লিখেছেনঃ যিনাতুল ইসলাম
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ তে নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ লক্ষ্যে উল্লেখ আছে “স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন ধর্মের কোন অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারী স্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইন বিরোধী কোন বক্তব্য প্রদান বা অনুরূপ কাজ বা উদ্যোগ গ্রহণ না করা।” এমতাবস্থায় আমার লেখাটি কতটা গৃহীত হবে জাতীয় পর্যায়ে সে ব্যাপারে সন্দিহান। তারপরও চেষ্টা করলাম।
বেশ কয়েকদিন ধরেই তর্কের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে সরকার ও ইসলামি ঐক্য জোট, চারদলীয় জোটের মধ্যে, এমনকি সাধারণ আড্ডায়, রাজনৈতিক কথোপকথনে – জাতীয় নারী নীতিমালা ২০১১ না কুরআন। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ পড়ে সত্যিই মনে হলো নারীদের মুমূর্ষু অবস্থা। যখন কষ্ট পাচ্ছি নারীর অসহায়ত্বের কথা ভেবে তখনই অন্যদিকে মনে হচ্ছে এতো বাংলাদেশের মতো মুসলিম রাষ্ট্রে অবধারিত। নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ কুরআন-এর পরিপন্থী কিনা সে বিষয়ে তর্কের আগে এটা নির্ধারণের বিষয় যে বাংলাদেশকে আমরা একটি মুসলিম রাষ্ট্র বলবো কি না।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র। এখানে প্রায় ৮৩% জনগণই মুসলিম। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রসঙ্গ টানলে বলতে হয় তাও মুসলিম রাষ্ট্রের সংবিধান। কারণ সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ আছে “সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” এর কথা। উপরন্তু ২(ক) তে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে শুধুমাত্র ইসলামের উল্লেখ আছে। অপরদিকে সংবিধানে কুরআনের পরিপন্থী বিষয়গুলিরও অন্তর্ভুক্তি দেখা যায়; যেমন নারীর সমঅধিকার ও বৈষম্যহীনতার ক্ষেত্রে। যাই হোক, বাংলাদেশ যে একটি মুসলিম রাষ্ট্র তা এখানকার জনগণের (ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী) আধিক্য ও সংবিধানের আলোকে প্রমাণিত। সুতরাং সে অনুসারে সরকার কর্তৃক গৃহীত সকল নীতি ও আইন ইসলাম পরিপন্থী বা কুরআন পরিপন্থী হওয়া যাবে না।
এখন জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১-এর প্রসঙ্গে। নীতিমালায় সংবিধানের নারী অধিকার বিষয়ক সামঞ্জস্যতা থাকলেও দু’টি গুরুতর ত্র“টি বিদ্যমান Ñ এই নীতিমালা ১. সংবিধান পরিপন্থী এবং ২. কুরআন পরিপন্থী।
প্রথম ক্ষেত্রে অর্থাৎ সংবিধান প্রসঙ্গে যখন কথা হচ্ছে তখন প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন সংবিধান নিজেই স্ববিরোধী। একদিকে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও পূর্ণ আস্থার কথা বলা হচ্ছে অর্থাৎ কুরআনের ওপর পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপনের কথা বলা হচ্ছে অন্যদিকে ২৮নং অনুচ্ছেদে নারীর রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি জীবনে সমঅধিকারের উল্লেখ আছে। যেখানে কুরআনে পরিষ্কারভাবেই বলা আছে উল্টো কথা। দ্বিতীয় পয়েন্ট আলোচনা করার সময় তা আরও স্পষ্ট হবে।
দ্বিতীয় পয়েন্টে প্রথমেই আসি কুরআনের কথায়। কুরআনের সুরা বাকারায় উল্লেখ আছে “তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র। সুতরাং যেভাবে ইচ্ছা তোমরা তোমাদের শসক্ষেত্রে যাও।” (সুরা বাকারা, আয়াত ২২৩)। অর্থাৎ নারীর পারিবারিক জীবনে অধিকার পুরুষের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ এর ১৬.১, ১৬.২, ১৬.৩, ১৬.৪, ১৬.৮, ১৬.১২ লক্ষ্যসমূহ সরাসরি কুরআন পরিপন্থী। এই লক্ষ্যসমূহে বলা হয়েছে নারীর সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে নিরাপত্তা, অধিকার, সমঅধিকার ও মানবাধিকার সংরক্ষণের কথা। কুরআন অনুসারে নারীকে (শস্যক্ষেত্র) যেখানে ইচ্ছা ব্যবহার বা ভোগ করার অধিকার পুরুষের থাকে তাহলে কীভাবে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে নিরাপত্তা ও মানবাধিকার, সমঅধিকার সংরক্ষণ ও নিশ্চিত করা সম্ভব সে বিষয়টি পরিষ্কার নয়। অপরদিকে কুরআন যদি মানতে হয় যা সংবিধানের প্রথমেই বলা আছে, তাহলে নীতিমালার এই লক্ষ্যসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা যায় কীভাবে। শুধু তাই নয়, এতে করে নীতিমালাটি সংবিধান পরিপন্থীও কি হয় না? জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত মানবাধিকারের সংজ্ঞা হলো, “মানবাধিকার হলো মানুষের জন্মগত অধিকার ও অনস্বীকার্য চাহিদা যা তার প্রাকৃতিক ও জ্ঞানসম্পন্ন বিকাশে যৌক্তিক চাহিদাকে পূরণ করে” (ইসলাম, ২০০৬)। এই সংজ্ঞা ও সুরা বাকারায় উল্লেখিত আয়াতকে মিলাতে গেলে পুরুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা যতটা সহজ হয় নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ততটাই অসম্ভব। অর্থাৎ সিডও সনদে স্বাক্ষর করার পূর্বে তা ইসলামের পরিপন্থী হচ্ছিল কিনা ভেবে দেখা দরকার ছিল। সিডও সনদ অনুসারে নারী উন্নয়ন নীতিমালা যথার্থ কিন্তু উভয়েই নারীর মানবাধিকারের প্রশ্নে ইসলাম ও বাংলাদেশের সংবিধানের বিপক্ষে যায়।
“আল্লাহ তোমাদের সন্তান-সন্ততির সম্বন্ধে নির্দেশ দিচ্ছেন: এক পুত্রের সঙ্গে দুই কন্যার সমান” (সূরা নিসা, আয়াত ১১) অথবা সাক্ষ্য প্রদান সংক্রান্ত, “…তোমাদের পছন্দমত দু’জন পুরুষ স্বাক্ষী রাখতে। দু’জন পুরুষ সাক্ষীর অভাবে একজন পুরুষ ও দু’জন নারী সাক্ষী যা তোমরা পছন্দ কর…।” (সুরা বাকারা, আয়াত ২৮২)। এই দুই ক্ষেত্রেই প্রমাণিত হয় ‘১টি ছেলে = ২টি মেয়ে’ এই সূত্র। তো সূত্রানুসারে নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১-এর কন্য শিশুর উন্নয়ন সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা ১৮.৪ নির্ধারণ করা যায় কীভাবে? তা কি কুরআন পরিপন্থী হয় না? অর্থাৎ এই ধর্মীয় আইনটি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সমঅধিকার ও বৈষম্য বিলোপের প্রশ্নের ক্ষেত্রে অসংগতিপূর্ণ।
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১-এর কুরআনের প্রেক্ষিতে যৌক্তিকতা ও যথার্থতার প্রশ্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়াত “…আপোষ মীমাংসা করতে চাইলে স্বামীরাই তাদের পুনঃগ্রহণে অধিক হকদার। নারীর যেমন পুরুষের উপর ন্যায়সংগত অধিকার পুরুষেরও তেমনি নারীর উপর। তবে নারীর উপর পুরুষের মর্যাদা বেশি…” (সুরা বাকারা, আয়াত ২২৮)। আপোষ বলতে এখানে তালাকের ব্যাপারে বোঝানো হয়েছে। এবং “পুরুষ-নারীর কর্থা আল্লাহই তাদের একজনকে অন্যের উপর মর্যাদা দিয়েছেন। কারণ পুরুষ তাদের জন্য অর্থ ব্যয় করে। সুতরাং সতী নারীরা তাদের অনুগত হবে এবং তাদের অনুপস্থিতিতে আল্লাহ যা হেফাজত করতে বলেছেন তা হেফাজত করবে; তাদের অবাধ্যতার আশংকা করলে সদুপদেশ দাও, বিছানা ভিন্ন কর এবং তাদের মার দাও।” (সুরা নিসা, আয়াত: ৩৪)। এই দুটি আয়াতের প্রেক্ষিতে নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ এর ১৬.১, ১৬.২, ১৬.৩, ১৬.৪, ১৬.৫, ১৬.৬, ১৬.৭, ১৬.৮, ১৬.৯, ১৬.১০, ১৬.১১, ১৬.১২, ১৬.১৩, ১৬.১৪, ১৬.১৫, ১৬.২০, ১৬.২২, ১৭.১, ১৯.১, ১৯.২, ১৯.২, ১৯.৪, ১৯.৮, ১৯.৯, ১৯.১০, ১৯.১১, ২১.১, ২২.১, ২২.৩, ২৩.১, ২৩.২, ২৩.৩, ২৩.৪, ২৩.৭, ২৪.২, ২৪.৩, ২৫.১, ২৫.২, ২৬.৪, ৩০.২, ৩০.৩, ৩১.১, ৩২.১, ৩২.২, ৩২.৩, ৩২.৫, ৩২.৯, ৩৩.১, ৩৩.২, ৩৩.৩, ৩৩.৪, ৩৩.৫, ৩৪.৬, ৩৪.৯, ৩.৬২, ৩৬.৩ ইত্যাদি লক্ষ্যসমূহ অর্জন আদৌ কতটা সম্ভব সে বিষয়ে প্রশ্ন একাধিক। এই লক্ষ্যসমূহের মূল কথা হলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে নারীর সমঅধিকার ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সেই সাথে বর্ধিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। পুরুষের মর্যাদা নারীর ওপর বেশি হলে এবং পুরুষ নারীর কর্তা যদি হয়ে থাকে তাহলে তার অংশগ্রহণ পুরুষের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। সংবিধানে যখন দেশকে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় সেখানে উন্নয়ন নীতিমালাটি পুরুষের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হলে বর্তমান তর্কের খপ্পরে পড়তো না। আর যখন নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল এবং মর্যাদা পুরুষের বেশি তখন নারী ও পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিতকরণের প্রসঙ্গটি প্রশ্নবিদ্ধ করারও সুযোগ থেকে যায় অর্থাৎ পুরুষ নারীকে সমঅধিকার দিতে প্রস্তুত বা চায় কিনা সে বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। যখন তখন নীতিমালায় পুরুষের সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে এহেন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ স্বাভাবিকভাবেই কুরআন পরিপন্থী। শুধুমাত্র সমঅধিকার ও বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে নয় নির্যাতনের প্রশ্নেও কতটুকু পর্যন্ত পারিবারিক নির্যাতন এই নীতিমালা বহির্ভূত তা স্পষ্ট নয়। কুরআন অনুসারে পুরুষ নারীকে প্রহার করার অধিকার রাখে শারীরিক ও মানসিক উভয় পদ্ধতিতেই (“বিছানা ভিন্ন করা ও তাদের মার দেয়া” এই দুই পদ্ধতি)।
সুতরাং পারিবারিক জীবনে নির্যাতন নারীর জন্য কুরআন অনুসারে বৈধ। নীতিমালাটিতে নির্যাতন রোধকল্পে যে লক্ষ্যমাত্রাগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে তা কুরআনের বৈধতাকে কতটুকু ধারণ করবে তা মোটেই পরিষ্কার নয়। আর যদি কোন প্রকার নির্যাতনই নীতিমালা সহ্য না করে তাহলে তা কুরআন পরিপন্থী হবে বৈকি। ডঐঙ এর সংজ্ঞানুসারে শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে কোন ক্ষতিকর অস্ত্রদ্বারা আঘাত, শরীরে ঝাঁকুনি দেয়া, জোরে ধাক্কা দেয়া, দম বন্ধ করা, প্রহার, কামড়, আগুন ধরিয়ে দেয়া, মারের মাধ্যমে কাউকে অসুস্থ করা ইত্যাদি (আজম ও রহমান, ২০০৭)। এই সবগুলির মধ্যে প্রহারের কথা কুরআনে উল্লেখ আছে এবং তাকে বৈধ করা হয়েছে। নারী নীতিমালা সিডও সনদের আলোকে নারী নির্যাতন বন্ধ করতে চায় তাহলে প্রহার অবৈধ এবং নারী নীতিমালা কুরআনের আলোকে তৈরি করতে হয় তাহলে প্রহারকে বৈধ ঘোষণা করতে হবে। তাহলে নারী নির্যাতনের কোন পরিধি ও কোন সংজ্ঞাকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে নেবে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
কুরআন, সংবিধান, সিডও সনদ ও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-এ চারটির মধ্যে সমন্বয় ঘটানো অসম্ভব। কুরআনকে মানতে গেলে সংবিধানথেকে নারী ও পুরুষের সমঅধিকার বিষয়টি বাদ দিতে হবে নতুবা সংবিধান থেকে আল্লাহর বিধানের ওপর আস্থার প্রসঙ্গটি মুছে দিতে হবে। সংবিধান ও সিডও সনদের মধ্যে সামঞ্জস্যতাও তখনই আনা সম্ভব। অন্যদিকে সিডও সনদ ও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ এর মধ্যে সংশ্লেষ তো রয়েছে কিন্তু তা সংবিধান ও কুরআনকে সহযাত্রী হিসেবে প্রথম গড়মিল ধরা পড়ে আল্লাহর বিধানের ওপর আস্থা রাখার বিষয়টিতে (সংবিধানের ক্ষেত্রে) এবং নারী-পুরুষ সমঅধিকার, নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণ নারীকে প্রহার তথা নির্যাতন যা সবই পুরুষের সিদ্ধান্ত ও মর্জির ওপর নির্ভরশীল (কুরআন অনুসারে)। এই আলোচনাটি শুধু কুরআনের বিশেষ সংবেদনশীল আয়াতের প্রেক্ষিতে করা হয়েছে। পুরো কুরআনকে ধরলেও দেখা যায় প্রায় সব আয়াতই পুরুষকে উদ্দেশ্য করে বর্ণিত। সুতরাং কুরআন গ্রন্থটিই যখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে সেখানে জাতীয় নারী নীতিমালা ২০১১ নারীকে পুরুষের সমকক্ষ হিসেবে প্রণীত হবার সাহস বাংলাদেশের মত মুসলিম রাষ্ট্রে (আলোচনার প্রথমেই প্রমাণিত) পায় কীভাবে? সবশেষে আমার প্রশ্ন তাহলে কি নারীরা শোষিত হবে এটাই তাদের জন্মগত অধিকার নাকি তাদের শোষণমুক্ত নির্যাতনমুক্ত মানুষের পরিবারে স্বাগতম জানানোর জন্য অন্য কোন সমাজ কাঠামোর প্রবর্তন আবশ্যক? হয়ত অবশ্যম্ভাবী।
তথ্যসূত্র:
- 1. ১. জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১, http://www.mowca.gov.bd/
২. ইসলাম আশরাফুল এ. কে. এম. (২০০১),আল কোরানের বাংলা অনুবাদ, বিশ্ব সাহিত্য ভবন, বাংলাবাজার, ঢাকা, বাংলাদেশ
৩. Constitution of the Peoples Republic of Bangladesh, International Relations and Security Network, www.isn.ethz.ch
৪. আযম গোলাম মো. ও রহমান মাহফুজুর মোহাম্মদ (২০০৭), স্ত্রীর প্রতি সহিংসতার প্রভাব: অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত, উন্নয়ন সমীক্ষা, সংখ্যা-২৪, বিআইডিএস, ঢাকা, বাংলাদেশ
প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
লেখাটি পড়ে বুঝলাম,লেখক সত্যিই ইসলাম সম্পর্কে বিশেষ ‘অজ্ঞ’। আর তিনি আচ্ছা করেই এর বিকৃতি ঘটিয়েছেন। আমাদের প্রথমে দেখতে তার যুক্তিগুলো কতটুকু ঠিক আছে। 1.নারীরা পুরুষের শষ্যক্ষেত্র,সুতরাং…….। আসলে লেখক শুধু কোরআনের অনুবাদ দেখে ইসলামি চিন্তাবিদ হতে চেয়েছেন। তাই এ অবস্থা। কারণ,এ আয়াতটি বলা হয়েছে স্ত্রী সহবাসের ক্ষেত্রে। আয়াতটির ব্যাখ্যা ‘নারীরা সন্তান উৎপাদনে তোমাদের শষ্যক্ষেত্র সুতরাং তোমরা তাদের সাথে যেভাবে ইচ্ছা সহবাস করতে পারো (তবে অন্য আয়াতে গুহ্যদারে সহবাস নিষেধ করা হয়েছে)। সুতরাং এটা পারিবারিক জীবন ক্ষেত্রে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিধান নয়। দেখুন ( তাফসীরে ইবনে কাছীর,রুহুল মাআনী)ইত্যাদি। 2.উত্তরাধিকারে নারীরা পুরুষের অর্ধেক পাবে।’ কথাটি কুরআনে এভাবে আছে। আসুন দেখি নারীরা কি এতে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রথমেই আমরা দেখি পুরুষরা কাদের থেকে সম্পত্তি পায়। পুরুষ সম্পত্তি পায় : বাবা,মা ও সন্তান থেকে। কিন্ত নারী যাদের থেকে সম্পত্তি পায় তা হলো : বাবা,মা,স্বামী,সন্তান,ভাই, (সন্তান না থাকলে) এরকম মোট সরাসরি আটটি সূত্র থেকে। কিন্ত একটা জিনিস দেখুন ‘হিন্দু ধর্মে মেয়ে তো কোন সম্পদই পায় না’ এটা রনয়ে তো তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই (দরকার হলে এ ব্যাপারে গণভোট হোক)। এবার লালন-পালনের বিষয় আসা যাক। ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক হলে ছেলের জীবিকার ভার ছেলেকেই নিতে হবে (এটা আইন)। কিন্ত বিয়ের আগ পর্যন্ত মেয়ের দায়িত্ব বাবার। আর বিয়ের পর তার দায়িত্ব স্বামীর। অর্থাৎ,বাবা-স্বামী যেখান থেকে পারে তার সকল প্রয়োজন মিটাতে হবে। এটাও কি ইসলামে অন্যায় করা হয়েছে? বরং হাদীসে বাবার জন্য বলা হয়েছে,যে একটি সুপাত্রস্থ করার আগ পর্যন্ত লালন-পালন করবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব। কই ছেলের ব্যাপারে তো এমন কিছু বলা হয় নি। তিনি নিজেও কন্যা পালন করে আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপর করে গেছেন। স্বামীর ব্যাপারে বলা হয়েছে: ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যাক্তি যে তার স্ত্রীর নিকট প্রশংসনীয়। স্ত্রী মর্যাদা দেখতে হলে দয়া করে দেখুন: ইসলাহী খুতুবাত,2য় খণ্ড,দারুল উলুম লাইব্রেরী,বাংলা বাজার। এবার আসুন সাক্ষ্যর ব্যাপারে। ইসলামে এটা বলা হয়েছে। এটা কোন মেয়ে অস্বীকার করতে পারবে না যে,ব্যক্তি আদর-মমতা সর্বদিক থেকে তারা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে। ইসলাম একথা বলেছে যে, যদি কোন নারী না থাকে তাহলে দুইজন নারী তার সাক্ষ্য দিলে গ্রহণযোগ্য। নারীর এই স্বাভাবিক দুর্বলতার কারণেই কিন্ত বিশ্বের সকলে দেশে নারীর ভোটাধিকার নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। হিলারী প্রেসিডেন্ট হতে পারে নি। এটা তাদের দোষ নয় গুন। যেমন,আমরা যদি কোন মেয়ের ব্যাপারে বলি‘সহজ-সরল’, তাহলে কেউ দোষ মনে করে না। কিন্ত যদি ছেলের ব্যাপারে এমন বলি তাহলে দোষ মনে করে। কারণ,নারী তার নারিত্বে এবং পুরুষ তার পুরুষত্বে ভালো মানায় (অনেক কিছু এখানে বলার আছে)। লেখক একটা আয়াতের অর্থ বিকৃত করেছেন। ‘নারী পুরুষের পোশাক স্বরূপ ও পুরুষ নারী পোশাকস্বরূপ’ কুরআনে এতটুকু বলা হয়েছে। কিন্ত ‘পুরুষ প্রাধান্য পাবে’ এটা লেখক নিজ থেকে বাড়িয়ে বলেছেন। নারী অবশ্যই শালীনতার সাথে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে পারে। নয়তো জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির মতো সেঞ্চুরি হতে পারে। কেউ যদি তা চায় তবে তার র্বক্তিগত ব্যাপার।সময় স্বল্পতার কারণে বেশি লিখতে পারলাম না। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন না। সুতরাং নতুন আইন না করে আমাদের উচিত,ইসলামি আইন বাস্তবায়ন করা। তাহলে সেই সোনালি যুগের আমাদের সময়ও সোনার জন্ম হবে।
আসলে সরকারের যদি উদ্দেশ্য ভাল হত, তা হলে ইসলাম নারীকে যে অধিকার দিয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে এগিয়ে আসত। তাদের কথা সত্য, মতলব কিন্তু খারাপ!
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে- এই জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ প্রকাশের পর সবচেয়ে বেশী আলোচনা হয়েছে পারিবারিক উত্তরাধিকার আইন নিয়ে। আমিনী ও তাবৎ মোল্লা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে পুরুষেরা হায় হায় করে উঠেছে সম্পত্তির উত্তরাধিকার বন্টন বিষয়ে, ভয়ে চিৎকার করে উঠেছে- এবং কোনমতেই যাতে পৈত্রিক সম্পত্তিতে নারী পুরুষের সমান ভাগ না পায় সে ব্যাপারে উচ্চকিত থেকেছে! বিভিন্ন জায়গায় এর পক্ষে-বিপক্ষে ডিবেট হয়েছে। আমার মাও একদিন তার অফিস থেকে হতাশ হয়ে এসে বললেন- শিক্ষিত মানুষেও (আমি সংশোধন করে দিয়েছিলাম- “বলো পুরুষেরা”) যদি না বুঝে- আজে বাজে যুক্তি করতে থাকে- তাহলে কেমন করে হবে! (কয়েকটা মজার যুক্তির কথা মা বললো- “মেয়ের বিয়েতে প্রচুর খরচ করতে হয়”!! “মেয়ে তো বিয়ের পরে চলে যায়”!! “মেয়ের তো লস হচ্ছে না- তার হাসব্যাণ্ডতো আবার ঠিকই দ্বিগুন সম্পত্তিই আনছেই” … ইত্যাদি)
এমন যুক্তি-তর্কের ঝড়, অথচ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আমি উত্তরাধিকার ও সমানাধিকার একসাথে কোন জায়গাতেই পেলাম না। অবাক ব্যাপার তাই না? একদল আওয়ামীলীগ কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী কাজ করে ফেললো বলে জিগির তুলছে আর অন্যদিকে আমার মা ও অনেকেই আওয়ামিলীগকে- হাসিনাকে প্রগতিশীল ভেবে গদগদ হয়ে যাচ্ছে! এই মিথ্যাপ্রচারণাটা চালালো কে? হাসিনাদের বক্তব্য অনুসারে আমিনী গং!
নারী নীতি ২০১১ খুঁজে নীচের ধারাগুলো পেলাম- যেগুলোর দেখে অনেকে এমন মনে করতে পারে যে- উত্তরাধিকারে সমান অধিকার দেয়া হচ্ছে:
মজার ব্যাপার হচ্ছে- সম্পদ মানে কেবল উত্তরাধিকার বুঝায় না। রাষ্ট্রীয়/পাবলিক সম্পদ, সুযোগ-সুবিধা বেশী প্রযোজ্য এখানে। ফলে, নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে এসব ক্ষেত্রে। আর, ২৫.২ ধারাটিতে উত্তরাধিকার শব্দটি উল্লেখ করা হলেও সমান অধিকার শব্দটি সেখানে নেই- আছে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ উত্তরাধিকার বন্টন কেমন করে হবে- সে বিষয়ে কোন কথা নেই, আছে- তা যেমনেই বন্টন করা হোক না কেনে- বন্টিত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকবে নারীর!! এটা আসলে, একরকম ধাপ্পাবাজিই- এমনভাবে ভাষায় প্রকাশ করেছে যে হঠাতই মনে হবে- কতই না প্রগতিশীল- ভালো করে তাকালে বুঝা যায়- পুরাটাই ঠনঠন!!
আর সে কারণেই- শুরুতে আওয়ামিলীগ সুশীল সমাজের উদ্দেশ্য প্রচার করলো- তারা কত প্রগতিশীল- নারীদের সমান অধিকার দেয়ার জন্য নারী উন্নয়ন নীতিমালা করেছে, নারীদের প্রতি সমস্ত বৈষম্য তারা দূর করে ফেলছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর, যখনই আমিনীরা একটু নড়েচড়ে বসলো- তখন সমস্বরে সমস্ত আওয়ামিলীগাররা বলা আরম্ভ করে দিলো যে- “এতে কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী কিছু নাই, নীতিমালা পড়ে আসেন – ওপেন চ্যালেঞ্জ- একটাও নীতি বের করতে পারবেন যেটা কোরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী” ইত্যাদি।
হরতালের আগের দিন তো ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে সমস্ত দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি আকারে ছাপানো হলো যে- আমিনী গং দের সমস্ত দাবীই মিথ্যা (http://eprothomalo.com/index.php?opt=view&page=13&date=2011-04-03)।
[img]http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/nastikerdharmakathablog_1303183310_1-2011_04_03_13_8_b.jpg[/img]
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য নিয়ে বলার কিছু নেই- নারী নীতি ২০১১ পড়ার পরেই মনে হয়েছে- এগুলোর আসল অর্থ কি। এই বিজ্ঞপ্তিতে দেখার মতো বিষয়টা হচ্ছে- বিসমিল্লাহ আর আসসালামের ছড়াছড়ি! বুঝেন তাইলে- এই হইলো আমাদের সেক্যুলার(!) আওয়ামিলীগের চেহারা! আসলে, তশবী হাতে ফটুক লাগায়া দেশবাসীর ভোট চায় যে দল- ভোটে জেতার জন্য খেলাফত মজলিশের মত দলের সাথে যারা সমঝোতা করে- ফতোয়ার বিধানকে পর্যন্ত জায়েজ করতে কুন্ঠা বোধ করে না- তাদের সেক্যুলার প্রগতিশীল কেবল দলান্ধরাই বলতে পারে!
এবারে আসি ২য় অধ্যায়ে। এই অধ্যায়কে বলতে পারেন- নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এর মূল পদক্ষেপ/ নীতি / লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
১৬. জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির লক্ষ্য (২২ টি ধারা)
১৭. নারীর মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ (৯ টি ধারা)
১৮. কন্যা শিশুর উন্নয়ন(৮ টি ধারা)
১৯. নারীর প্রতি সকল নির্যাতন দূরীকরণ (১১ টি)
২০. সশস্ত্র সংঘর্ষ ও নারীর অবস্থা (৩ টি)
২১. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (৩)
২২. ক্রীড়া ও সংস্কৃতি (৪)
২৩. জাতীয় অর্থনীতির সকল কর্মকান্ডে নারীর সক্রিয় ও সমঅধিকার নিশ্চিতক (১১ টি)
২৪.নারীর দারিদ্র দূরীকর (৫ টি)
২৫. নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন (২ টি)
২৬. নারীর কর্মসংস্থান (৬ টি)
২৭. জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট এবং জেন্ডার বিভাজিত (Disaggregated) ডাটাবেইজ প্রণয়ন (৩ টি)
২৮. সহায়ক সেবা (১ টি)
২৯. নারী ও প্রযুক্তি (৩ টি)
৩০. নারীর খাদ্য নিরাপত্তা (৩ টি)
৩১. নারী ও কৃষি (৪ টি)
৩২. নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন (৯ টি)
৩৩. নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন (৭ টি)
৩৪. স্বাস্থ্য ও পুষ্টি (১১ টি)
৩৫. গৃহায়ণ ও আশ্রয় (৩ টি)
৩৬. নারী ও পরিবেশ (৩ টি)
৩৭. দুর্যোগ পূর্ববর্তী, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে নারী ও শিশুর সুরক্ষা (১০ টি)
৩৮. অনগ্রসর ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি নারীর জন্য বিশেষ কার্যক্রম (৩ টি)
৩৯. প্রতিবন্ধী নারীর জন্য বিশেষ কার্যক্রম : (৬ টি)
৪০. নারী ও গণমাধ্যম (৪ টি)
১৬, ১৭, ২৩, ২৫, ২৬ অনুচ্ছেদের ধারাগুলো/ লক্ষ্যগুলো উল্লেখ করছি:
এসবের মাঝে অনেক ধারাই দেখা যাবে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে আইন পর্যন্ত আছে কিংবা সব সরকারের কর্তাব্যক্তিরা মুখে হলেও নীতিগত সমর্থন জানিয়েছেন – কিন্তু আদতে সেগুলোর বাস্তবায়ন কতটা হচ্ছে তা দেখার ফুসরত কখনো কারো হয় নি (যেমন: নারী সমাজকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা, নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা, নারী সমাজকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা, নারী পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করা, নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন দূর করা, নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি)।
ফলে, এসব ধারা বা লক্ষ্য কিভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে তা উল্লেখ না থাকলে যথারীতি একটা অনাস্থা তৈরি হয়ে যায়, কেননা এসব সুন্দর সুন্দর কথা আমাদের সেই কোন আমল থেকেই শোনানো হয়েছে এবং এখনো শুনছি কার্যত উপর উপর ও লোকদেখানো কিছু কর্মকান্ড ছাড়া কোন পদক্ষেপই আসলে চোখে পড়েনি কখনো।
৪.১ অনুচ্ছেদের পরেই আছে ৫ নং ধারা: নারীর মানবাধিকার ও সংবিধান। সেখানে সংবিধানের ২৭, ২৮(১), ২৮(২), ২৮(৩), ২৮(৪), ২৯(১), ২৯(২) ও ৬৫ (৩) অনুচ্ছেদ তুলে ধরা হয়েছে। “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না” (২৮/১) বা “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না” (২৮/৩) বা “নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না” (২৮/৪) বা “প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে” (২৯/১) কিংবা “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারীপুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মের নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না” (২৯/২) নারী নীতির ৫ নং ধারায় সংবিধানের এইসব অনুচ্ছেদ পড়তে কতই না ভালো লাগে- অনেক সময় এমনও মনে হতে পারে- এ বুঝি ১মবারের মত এই নারী নীতিরই আবিস্কার! বাস্তবে উল্লসিত হওয়ার মত কিছু নেই। এসমস্ত অনুচ্ছেদই ১৯৭২ সালে লিখিত (৬৫/৩ ব্যতীত)। বাস্তবে আমাদের সংবিধানটাই হচ্ছে স্ববিরোধিতায় ভরপুর- সংবিধানের উপরিউক্ত অনুচ্ছেদগুলো বলবদ থাকলে কোন প্রকারেই সংবিধান স্বীকৃত ব্যক্তিগত পারিবারিক উত্তরাধিকার আইন ১৯২৫, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ ও সংশোধনী ১৯৮৯, বিবাহ সংক্রান্ত আইন প্রভৃতি কোন প্রকারেই টিকার কথা নয়। অথচ- উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে ইউনিভার্সল ফ্যামিলি কোড আইনের পরিবর্তে মুসলিম পারিবারিক আইন (পুত্র কন্যার দ্বিগুন পাবে), হিন্দু আইন (বৌদ্ধদের জন্যও একই: আরো বর্বর- কন্যা সন্তান কিছুই পাবে না) প্রভৃতি এখন চলছে- মুসলিম বিবাহ আইন, হিন্দু বিবাহ আইন প্রভৃতিও চলছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে- সাক্ষ্য আইন ১৯৭২ ও চুক্তি আইন ১৯৭২ দ্বারা সাক্ষ্য হিসাবে বা চুক্তিসম্পাদনকারী হিসাবে নারী ও পুরুষ সমান হিসাবে বিবেচিত হলেও- মুসলিম বিবাহ আইন অনুযায়ী বিয়ের সাক্ষ্য হিসাবে ১জন পুরুষ সমান ২ জন নারীই কেবল নয়, ২ জন পুরুষের ক্ষেত্রে ৪ জন নারী থাকলেও চলবে না- কমপক্ষে ১ জন পুরুষ থাকতেই হবে!!!! (২ জন পুরুষ সাক্ষ্য থাকলে নারী সাক্ষ্যের কোন দরকার নেই!!)
যাহোক, যেটা বলছিলাম- খুব ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে যে-নারী নীতিতে উল্লেখিত সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলো প্রায় সবই ১৯৭২ সালে রচিত হলেও সেগুলো ৪১ বছর ধরে কেবল কথার কথা হিসাবে রয়ে গিয়েছে- কেননা- এই সংবিধান অনুযায়ীই মুসলিম-হিন্দু-খৃস্টান বিবাহ আইন, উত্তরাধিকার আইন এগুলো আমাদের দেশের প্রচলিত আইন। সুতরাং- এই সব প্রচলিত আইন রদের বিষয়ে কোন সুপারিশ না রেখে- কেবল ঐসবের উল্লেখ শুভংকরের ফাঁকি ছাড়া কিছুই না। আলবৎ এগুলো ধোঁকাবাজি। নারী উন্নয়ন নীতির ২য় ভাগ দেখুন। এখানে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির লক্ষ্য(১৬) হিসাবে প্রথমেই বলা হয়েছে: ১৬.১ বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও গণজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
বর্তমানের আমাদের স্ববিরোধী সংবিধানের আলোকে আপনারাই বলেন- কতটুকু সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব?
আবার, ১ম ভাগ ৪.১ নং ধারায় যাই।
১ম ১০ স্বাক্ষরকারী দেশ এ দাবীর সত্যতা বিষয়ক (১৯৮৪ তে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে আর ১৯৮১ তে ২০ স্বাক্ষরকারী দেশ নিয়ে সিডও সনদকে কার্যকর হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়!) আলোচনায় না গিয়ে সরাসরি সিডও সনদে স্বাক্ষরের ধরণ নিয়েই কথা বলা যাক।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চারটি ধারায় [২, ১৩(ক), ১৬(ক) ও ১৬(চ)] সংরক্ষণ সহ এ সনদ অনুসমর্থন করে- পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে যার মধ্যে ধারা ১৩(ক) এবং ১৬.১(চ) থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করা হয়। অর্থাৎ ধারা ২ এবং ধারা ১৬ (ক) থেকে এখনও সংরক্ষণ প্রত্যাহার করা হয় নি! ধারা ২ ও ধারা ১৬ (ক) এ সংরক্ষণ রাখার কারণ এগুলো নাকি কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী!
তাহলে শুরুতে ধারা ২ এবং ধারা ১৬ (ক) -ই দেখা যাক:
(সূত্র: http://www.un.org/womenwatch/daw/cedaw/text/econvention.htm#article2)
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে- ধারা ২ হচ্ছে পুরা সিডও সনদের একদম Policy Measures – যাকে বলা যায় সিডও সনদের প্রাণ তথা মূলনীতি। একে বাদ দিয়ে সিডও সনদে স্বাক্ষর করা (১ম ১০ স্বাক্ষরকারী দেশের অন্যতম হওয়া) আমার কাছে রেইনকোট পরে বৃষ্টিতে গোসল করার মতই মনে হয়েছে, কিংবা বলা যেতে পারে- মক্কায় হজ্জে যামু মাগার নামাজ পড়ুম না- এই টাইপের!!! এবং ১৬ নং ধারাটি হচ্ছে বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ নীতি, শুধু এক লাইন: “বিবাহে আবদ্ধ হওয়ার জন্য নারী ও পুরুষের একই অধিকার”- এটাও বাদ দিয়ে স্বাক্ষর করা হয়েছে কেবল এই অযুহাতে তা কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী হবে!!!!
এবং এই জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এ কোথায় বলা হয় নি যে- ধারা ২ ও ধারা ১১ থেকে সংরক্ষণ তুলে নেয়া হবে!
ফলে, এবার আমাকে বলুন- সিডও সনদ ও কোরআন-সুন্নাহ পরষ্পর পরিপন্থী হতে পারে, কিন্তু সিডও সনদে বাংলাদেশের স্বাক্ষর ও কোরআন-সুন্নাহ কি সাংঘর্ষিক? কিংবা নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ ও কোরআন-সুন্নাহ? যতই- এই নারী নীতি ২০১১ এর ১৭.২ ধারায় বলা হোক না কেন: “নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (CEDAW) এর প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।”- এটা দ্বারা ধারা ২ ও ১৬ (ক) বাদ দিয়েই কেবল CEDAW এর প্রচার ও বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে!
শুরুতেই লেখক কর্তৃক উল্লেখিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ এর ২য় ভাগ (নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ লক্ষ্য) এর ১৭.৫ নং লক্ষ্য তথা নীতিটি দেখি: “স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন ধর্মের কোন অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারী স্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইন বিরোধী কোন বক্তব্য প্রদান বা অনুরূপ কাজ বা উদ্যোগ গ্রহণ না করা।”
এই লক্ষ্যটি সম্পর্কে যদিও লেখকের বক্তব্য পরিস্কার নয়, এবং শেষ পর্যন্ত লেখক জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ কে কোরআন পরিপন্থী হিসাবে উল্লেখ করেছেন- আমার কাছে এধরণের আমিনীয় দাবীকে সঠিক মনে হয় না, বরং হাসিনা এণ্ড কোং এর দাবীকেই সঠিক মনে হয়- অর্থাৎ এই উন্নয়ন নীতি ২০১১ মোটেও কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী নয় এবং লেখক উল্লেখিত ১৭.৫ নং নীতি একটু ভালো করে পড়লেই আশা করি বুঝতে পারবেন। “কোন ধর্মের কোন অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারী স্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইন বিরোধী কোন বক্তব্য প্রদান বা অনুরূপ কাজ বা উদ্যোগ গ্রহণ করা যাবে না। খেয়াল করবেন কিন্তু। কোন ধর্মের কোন অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারী স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করা যাবে না- এই বাক্যটি দ্বারা আসলে কি বুঝায়? ধর্মীয় অনুশাসনের সঠিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারী স্বার্থের পরিপন্থী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে তাহলে? নাকি- এই নীতিমালা প্রণেতারা মনে করেন যে- ধর্মীয় অনুশাসনের সঠিক মোতাবেক যে ব্যবস্থাই নেয়া হোক না কেন- তা-ই হয়ে যাবে নারী স্বার্থানুযায়ী?
এমন করে- এই আলোচ্য লক্ষ (১৭.৫) হয়ে উঠেছে কোরআন-সুন্নাহরই পরিপূরক; এমনকি সম্প্রতি ফতোয়া নিষিদ্ধ করে হাইকোর্টের যে রায়- সেটারো ধারে কাছে যেতে পারে নি উক্ত ধারাটি! অথচ, সদিচ্ছা থাকলে ধারাটি এমন হতে পারতো: “নারীর স্বার্থের পরিপন্থী ও প্রচলিত আইন বিরোধী যে কোন বক্তব্য প্রদান বা অনুরূপ কাজ বা উদ্যোগ গ্রহণ না করা”।
আরো আলোচনার আগ্রহ থাকলো- দেখি সময়ে কুলায় কি না …. (হরতাল/টরতাল পাইলে ভালা হইতো !!! 🙁 )
===>>> কথাটা সত্য। এবং আমিনীর সামান্য ফু-তেই হাসিনা থেকে শুরু করে মন্ত্রী-মিনিস্টারেরা সবাই জপ করা আরম্ভ করেছেন এই বলে যে, এই উন্নয়ন নীতি ২০১১ এর সাথে কোরআন-সুন্নাহ’র কোন বিরোধ নেই এবং হরতালের আগে ধর্ম মন্ত্রণালয় জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফলাও করে সেটার জানান দেয়; তখনই বুঝা যাওয়া উচিৎ- এই জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ আসলে কি জিনিস?
যে ৪.১ অনুচ্ছেদ প্রথম ভাগ নিয়ে এত কথাবার্তা- সেটা আসলে কিছুই না। শিরোনামটাই কেবল “নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সনদ”! ভেতরে আছে- সিডও সনদে বাংলাদেশ কবে কিভাবে স্বাক্ষর করেছে। ফলাও করে বলা হয়েছে- বাংলাদেসগ সিডও সনদে ১ম ১০ স্বাক্ষরকারী দেশের একটা। তো- সেই স্বাক্ষরও বাংলাদেশ করেছে প্রায় এক যুগ আগে। তো? বৈষম্য দূর হয়েছে?
নারীর সমানাধিকার, নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ, রাষ্ট্রের নিকট ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গভেদে সবাই সমান ইত্যাদি কথাবার্তা সবই এসেছে ভবিষ্যৎ টার্গেট হিসাবে না- ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে- বাংলাদেশের আইনে- বাংলাদেশের সংবিধানে এগুলো গৃহিত নীতি হিসাবে বিবেচিত – এ হিসাবে! সংবিধানের ২৭, ২৮(১), ২৮(২), ২৮(৩), ২৮(৪), ২৯(১), ২৯(২), ৬৫(৩) এইসব অনুচ্ছেদ তো ১৯৭২ থেকেই বিদ্যমান। ফলে- এগুলোর কেবল উল্লেখ কি যথেষ্ট? নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এ এর বাইরে কিছুই নাই!
আমার যেটা মনে হয়েছে- নারীর অবস্থা যা ছিল তাই থাকবে। এটা কেবল বিদেশী দাতাগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করার একটা কৌশল মাত্র। এনজিওগুলোরও কিছু চাপ থাকতে পারে। নারীর ক্ষমতায়ন- কর্মসংস্থান- বিত্তহীন নারীদের জন্য অমুক-তমুক গালগল্প যেগুলো এনজিওগুলোর পেপারসে সচরাচর দেখা যায়- এই উন্নয়ন নীতি ২০১১ এ পাবেন। এসবও নতুন কিছু নয়।
নারীর সম-অধিকার আল্লাহরই ইচ্ছা। আল্লাহ মৌলবাদীদের পছন্দ করেন না। এমন কি কোরানভিত্তিক মৌলবাদীদেরও না। আল্লাহ চৌদ্দশ বছর আগে লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছেন এমনটা ভাবা ঠিক না। মানবতাবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, এইসব ধারণার কোনোটারই অস্তিত্ব আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া সম্ভব ছিল কী? সকলে নফসের কথা মেনে চলুন। নফসই প্রকৃত কোরান।
@রূপম (ধ্রুব), 😀
শুরুতেই কয়েকটি উদাহরণ দেইঃ
১) বাংলাদেশী ও পাকিস্তানীরা মনে করে সৌদি আরব নবীরাসুলের দেশ তাই সেখানে ইসলাম নিশ্চয়ই সুপ্রতিষ্ঠিত, আসলেই ইসলামের আইনকানুনগুলো সুপ্রতিষ্ঠিত তবে, সৌদিরা ব্যক্তিপর্যায়ে সেই ইসলামিক আইনকানুনের প্রায় কিছুই মানেনা। আর বাঙ্গালি ও পাকিস্তানীরা মুসলিম কি মুসলিম না, এব্যাপারে সৌদিদের তেমন মাথাব্যথা নেই, বাঙালি ও পাকিস্তানী শ্রমিকেরা কাজ করলেই তারা সন্তুষ্ট ।
যেমনঃ মদ্য পান করার জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে, তা সাধারণ জনগণের ওপর খাটানো হয়, কিন্তু সৌদি রাজপুত্র খেলে কিছু হয়না, আবার সাধারণ জনগণও ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে ঠিকই খায়।
হজ্বের পয়সা দিয়ে হজ্বের পর সৌদি রাজপরিবার ও ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা ইউরোপ আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ নারীদের সঙ্গে বার ক্যাসিনো ও হোটেলে রাত্রিযাপন করেন । তাই সৌদি আরবে বাইরে ইসলাম চললেও ভেতরে চলেনা।
২) বাংলাদেশীরা পাকিস্তানী মুসলিমকে মুসলিম মনে করেনা, কেননা বাংলাদেশীদের বিশ্বাস, এক মুসলিম আরেক মুসলিম ভাইকে মারতে পারেনা, আরও মনে করে, মৌলবাদ ইসলামবিরোধী, কোরানে কোন নারীবিদ্বেষী ধর্মবিদ্বেষী আয়াত নেই ও থাকতে পারেনা ।
৩) পাকিস্তানীদের এক অংশ বাঙ্গালিদের মুসলমান মনে করেনা কিংবা করলেই মনে করে, বাংলাদেশীরা প্রকৃত মুসলিম নয়, কেননা বাংলাদেশীদের সংস্কৃতির অনেকটা অংশ এসেছে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি থেকে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে, হিন্দু জমিদার থেকে আর বখতিয়ার খলজীর আগে এদেশ সুদীর্ঘ সময়কাল ধরে হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসকদের হাতে ছিল ।
১টি ইসলাম নিয়ে ৩টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের ৩ ধরনের বিশ্বাস বা ধারণা ।
উদাহরণ দেওয়ার কারণ হলো, আমাদের দেশে জনসাধারণের ইসলাম নিয়ে যেই ধারণা, তাতে ইসলাম মানবতার কথা বলে ও তাই ইসলামে নারী বিদ্বেষ থাকতেই পারেনা।
এর পেছনে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি দায়ী, এদেশের মানুষদেরকে লালন ফকিরেরা মুসলমান বানিয়ে গেছে সত্য, কিন্তু শেকড়ের হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে পরিবর্তিত করতে পারেনি। তাই হিন্দু-মুসলিমের সংকর বাংলাদেশীরা কোরান মানে (ইসলামের আবেশে) কিন্তু মৌলবাদ মানেনা (জন্মগত হিন্দুয়ানী কালচারের আবেশে)।
অথচ কোরান অর্থসহ পড়লে বোঝা যায় যে, কোরানে মৌলবাদ মজ্জাগত, কোরানের পরতে পরতে মৌলবাদ ও নারীবিদ্বেষ জাতিবিদ্বেষ অন্যধর্মবিদ্বেষ রয়েছে ।
আমাদের দেশের মানুষেরা কোরান অর্থসহকারে পড়েনা,লোকমুখে শোনা গল্পে দাবী করে কোরানে এই আছে ঐ আছে ইত্যাদি।আবার ১ম-১০ শ্রেণী পর্যন্ত ইসলাম শিক্ষা পড়ে যে বিচ্ছিন্ন ও সামান্যজ্ঞান লাভ করে তাতেই দাবী করে যে তারা কোরান পুরোপুরি পড়েছে।
তাই, আওয়ামী লীগ পড়েছে এখন বেকায়দায়।এই সরকার কিছুটা হলেও মুক্তবুদ্ধিকে প্রশ্রয় দেয়, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীলতার পক্ষে। তাই তারা মনে করে যে কোরানে নারীবিদ্বেষী আয়াত থাকার কোন সুযোগ নেই (তাদের এ ধারণা ভুল, কোরান চরম নারীবিদ্বেষী),আওয়ামী লীগের এই ধারণাকে খারাপ বলা যায়না, কেননা তারা প্রগতিশীলতায় কিছুটা হলেও বিশ্বাস করে,যদিও তারা পুরোপুরি মুক্তচিন্তার নয় বলে, ব্যাপারটিকে এভাবে দেখে যে,আল্লাহ ন্যায়বিচারক হলে অসমান কিছু অবশ্যই করতে পারেন না (অথচ আল্লাহর কোরানে অসমানের কথাই বলা হয়েছে)। তাই আওয়ামী লীগ সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলে যে, কোরান বিরোধী আইন করা হয়নি । প্রকৃতপক্ষেই তা হয়নি বলতে গেলে, কারণ নারীনীতিতে ভাষাগত সামান্য কিছু ব্যাপার আছে যাকে নিয়ে এই ধর্মবাদী দলগুলো ইস্যু বানাচ্ছে।
আর মোল্লা আমিনী কামিনী যামিনীরা যতই অশিক্ষিত হোক, কোরান যে নারীকে সম-অধিকার দেয়নি, এটা তারা জানে এবং আমিনী কামিনীরাই এক্ষেত্রে সঠিক । তাই তারা হাউ কাউ করে আন্দোলন ও হরতাল করে। তাদের জানা সঠিক, কিন্তু নারী পুরুষ সমান অধিকারই যুক্তিযুক্ত, তাই আমিনীদের জানাটা সঠিক হলেও যুক্তির বিচারে এই হরতাল অন্যায় ।
আমাদের দেশে এই সত্য কথাটা কেউ বলেনা, সবাই কোরান ও নারীর সমান অধিকারের মধ্যে এক ধরনের জগাখিচুড়িময় সামঞ্জস্য বা মিলমিশ করে চলতে চায়।
আওয়ামী লীগ কোরানকে রাখতেও চায়,আবার নারীর সমান অধিকারও চায়,অথচ দুটি পরস্পরবিরোধী।
আওয়ামী যদি সরাসরি বলে যে, আমরা নারীকে সমান অধিকার দিতে চাই তাহলে এদেশে তারা ভোট হারাবে। (যদিও এটাই যুক্তিযুক্ত)
আর আওয়ামী যদি বলে যে, নারীদের সমান অধিকার দেবনা, তাহলে আওয়ামীর শুভাকাঙ্ক্ষী বুদ্ধিজীবী সমাজ অসন্তুষ্ট হবে ।
তাই আওয়ামীর সামনে কোরান ও নারীর সমান অধিকারের মধ্যে মোটামুটি মিলমিশ ঘটিয়ে সমঝোতাপূর্বক অবস্থান নেওয়া ব্যতীত অন্য রাস্তা খোলা নেই।
@ডঃ মুশফিক,
সারমর্মঃ
আওয়ামী লীগ জন্মগতভাবে মুসলিম = তাই ইসলামবিরোধী কোনকিছু তারা করতে চায়না, এর প্রমাণ সংবিধানে কোর্টের রায়কে তোয়াক্কা না করে জিয়াউর রহমানের এক আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসকে অপরিবর্তিত রেখেছে ।
আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন = এটিকে বিএনপি অসৎভাবে বর্ণনা করে বলে, আওয়ামী আসলে দেশ ভারত নিয়ে যাবে, ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৮-২০১১ পর্যন্ত দেশ ভারত নেয়নি, এ থেকেই প্রমাণিত হয় খালেদা জিয়ার দাবী মিথ্যা ও মানুষের ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি ফায়দা লোটার চেষ্টা করে।
আওয়ামী লীগ কিছুটা মুক্তমনের চর্চা ও প্রগতিশীলতার পক্ষে = এর পেছনে হাজার বছরের মজ্জাগত বাঙ্গালি সংস্কৃতির প্রভাব আছে, ইসলামপন্থী পাকিস্তান বিদ্বেষের প্রভাব আছে আবার ভারতের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কিছু অবদান আছে ।
তাই আওয়ামী লীগ মুসলমান(বদ্ধমনা)+অসাম্প্রদায়িক(মুক্তমনা) এর মিশ্রণ।
এই কারণে তাকে ২ পক্ষের সঙ্গেই সমঝোতা করে থাকতে হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটিই চলনসই পন্থা। তাই নারীনীতি ২০১১ চমৎকার না হলেও মন্দের ভালো,বিএনপি বা অন্যদলগুলো আসলে তাদের নারীনীতি চরমভাবে নারীর অধিকারের পরিপন্থী হতো।
বাংলাদেশের নারী সমাজের উচিত, নারীর সমানাধিকারের প্রতি সোচ্চার হওয়া, অন্য দলগুলো ক্ষমতায় আসলে নারীর বিন্দুমাত্র উন্নতি হবেনা, কারণ বিএনপিসহ অন্যদলগুলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রচলন করবে,যা নারী উন্নয়নকে মারাত্মকভাবে ব্যহত করবে।
তাই বাংলাদেশের নারীসমাজ যদি তার উন্নয়ন চায়, তার ন্যায্য অধিকার চায়, তবে যে রাজনৈতিক দল নারীর সমান অধিকারের পক্ষে কিছুটা হলেও কথা বলে, সেই দলের প্রতি সমর্থন জানানো উচিত আর আমিনী কামিনীদের হরতাল যাতে ভবিষ্যতে সফল না হতে পারে তার জন্য নারীসমাজেরই মানববন্ধন বা অন্যান্য আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবী জানানো উচিত, যাতে আমিনীকামিনীদের প্রতিরোধে সরকার চুপ না থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। আন্দোলন জোরদার হলে সরকার তখন শক্ত ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, সুতরাং এই অর্ধেক জনসংখ্যা যদি সোচ্চার হয় তো, সরকারের অনেক সুবিধা হবে আমিনী কামিনীদের দমন করতে।
@ডঃ মুশফিক,
লালন ফকিররা ধর্মান্তর করে না বলেই জানি। আরব থেকে আগত বণিক আর সুফি দরবেশরা ধর্মান্তরে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের সাথে হয়তো লালন ফকিরদের গুলাচ্ছেন।
@রূপম (ধ্রুব),
লালন ফকির জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও সিরাজ সাঁই নামের একজন মুসলমান বাউল তাকে আশ্রয় দেন ও সুস্থ করে তোলেন। লালনের কবিতায় পাওয়া যায়,
বস্তুত, লালন ফকির অসাম্প্রদায়িক ছিলেন,তবে বর্ণবাদী হিন্দু ব্রাক্ষ্মণদের অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হয়ে নিম্নবর্ণ শূদ্র জনগোষ্ঠী দলে দলে বাউল-সুফীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে । তাই বাউলদের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িকতা ও সুফীদের গোঁড়ামিবর্জিত ইসলামিক অসাম্প্রদায়িকতা-দুটোই মানুষকে শূদ্র থেকে মুসলমান হতে প্রভাবিত করে।
সেই অর্থে বলা হয়েছে। বাউলরা যে ধর্ম পরিবর্তনের দীক্ষা নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, এমন দাবী করিনি।
আর লালন তো একা বাঊল নন,উনি ছাড়া আরো ছিলেন সিরাজ সাঁই, পাঞ্জু সাঁই, পাগলা কানাই, শাহ আব্দুল করিম, শেখ মদন, দুদ্দু সাঁই, পূর্ণদাস বাউল, যার বেশিরভাগই মুসলিম।
তবে আমাদের মূলকথা এখানে বাউলরা নন, আমাদের মূলকথা নারীনীতি ও হাসিনা-আমিনীদের অবস্থান। একটি গৌণ বিষয় নিয়ে বাক্যের সামান্য অস্পষ্টতাকে কেন্দ্র করে মূল বিষয় থেকে দূরে অন্য বিষয়ের অবতারণা না করে যদি নারীনীতি ২০১১ নিয়ে কিছু বলেন, তাহলে আমরা সকলে কৃতার্থ হই।
ধন্যবাদ । 🙂
@ডঃ মুশফিক,
==>> এই বাউলদের বেশীরভাগ মুসলমান – বা লালনের গুরু সিরাজ সাঁই মুসলমান- এটা বলার মধ্য দিয়ে কি বলতে চাচ্ছেন? এমনটা কি প্রমানিত হয় যে- তারা এদেশের মানুষকে মুসলমান বানিয়ে গেছেন বা তারা ধর্মান্তরে ব্যস্ত ছিলেন?
আশ্চর্য! যাদের নাম উল্লেখ করলেন- তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মোল্লা-পুরুতরআ সরাসরি রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল ‘ধর্ম গেল ধর্ম গেল’ এই আশংকায় – আর, আপনি বলছেন লালন ফকিররা এদেশের মানুষদের মুসলমান বানিয়ে গেছেন!!!
===>>> বাউলদের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িকতা কেমন করে মানুষকে শুদ্র থেকে মুসলমান হতে প্রভাবিত করতে পারে? নাকি- ধর্মনিরপেক্ষ/ অসাম্প্রদায়িক বাউলদের দ্বারা মুসলমান হওয়ার চাইতে অসাম্প্রদায়িক হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?
দয়া করে সুফী-দরবেশদের সাথে বাউল সম্প্রদায়রে জড়াবেন না।
===>>> এটা আদতে অসত্য এবং আপত্তিকর। ভুল করেও এমনটা বলা উচিৎ নয় বা বাক্যের এই ধরণের অস্পষ্টতাও কাম্য নয়।
@নাস্তিকের ধর্মকথা,
বাউলদের অনেকেই মুসলমান ছিলেন, তারা ব্যক্তিগতভাবে ধার্মিক না হলেও মানুষ তাদের ধর্মীয় পরিচয় থেকে প্রভাবিত হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় সূফীদের ইসলামিক অসাম্প্রদায়িকতা ও ব্রাক্ষ্মণদের অত্যাচার নির্যাতন নিপীড়ন, ৩ টার নেট ফলাফল, ইসলামের দিকে মানুষের ঝুঁকে পড়া ।
জন্মসূত্রে হিন্দু বাঊলদের ব্যাপারটি এখানে গৌণ কেননা হিন্দু বাউলরা নিজেরাই বর্ণবাদী ব্রাক্ষ্মণদের বিরোধী ছিলেন, আর মুসলমানদের যেমন সূফী ছিল, হিন্দুদের এক্ষেত্রে সূফী জাতীয় কোন ধর্মীয় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ছিলনা ।
লালন ফকিরেরা বলতে এই পুরো সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী বোঝানো হয়েছে, বাউল ও সূফী উভয়কেই ।
@ডঃ মুশফিক,
ভালো বলেছেন। আপনার মন্তব্যের অধিকাংশ বিষয়েই সহমত প্রকাশ করছি।
এই লেখায় কোরানিক অসংগতির পাশাপাশি মূল নীতিমালার অন্য দূর্বল দিকগুলোর আরো ব্যাখ্যা থাকলে ভালো হতো। লেখাটিতে কুরআন, সংবিধান, সিডও সনদ ও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার পারস্পরিক সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো একে একে তুলে ধরাই ছিলো যৌক্তিক। এর অনুপস্থিতি বেশ খানিকটা হতাশ করেছে। (W)
সুতরাং পারিবারিক জীবনে নির্যাতন নারীর জন্য কুরআন অনুসারে বৈধ। নীতিমালাটিতে নির্যাতন রোধকল্পে যে লক্ষ্যমাত্রাগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে তা কুরআনের বৈধতাকে কতটুকু ধারণ করবে তা মোটেই পরিষ্কার নয়। আর যদি কোন প্রকার নির্যাতনই নীতিমালা সহ্য না করে তাহলে তা কুরআন পরিপন্থী হবে বৈকি।
একমত।
কাকে বলা হচ্ছে এটা? এটা কি সরকারি অফিসারদের প্রতি নির্দেশনা?
@রৌরব,
আপনার দেয়া লিংক থেকে নারী উন্নয়ন নীতিটা মোটামুটি পড়লাম। লিংকটার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। লিংক পড়েও অবশ্য বুঝতে পারিনি, কাকে নারী স্বার্থের পরিপন্থী বক্তব্য দিতে নিষেধ করা হচ্ছে।
একমত।
এ নিয়ে নানা রকম জোড়াতালি দে’য়ার চেষ্টা চলছে। আর এ জোড়াতালির বিষয়টি প্রগতিশীলদের তুলনায় ধর্ম ভিত্তিক সংগঠ্নগুলোর চোখে খুব বেশি ধরা পড়েছে, তাই গর্জনটা অন্ধকার দিক থেকেই বেশি….।
প্রচলিত অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কাঠামোর আওতায় যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, মনে হয়, এ ধরণের ভেল্কিবাজি চলতে থাকবে।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আশা করি এ নিয়ে খুব গঠনমূ্লক আলোচনা হবে।
এখানেই রাজনীতি। আমিনীরা সংবিধানে ২৮ (৪) অনুচ্ছেদের ”নারী ও শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকের যে কোন অনগ্রর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।”ইস্যু নিয়ে কথা বলতে সাহস পায় না।
সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ তো স্বাধীনতার পর করা। এ নিয়ে কিছু বলতে গেলে তাদের স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকার বিষয়টি সামনে চলে আসে। কাজেই এ অনুচ্ছেদ নিয়ে টো শব্দটি নেই। আর এ অনুচ্ছেদকে ভিত্তি করে নারী ও শিশুদের জন্য নীতি করা নিয়ে প্রশ্ন করা মানে সংবিধান অবমাননা।
আমিনীদের বিরুদ্ধে সংবিধান অবমাননা ও কোরান হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল বলে কোরান অবমাননা নিয়ে মামলা করা উচিত।