঁদিয়ে যান, আর দীর্ঘ সময় পরে মাঝ রাতে বাসায় গিয়ে বউকে আলিঙ্গন করে বলেন …আজকেও ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল, বুঝলে এত কাজ থাকে… এই ব্যাপারটা এক্ষণে মন্টু মিয়ার কাছ হইতে চাপিয়া যাওয়াই শ্রেয় মনে করিলেন ডঃ আজীম)।

 

হ স্যার ওগো জিনিস ভালা। আমি জানি

 

তো এতদিন পর এরকম একটা চান্স… নিশ্চয় অনেক আমোদ ফুর্তি করবে

 

হ স্যার। লটের সব থেইক্যা সুন্দর মাইয়াডারে ভাড়া করুম। লগে এক  বোতল কেরু

 

বাহ তারপর? ডাক্তার সই করার কথা ভুলে মন্টু মিয়ের দিকে চাইলেন।  কেরুর প্রতি ডঃ আজীমের বিন্দুমাত্র আকর্ষণ না থাকলেও (তিনি আবার বিদেশি মদ ছাড়া কিছু মুখে দেন না), নারীদেহের প্রতি তার অন্তহীন আকর্ষণ। মন্টু মিয়া হোটেলে গিয়ে কি করবেন, তা ভেবেই তিনি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতে লাগলেন।

 

তারপর আর কি! একটা রুম বুক দিমু। টেকা পয়সা যা আছে তাতে চইলা যাইব

 

টাকা পয়সা যে তোমার আছে তা ত জানি।  কিন্তু তুমি রুমে গিয়ে কি করবে? ডাক্তার সাহেবের আর তর সয় না।

 

রুমে গিয়া দরজাটা ভাল মত লক করমু আগে। তারপর মাইয়াডারে বিছানায় বহাইয়া কেরুর বোতল খুইলা দিমু চুমুক। তারপর আস্তেধীরে মাইয়াডার দিকে আগামু…

 

তারপর, তারপর? ডাক্তার সাহেবের শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে উঠছে।

 

তারপর স্যার … মাইয়াডার কাপড় আস্তে ধীরে খুলতে শুরু করমু।  তারপর …

 

তারপর? ডাক্তার সাহেব উত্তেজনায় পারলে একেবারে দাঁড়িয়ে যান।

 

– তারপর ব্রা টা খুইলা লমু …

 

হ্যা, তারপর?  তারপর কি করবে? ডঃ আজীম এবারে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেছেন একেবারে।

 

তারপর স্যার,  ওই ব্রাটার ইলস্টিকটারে গুলতি বানায়া হোটেলের জানালার সমস্ত কাঁচ ভাঙ্গুম!’

 

কী!!!! ডঃ আজীম মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন।

 

 

*** ***

 

 

 

 

ছোটবেলায় শোনা এই বড়দের জোকটা ফালতু মনে হলেও এর মর্মার্থ কিন্তু ব্যাপক। এতে আমাদের মানব মনের এক অন্তহীন প্রকৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে। এই বড়দের ঈশপের গল্পের মর্মার্থ হল – কারো কারো মাথার ক্যারা এমনই যে, যত চেষ্টাই করা হোক না কেন সেই ক্যারা কোন রকমেই বের করে ফেলা যায় না ।   যত সাইকোথেরাপিই দেয়া হোক না কেন, দেখা যায় আবার সুযোগ পেলেই এবাউট টার্ন করে রোগী। আমি ‘সমকামিতা কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ‘ নামে একটি সিরিজ লিখেছিলাম, সেখানে বহু দৃষ্টান্ত হাজির করে দেখিয়েছিলাম যে,   সমকামিতার ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রেই স্রেফ পরিবেশ নির্ভর নয়,  বরং ‘বায়োলজিকালি হার্ডওয়্যার্ড’।  একটা সময় ছিলো যখন, সমকামিতাকে ঢালাওভাবে মনোরোগ বা বিকৃতি বলে ভাবা হত। ভাবা হত সমাকামিতা বোধ হয় কিছু বখে যাওয়া মানুষের বেলাল্লাপনা ছাড়া আর কিছু নয়।  আজকের দিনে সেই ধারণা (অন্ততঃ পশ্চিমে) অনেকটাই পাল্টেছে।এ প্রসঙ্গে জানানো যেতে পারে যে, ১৯৭৩ সালের ১৫ ই ডিসেম্বর American Psychiatric Association (বহু চিকিৎসক এবং মনোবিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন) বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার মাধ্যমে একমত হন যে সমকামিতা কোন নোংরা ব্যাপার নয়, নয় কোন মানসিক ব্যধি। এ হল যৌনতার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। ১৯৭৫ সালে American Psychological Association একইরকম অধ্যাদেশ দিয়েছিলেন। সকল আধুনিক চিকিৎসকই আজ  এ বিষয়ে একমত।

 

মন্টু মিয়ার পাগলামো কিংবা সমকামিতাই কি ক্যারা মাথার কেবল একমাত্র উদাহরণ? না তা মনে করা ভুল হবে। আমাদের চারপাশে কি আরো উদাহরণ  চোখ মেললেই আমরা মানব প্রকৃতির এ ধরনের আরো মজার মজার উদাহরণ দেখতে পাব। একই রকম কিংবা প্রায় একই রকম পরিবেশ দেয়ার পরও অভিভাবকেরা লক্ষ্য করেন – তাদের কোন বাচ্চা হয় মেধাবী, অন্যটা একটু শ্লথ, কেউ বা আবার অস্থির, কেউ বা চাপা স্বভাবের,কেউ বা কোমল কেউ বা হয় খুব ডানপিটে। কেউ বা স্কুলের লেকচার থেকে চট পট অংকের সমস্যাগুলো বুঝে ফেলে, কেউ বা এ ধরণের সমস্যা দেখলেই পালিয়ে বাঁচে, কিংবা মাস্টারের বেতের বাড়ি খেয়ে বাসায় ফেরে। ছোট বেলা থেকেই কেউ পিয়ানোতে খুব দক্ষ হয়ে উঠে, কেউ বা রয়ে যায় তাল কানা। কেউ বা খেলাধূলায় হয় মহা চৌকষ, কারো বা ব্যাটে বল লাগতেই চায় না। কেউ ছোটবেলা থেকেই গল্প-কবিতা লেখায় খুব পারদর্শি হয়ে উঠে,তার কেউ সাহিত্য শব্দটা উচ্চারণ করতে গেলেই দাঁত খুলে আসে কিংবা একটা চার লাইনের কবিতা লিখতে গেলেই কলম ভেঙ্গে পড়ে। এ ধরনের ব্যাপার স্যাপারের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত।    

 

কাজেই, আমরা কিছু উদাহরণ পেলাম যেগুলো হয়ত অনেকাংশেই পরিবেশ নির্ভর নয়। অন্ততঃ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে আমরা সেগুলোর প্রকৃতি রাতারাতি বদলে দিতে পারি না।আইনস্টাইনকে শিশু বয়সে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলে বড় করলেই কি তিনি ম্যারাডোনা বা পেলে হয়ে উঠতে পারতেন? তা কিন্তু হলফ বলা যাবে না। তার মানে ভাল বা ‘উপযুক্ত’ পরিবেশ দেয়ার পরও বাঞ্ছিত ফলাফল আমরা পাই না বহু ক্ষেত্রেই। তখন কপাল চাপড়ানোই সার হয়।কিন্তু তার মানে কিন্তু এটা মনে করা ভুল হবে যে,  জীবন গঠনে পরিবেশের কোন প্রভাব নেই।  অবশ্যই আছে। জীবন গঠনে পরিবেশের ভূমিকা যে অনস্বীকার্য, সেটা তো আমরা ছোটবেলা থেকেই জানি। সে জন্যই প্রত্যেক পিতামাতা তার সন্তানকে একটা ভাল পরিবেশ দিয়ে বড় করতে চান। শিশুর মানসপটে  পরিবেশের প্রভাব আছে বলেই ভাল একটা পরিবেশ প্রদানের জন্য কিংবা ভাল একটা স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তি করানোর জন্য অভিভাবকেরা  অহর্নিশি চিন্তিত থাকেন। তারপরও কি তারা সবসময় প্রত্যাশিত ফল পান? মুনির ঘরে কি শনি জন্মায় না? কিংবা আলিমের ঘরে জালিম?  জন্মায় জন্মায়। এই আমার উদাহরণটাই ধরুন। আমার মা ছোটবেলা থেকে কত করে চাইলো তার ছেলেটার যেন ধর্ম কর্মে মতি থাকে,সবার সাথে যেন  ভাল ব্যবহার করি, কারো সাথে যেন ঝগড়া ফ্যাসাদে না জড়াই। তা আর হোল কই!  ধর্ম কর্ম আর আমার ধাতে সইলো না।  মুনাফেকের খাতায় অচীরেই নাম উঠে গেলো আমার।  সাত বছর বয়সে আমি ঘোষণা দিয়ে বললাম মন্দিরের প্রসাদ যেন আমাকে না খাওয়ান হয় কখখনো।  আমাদের পাড়ার (মা-বাবার দৃষ্টিতে) সবচেয়ে অপছন্দের আর বখে জাওয়া ছেলেটার সাথে মিশতে শুরু করে দিলাম। আমার মা নীরবে চোখের জল ফেলেন- কী কুক্ষণে যে এইটারে পেটে ধরেছিলাম! অথচ এমন কি হবার কথা ছিলো? ভাল পরিবেশের কোন অভাব ছিলো না আমার …

 

পাঠকদের মাথায় নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করেছে পরিবেশই যদি মানব প্রকৃতি গঠনের একমাত্র নিয়ামক না হয়ে থাকে, তাহলে আর বাকী থাকে কি?  বাকী থাকে একটা খুব বড় জিনিস।  আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা বলেন, মানব প্রকৃতি গঠনে পরিবেশের প্রভাব যেমন আছে, তেমনি আছে আরেকটা জিনিসের প্রভাব। সেটা হচ্ছে বংশানু বা জিন।  মানুষের প্রকৃতি বিশ্লেষণে জিনকে নিয়ে আসায় অনেকের চোখই হয়তো কপালে উঠে যাবে। ভুরুও কুঁচকে যেতে পারে কারো কারো। তবে আমি এ প্রবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করব যে, পরিবেশ এবং জিন – মানব প্রকৃতি গঠনে কোনটার প্রভাবই কোনটার চেয়ে কম নয়।  আমরা প্রায়শই এক সন্তানদের দেখিয়ে বলি ছেলেটা বাপের মতই বদরাগী হয়েছে, কিংবা বলি মেয়ে হয়েছে মার মতই সুন্দরী।  চোখগুলো দেখেছ কি রকম টানা টানা?  এগুলো কিন্তু আমরা এমনি এমনি বলি না।  বহুদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই এগুলো বলি, আর সেজন্যই এই উপমাগুলো আমাদের সংস্কৃতিতে এমনিভাবে মিশে গেছে।  কেবল শারীরিক সৌন্দর্য নয়, আবেগ, অনুরাগ, হিংসাত্মক কিংবা বদরাগী মনোভাব এমনকি ডায়াবেটিস কিংবা হৃদরোগের ঝুঁকি পর্যন্ত আমরা বংশপরম্পরায় বহন করি জেনেটিক তথ্য হিসবে আমাদের অজান্তেই।  বাবার হৃদরোগের উপসর্গ থাকলে ছেলেকেও একটু বাড়তি সচেতন হতে পরামর্শ দেন আজকের ডাক্তারেরা। কার্ব আর রেড মিট ছেড়ে দিতে বলেন। পরিবারে কারো ডায়াবেটিস থাকলে  কিংবা কাছের কোন আত্মীয়রের দেহে এ রোগ বাসা বেধে থাকলে অন্যান্যরাও নিয়মিত সুগার চেক করা শুরু করে দেন।  এগুলো কিন্তু আমরা  সবাই জানি।  শারীরিক গঠন কিংবা রোগ-বালাইয়ের ক্ষেত্রে তাও না হয় মানা যায়, কিন্তু মানুষের চরিত্র গঠনে জিন-এর প্রভাব থাকতে পারে, এ ব্যাপারটা মেনে নিতে অনেকেরই আপত্তি ছিলো, এখনো আছে বহুজনেরই।  আর আপত্তি আছে বলেই আমরা জ্ঞানের ক্ষেত্রটিকে পরিস্কার দুইভাগে ভাগ করে ফেলেছি  – জীববিজ্ঞান আর সমাজবিজ্ঞান নামের অভিধায়।  প্রাণিদেহের এবং সর্বোপরি মানুষের শারীরিক গঠন, দৈহিক বৈশিষ্ট্য, মিউটেশন ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করবেন জীববিজ্ঞানীরা, আর সমাজ সংস্কৃতি আর মানুষের মন  নিয়ে গবেষণা করবেন সমাজবিজ্ঞানীরা কিংবা মনোবিজ্ঞানীরা।  এ যেন দুই সতন্ত্র বলয়। জীববিজ্ঞানের আহৃত গবেষণা সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীরা নিরব থাকবেন। আবার সমাজিক বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন সামাজিক গবেষণা সম্পর্কে জীববিজ্ঞানীরা উদাসীন থাকবেন। এটাই চিরন্তন নিয়ম হয়ে গিয়েছে যেন।  কিন্তু এই বিভেদ কি যৌক্তিক? এই দুই বলয়ের মধ্যে কি কোনই সম্পর্ক নেই? আধুনিক চিন্তাবিদরা কিন্তু বলেন, আছে। খুব ভালভাবেই সম্পর্ক আছে।  আসলে সংস্কৃতি বলি, কৃষ্টি বলি, দর্শন বলি, কিংবা সাহিত্য এগুলো কিন্তু মানব মনের সম্মিলিত প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। আবার মানব মন কিন্তু মানব মস্তিস্কেরই (Human brain) অভিব্যক্তি, যেটাকে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন পিঙ্কার তার হাও মাইন্ড ওয়ার্ক্স বইয়ে খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এই বলে ‘Mind is what the brain does’। আর এ কথা তো সবারই জানা যে,  দীর্ঘকালের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়াতেই তৈরি হয়েছে মানব বংশানু যা আবার মস্তিস্কের গঠনের অবিচ্ছেদ্য নিয়ামক।  কাজেই একধরনের  সম্পর্ক কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। আমরা চাইলেও আর সামাজিক আচার ব্যবহার কিংবা মানব প্রকৃতি বিশ্লেষণে জীববিজ্ঞানকে আর সমাজবিজ্ঞান থেকে আজকে আলাদা করে রাখতে পারি না। এ ব্যাপারটাই স্পষ্ট করেছেন জন ব্রকম্যান তার সাম্প্রতিক সায়ন্স এট এজ (২০০৮) বইয়ের ভূমিকায়

 

Connection do exist: our arts, our philosophies, our literature are the product of human minds interacting with one another, and the human mind is a product of human brain, which is organized in part by the human genome and has evolved by the physical process of evolution.   

 

মানব-প্রকৃতি বিশ্লেষনে জিন বা বাংশানুকে গোনায় ধরা উচিত এ ব্যাপারটি প্রথম স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন এডওয়ার্ড ও উইলসন তার বিখ্যাত ‘Sociobiology’ (১৯৭৫) নামক বিখ্যাত পুস্তকে। সে সময় উইলসনের  গবেষণার বিষয় ছিলো পিঁপড়ে এবং পিঁপড়েদের সমাজ। পিঁপড়েদের চালচলন গতিবিধি এবং সমাজব্যবস্থা নিয়ে অনেকদিন ধরেই ভদ্রলোক রিসার্চ করছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি এ নিয়ে একটি সুন্দর একাডেমিক বইও লিখেছিলেন দ্য ইনসেক্ট সোসাইটি নামে। ১৯৭৫ সালের সোশিওবায়োলজি বইটিতেও তিনি পিপড়েদের আকর্ষণীয় জীবন যাপন আর সমাজের নানা রকমের গতিবিধিই মূলতঃ ব্যাখ্যা করছিলেন।  তিনি যদি সেখানেই থেমে যেতেন, তবে কোন সমস্যা ছিলো না।  কিন্তু তিনি সেখানে থেমে না গিয়ে শেষ অধ্যায়ে তার ধ্যান ধারণা একেবারে মানবসমাজ পর্যন্ত নিয়ে যান।  পরে সেই ধারণাকে উইলসন আরো বিস্তৃত করেন তার পরবর্তী বই ‘On Human Nature‘(১৯৭৮)-এ। তিনি বলেন আজকে আমরা যাদের আজ আধুনিক মানুষ নামে অভিহিত করি, সেই হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতিটির মূল মানসপটের বির্নিমান আসলে ঘটেছিলো অনেক আগে  – যখন তারা বনে জঙ্গলে শিকার করে আর ফলমূল কুড়িয়ে জীবন যাপন করত। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, সেই আদি স্বভাবের অনেক কিছুই কিছুই এখনো আমরা আমাদের স্বভাবচরিত্রে বহন করি – যেমন বিপদে পড়লে ভয় পাওয়া, দল বেধে বিপদ মোকাবেলা করা, অন্য জাতি/গোত্রের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া,  সবার আগে নিজের পরিবারের বা গোত্রের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হওয়া ইত্যাদি। এগুলোর সাথে এখন যুক্ত হয়েছে বর্তমান সভ্যতার জটিল সাংস্কৃতিক উপাদান। এই জিন এবং সাংস্কৃতিক উপাদানের সুষম মিশ্রনেই গড়ে উঠে মানব প্রকৃতি, যাকে উইলসন তার বইয়ে চিহ্নিত করেন ‘জিন-কালচার কোএভুলুশন‘(Gene-culture coevolution) নামে।

 

যখন অধ্যাপক উইলসনের  বইটি প্রকাশিত হয়, তা একাডেমিয়ায় তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়। সমাজবিজ্ঞানীরা অধ্যাপক উইলসনের কাজকে দেখেছিলেন তাদের গবেষণার ক্ষেত্রে ‘অযাচিত’ হস্তক্ষেপ হিসেবে। আর তাছাড়া সামাজিক ডারউইনিজম আর ইউজিনিক্সের দগদগে ঘা তখনো মানুষের মন থেকে শুকোয়নি। মানব প্রকৃতি ব্যখ্যা করতে গিয়ে ‘জিন’ বা বংশানুকে নিয়ে আসায় উইলসনকে অভিযুক্ত হতে হয় নিও-সোশাল ডারউইনিস্ট অভিধায়। অভিযোগ করা হয় – উইলসন নিজের জাতিবিদ্বেষী মনোভাবকে  বিজ্ঞানের মোড়কে পুরে উপস্থাপন করতে চাচ্ছেন। উইলসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন সে সময়কার আদর্শবাদী চিন্তাবিদেরা। তাদের অধিকাংশই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ছাড়া অন্য কোন বিশ্লেষণ দিয়ে মানব-প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াসকে মেনে নিতে বরাবরই অনাগ্রহী ছিলেন। Science for the People নামের বাম ভাবাদর্শে দীক্ষিত একটি সংগঠন উইলসনের বিরুদ্ধে সে সময় সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৮৪ সালে  রিচার্ড লেওনটিন, স্টিফেন রোজ এবং লিওন কামিন – এই তিন মাস্কেটিয়ার্স ১৯৮৪ সালে ‘নট ইন আওয়ার জিনস’ বইয়ে উইলসন এবং অন্যান্য সামাজিক জীববিজ্ঞানীদের  আক্ষরিক অর্থেই তুলোধুনো করেন। তারা তাদের বইয়ে দেখানোর চেষ্টা করেন যে, বিজ্ঞান এখন জাত্যাভিমানী পশ্চিমা পুঁজিবাদি সমাজের প্রোপাগান্ডা মেশিনে পরিণত হয়েছে, আর উইলসন সেই বৈষম্যমূলক পুঁজিবাদী বিজ্ঞানকে  প্রমোট করছেন। তারা উইলসনের যমজ নিয়ে পরীক্ষা,পরিগ্রহণ পরীক্ষা প্রভৃতির উপর পদ্ধতিগত আক্রমণ পরিচালনা করেন, শুধু তাই নয় তাদের মার্কসবাদী দার্শনিক বিশ্বাস থেকে প্রস্তাব করেন জীববিজ্ঞানেও মার্ক্সবাদের মত দ্বান্দ্বিকবা ডায়লেক্টিকাল পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। এ নিয়ে অধ্যাপক রিচার্ড লেওনটিন একটি বইও লেখেন সে সময় ডায়লেক্টিকাল বায়োলজিস্ট নামে।

 

এর প্রতিক্রিয়ায় বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স ১৯৮৫ সালে রিচার্ড লেওনটিন, স্টিফেন রোজ এবং লিওন কামিনের কাজের তীব্র সমালোচনা করে তাদের বইকে  স্থুল,আত্মাভিমানী,পশ্চাৎমুখী এবং ক্ষতিকর হিসবে আখ্যায়িত করে নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। অধ্যাপক ডকিন্স অভিযোগ করেন যে,  লেওনটিনরা নিজস্ব দার্শনিকভিত্তি থেকে মদদপুষ্ট হয়ে সামাজিক জীববিজ্ঞানীদের উপর যেসমস্ত অভিযোগ করেছেন এবং যে ভাবে ভিত্তিহীন আক্রমণপরিচালনা করেছেন তা স্ট্রম্যান হেত্বাভাষ দোষে দুষ্ট। তিনি বলেন, বিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে প্রকৃতির রহস্য উদঘাটন করা, কোন বৈষম্যমূলক পুঁজিবাদকে প্রমোট করা নয়।

 

ছবি: অধ্যাপক উইলসনের সোশিওবায়লজি বইটির ২৫ বছর পুর্তি এডিশন  (২০০৪)

 

 

সোশিওবায়লজি বইটি প্রকাশের তিনদশক পরে আজ এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, উইলসন সামাজিক বিবর্তনবাদ নিয়ে যে কাজ শুরু করেছিলেন তা মৌলিক ছিলো নিঃসন্দেহে। উইলসন সেই কাজটিই করেছিলেন যেটি ডারউইন পরবর্তী যে কোন জীববিজ্ঞানীর জন্য হতে পারে মাইলফলক। তখন তিনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলেও পরে অনেকেই তার কাজের গুরুত্ব অনুভব করতে পেরেছিলেন। উইলসন মানবপ্রকৃতি নিয়ে তার ব্যতিক্রমধর্মী কাজের কারণে দু-দুবার পুলিৎসার পুরস্কার পেয়েছিলেন।শুধু তাই নয় উইলসন যে কাজটি সামাজিক জীববিজ্ঞানকে  এখন দেখা হয় বিবর্তনের সাম্প্রতিক গবেষণার অন্যতম সজীব একটি শাখা হিসেবে, যা পরবর্তীতে আরো পূর্ণতা পেয়েছে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান (evolutionary psychology) নামের ভিন্ন একটি নামে। উইলসনের সোশিওবায়লজি বইটির পর  বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের জগতে অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল রিচার্ড ডকিন্সের সেলফিশ জিন (১৯৭৬) নামের অনন্যসাধারণ একটি বই। এই বইয়ের মাধ্যমেই ডকিন্স সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করলেন কেন জেনেটিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। তিনি তার বইয়ে দেখালেন যে, আমরা আমাদের এই দেহের পরিচর্যা নিয়ে যতই চিন্তিত থাকিনা কেন-  দেহ কিন্তু কোন প্রতিলিপি তৈরি করেনা;  প্রতিলিপি তৈরি করে বংশানু বা জিন। তার মানে হচ্ছে আমাদের দেহ কেবল আমাদের জিনের বাহক (vehicle) হিসেবে কাজ করা ছাড়া আর কিছুই করে না। আমাদের খাওয়া, দাওয়া, হাসি কান্না, উচ্ছ্বাস, আনন্দ, সিনেমা দেখা, খেলাধূলা বা গল্প করা আমাদের দেহ যাই করুক শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত স্বার্থপরভাবে জিনকে রক্ষা করা আর জিনকে পরবর্তি প্রজন্মে পৌঁছে দেয়াতেই  উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে বাধ্য করে, বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোন থেকে  জীবনের কোন উদ্দেশ্য যদি থেকে থাকে তবে সেটাই সে উদ্দেশ্য। মা বাবারা যে সন্তানদের সুখী দেখতে পাবার জন্য পারলে জানটুকু দিয়ে দেয় এটা কিন্তু  জৈবিক তাড়না, আরো পরিস্কার করে বললে জিনগত তাড়না থেকেই ঘটে। শুধু মানুষ নয় অন্য যে কোন প্রানীর মধ্যেই সন্তানদের প্রতি অপত্য স্নেহ প্রদর্শন কিংবা সন্তানদের রক্ষা করার জন্য মা বাবারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে। অর্থাৎ, নিজের দেহকে বিনষ্ট করে হলেও পরবর্তী জিনকে রক্ষা করে চলে।  পরবর্তী জিন রক্ষা না পেলে নিজের দেহ যত সুষম, সুন্দর, শক্তিশালী আর মনোহর কিংবা নাদুস-নুদুস হোক না কেন, বিবর্তনের দিক থেকে কোন অভিযোজিত মূল্য নেই।  এক ধরণের  ইঁদুর আছে যারা শুধু সঠিক সঙ্গী খুঁজে জিন সঞ্চালন করার জন্য বেঁচে থাকে।  যৌনমিলনের পর পরই পুরুষ ইঁদুরটি মৃত্যুবরণ করে। অথচ এই মৃত্যুকূপের কথা জেনেও পুরুষ ইঁদুরটি সকল নিয়ে বসে থাকে সর্বনাশের আশায়।  এক প্রজাতির ক্যানিবাল মাকড়শা আছে যেখানে স্ত্রী মাকড়শাটি যৌনমিলনের পর পরই পুরুষ মাকড়শাটিকে খেয়ে ফেলে। সাক্ষাৎ এই মৃত্যুর কথা জেনেও দেখা গেছে পুরুষ মাকড়শাগুলো জিন সঞ্চালনের তাড়নায় ঠিকই তাড়িত হয়।  অর্থাৎ, দেহ এবং জিনের  সঙ্ঘাত যদি উপস্থিত হয় কখনো সে সমস্ত বিরল ক্ষেত্রগুলোতে দেখা গেছে জিনই জয়ী হয় শেষপর্যন্ত। আমাদের দেহে জাংক ডিএনএ কিংবা সেগ্রেগেশন ডিস্টরশন জিন-এর উপস্থিতি সেই সত্যটিকেই তুলে ধরে যে শরীরের ক্ষতি করে হলেও জিন অনেক সময় নিজেকে টিকিয়ে রাখে অত্যন্ত স্বার্থপর ভাবেই।  ডকিন্সের এ বইয়ের মূল্য একাডেমিয়ায় অনেক। এই বইয়ের মাধ্যমেই আসলে জীববিজ্ঞানীরা সমাজ এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখা শুরু করলেন।  পরার্থতা, আত্মত্যাগ, দলগত  নির্বাচনের মত যে বিষয়গুলো আগে বিজ্ঞানীরা পরিস্কার করে ব্যাখ্যা করতে পারতেন না, সেগুলো আরো বলিষ্ঠভাবে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে ব্যখ্যা করতে পারলেন তারা।  তবে তার চেয়েও বড় যে ব্যাপারটি ঘটল, সেটা হল মানবসমাজের বিভিন্ন সামাজিক প্যাটার্ন ব্যখ্যা করার নতুন এক দুয়ার খুলে গেল জীববিজ্ঞানীদের জন্য।  সেজন্যই Richard Dawkins: How a Scientist Changed the Way We Think: Reflections by Scientists, Writers, and Philosophers নামের একটি বইয়ে তার সমসাময়িক বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা বলেছেন, ডারউইনের অরিজিন অব স্পিশিজ এর পর কোন জীববিজ্ঞানীর লেখা বই যদি মানসপট এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে, তো সেটি ডকিন্সের সেলফিশ জিন।  এ ব্যাপারে ২০০১ সালে প্রকাশিত  The Triumph of Sociobiology গ্রন্থে জন অ্যালকের মন্তব্যটি  অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক

 

প্রাণীজগতের আচরণ নিয়ে বর্তমান গবেষণার ক্ষেত্রে কেউ সোশিওবায়োলজি কিংবা সেলফিশ জিন শব্দগুলো নিয়ে কথা বলার কিংবা নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনবোধ করেন না কারণ এগুলো এখন বিজ্ঞানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে

 

 

ছবি: ডকিন্সের সেলফিশ জিন যখন প্রথম ১৯৭৬ সালে বের হয় – তখন তার কভার ছিলো এরকম বিদ্ঘুটে!

 

ডারউইন ১৮৫৯ সালে যখন তার সেই বিখ্যাত গ্রন্থ অরিজন অব স্পিশিজ লিখেছিলেন, তখন তিনি পুরো বইটিতে মানুষের বিবর্তন নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য করেননি। হয়ত অনাকাংখিত বিতর্ক এড়াতে গিয়েই এই কৌশল নিয়েছিলেন ডারউইন, যদিও বইয়ে মানব সমাজ এবং বিবর্তন নিয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এই বলে –‘ Light will be thrown on the origin of man and history।  এবং একই প্যারাগ্রাফে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন –‘In the distant future… Psychology will be based on a new foundation.

 

মজার ব্যাপার হল – ডারউইন যেমন তার অরিজন অব স্পিশিজ বইয়ে মানববিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে বিতর্কিত হতে চাননি, ঠিক তেমনি তার একশ বছরেরও পরে বই লিখতে বসে ডকিন্স  এবং উইলসনরাও তাদের হাটু কাঁপুনি থামাতে পারেননি। তারাও তাদের বইয়ে মানব সমাজ নিয়ে খুব বেশি  আলোচনা করে বিতর্ক-এর কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে হয়ত চাননি।  ডকিন্সের সেলফিশ জিন সুস্থ বৈজ্ঞানিক যুক্তি এবং আলোচনায় ভরপুর, কিন্তু প্রায় পুরোটাই তিনি সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন নিম্নস্তরের প্রানীজগতের ক্ষেত্রে। উইলসন তার ৫২৬ পৃষ্ঠার ঢাউস আকারের বইটির পুরোটুকুতেই পিঁপড়া আর পোকামাকড় নিয়েই পড়ে ছিলেন,  মানুষ নিয়ে কথা বলেছিলেন শেষ ২৮ পৃষ্ঠায় এসে।  তারপরও ডারউইন যেমন বিতর্ক এড়াতে পারেননি, আধা মানুষ আর আধা বানরের কার্টুনের কেরিক্যাচার হজম করতে হয়েছে, ঠিক তেমনি ডারউইনের উত্তরসূরীদের নানা ধরণের কটুক্তি হজম করতে হচ্ছে  ডারউইনেরই ভবিষ্যদ্বানী সাইকোলজি উইল বি বেসড অন এ নিউ ফাউন্ডেশনকে পূর্ণতা দিতে গিয়ে।

 

তবে আধুনিক বিবর্তন মনোবিদ্যার জন্ম এদের কারো হাতে হয়নি, এর জন্ম হয়েছে মূলতঃ এক সেলিব্রিটি দম্পতি জন টুবি (নৃতত্ত্ববিদ) এবং লিডা কসমাইডস (মনোবিজ্ঞানী) এর হাত দিয়ে।  তারা ১৯৯২ সালে ‘The Adapted Mind: Evolutionary Psychology and the Generation of Culture’ নামের যে বইটি লেখেন সেটিকে আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ভিত্তিমূল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  তারা এই বইয়ের মাধ্যমে প্রথমবারের মত সমাজবিজ্ঞানের প্রচলিত মডেলকে (standard social science model, সংক্ষেপে SSSM)  প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং সামাজিক বিবর্তন এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপরেখা জৈববিজ্ঞানীয় দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাখ্যা করেন। এই দৃষ্টিকোনটিকে আজ অনেকেই অভিহিত করছেন  মনের নতুন বিজ্ঞান (‘the new science of the mind’) নামে। যারা জন টুবি এবং লিডা কসমাইডসের এই নতুন বিজ্ঞানের   সাথে পরিচিত  হতে চান, তারা  অন লাইনে Evolutionary Psychology: A Primer প্রবন্ধটি পড়ে নিতে পারেন।

 

ছবি: জন টুবি এবং লিডা কসমাইডস – বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা দম্পতি একটি কনফারেন্সে আমাদের মানসপটকে সুইস আর্মি নাইফের সাথে তুলনা করে দেখাচ্ছেন। তারা বলেন বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ায় উদ্ভুত মানব মন আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই হাণ্টার-গ্যাদারারদের সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত হয়েছিলো বলেই তার ছাপ আমরা এখনো বিভিন্ন কিছুতে খুঁজে পাই।

 

 

১৯৯৪ সালে রবার্ট রাইট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখলেন ‘The Moral Animal: Why We Are, the Way We Are: The New Science of Evolutionary Psychology’ নামে। বিবর্তনীয় মনোবিদ্যার উপর একটি পূর্ণাংগ বই। এই বইয়ের লেখক প্রথমবারের মত সাহস করে  ডারউইনের বিবর্তনের আলোকে মনোবিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করতে উদ্যোগী হন।  শুধু তাই নয়, ডারউইনের জীবন থেকে অজস্র দৃষ্টান্ত হাজির করে দেখালেন,  ভদ্র, সৌম্য, লাজুক স্বভাবের ডারউইনও শেষ পর্যন্ত আমাদের মতই জৈব তাড়নায় তাড়িত একধরণের এনিমেল ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। রবার্ট রাইটের বইটির পর এই বিষয়ে গণ্ডা গণ্ডা বই লেখা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে যে বইটি ভাল লেগেছে সেটি হল ম্যাট  রিডলীর লেখা ‘The Red Queen: Sex and the Evolution of Human Nature’। বইটি অসাধারণ রকমের সুখপাঠ্য। আমার লেখার পাঠকদের বইটি সুযোগ এবং সময়মত পড়ে দেখবার আহবান জানাই।

 

২য় পর্ব দ্রঃ…