যুক্তিবাদীদের বিয়ে
দ্বিতীয় পর্ব

 

মুক্তচিন্তা

যুক্তিবাদ

বিজ্ঞানমনস্কতা

“যুক্তি আনে চেতনা
চেতনা আনে সমাজ পরিবর্তন।”

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি

গত ১১ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির পরিচালনায় দু’জন যুক্তিবাদীর মধ্যে সমকালীন চিন্তাচেতনার আলোকে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এক যুগান্তকারী বিবাহ অনুষ্ঠিত হলো। বিয়েটি এ কারণেই যুগান্তকারী যে, এই বিয়ের অনুষ্ঠানে কোন রকম ধর্মীয় উপাসনা বা আনুষ্ঠানিকতা ব্যতীত সম্পন্ন হয়। আমাদের প্রচলিত সমাজে যুক্তিবাদীদের সংখ্যা নিতান্তই কম হওয়ার কারণে জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু ইত্যাদি ঘটনার সময়ে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার আশ্রয় নিতে হয় বা নিতে বাধ্য করা হয়। সমাজপতিদের পেশিশক্তি আর মৌল্লাপুরোহিত- ঠাকুরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ধর্মীয় প্রথার বাইরে এসে বাস করা সম্ভব হয় না। সে হিসেবে এ ধরনের ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে এসে বিয়ে করার ব্যাপারতি অবশ্যই ব্যতিক্রম। আমরা মুক্তমনায় এমনি একটি বিয়ের খবর আগে প্রকাশ করেছিলাম।  ১০ ই মার্চ ২০০৫ তারিখে অনুষ্ঠিত সে বিয়েতে বর এবং কনে ছিলেন বাবলু ও বীথি।  এবারের বিয়ের পাত্র-পাত্রী ছিলেন  কল্যাণ ও  লিঠু’।

 

 এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দীর্ঘদিন ধরে কল্যান ও লিঠু দু’জনে পরস্পরকে জানা ও বোঝার মধ্য দিয়ে ভালো লাগা থেকে গভীর ভালোবাসা সৃষ্টির কারণে দু’জনে আলোচনা করে বিবাহের সিদ্ধান্ত নেন এবং সে সিদ্ধান্ত সমিতির নেতৃত্বকে জানান। সমিতির নেতৃত্ব ও সহযোদ্ধারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সহযোদ্ধা ভাবী বর ও কনেকে নিয়ে নান্দনিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও শপথ গ্রহণের আয়োজন করেন। ভাবী বর ‘কল্যাণ’ ও কনে ‘লিঠু’ শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে যৌথ জীবনে প্রবেশ করেন।

বিবাহ অনুষ্ঠানটিকে ধারাবাহিকভাবে এখানে উপস্থাপন করা হলো। সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন অনুপ মল্লিক (প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, বসুনদিয়া কলেজ, অভয়নগর, যশোর এবং ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ সুন্দলী বাজার শাখা, অভয়নগর, যশোর-এর সভাপতি)।

সমগ্র অনুষ্ঠানটিকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়- ১) ‘নান্দনিক অংশ’, যার মধ্যে রয়েছে নৃত্য, গান ও কবিতা আবৃত্তি এবং ২) ‘শপথ গ্রহণ অংশ’।

‘শপথ অংশ’-এর শুরুতে সমিতির বক্তব্য পাঠ করেন ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ পাবনার প্রবীর সাহা।

 

কল্যাণ-লিঠু’র বিয়েতে ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র বক্তব্য

সম্মানিত সুধীজন,

আজকে ভাটবিলাতে কল্যাণ-লিঠু’র বিয়ের এই অনুষ্ঠান আঙ্গিনায় আপনাদের আন্তরিক উপস্থিতি আমাদেরকে ধন্য করেছে। অতীতে বিভিন্ন সময়ে আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে আজকের এই বিবাহ অনুষ্ঠানকে সুন্দর ও প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য আপনাদের অনুরূপ সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।

বিয়ে হচ্ছে একটি সামাজিক বন্ধন। আধুনিক বিশ্বে যার রয়েছে আইনগত রেজিস্ট্রেশন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং সমাজে বিয়ের রীতি-নীতি বিভিন্ন রকম। বিবাহের যাবতীয় রীতি-নীতি ও আইন-কানুনের কথা স্মরণ রেখেই বিবাহ রীতি-নীতিকে আরো একটু অগ্রসর করে নেওয়ার যে প্রয়াস, এ অনুষ্ঠান তারই অংশ। যুগে যুগে বিবাহ রীতি-নীতি ও আইন-কানুনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই সমাজ সভ্যতা আজকের এই পর্যায়ে এসেছে। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনেই সেগুলোকে ক্রমাগত আরো উন্নততর পর্যায়ের দিকে নিয়ে চলেছে। কারণ মানুষের চেতনা, মূল্যবোধ আরো বেশি বেশি করে মানবিক হচ্ছে—মানুষ এগিয়ে চলেছে মানবতার চরম বিকাশ মনুষ্যত্বের দিকে।

রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিয়ের অনেক অমানবিক প্রথার বিলোপ সাধন করেন এবং অনেক মানবিক প্রথা ও ধারার প্রচলন করেছেন। যেখানে মনু’র বিধানে বাল্যবিবাহ ছিল বাধ্যতামূলক, সেখানে রায় বাহাদুর হরিবিলাস সারদা’র ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯২৯ সালের ১৯ নং আইনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহকে সম্পূর্ণ বেআইনি ঘোষণা করা হয়, যা মনু’র বিধানের সম্পূর্ণ বিপরীত। আজকের সমাজে কোনো সুস্থ মানুষ বাল্যবিবাহকে সমর্থন করেন না। অর্থাৎ এখানে মনু’র বিধানের পরিবর্তে আধুনিক চিন্তাচেতনা ও আইনকে সমর্থন করেন এবং মানেন।

একদল মানুষের আপত্তি সত্ত্বেও আরেকদল মানুষ অগ্রসর চিন্তাচেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে উন্নত মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য ইতিবাচক পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। কাজেই আমাদের মহত্তম দায়িত্ব হচ্ছে—আগামী প্রজন্মের জন্য এমন একটি উত্তরাধিকার দিয়ে যাওয়া; যার জন্য তারা গর্ববোধ করবে।

আজকে, কল্যাণ-লিঠু নিজেদের জীবনে দাম্পত্য সম্পর্ক সৃষ্টিতে যে নিষ্ঠা ও সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসেছে—আসুন, আমরা সবাই মিলে ওদেরকে স্বাগত জানাই। উত্তর প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমরা বর্তমানকে উৎসর্গ করি।

“সুন্দর আসে ঐ যুক্তির পথে
সাদরে লও তারে আপনার সাথে।”

আপনাদেরকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা কল্যাণ-লিঠু’র বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু করছি।

ধন্যবাদ।

‘শপথ অংশ’-এর শুরুতে বিবাহ বিষয়ক সমিতির ভাবাদর্শকে তুলে ধরার জন্য ‘বিয়ে এবং কিছু কথা’ শিরোনামে একটি লিফলেট উপস্থিত সুধীজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং পরে এটি পাঠ করে শোনান ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’-র অন্যতম সংগঠক ডাঃ বাবলু কিশোর বিশ্বাস (মেডিকেল অফিসার, উপজেলা সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মনিরামপুর, যশোর)।

বিয়ে এবং কিছু কথা

প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহে নারী ভোগ্যপণ্য পুরুষের, আর নারী-পুরুষ উভয়ই পণ্য পুরোহিতের। বহু টাকা সোনা-রূপার বিনিময়ে বর কিনে কন্যাদানে মুক্তি খোঁজে কন্যার পিতা-মাতা। নর-বলি, গঙ্গায় সন্তান বিসর্জনের মতো কন্যাদানও এক অমানবিক প্রথা। কন্যা বস্তু না পশু? কন্যা, তুমিও কি চাও বহুমূল্যে কেনা ধনে-মানে সুরক্ষার উজ্জ্বল ঠিকানা? সত্যি কি পার না বুঝতে, আসলে ওটা ভালোবাসার বাসগৃহ নয়, মিথ্যা মায়াময় সোনার খাঁচা। ইতিহাস কথা বলে- দাস-যুগে মুদ্রায় কেনা হতো দাস-দাসী হাটে-বাজারে। সামন্ততন্ত্রে বিয়ের মন্ত্রে পুরোহিতের মুখযন্ত্রে : “আজও নর-নারী মানুষ নয়, দাস-দাসী কয় তারে।” কোথায় শ্রদ্ধা-ভালোবাসা? বিয়ের মন্ত্রে শুধু মূর্খের প্রলাপ শুনি, নামের-চাঁদর জড়ানো গুণহীন ন’গুণের তন্ত্রে।

প্রিয় কল্যাণ ও লিঠু,

বিশ্ব-প্রকৃতির এক অনিবার্য সৃষ্টি মনুষ্যজন্ম। যার পরিপূর্ণ বিকাশ মানবতার মহত্তম প্রকাশে। মহান মানবজীবনের এক অনিন্দ্য সুন্দর অধ্যায় হচ্ছে যৌথ বা দাম্পত্য জীবন। মহাকালের জীবনস্রোতে আমাদের জীবন এক সংক্ষিপ্ত বুদ-বুদ মাত্র। আমরা চাই এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মানবজন্ম যেন হয় সুস্থ, সুন্দর, সার্থক ও আনন্দময়। মানবজীবনের কাছে স্রষ্টা মহাবিশ্বের এ যেন এক আকুল প্রত্যাশা। এতে ইতিহাস পাবে তার অনিবার্য গতি, সমকাল পাবে প্রকৃত আলোর দিশা, নতুন প্রজন্ম হবে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর।

গতানুগতিক যৌথ একাকীত্বের বিষবৎ দাম্পত্য জীবনের বিরানভূমিতে তোমরা হবে আদর্শ আলোকবর্তিকা। অসাম্যের ভেদ-বুদ্ধি নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধের সমদর্শিতায় শুধরে নিও বিরোধের ভুল-চুক। তোমাদের যৌথজীবন হোক জ্যোতিষ্কের মতো দীপ্তমান; যার আলোয় আলোকিত হবে অন্ধকারের সমস্ত কানা-গলিও, যা আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
– সংগ্রাম ও প্রেরণার সহযোদ্ধারা।

নর-নারীর প্রতি :

সামন্ততন্ত্রের শুরুতে পুরুষতন্ত্র তোমাকে দাসের মতো করেছে শৃঙ্খলাবদ্ধ। হাতে পরিয়েছে বালা, পায়ে দিয়েছে মল আর তোমরা অসহায়ভাবে আত্মসমর্পন করেছ বর্বর, অমানবিক পুরুষতন্ত্রের হাতে। মোল্লা-পাদ্রী-পুরোহিততন্ত্রের, সমাজপতিদের শোষণের যন্ত্রের লোহার শিকল ভেঙে মুক্ত হও। নিজেকে উজাড় করে যে তোমাকে দেবে মন-প্রাণ; তোমার স্বাধীন প্রেম তুমি তাকে নিঃশেষে দাও। পুরুষ, তুমি পুরুষতন্ত্রের বুকে পদাঘাত করে বেরিয়ে এসো মুক্ত পৃথিবীতে। নিজেকে মানুষ ভাবতে শেখো। আপ্রাণ চেষ্টা করো মনুষ্যত্ব অর্জনের। নারীকে দেখতে শেখো পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে। আর ভালোবাসতে শেখো—বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং স্বাধীন ব্যক্তিত্বে।

তথাকথিত ধর্মশাস্ত্রের যুগে মনু ও ভীষ্মের বিধানে কল্যাণ বিবাহের নামে বাল্যবিবাহের (বিশেষ করে মেয়েদের) ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আজকের আধুনিক আইন বাল্যবিবাহকে আইনত নিষিদ্ধ ও দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে দেখছে। আধুনিক যুক্তিবাদী মানসিকতা বাল্যবিবাহকে দেখে চরম অমানবিক প্রথা হিসেবে।

আর্য সমাজে আট রকমের বিয়ের কথা আমরা পাই। মনু-ই এই আট প্রকার বিয়ের সংজ্ঞা ঠিক করে দিয়েছিলেন।

১। ব্রাহ্ম বিবাহ : “শাস্ত্রজ্ঞান সম্পন্ন ও চরিত্রবান পাত্রকে কন্যাপক্ষয়েরা স্বয়ং আহ্বান করে যথোচিত অভ্যর্থনা করে কন্যাকে সুচারুবস্ত্রে আচ্ছাদিত ও অলংকারে ভূষিত করে ঐ পাত্রকে যদি সম্প্রদান করে,তবে তাকে ‘ব্রাহ্ম বিবাহ’ বলে।” (মনুসংহিতা, ৩য় অধ্যায়, শ্লোক ২৭)।

২। দৈব বিবাহ : “যজ্ঞের অনুষ্ঠানকালে সেই যজ্ঞে যিনি পৌরহিত্য করেন তাকে যদি যজ্ঞের আয়োজক সালঙ্কারা কন্যা দান করেন, তবে সেই বিবাহকে বলে ‘দৈব বিবাহ’।” (মনুসংহিতা, ৩য় অধ্যায়, শ্লোক ২৮)।

৩। আর্য বিবাহ : “পাত্রের কাছ থেকে একটি গাভী ও একটি বৃষ অথবা দুইটি গাভী ও দুইটি বৃষ নিয়ে ঐ পাত্রকে যখন কন্যা দান করা হয় তখন সেই বিবাহকে ‘আর্য বিবাহ’ বলে।” (মনুসংহিতা, ৩য় অধ্যায়, শ্লোক ২৯)।

৪। প্রজাপত্য বিবাহ : “পাত্র ও পাত্রী দু’জনে মিলে একসাথে গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করবে- বরের কাছ থেকে এই প্রতিশ্র“তি পাওয়ার পর যথাবিধি অলংকার, বস্ত্র প্রভৃতির দ্বারা সুচারু-সজ্জিত কন্যাকে পাত্রের কাছে সম্প্রদান করে যে বিবাহ তাকে বলে ‘প্রজাপত্য বিবাহ’।” (মনুসংহিতা, ৩য় অধ্যায়, শ্লোক ৩০)।

বিবাহযজ্ঞে পাত্রকে কন্যা ‘সম্প্রদান’ করা হয়। কন্যার খাদ্য-বস্ত্রসহ ভরণ-পোষণ ও রক্ষার সমস্ত দায়-দায়িত্ব বহনের জন্য পাত্র প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। এই বিয়ে আর্য-সমাজে বেশি প্রচলিত ছিল এবং আজও হিন্দু-সমাজে বেশি প্রচলন রয়েছে।

৫। অসুর বিবাহ : “ কন্যার পিতা ও অন্য গুরুজনকে যথেষ্ট ধন দানের মধ্য দিয়ে সন্তুষ্টি উৎপাদন করে কন্যাকে পাত্র কর্তৃক গ্রহণ করাকে বলে ‘অসুর বিবাহ’ (মনুসংহিতা, ৩য় অধ্যায়,শ্লোক ৩১)”।

৬। গান্ধর্ব বিবাহ : “পাত্র-পাত্রী পরস্পরের প্রতি অনুরাগবশতঃ যখন দেহ-মিলনে আবদ্ধ হয়, তখন তাকে ‘গান্ধর্ব বিবাহ’ বলে। এই বিবাহ পাত্র-পাত্রী গুরুজনের অনুমতির অপেক্ষা না করে মৈথুন ইচ্ছায় ঘটে থাকে।” (মনুসংহিতা, ৩য় অধ্যায়, শ্লোক ৩২)।

৭। রাক্ষস বিবাহ : “কন্যাকে জোরপূর্বক হরণ করে বিয়ে করাকে বলে ‘রাক্ষস বিবাহ’।” (মনুসংহিতা, ৩য় অধ্যায়, শ্লোক ৩৩)। যেহেতু রাজ-পুরুষেরাই এই ধরনের রাক্ষস বিবাহ করার মতো শক্তিধর ছিলেন, তাই রাজপুরুষদের তুষ্টি বিধানের জন্য আর্য-সমাজের পুরোহিতরা এই ‘রাক্ষস বিবাহ’কে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

৮। পৈশাচ বিবাহ : “নিদ্রায় অভিভূতা, মদ্যপানে বিহ্বলা, অপ্রকৃতিস্থা নারীকে নির্জনে নিয়ে গিয়ে পুরুষ যদি বলপূর্বক সম্ভোগ করে, তবে তাকে ‘পৈশাচ বিবাহ’ বলে।” (মনুসংহিতা, ৩য় অধ্যায়, শ্লোক ৩৪)। শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে পুরোহিতগোষ্ঠীর সমঝোতাই ছিল প্রধাণ কারণ এই ধরনের বিয়ের অনুমোদন দেওয়ার পিছনে।

বিবাহের কনে দেখার পদ্ধতিটি রুচিহীন একটি অনুষ্ঠানের নাম। চুল খুলে দেখাও, হেঁটে দেখাও, হাতটা একটু দেখাও—এই জাতীয় বিভিন্ন ধরনের বিষয় সেখানে আলোচনা হয় এবং ঘটে। কোন জিনিস কেনার সময় ক্রেতা যেমন তাকে ধরে টিপে দেখে, পরখ করে; গরু-ছাগল কেনার সময় ক্রেতা যেমন তার দাঁত, লেজ, হাঁটা, বয়স ইত্যাদি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে, কনে দেখাও সেই ধরনের ব্যপার আর কি! আজকাল যেরকম ভাবেই তাকে পরিমার্জিত করা হোক না কেন, অনুষ্ঠানটি নারীত্বের প্রতি চুড়ান্ত রকমের অবমাননাকর এবং অমানবিক। কনের অভিভাবকরাও কনেকে রং মাখিয়ে সং সাজিয়ে এনে উপস্থিত করে জনাকয়েক অপরিচিত পুরুষের সামনে; যারা পরখ করে দেখে গৌরবর্ণা, গৃহকর্মে সুনিপনা কিনা ইত্যাদি। পছন্দ হলে শুরু হয় আরেক অমানবিক অধ্যায় যার নাম ‘পণ প্রথা’। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কন্যার অভিভাবকের নাভিশ্বাস ওঠার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বর বা বরের অভিভাবকের নির্লজ্জ লোভ দেখলে মনে হয় ক্ষুধার্ত কুকুরের লালা-ঝরা জিভ। আবার কন্যা বা কন্যার অভিভাবকও চায় পাত্রের যেন থাকে বড় বড় ডিগ্রী, চাকুরী, অনেক উপার্জন কিংবা পিতার বিপুল সম্পত্তি তা সে যে কোনো প্রকারেই হোক না কেন। এভাবে নির্লজ্জের মতো অনেক দরকষা-কষির পর ঠিক হয় দর-দামের পালা। বিবেক, রুচি, মূল্যবোধ, মানবিকতা, ব্যক্তিত্ব এগুলো যেন কোন ধর্তব্যের বিষয়-ই নয়!

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে যে বর্বর মূল্যবোধ ও আদিম কুসংস্কারের প্রকাশ দেখা যায়, বিবাহের অনুষ্ঠানটির মধ্যেও তা জাজ্জ্বল্যমান। বিবাহের কেন্দ্রীয় বা মূল অনুষ্ঠানটি হলো কন্যা সম্প্রদান। কন্যাকর্তা কন্যাকে বর বা বরের অভিভাবকের হাতে সম্প্রদান করেন। এই সম্প্রদান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যে সত্য চরমভাবে প্রকাশ পায় সেটা হলো কন্যা একটা বস্তু বা পশু বিশেষ, নিজের সত্তার উপর যার কোন অধিকার নেই। বিবাহের আগে পর্যন্ত ছিল একজনের সম্পত্তি- আর বিবাহের অনুষ্ঠানে সম্পত্তিটির হাত বদল হয়ে আরেকজনের সম্পত্তি। সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে এই অনুষ্ঠানটিকে শুভ বলা যায় কি করে? এটা কোন মতেই শুভ অনুষ্ঠান হতে পারে না। যে প্রাণীকে দান করা হয় তার আবার হৃদয় কি? একদিকে সালাঙ্কারা কন্যা সম্প্রদান, অন্যদিকে ‘যদিদং হৃদয়ং মম..’। সত্যি নারীর সাথে এ এক বর্বর রসিকতা বৈ কিছু নয়! বিবাহের অনুষ্ঠানে কিছু আচার আছে যেগুলি নিলর্জ্জভাবে অশ্লীল। আছে স্থুলরুচির সাত-পাকে ঘোরানোর মতো অনুষ্ঠান। যখন বাল্য-বিবাহের প্রচলন ছিল তখন একটি শিশুকে পিঁড়িতে বসিয়ে সাত-পাকে ঘোরানোটা হয়তো ছিল কৌতুককর; কিন্তু এখন যখন বিবাহ সভায় একটি বিশ-পঁচিশ বছরের মন দেড়েক ওজনের সিল্ক ও সোনায় জড়ানো মহিলাকে ধরাধরি করে পিঁড়িতে বসিয়ে ঘোরানো হয় তখন সে দৃশ্য দেখে যারা পুলকিত হয় তাদের রসবোধের বাহ্বা দিতে হয়!

একান্ত চাওয়া :

সামন্তবাদী সমাজের শিকার সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তির মর্ষকামী সতীত্বের দোহাই দিয়ে সমাজ ব্যবস্থা যে পুরুষতান্ত্রিক অব্যবস্থার ঘুণে আক্রান্ত, সেই বস্তাপঁচা গতানুগতিকতা নয় অথবা কোনও কথিত আধুনিক সভ্যতার বিলাসী ব্যঞ্জনে বিপন্ন বিলাপ নয়, নয় কোন নগ্নতার উল্লাস অথবা পুরোহিততন্ত্রের পৌত্তলিক অগ্নিস্বাক্ষী কিংবা শাঁখা-সিঁদুরের মিছে মায়াডোর; বরং বিবাহিত জীবনের মূল সুর বাঁধা হোক বিশ্বাস, বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা আর মতাদর্শিক গ্রন্থিতে। “সতীর দেবতা পতি জীবনের সার, পূঁজিতে এসেছি ভবে চরণ তাহার”—ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করো পুরুষতন্ত্রের এই নির্লজ্জ আপ্তবাক্যকে। বিশেষ বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এক সাথে উচ্চারণ করো : “তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবার; জনমে-জনমে যুগে যুগে অনিবার।”

ভালোবাসাহীন, শ্রদ্ধাহীন, মতাদর্শিক-অসাম্যের চোরাবালির সাত পাকের বন্ধন নিরর্থক। বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাহীন দাম্পত্য জীবন সুবিধাবাদী লাম্পট্য ছাড়া আর কি? তাই আমরা চাই মনুষত্বের মঙ্গলালোকে আলোকিত সুস্থ, সুন্দর দাম্পত্য জীবন।

প্রচারে :
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি

“যুক্তি আনে চেতনা
চেতনা আনে সমাজ পরিবর্তন।”

এরপর যশোরের বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি, মশিয়াহাটি শাখা, অভয়নগর কেন্দ্রের সভাপতি রনজিৎ বাওয়ালীর লেখা ‘বিয়ের পদাবলী’ আবৃত্তি করেন কবি নিজেই। নীচে সেই কবিতাটি তুলে ধরা হল :

বিয়ের পদাবলী

বিবর্তনে সৃষ্টি-ধারা জীব মধ্যে বয়,
এককোষী হতে জীব বহুকোষী হয়।
একমাত্র মানুষের যৌন ক্ষুধা নয়,
যৌনমিলন আকাংক্ষা প্রাণীজগতময়।
ঋতু ছাড়া অন্য প্রাণী করে না বিহার,
জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের নাই কোন বিচার।
আদিকালে মানুষের দল ঘুরতো জঙ্গলে,
মুক্তপ্রেম, মুক্তবিহার ছিল সেইকালে।
পরিবর্তনশীল জীবজগত হচ্ছে রূপান্তর,
স্মৃতিচিহ্ন থাকে তার এই ধরণীপর।
জাতি, ধর্ম, রাষ্ট্র ছিল না সেইকালে,
নারী ছিল সমাজকর্তা ইতিহাস বলে।
খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, ময়মনসিং উত্তরে
মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আদিবাসীর ঘরে।
মামাতো, পিসতুতো বোন দক্ষিণ ভারতে
ভাইয়ের সাথে করে বিয়ে পরম আনন্দতে।
ভারতের বিবাহের আছে ইতিহাস,
সেই তত্ত্ব এইখানে করিব প্রকাশ।
মহাভারতে সুভদ্রাকে অর্জুন করে বিয়ে,
পিসেতো বোন ইরাবতী, পরীক্ষিত যায় নিয়ে।
উপস্থিত সুধীজন শোনেন দিয়া মন,
বৈদিক যুগের কথা কিছু করিব বর্ণন।
স্বাধীনভাবে চলতো নারী,স্বাধীন অধিকার,
পতি নির্বাচন করতো যেমন ইচ্ছা যার।
আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র পরিষ্কার বলে,
বংশের ভাই নয় শুধু সহোদরও চলে। (৭/২/৫)
বৈদিক বিয়ের সুচনায় নাহতো অনুষ্ঠান,
পিতামাতা হাত ধরে করতো কন্যাদান।
বেদোত্তর যুগে চার বিয়ে দেখতে পাই,
আসুর, রাক্ষস, গান্ধর্ব, পৈশাচিক জানাই।
পণ লেনদেন নিয়ে যত বিয়ে হয়,
আসুর বিবাহ ইহা জানিবে নিশ্চয়।
চুরি করে, বলপূর্বক নারী হরণ করে,
রাক্ষস বিয়ে গণ্য হয় শাস্ত্রীয় বিচারে।
প্রবঞ্চণা, ছল করি নিয়ে যায় ঘরে,
পৈশাচিক বিয়ে ইহা বলে শাস্ত্রকারে।
নির্জনে প্রেমালাপ করে মাল্যদান,
গান্ধর্ব বিয়ে এই শাস্ত্রেতে প্রমাণ।

গঙ্গা সাথে শান্তনুর গান্ধর্ব মতে বিয়ে
শূদ্রকন্যা হিড়িম্বা বরে ভীমে মাল্য দিয়ে।
মহাকাব্যিক মহাভারত শুনে মধু ভরে,
জোর করে রুক্কিনীরে কৃষ্ণ বিয়ে করে।
দেবকের রাজসভায় সিনির গমন,
গায়ের জোরে দেবকীরে করিল হরণ।
বাসুদেবের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়েছিল।
মামাতো বোন অর্জুন হরিয়া আনিল।
এইসব রাক্ষস বিয়ে মহাভারতে গাঁথা,
হাজারো কাহিনী ভরা মহাভারতের পাতা।
বিধবা বিবাহ মহাভারত যুগে ছিল,
ঐরাবত দুহিতার স্বামী গরুড়ে মারিল।
সযতেœ অর্জুন বীর বিয়ে করে তারে,
ইরাবন নামে পুত্র বিখ্যাত সংসারে।
ভিক্ষা মাগি গৌতম ঋষি শূদ্রদ্বারে যায়,
শূদ্রাণী এক বিধবাকে বিয়ে করে লয়।
ব্রাহ্মণকন্যার সাথে শূদ্রের বিয়ে হতো,
সেই গর্ভে সন্তান হলে চন্ডাল বলিত।
চণ্ডালকন্যা বিয়ে ব্রাহ্মণে বৈধ ছিল,
তার গর্ভে পুত্র হলে গলায় পৈতা দিল।
এক পুরুষের বহুপত্নী বিয়ের প্রথা ছিল,
শর্মিষ্ঠা, দেবযানী যযাতিকে বরিল।
শকুন্তলা,লক্ষণারে দুষ্মন্ত আনে ঘরে,
গঙ্গা আর সত্যবতী শান্তনু বিয়ে করে।
ষোল হাজার মুনিকন্যা কৃষ্ণ আনে হরে,
অবৈধ শৃঙ্গার করে রাখিয়া অন্দরে।
কন্যাগন বলে কৃষ্ণ মোদের বিয়ে করো,
অনূঢ়া শৃঙ্গার করে কেন ইজ্জত মারো।
বিবাহের পরে তাদের মনের দুঃখ গেল,
দশটি করে পুত্র তাদের গর্ভে জন্মিল।
এক নারী বহুপতি মহাভারতে আছে,
পঞ্চপাণ্ডব সকলে যায় দ্রৌপদীর কাছে।
ঋষিকন্যা বাক্ষীকে দশ ভাই বিয়ে করে।
জ্যেষ্ঠ ভাইয়ে করলে বিয়ে অধিকার দেবরে।
বিবাহকালে দ্রোপদীরে ব্যাস ডেকে কয়,
বহুপতি পেলে নারী সনাতন ধর্ম পায়।
দক্ষরাজের ষোল কন্যা ভিন্ন প্রথায় বিয়ে,
একসাথে ষোল কন্যা ধর্ম যায় নিয়ে।
সত্যবতী খেয়া বায় যৌবনে যমুনায়,
প্রাতঃকালে পরাশর ঘাটেতে উদয়।
অপূর্ব রূপসী যেন ফোটা গোলাপ ফুল,
মধু পেয়ে মধুকর কামেতে ব্যাকুল।
হাসিয়া বলেন মুনি সত্যবতীর ঠাই,
তোমারূপে মুগ্ধ আমি কাম ভিক্ষা চাই।
নিশি অবসানে, এখন অরুণ উদয়,
চারিদিকে কলরব, লোক লাজ-ভয়।
হেন বাক্য শুনি মুনি ছাড়েন হুংকার,
কুয়াশায় ঢেকে গেল, হলো অন্ধকার।
আনন্দে কাম তৃপ্তি করে পরাশর,
কুমারী গর্ভে জন্মে ব্যাস এই ধরাপর।
বিপ্রশা মুনির ঔরসে গঙ্গার উদরে,
কুরুকূল চুড়ামণি জন্মলাভ করে।
যৌবনে শান্তনুরাজ গঙ্গা বিয়ে করে,
শান্তনুর ঔরসে ভীষ্ম গঙ্গার উদরে।
সত্যভঙ্গ করলে রাজা গঙ্গা চলে যায়।
ঘুরতে ঘুরতে নৃপতি গেলেন যমুনায়।
গঙ্গাজ্ঞানে সত্যবতী গৃহেতে আনিল,
সুুচিত্রবীর্য, বিচিত্রবীর্য দুই নন্দন জন্মিল।
অম্বিকা, অম্বালিকা এনে পুত্রবধু করিল,
বংশরক্ষা না হতে তারা যমালয়ে গেল।
বিপদ বুঝে সত্যবতী ভীষ্মে ডেকে কয়,
কুরুকূল হয় নির্মূল করহে উপায়।
ভীষ্মদেব বলে মাতা তোমারে জানাই,
চির ব্রহ্মচারী আমি কোন উপায় নাই।
বিপদ ভারী চিন্তা করি ব্যাসকে ডাকিল,
তার ঔরসে রানীদ্বয়ের গর্ভে পুত্র হলো।
ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ভাই দুইজন,
দাসী গর্ভে জন্মিলেন বিদুর সুজন।
ছোট ভাইবৌয়ের গর্ভে সন্তান জন্মদান,
হেন নীচ কাজ করলেন ব্যাস মতিমান।
মাতা-পুত্রে বিয়ে হতো মহাভারত যুগে,
শান্তনু গঙ্গার বিয়ে আর কি প্রমাণ লাগে?
ঢাক-ঢোল-কাসর বাজে, বাজে সানাই বাঁশী,
শাস্ত্রকথা ছেড়ে দিয়ে মূল কথায় আসি।
গুরুচান্দ চরিতে এই কথাটা কয়,
বিবাহ স্বীকৃতিমাত্র আর কিছু নয়।
বর্তমান বিজ্ঞানযুগ চারিদিকে আলো,
কুসংস্কার ছেড়ে এবার বাস্তবেতে চলো।
পাত্র-পাত্রী জেনে নেবে নিজেদের মন,
মনে মনে মিল হলে হবে একমন।
ছেলে-মেয়ে দুইজনে মেডিকেল করাবে,
মল-মুত্র, রক্ত-বীর্য পরীক্ষা করে নেবে।
মালা বদল নাচ গান কর আয়োজন,
এই বিয়েতে লাগে না নাপিত ব্রাহ্মণ।
বিয়ের পর পাত্র-পাত্রী আদালতে যাবে,
আইন মোতাবেক বিয়ে রেজিষ্ট্রি করাবে।
শাস্ত্র মধ্যে পেয়েছি যাহা করেছি বর্ণন,
ভুল ত্র“টি করবেন ক্ষমা যত সুধীজন।।

এরপর বর ও কনেকে মঞ্চে আসার জন্য আহ্বান করা হয়। বর ও কনেকে শপথ বাক্য পাঠ করান বিমান বিহারী গোলদার (সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, কপিলমুনি কলেজ, পাইকগাছা, সাতক্ষীরা এবং ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ কপিলমুনি শাখা, সাতক্ষীরা-এর সাধারণ সম্পাদক)।

বিয়ের শপথনামা

আমি কল্যাণ কুমার বিশ্বাস, পিতা : সুশান্ত কুমার বিশ্বাস, মাতা: নমিতা বিশ্বাস, গ্রাম : কুচলিয়া, থানা : মনিরামপুর, জেলা : যশোর।

আমি লিঠু রাণী মল্লিক, পিতা : কণক রঞ্জন মল্লিক, মাতা : দুলালী মল্লিক, গ্রাম : ভূলাপাতা, থানা : অভয়নগর, জেলা : যশোর।

যে আদর্শ মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবতে শেখায়, মানুষকে সবার উপরে স্থান দেয় এবং মানুষের সার্বিক মুক্তির পথ দেখায় আমরা উচ্চনিনাদে মুক্তকণ্ঠে সেই মানবতাবাদী আদর্শ যুক্তিবাদের জয় ঘোষণা করছি।

আমরা মুক্তমনা, আধুনিক চিন্তাচেতনায় আস্থাশীল মানবতাবাদী যুক্তিবাদী। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন স্বাধীনচেতা প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষ। গভীরভাবে শ্রদ্ধা পোষণ করি মানুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতায়।

আমরা একে অপরকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি, বিশ্বাস করি, ভালবাসি এবং জীবনসঙ্গী হিসাবে জীবন-যাপনের জন্য আমরা উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে শপথ করছি।

আজকের এই প্রাণময় উজ্জ্বল মুহূর্তে স্বপ্নময় ভবিষ্যতের লক্ষ্যে একে অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও আস্থা প্রকাশ করে উভয়ে উভয়কে বিবাহিত হিসাবে গ্রহণ করছি।

মর্যাদার সঙ্গে সমাধিকারের ভিত্তিতে দাম্পত্য জীবনের সকল দায়িত্ব পালন করব। উভয়ে উভয়ের অধিকার ও স্বাধীন ব্যক্তিসত্ত্বাকে সচেতনভাবে সম্মান জানাব। দুজনই যাতে নিজেকে সুস্থ ও স্বাধীনভাবে বিকশিত করতে পারি সে ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার ভূমিকা স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পালন করব। প্রভু-দাসীর অমানবিক সম্পর্ক নয়, বন্ধুত্বের মানবিক সম্পর্কই আমাদের দাম্পত্যজীবনের প্রাণ-প্রদীপ।

আমাদের চিন্তাচেতনায় বৈচিত্র্য থাকবে কিন্তু বৈপরীত্য থাকবে না। দু’জনকে একই ফুল ভালবাসতে হবে, একই গায়কের গান ভালো লাগতে হবে এমনটা নয়। এই ধরনের প্রশ্নাতীত সহমত অনেক সময় দাসত্বের প্রকাশ। আমরা ভিন্নমত পোষণ করতেই পারি কিন্তু আদর্শকে ভালবাসার ক্ষেত্রে আমরা অভিন্ন থাকব।

আমাদের মধ্যে কেউ আদর্শচ্যুত হলে সঙ্গত কারণেই উভয়ের মধ্যে দেখা দেবে দ্বন্দ্ব। আর সেক্ষেত্রে শ্রদ্ধাহীন বন্ধুত্বহীন দাম্পত্যজীবন অটুট রাখা অসম্ভব ও সুস্থ মানসিকতার পরিপন্থী।

নরের দৃষ্টিতে নারীকে দাসী হিসাবে দেখার ব্রাহ্মণ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর বিপরীতে নর-নারী পরস্পরকে মানুষ হিসাবে দেখার মানবিক যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করছি। আমরা কোন অন্ধ আবেগের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারস্পারিক শুভেচ্ছা, উৎফুল্লতা ও যুক্তিবোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যৌথ জীবনে প্রবেশ করছি।

আমাদের নিখাঁদ বন্ধুত্ব, ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, নির্ভরতা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার সম্পর্ক আনন্দঘন এই অনুষ্ঠানে, এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে প্রাণের জোয়ার এলো। আমরা প্রগাঢ় ভালবাসার মধ্য দিয়ে সুস্থ-সুন্দর দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করছি।

শপথ পাঠ শেষে বর ও কনে মালাবদল করেন, যা অনুষ্ঠানটিকে আরও নান্দনিক করে তোলে। তারপর নব দম্পতি যৌথভাবে আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অনন্ত প্রেম’ কবিতাটি, যা প্রকাশ করে মুক্তমনা দম্পতির স্বপ্ন ও আদর্শের অভিব্যক্তি।

অনন্ত প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্র“বতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।

 

উল্লেখ্য, নব দম্পতির দু’পরিবারই এবং তাদের আত্মীয়স্বজনসহ এলাকার অনেক মানুষ বিয়ের সমগ্র অনুষ্ঠান আনন্দের সাথে উপভোগ করেন এবং প্রশংসা করেন। তবে কতিপয় চিহ্নিত ব্যক্তিকে বিরূপ মন্তব্য করতেও শোনা যায়।

এ ছাড়াও সমগ্র অনুষ্ঠানটিকে প্রাণোবন্ত করতে সহযোগিতা করেন রবীন বিশ্বাস, নিউটন সরকার, অনির্বান, মিলন, কৃপা, মিঠুন, সত্যজিৎ, সুব্রত, শিবানী, বীথি মল্লিক, অনুকূল বিশ্বাস, টিয়া মাসি, নিত্যা দাদাসহ আরও অনেকে।