৩১ রানে শচীনের উইকেট যেতেই যেভাবে গোটা ভারত কেঁদে উঠেছিল, মনে হচ্ছিল পাড়াতে কলেরা এসেছে। ক্যামেরাতে তখন ভারতের ধনীশ্রেষ্ঠ মুকেশ আম্বানীর কান্না -আমি একটু অবাক। শ্রীলঙ্কার বোলিং বেশ সাদামাটা। মালিঙ্গা মোটে ও হোল্ডিং বা আক্রামের জাতের বোলার না-যে দেখে খেললে-তাকে খেলতে এই ব্যাটিং লাইন আপের কোন অসুবিধা হবে। একটু আন্ডারআর্ম একশনে উইকেট টু উইকেট জোরে বল করে। শচীন মোটেও ক্রিকেটোচিত শট খেলে আউট হয় নি- ব্যাটের ব্লেড ওপেন করে বেশ বাজে ডিফেন্সিভ শট নিতে গিয়ে আউট। এই বোলিং দেখে ভিরমি খেলে, ১৯৮৩ এর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মার্শাল, হোল্ডিং, গার্নার এবং রবার্টসকে লর্ডসের গ্রীষ্মের সুইং আবহে খেলতে হলে কি হত? যদ্দুর স্মৃতির দরজা খুলে দেখি, তখন এই চারজন মূর্তিমান বিভীষিকার মধ্যে রবার্টসকেই একটু তাও খেলা যেত-তবে সেই এন্ডি রবার্টস আজকের ম্যালিঙ্গার থেকেও বড় বোলার। বাকি মার্শাল, হোল্ডিং আর গার্নারের কথা ছেরে দিলাম।
১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল আমার দেখা টিভিতে প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ। অনেক দূরে গ্রামে ছিল আমাদের বাড়ি। রেডিওতে শুনে আর খবরের কাগজ পড়ে, মহিন্দার অমরনাথ, কপিলদের নিয়ে উদ্বেলিত হচ্ছিল মন। কিন্ত তখনত এখনকার মতন টিভি ছিল না -কেবল চ্যানেলও ছিল না। দূরদর্শনের ভি এইচ এফ ট্রান্সমিশন সার। সেই ১৯৮৩ সালে দূরদর্শনের কোন রিলে স্টেশন ছিল না-কোলকাতা থেকেই ট্রান্সমিশন হত-৮০ কিলোমিটারের বাইরে কোন ঠিক ঠাক ছবিই আসত না । ফাইনাল টিভিতে দেখব বলে কৃষ্ণ নগরে জেঠুর বাড়িতে গেলাম। তখন জেঠু জাপান থেকে একটা সদ্য সোনির সেট নিয়ে এসেছিল। তাও ভাল দেখা যাচ্ছিল না । তখন টিভির ওপর রেডিও চাপিয়ে খেলা দেখতে হত-কারন বলটা ভাল দেখা যেত না । মনে আছে খেলা শুরু হতে হতেই সানি তার গ্লাভস খুলে প্যাভেলিয়ানে ফিরে আসলেন, মার্শালের বলে পরাস্ত। তখনও ভারতে ক্রীকেট যুগধর্ম হয়ে ওঠেনি-সবাই এত ক্রিকেট বুঝতো না সেকালে। তবে এটা বিলক্ষণ মনে আছে-সে খেলা ছিল বোলারদের। হোল্ডিং প্রায় সব বলেই মুর্গী করছিলেন শ্রীকান্তকে-আর যেটা ব্যাটে লাগছিল ওই বীভৎস পেসে-সেটা চার। এইভাবে খেলা হচ্ছিল ফাইনালে। একমাত্র মহিন্দার অমরনাথ ঐ পেসটা খেলতে পারতেন। বাকিরা বেশ চাপমুক্ত হয়েই খেলছিলেন-কারন ওই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ভারতের টিমটা ছিল দুগ্ধপোষ্য শিশু। আমার এখনো মনে আছে মদনলালের বোলিং- গতি নেই – কিন্ত সুইং মারাত্মক। ক্লাইভ লয়েড আউট হতে -ওকে আর কেও খেলতে পারল না ।
এর পরেরটা ইতিহাস। ১৯৮৩ সালে ভারতের জয় ক্রিকেট খেলাটাকেই বদলে দেয়-কারন গোটা ভারতের কিশোররা ক্রিকেট নিয়ে মেতে ওঠে। ১৯৮৩ সালে আমার বয়স দশ। তখন ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবলটাই খেলা হত বেশী-ক্রিকেট সেইভাবে কেও বুঝত না। ওই একটা বিজয় সব বদলে দেয়। টিভির প্রসারও হয়েছে ভারতে সেই ৮৩ সালের বিজয়কে কেন্দ্র করেই। এবং এক বিলিয়ান লোকের বাজারে এসে ক্রীকেট টাও হয়ে গেছে ভারতীয় ক্রিকেট। ক্যারিবিয়ানদের লাগামহীন পেস বা ক্যালিপসো ব্যাটিং না – ব্যাটিং পিচে ব্যাটসমানদের তান্ডব হয়ে ওঠে ক্রিকেটের ট্রেন্ড। তবে তখন সেই দিন ভারত কাগজে কলমে জিতলেও, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ই ছিল বিশ্বসেরা-বা বিশ্ব ত্রাস বলাই ভাল। তারপরেই ভারতে এসে ওরা ভারতকে হারিয়েছিল ৬-০ তে। টেস্টে ৩-০।
তখন টিভি এসে গেছে। ট্রান্সমিশন রিলেও বসে গেছে। সেই সিরিজে ভারতের করুন হাল অনেকবার দেখতে হয়েছে। গাভাসকার এবং অমরনাথ ছাড়া মার্শাল আর হোল্ডিংকে কেও খেলতেই পারত না । তবে দুঃখ করার কিছুই নেই। লয়েডের সেই টিমটা ছিল বিশ্বের সর্বকালের সেরা ক্রিকেট টিম। আজকে মালিঙ্গার বলে ভারতের প্রথমে এই করুণ হাল হওয়াতে একটু হাঁসছিলাম। সন্দেহাতীত ভাবেই ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ আজ বিশ্বসেরা। ধোনি ত মনে হচ্ছিল ডাঙ্গুলি খেলছিল। গম্ভীর একটু ধরে খেলতেই, শ্রীলঙ্কার বোলিং নির্বিষ। বহুদিন থেকেই ব্যাটিং এ গভীরতা ভারতের। যবে থেকে শচীন সৌরভ দ্রাভিদরা খেলেছে-বিগত দুই দশক ধরেই ভারতের ব্যাটিং গভীরতা এবং প্রতিভা অনেক বেশী। তারপরেও আমি লিখতে বাধ্য, ১৯৮৩ তে মার্শাল, হোল্ডিং বা গার্নারকে খেলার মতন প্রতিভা এই টিমে তেন্ডুলকার ছাড়া আর কারো নেই। রিয়াজ বা মালিঙ্গার সামনে যে ব্যাটিং কেঁপে যাচ্ছে, তারা হোল্ডিং বা গার্নারের বিরুদ্ধে খুব বেশী কিছু করতে পারত বলে মনে করি না ।
তবে সবই ইতিহাস। আজকের বিশ্বে কোন জোয়েল গার্নার বা মাইকেল হোল্ডিং নেই। রিচার্ড হেডলি বা ইমরান খানও নেই। লাস্ট মোহিকান্ত- আক্রাম বা ম্যাকগ্রাথরাও এখন অতীত। সাধারান মানের বোলিং এর বিরুদ্ধে ব্যাটসম্যানদের তান্ডব-এটা হচ্ছে বর্তমানকালের ক্রিকেট। ওয়াহাব রিয়াজকে সেমিফাইন্যালে দেখে রিচার্ড হ্যাডলির কথা মনে পড়ছিল। শুনেছি ছেলেটাকে ওয়াকার ইউনুস নিজের হাতে তৈরী করেছে। আমি এবার খুব অল্প ম্যাচ দেখেছি-কিন্ত ওই রিয়াজের স্পেলটা ছাড়া কোন বোলিং চোখে পড়ে নি-যা উল্লেখ করার মতন। যদি কেও জিজ্ঞেস করেন হোল্ডিং কি রকম বল করতেন ১৯৮৩ তে-তাহলে রিয়াজের স্পেলটাকে দেখতে বলব। ওই রকম সুইং এর ওপর কন্ট্রোল এবং আরো জোরে বল।
তবে বর্তমানের এই বোলারহীন বিশ্বে ভারত সত্যিকার অর্থের চ্যাম্পিয়ান। ২০১১ এর জয়- সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ান টিমের জয় । ভারত এখন টেস্টেও এক নাম্বারে। এই ব্যাটিং লাইন আপ থামাতে ৮৩ এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা ম্যাকগ্রাথ শেন ওয়ার্ন জুটি বা ইমরান আ ক্রাম আব্দুল কাদির জুটি লাগবে। ইমরান খান বহুদিন আগে লিখেছিলেন- আজকের দিনে ব্যাটসম্যানদের ত আর মার্শাল হোল্ডিং হ্যাডলিদের খেলতে হয় না -ফলে চারিদিকে ব্যাটিং প্রতিভার ছড়াছরি। এই বিশ্বকাপে সেটাই ভীষন ভাবে প্রকট। ভাল বোলার নেই- তাই আজকাল ক্রিকেট দেখি না খুব বেশী। ক্রিকেটটা ক্রমশ বেসবল হয়ে যাচ্ছে। বোলিং হারিয়ে গেলে, ক্রীকেটের শিল্পটাই হারিয়ে যাবে। ভারত জিতল। আমি খুশী। কিন্ত ক্রিকেট থেকে যেভাবে বোলিং শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে-তাতে দুঃখও পাচ্ছি। নইলে দেড়খানা বোলারের টিম শ্রীলঙ্কা ফাইনালে উঠল কি ভাবে?
বিপ্লবদার বানান হইলো আর্ষ প্রয়োগ!
:-Y
শচীন অন্তত কাপটা পেল এটাই এই বিশ্বকাপের পাওয়া। ক্রিকেটকে সে যা দিয়েছে তার একটা কাপ না পাওয়াটা খুব বেদনাদায়ক হতো।
কথা গুলো একটু পরষ্পর বিরোধী মনে হচ্ছে। পেস টা যদি শুধু একা অমরনাথ ভাল খেলেন বাকিরা চাপ মুক্ত হয়ে খেলবেন কি ভাবে?
@রাজেশ তালুকদার,
তাদের ওপর চাপ ছিল না। কপিল কালকেও ইন্টারভিউ দিয়েছেন এই নিয়ে-সবাই চাপমুক্ত ছিল-বিন্দাস।
ক্রিকেট দেখা শুরু করি ১৯৯৬ সালের শ্রীলংকার জয় দিয়ে… তাই ৮৩ এর ইন্ডিয়ার অবস্থান জানতে পেরে ভাল লাগলো।
আমি নিজে ছোটবেলায় বোলার ছিলাম।তাই ব্যাটিং নির্ভর ক্রিকেটে বোলারদের কষ্টটা একটু বেশিই অনুভব করি। ছোটবেলায় এমন অনেক খেলা দেখেছি যেখানে শেষ ওভারে ৬ বলে ৫ রান লাগে-হাতে ৪ উইকেট- এমন ম্যাচও ফিল্ডিং টিমকে জিততে দেখেছি।এখন যদি এমন পরিস্থিতি আসে তাহলে বোধ হয় বোলিং শুরুর আগেই বোলার ধরে নেবে সে হারতে যাচ্ছে!
@নিটোল,
আমার ও সেই অবস্থা। আমি বোলিং ওপেন করতাম। ব্যাট করতাম ১১ নাম্বারে। তাই দুঃখের সীমা নেই।
ভারতকে অভিনন্দন। শুরু থেকেই এই ট্যুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট ছিল তারা। পুরো প্রতিযোগিতাতে অসাধারণ খেলে সেটার যথার্থতা প্রমাণও করেছে। সেরা দলটিই এবার কাপ জিতেছে।
শ্রীলংকারতো তবু দেড়খান বোলার ছিল। ভারতের তাও ছিল না। তারপরেও কাপটা গেল তাদেরই ঘরে। ওয়ানডে ক্রিকেট এখন ব্যাটসম্যানদের রামরাজত্ব, তারাই গর্ভজাত পুত্র। বোলাররা এখানে সুবিধাবঞ্চিত, সৎপুত্র। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অসহায়ভাবে মার খাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই তাদের।
@ফরিদ আহমেদ,
ভাজ্জিকে একখানা ধরা যায়-বাকি সব শুন্যই পাবে। আশিস নেহেরার প্রতিভা ছিল-কিন্ত সে সর্বদা চোট পেয়ে মাঠের বাইরে থাকে। বাকি মুনাফ প্যাটেল বা জাহির সাধারন মানের ব্যাটসম্যানদের জন্যে ত্রাস কিন্ত জয়বর্ধনের মতন ক্লাস প্লেয়ারদের বিরুদ্ধে কিছু করার মতন না।
এই ব্যাটিং নির্ভর ক্রিকেট- যে ক্রিকেট আমরা জানতাম তার থেকে অনেক আলাদা। এখন বোলার উইকেট পাওয়ার জন্যে বল করে না-মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্যে বল করে। এইসব কি আর দেখতে ভাল লাগে।
ভারতকে অভিনন্দন,যোগ্য দল হিসেবেই বিশ্বকাপ জিতলো এবং শচীন তার পুরষ্কার পেল, যা না পেলে কষ্টই পেতাম।
আজকাল ক্রিকেট দেখতে উৎসাহ পাই না।১০-১৫ বছর আগেও ২১০ রান করলেই চরম প্রতিযোগীতা দেখা যেত।খেলোয়াড়গুলোও মানুষের মত খেলতো কিন্তু ইদানিং দেখে মনে হয় সফটওয়্যার খেলছে।তার উপর পাওয়ার প্লে,হেন-তেন করে খেলাটা সম্পূর্ণ ব্যাটসম্যানদের হয়ে গেছে!
অবশ্য আমি নিজেকেই দোষ দেই ভেবে যে বোধহয় এটা আমারই নষ্টালজিয়া কিন্তু আপনার মোহমুক্ত লেখার মাঝেও বর্তমানের “ট্রেন্ড”টার প্রতি অভক্তি দেখে মনে হচ্ছে পুরোটাই আমার দোষ নয় সত্যিই মান নষ্ট হয়েছে।
@অসামাজিক,
ভাল বোলিং ছাড়া উন্নত মানের ক্রিকেট সম্ভব না। ভারত বাংলাদেশের ম্যাচটা এবার বিশ্বকাপে আমার দেখা প্রথম ম্যাচ। সম্পূর্ন ব্যাটং উইকেটে খেলা হচ্ছে। বাংলাদেশেও কোন বোলার নেই, ভারতের বোলারদের ও করুন অবস্থা দেখলাম। এইভাবে কি ক্রিকেট হয়। ওই খেলাটা দেখতে দেখতে উঠে আসি। মনে হচ্ছিল ছেলে খেলা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার এই টিমটাই মালিঙ্গা ছারা বোলার নেই। মুরালী ভারতের মাটিতে ভারতের বিরুদ্ধে অকেজো। কোন বোলার কত বড়, সেটা দেখতে ভারতের বিরুদ্ধে ভারতের মাটিতে পরিসংখ্যান দেখুন। তাহলে দেখবেন হোল্ডিং মার্শাল আক্রাম বা কাদির এদের থেকে অনেক বড় বোলার ছিলেন।
একটা মাত্র বোলার নিয়ে যখন ফাইনালে ওঠা যায়-তখন প্রতিযোগিতার মান নিয়ে সংশয় হয়। ৮৩ তে কপিল এবং মদনলাল-দুজনেই খুব ভাল বল করেছিল-রজার বিনি বা মহিন্দারের স্লো সুইংও কার্যকরী বল ছিল। পাকিস্থানের বিরুদ্ধে নেহেরাই সেই অর্থেই সত্যি ভাল বল করেছে। মুনাফের ধারাবাহিকতা নেই। আর স্লগ ওভারে জাহির নিজেও জানে না ওর কোন বলটা ফুলটস হবে বা রিভার্স সুইং করবে।
@বিপ্লব পাল,
ক্রিকেট নিয়ে ভিন্নমাত্রার লেখায় জাঁঝা। (Y)
ভাল বিশ্লেষণ। তবে
তেমনি বানান ভুলেরও ছড়াছড়ি।বানানগুলো শুদ্ধ করে দিলে পড়তে দৃষ্টি মধুর হবে।
@গীতা দাস, :lotpot:
ব্যাপারটা এই ভাবে চিন্তা করি নাই।
@আসরাফ,
২৫ বছর আগে ক্রিকেট এভাবে খেলা হত না। এখন যেমন শুধু বাংলাদেশই ১০০ রানের কমে বান্ডল হয়, তখন ওই ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেস ব্যাটারির সামনে পৃথিবীর যেকোন টিমই ওই ভাবে ৫০-৬০ রানে গুটিয়ে যেতে পারত।
বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমকে খুব দুর্বল বলেই মনে হল [ ভারতের বিরুদ্ধে শুধু একটা ম্যাচ দেখেছি] ।
শ্রীলঙ্কা উঠে এল, বাংলাদেশ কেন উঠতে পারল না, সেটা বিশ্লেষন করা দরকার। আমার ধারনা এর মূল কারন, বাংলাদেশে ফাস্ট ঘাসের পিচে না খেলে ব্যাটিং প্রতিভা খোঁজা। এতে যারা ব্যাটিং প্রতিভা না, তারাও প্রতিভা হয়ে দেখা দেয়-আর ভাল বোলার ও তৈরী হয় না।