(প্রথম পর্ব) , (দ্বিতীয় পর্ব) , (তৃতীয় পর্ব) , (চতুর্থ পর্ব) , (পঞ্চম পর্ব) , (ষষ্ঠ পর্ব) , (সপ্তম পর্ব), (অষ্টম পর্ব)
পঁচিশে মার্চের রাতে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রোডের সেই ঘটনাবহুল বাড়িটিতে বসে শেখ মুজিব কাকে কি বলেছিলেন তা নিয়ে অনেক রকমের কথা শোনা যায়। সবাই সবকিছু নিজ কানে শুনেছেন বা স্বচক্ষে দেখেছেন বলে দাবী করেন, যদিও একজনের কথার সাথে আরকেজনের ভাষ্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে শেখ মুজিব যে তাঁর সহকর্মীদের সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলেছিলেন এবং নিজে গ্রেফতার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন তা নিয়ে সন্দেহে থাকার কোন অবকাশ নেই।
আমি নিশ্চিত আওয়ামী লীগের নেতাদের কোন ধারণাই ছিল না, মিলিটারি সে রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে জঘন্য, পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ শুরু করবে ঢাকায়। তখনকার আওয়ামী লীগের মতো একটা দলের ইন্টেলিজেন্স যে এতো দূর্বল হতে পারে জেনে বিস্মিত হতে হয়। সে রাতে ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ত্যাগের খবরটাও নাকি আওয়ামী লীগ নেতারা জানতেন না। রাত এগারোটার দিকে তাঁদেরকে এই খবরটা জানিয়েছিলেন তেজগাঁ এয়ারপোর্টে কর্মরত এয়ারফোর্সের বাঙালি অফিসার উইং কম্যান্ডার এ.কে. খন্দকার (পরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ.কে. খন্দকার)।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও যে খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিলেন তা নয়। এমন কি ঝানু সাংবাদিকরাও কিছুই জানতেন না। অনেককে পত্রিকার অফিসেই প্রাণ দিতে হয়েছে।
পাকিস্তানী মিলিটারিও ইন্টেলিজেন্সের বাঙালি অফিসারদের ওপর নির্ভর করতে পারে নি। তাই দেখা যায় শেখ মুজিব আর কামাল হোসেন ছাড়া আওয়ামী লীগের কোন বড় নেতাই ধরা পড়ে নি। তাঁরাও গ্রেফতার এড়াতে চান নি বলেই এমনটি ঘটেছে।
সে রাতে মিলিটারির টার্গেট ছিল, প্রথমত, পিলখানায় ইপিআর আর রাজারবাগে পুলিশের ওপর আক্রমণ – উদ্দেশ্য ছিল এদেরকে নিরস্ত্র করা। দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ওপর আক্রমণ। হয়তো তাদের ধারণা ছিল ছাত্রদের হাতে অস্ত্র রয়েছে।
কিন্তু শিক্ষকদের কয়েকজনকে ধরে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক হিংসাপ্রসূত ছিল বলে আমার মনে হয়। শহীদ মিনার ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলাখ্যাত সেই ঐতিহাসিক বটগাছটাকে উপড়ে ফেলার পেছনে মাথামোটা পাকিস্তানী সৈন্যদের কি মোটিভ ছিল আমি ভেবে পাই না। একটা মাত্র কারণ ছাড়া, আর তা হলো এদের উপরস্থ কারো মনে হয়েছে এগুলোকে ধ্বংশ করার মাধ্যমে বাঙালির সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ওপরে উপযুক্ত আঘাত হানা যাবে।
পঁচিশে মার্চের রাতেই আমরা চট্টগ্রামে খবর পেলাম ঢাকার রাস্তায় আর্মি নেমেছে। রেডিও নিস্তব্ধ, সাড়া-শব্দ নেই। মানুষ ভীতবিহবল, সন্ত্রস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই, রাত একটা-দেড়টা নাগাদ, শোনা যেতে থাকলো প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ। বন্দরের দিক থেকে শব্দ আসছে মনে হচ্ছিল। পরে জানা গেলো কামানের গোলা ছোঁড়া হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করা যুদ্ধজাহাজ ‘বাবর’ থেকে। ভাগ্যক্রমে সে রাতটা আমরা নিরাপদেই ছিলাম। সকাল (ছাব্বিশে মার্চ) হতেই বেরিয়ে পরলাম রাস্তায়।
শহরের বড় বড় দোকান, খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইয়ের পাইকারী বাজার, বক্সির বাজার, রিয়াজুদ্দিন বাজার, বিপনিবিতান – সব বন্ধ, কোন রকম ঘোষণা ছাড়াই। পাড়ার ছোট দোকানপাটগুলো আংশিক খোলা রেখে দোকানী কোনরকমে বেচাকেনা চালাচ্ছে। দু’একটা রিকসার গন্তব্যহীন চলাচল, দু’চার জন মানুষের ইতস্তত পদচারণা, তাদের ভীতসন্ত্রস্ত আলাপচারিতা, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভয়ার্ত চাহনি – চিরচেনা চট্টগ্রাম শহরকে একরাতের মধ্যে ভীষণ অপরিচিত করে দিল আমার কাছে।
উৎসুক কয়েকজনকে দেখলাম ক্যন্টনমেন্টের দিকে যেতে, পায়ে হেঁটেই। ওখানে নাকি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমানকে দেখলাম একটা হুড নামানো রিকশায়। মনে হলো এখনো ঠিক বুঝতে পারছেন না পুরোপুরি প্রকাশ্যে আসবেন কিনা – তাঁর ওপরে হুলিয়া (গ্রেফতারি পরোয়ানা) জারী করেছিল সামরিক সরকার।
দুপুরের দিকে চট্টগ্রাম বেতার থেকে শুনতে পেলাম, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, এবং নিরাপদ অবস্থানে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। চট্টগ্রাম বেতার তখন নিজেদের “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র” নামে পরিচয় দিচ্ছিল।
দারুণ উৎকণ্ঠা, সীমাহীন উদ্বেগ আর প্রচন্ড ভয় নিয়ে বাবা-মা ভাই-বোনদের সাথে নির্ঘুম রাত কাটালাম আমরা বাড়িওয়ালার পাকা বাড়ির ড্রয়িং রুমে। আমাদের ভাড়ার বাসাটা ছিল ছাপড়া টাইপের, নিম্নমধ্যবিত্তের মাথা গোঁজার ঠাঁই। এর মধ্যে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন আমার চাচাতো বোন আর তাঁর পরিবার। দুই পরিবারে মিলে আমরা দশজন। আমাদের গ্রাম থেকে আসা কাজের ছেলেটা, আঠারো-ঊনিশ বছর বয়স, কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেল। আমাদের সাথে থাকাটাকে সে আর নিরাপদ ভাবতে পারছিল না।
আমারা চিন্তা করতে লাগলাম কি ভাবে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে যাওয়া যায়।
ছাব্বিশ তারিখ রাতে ইয়াহিয়া খান বেতারে ভাষণ দিলেন। ঢাকার রেডিও স্টেশন ইতোমধ্যে চালু হয়েছে সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে। বললেন, শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ইত্যাদি। চট্টগ্রামে অনেকেই তখনো বিশ্বাস করছিলেন না, শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে (পশ্চিম) পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সাতাশ তারিখের রাতটাও আমরা কাটালাম বাড়িওয়ালার ড্রয়িং রুমে। সে দিনেই মনে হয় দুপুর কিংবা বিকেলের দিকে, জিয়াউর রহমানের গলা শোনা গেল চট্টগ্রামের কালুরঘাটের অস্থায়ী স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে। ইংরেজিতে পড়া হয়েছিল ঘোষণাটা। “আই, মেজর জিয়া,…”। এর পরে থেকে ‘শেখ মুজিব আমাদের সাথে আছেন’, এই কথাটা আর শোনা গেল না।
আটাশ তারিখে আমরা কিছুটা পায়ে হেঁটে, কিছুটা রিক্সায় নৌকার আশায় নদীর ধারে গেলাম। নৌকা পাওয়া গেল, পটিয়া পর্যন্ত যাওয়া যাবে। আমাদের মতো আরো অনেকেই তখন প্রাণভয়ে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে রওনা দিয়েছে। নৌকার মাঝি সন্দেহ করে বসলো আমাদের মধ্যে দু’একজন বিহারী হতে পারে। প্রকাশ্যেই বললো তার সন্দেহের কথা। আমার বড়ভাই, আমারই কাছাকাছি বয়সের, কিছুটা দীর্ঘকায় – আর আমার ভাগ্নী, আমার চাচাতো বোনের মেয়ে, সেও আমারই বয়সের, কিছুটা গৌরবর্ণ – তাতেই মাঝির মনে সন্দেহ পাকাপোক্ত হয়ে গেছে – এরা, বিশেষ করে এই দু’জন বাঙালি নয়; ‘এরা আমাদের লোক নয়’।
চাটগাঁ শহরের কেন্দ্র থেকে নদীর ঘাট, দূরত্ব তিন-চার মাইলের বেশি হবে না। কিন্তু সাংস্কৃতিক দূরত্ব, যার কারণ মূলত অর্থনৈতিক, যে কত বিশাল হতে পারে উপলদ্ধি করে বিস্মিত হলাম। সেদিন সেই ভীতিকর পরিস্থিতিতেও এই ভাবনাটাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। আসলেই তো, আমরা বাঙালি হলেও নৌকার মাঝিদের জাতের (শ্রেণীর) নই, তাতে কি সন্দেহ আছে!
শেষতক বেশি কথা না বাড়িয়ে মাঝি আমাদের নৌকায় তুলে নিল। নৌকা চলতে শুরু করলেই দেখতে পেলাম নদীতে ভাসছে লাশ -বেশ কয়েকটা। হতভাগ্য বিহারীদের। বিনাদোষে মরতে হলো ওদের। শেখ মুজিব সাতই মার্চের ভাষণে এই আশঙ্কা করেছিলেন। বলেছিলেন, আমরা যেন অবাঙালিদের জানমালের ক্ষতি না করি, আমাদের যেন বদনাম না হয়। নেতাসুলভ দিকনির্দেশনা ছিল তাঁর এই সতর্কবাণীতে।
কিন্তু অন্তত চট্টগ্রামে তাঁর এই কথা কোন কাজে আসে নি। আমরা আজো সেই বদনামের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি। শুনেছি, চট্টগ্রামের ইস্পাহানি কলোনিতে বিহারীদের জবাই করে তেলের খালি ড্রামে রক্ত জমা করা হয়েছিল। পরে সেই রক্ত বাঙালি যোদ্ধাদের কাজে লাগবে এই যুক্তিতে। বড় অদ্ভুত আর নৃশংস সেই যুক্তি!
ঘন্টা দুয়েক নৌকায় চলার পরে আমরা পটিয়া পৌঁছলাম। সৌভাগ্যক্রমে একটা মাইক্রোবাস পাওয়া গেল আমাদের গন্তব্য গ্রামে যাওয়ার জন্য। আরাকান রোড ধরে বাস চললো আরো প্রায় ঘন্টা চারেক কক্সবাজারের দিকে। পথে পথে ব্যারিকেড। জয় বাংলা স্লোগানে উচ্চকিত জনপদ, হাটবাজার। লাঠিসোটা নিয়ে তরুণ যুবকরা প্রতিটা গাড়ি থামাচ্ছে আর চেক করছে। কারো কারো হাতে একনলা-দোনলা বন্দুকও দেখা গেল। অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের গ্রাম হারবাং-এ। আরো আটমাইল আগে চুনতি-তে নেমে গেলেন আমার চাচাতো বোন আর তার পরিবার।
এই সেই হারবাং, আমার প্রিয় গ্রাম, যেখানে কেটেছে আমার শৈশব, কৈশোর। মায়ের কোলের মতোই মমতাময় স্নিগ্ধতায় ভরা হারবাং। হারবাং-এ পৌঁছে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
আমার মতো তরুণ বয়সের ছেলেরা দেখলাম প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবকিছুই অনিশ্চিত। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বয়স্করা উদ্বিগ্ন। চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাবে, এমন আশঙ্কা করছেন তাঁরা। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রাণভয়ে ভীত। সবকিছু মিলিয়ে একটা থমথমে ভাব।
যে কোন মূহুর্তে আর্মি এসে পড়তে পারে, সবার মনেই এই ভীতি। এপ্রিল মাসের মধ্যেই আর্মি কক্সবাজার শহরের দখল নিয়ে নিল। হারবাং-এর ওপর দিয়েই তাদের যেতে হয়েছে কক্সবাজারে আরাকান রোড ধরে। কিন্তু তারা হারবাং-এ থামে নি। কোন এক অজানা কারণে যুদ্ধের নয়মাসের মধ্যে হারবাং-এ আর্মি একবারও আসে নি। তবুও সবাই প্রকাশ্যে পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়েছে তাদের বাড়িতে, দোকানে, বাজারে। গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি ছাড়া সবাই ছিল স্বাধীনতার পক্ষে।
সাধারণত গ্রামে মানুষে মানুষে পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে বা বজায় থাকে তাতে দেখলাম চিড় ধরেছে। কেউ কারো ওপরে ঠিক আস্থা রাখতে পারছেনা। কেউ হয়তো মুখে বলছেনা কিন্তু ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতার বিপক্ষে, আবার অন্য কেউ হয়তো সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তথ্যটা গোপন রাখছে।
সবচেয়ে বেশি মুস্কিলে পড়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। তাদের পৃথিবী চোখের সামনে যেন হঠাৎ করে বদলে গেল, যাদেরকে মনে হতো আপনজন, সেই বন্ধু-প্রতিবেশীদের ওপরেই আর বিশ্বাস রাখা যাচ্ছে না। তাদের বাড়িঘর, জমিজমা, গরুছাগল, সহায়-সম্পদ, এমন কি স্ত্রী-কন্যারাও রেহাই পাবে বলে মনে হচ্ছে না এদের লোভের থাবা থেকে। তার ওপরে যে কোন মূহুর্তে আর্মির হাতে জীবন যাবার আশঙ্কাতো আছেই।
তবুও যুদ্ধের নয়মাসে দু’একটা বিচ্ছিন্ন চুরির ঘটনা ছাড়া হারবাং গ্রামটা শান্তই ছিল। স্কুল ছাড়া সবকিছুই চলেছে, সীমিত পরিসরে । হাটবাজার, কৃষিকাজ, ধর্মকর্ম চলেছে মন্থর গতিতে, কিন্তু একবারে থেমে যায় নি। আর্মির না আসাটা এর পেছনে একটা বিরাট কারণ। তবুও হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই চুপেচাপে ভারতে পাড়ি দিয়েছিল। আগস্ট মাস পর্যন্ত আমরা হারবাং-এ ছিলাম। আমার অলস কিন্তু অস্থির সময় কাটছিল তখন।
আকাশবাণী আর বিবিসির খবরে জানতে পারলাম, কুষ্টিয়ার ভারতের সীমান্তে বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর নাম দিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে। সতেরই এপ্রিল ঘোষিত হয়েছিল এই সরকার। আওয়ামী লীগের তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্নেল ওসমানী, খোন্দকার মোশতাক, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এঁরাই ছিলেন অস্থায়ী সরকারের মূল নেতৃবৃন্দ। কামাল হোসেনকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আগেই।
আমি যুদ্ধের ভারত-নির্ভর চরিত্রটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। পশ্চিম বাংলার বামপন্থীদের (নক্সাল এবং সিপিএম) ওপর ইন্দিরার কংগ্রেস সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন বাংলাদেশের জনগণের ওপর ইয়াহিয়ার বর্বর পাকসেনাদের আগ্রাসনের চাইতে কোন অংশে কম ছিল না। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি-সংযোগ কোনটাতেই ভারতের সিআরপি (সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ) পাক হানাদারদের চাইতে পিছিয়ে ছিল না। সেই ভারত সরকার আর তার প্রতিভু ইন্দিরা গান্ধীর ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়লো আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। মুজিবনগর যে কোলকাতার থিয়েটার রোডের একটা বাড়িতে আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রও যে কোলকাতাতেই তাতো আর কারো কাছেই অজানা ছিল না।
আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে আমার আস্থা ছিল না। সেই আওয়ামী লীগই এই যুদ্ধের নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগ তখন (একাত্তরে) মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও তা যে মেকি, তা বুঝতে আমার মতো অর্বাচীনেরও কষ্ট হয় নি। ক্ষমতায় গেলে যে আওয়ামী লীগ জনগণের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করবেনা বা করতে পারবেনা তা নিয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না।
হারবাং আর আশেপাশের গ্রামে অবস্থানকারী আমাদের ছাত্র সংগঠনের দু’একজনের সাথে দেখা হলো। তারাও আমার মতো বিভ্রান্ত। কিন্তু দেশকে হানাদারমুক্ত করতেই হবে, এ নিয়ে কোন বিভ্রান্তি কারো মনে ছিল না।
কোলকাতায় অবস্থিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (ততদিনে ‘বিপ্লবী’ শব্দটা খসে পড়েছে) তখন পুরোপুরি চালু। নিয়মিত শুনতাম। এম.আর. আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম। যুদ্ধটা ততদিনে আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকায় প্রায় প্রতিদিন এ নিয়ে খবর-আলোচনা পরিবেশিত হচ্ছে। ভারতের আকাশবাণীতো আছেই। বিশ্ব রাজনীতি আর কূটনীতির অঙ্গনে ঝড় তুলেছিল বাংলাদেশ পরিস্থিতি।
মাত্র ছয় বছর আগেও আমি এই হারবাং-এর প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফাইভের ছাত্র ছিলাম। তাই আমার বয়সের অনেক বন্ধুবান্ধব তখন গ্রামে ছিল। তাদের সাথে আড্ডা মেরে ভালোই সময় কাটছিল আমার। কিছু বইপত্রও যোগাড় করেছিলাম এর-ওর কাছ থেকে। সবচেয়ে বেশি উপভোগ করছিলাম বর্ষার ভরা মওসুমে গ্রামবাংলার প্রকৃতি। হাইস্কুলে পড়ার জন্য শহরে চলে যেতে হয়েছিল, তাই এই সুযোগ থেকে গত ছয় বছর ধরে বঞ্চিত ছিলাম। এই প্রকৃতি আমার চেনা, তবুও ষোল বছরের না-কিশোর না-যুবক হৃদয়ে ভিন্ন এক দ্যোতনা নিয়ে ওই সময়ে ওই প্রকৃতি আমার কাছে মোহময় হয়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশের অন্য আর পাঁচটা গ্রামের মতোই হারবাং। এর অধিকাংশ অধিবাসী ভূমিহীন কৃষক। জমিদারের জমি বর্গায় চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে তারা। অনেকেরই বর্গা নেয়ার মতো সহায়-সম্পদও নেই। গতর খাটে তারা বর্গাদারের ক্ষেতমজুর হয়ে। এদের জীবনে কোন স্বপ্ন নেই। জীবনে যে স্বপ্ন থাকতে হয় তাও এদের জানা নেই। এদের জীবন নিয়ে নিয়তি যে কি নিষ্ঠুর খেলা খেলে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
সেই এরাই একাত্তরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। মুক্তির স্বপ্ন। শুধু হানাদারদের থেকে মুক্তি নয়, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, অভাব থেকে মুক্তি।
তাদের চোখেমুখে আশা আর বিশ্বাস, দেশ স্বাধীন হলে সেই স্বপ্নের মুক্তি এসে ধরা দেবে হাতের মুঠোয়। মুক্তির আকাংখায় উজ্জীবিত গ্রামের কৃষক, দেশ স্বাধীন হলেই তারা পেতে শুরু করবে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য। ওইটুকুই ছিল তাদের চাওয়া। দু’মুঠো ভাত আর এক টুকরো কাপড়ের জন্য মাথা কুটে মরতে হবে না আর। স্বপ্নের ওই মুক্তির জন্য প্রাণ দিতে রাজী ছিল ওরা একাত্তরে।
২৪ মার্চ, ২০১১।
(আগামী পর্বে শেষ)
ধন্যবাদ ইরতিশাদ ভাই,খুব ভাল লেগেছে পড়ে। আচ্ছা শেষ পর্বটি কি এখনো লেখেন নাই নাকি আমি খুজে পাচ্ছি না?
পুরো নয় পর্ব একত্রে পড়লাম। এক কথায় অসাধারণ।
@স্বাধীন,
অনেক ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য। আপনার বিশ্লেষনমুলক মন্তব্য পেলে আরো ভাল লাগবে আমার।
@ইরতিশাদ,
আমাকে তুমি করে বললে খুশি হবো। আমার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পরে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ইতিহাস নির্মোহ ভাবে জানা এক প্রকার অসম্ভব। এই বিকৃতিগুলো যারা করেছে তাদের প্রতি এক প্রকার ঘৃণা পোষণ করি। তাই বিশ্লেষণমুলক মন্তব্য করার যোগ্যতা আমাদের নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি স্বল্প পরিসরে আপনার প্রথম আট পর্বে মুক্তিযুদ্ধের পটভুমির একটি ভালো চিত্র আমি পেয়েছি। আপনি চেষ্টা করেছেন যতটুকু নির্মোহ থাকা যায় থাকার। বাম রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারণে তাদের সেই সময়কার দ্বিধাগুলোও ভালো করে ফুটে উঠেছে। শেখ মুজিব সম্পর্কে বিশ্লেষণেও আমি আপনার সাথে একমত, যে তিনি যেহেতু একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন তাই রাজনীতির মধ্যে থেকে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছেন একটি সমাধান করার তাতে আমি ব্যক্তি মুজিবের কোন দোষ দেখি না। বরং কূটনৈতিক সমাধানে না গিয়ে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেই সেটা অবাক করা ব্যাপার হতো। যুদ্ধ আমাদের উপর চাপানো হয়েছিল, এবং তার জবাব তারা পেয়েছে, এটাই বাস্তবতা।
তবে আপনার কাছে অনুরোধ থাকবে এই সিরিজের পরে যুদ্ধ পরবর্তী চিত্র নিয়ে আরেকটি সিরিজ শুরু করবেন। সেই সময়কার একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ আমাদের নুতন প্রজন্মের প্রয়োজন। যুদ্ধ পরবর্তী মুজিবের শাসন, জিয়া, তাহেরের ঘটনাগুলো, সেই সময়কার বিভিন্ন বিপ্লবগুলো সম্পর্কে আপনার বিশ্লেষণ গুলো জানতে আগ্রহী।
তবে সেটারও পরে বিশেষ করে আমি আপনার কাছ থেকে জানতে চাই বর্তমান বাম আদর্শ নিয়ে আপনার চিন্তা কি? এখনো কি মনে করেন যে মার্ক্সবাদ, কিংবা পিকিং পন্থী বা মস্কোপন্থী রাজনীতি অথবা এই ডানপন্থী কিংবা লিবারেল কিংবা জাতীয়তাবাদ মতবাদ দিয়ে দেশের মানুষের পরিবর্তন সম্ভব কিনা? আমাদের মতো নুতন প্রজন্মের প্রতি আপনার বক্তব্য কি হবে?
@ইরতিশাদ,
আজ প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি লেখা এই প্রসঙ্গে আপনার সাথে শেয়ার করছি। আপনার মতামত পেলে ভালো লাগবে।
জাসদ: না বিপ্লব, না সমাজতন্ত্র
@স্বাধীন,
ধন্যবাদ লিঙ্কটার জন্য। আমার অনেক কিছুই বলার আছে এ নিয়ে। পরে সময় করে বসবো লেখার জন্য। তোমার আগের মন্তব্যেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছ, তবে সময় লাগবে এনিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে লিখতে। চেষ্টা করবো।
@স্বাধীন,
ছাত্র জীবনে জাসদে আকৃষ্ট হয়েছিলাম!
জাসদ করতে যেয়ে অনেক উজ্জল তরুন তরুনীর জীবনের
অপার সম্ভবনা শেষ হয়ে গিয়েছে!
এর মধ্যে আমার স্কুল জীবনের ফার্ষ্ট গার্ল ও আছে!
সোহরাব হাসানের-
এই কথাগুলোর খুবই একমত!
@লাইজু নাহার,
আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যদি পাঠকদের সাথে শেয়ার করতেন আমি নিশ্চিত অনেকেই তার থেকে লাভবান হতো।
আরেকটি ব্যাপার এখানে উল্লেখ্য যে এখনো অনেক তরুন সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্নের পেছনে নিজেদের জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করে যাচ্ছেন। বুয়েটের অনেক মেধাবী ছাত্র সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের রাজনীতির সাথে যুক্ত। আমার নিজের প্রায়ই প্রশ্ন জাগে এরা কি আদৌ জানে যে এরা কিসের পেছনে তাদের জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়গুলো ব্যয় করছে? আমার ইউটোপিয়, বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র লেখাটি তাদের জন্যেই লিখেছিলাম। আমি তাদের এই চেষ্টাকে খাটো না করে শুধু এটাই বলতে চেয়েছিলাম যে যে যাই করুক অন্যের কথায় না চলে নিজে থেকে বুঝে করুক। নিজে জানুক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে, নিজে জানুক সমাজতন্ত্রের ইতিহাস সম্পর্কে, নিজে জানুক নানান বিপ্লব সম্পর্কে, নিজে পড়ুক মার্ক্সের লেখাগুলো, নিজের দেশ সম্পর্কে জানুক, নিজেদের দেশের মানুষ সম্পর্কে জানুক, তারপর নিজ দেশের ক্ষেত্রে যে তন্ত্র প্রযোজ্য মনে হয় সেটা প্রয়োগ করুক। কোন ভিন্ন সময়ের, কোন ভিন্ন দেশের তন্ত্র সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগের চেষ্টা না করুক।
ইরতিশাদ ভাইয়ের সাথেও এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে আগ্রহ জানিয়েছি। আমি কখনো রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম না, তাই মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা নেই। এই ব্যাপারে ইরতিশাদ ভাই বা আপনি হয়তো ধারণা দিতে পারবেন। তাই আপনাদের কথাগুলো শুনতে আগ্রহী। একটি লেখা দিয়ে দিন আপনার চিন্তাগুলো নিয়ে। অগ্রীম ধন্যবাদ রইল।
@স্বাধীন,
অনেক ধন্যবাদ এ বিষয়ে আগ্রহ দেখানোর জন্য!
আমাদের মত দেশগুলোতে স্বাধীনতাউত্তর যে উন্মাদনা তা তরুন সমাজকে
ভাসিয়ে নিয়ে যায় আবেগে স্বপ্নে!
ঠিক তাই ঘটেছিল আমাদের সময়!
ছাত্রসমাজ দেখছিল শোষনের অবসান হয়নি, স্বজনপ্রীতির অবসান হয়নি,
দূর্নীতির অবসান হয়নি!
হয়েছিল শুধু ক্ষমতার হাতবদল!
তাই রব জলিলের ডাকে প্রচন্ড সাড়া দিয়েছিল ছাত্রসমাজ!
এখন মনে হয় তারাও সঠিক জানতেন না তারা ঠিক কি করতে চেয়েছিলেন!
মাঝখান থেকে অনেকগুলো জীবনের ক্ষতি হয়ে গেছে!
এর ভার কারা নেবে!
এই পথে চেষ্টাকরে দেখা যেতে পারে।
তবে সর্বক্ষেত্রে এর শেকড় থাকতেহবে।
বিশেষ করে গ্রামে।জাসদের তা ছিলনা।
ছিলনা সাধারন জনগোষ্ঠির মধ্যে সমর্থন।
সঠিক কর্মসূচীও ছিলনা তাদের!
তারা শুধু ভাল ভাল ছাত্রদের মগজ ধোলাই করত! আর ছিল শ্লোগান!
আমার মনে হয় বাংলাদেশে যে কোন পা্র্টির জন্য ফান্ড একটা ফ্যাক্টর।
আওয়ামী লীগের ফান্ড অতীতেও বুর্জোয়া আর ব্যবসায়ীরা জুগিয়েছে।
চেষ্টা করব এর ওপর কিছু লিখতে!
@লাইজু নাহার,
এই বিষয়টি আমি উল্লেখ করতে গিয়েও করিনি কিছুটা দ্বিধার কারণে। আমি এই বিষয়টাই ঠিক বুঝে পাই না কিভাবে সেটি সম্ভব। মগজ ধোলাই হতে হলে কোন বড় কিছুর প্রত্যাশা থাকতে হয়। ধর্মের ক্ষেত্রে যেমন পাপ/পূণ্য, বেহেস্তের সুখ ইত্যাদীর আকর্ষণ থাকে, এই ক্ষেত্রে কি?
একটি বিষয় দেখবেন বুয়েট/মেডিকেলের অনেক মেধাবী ছাত্রই তাবলীগ করে। যারা তাবলীগ করে তারা বেশ ডেডিকেটেড হয়ে থাকে। তেমনি অনেক মেধাবী ছাত্র ফ্রন্টের সাথে যুক্ত থাকে এবং এরাও বেশ ডেডিকেটেড থাকে। ঠিক কিসের আকর্ষণে তারা যায় সেটা জানার আগ্রহ। মগজ ধোলাই করতে হলেও মাশ মসলা লাগে। এরা মনে হয় পৃথিবীতেই একটি বেহেস্ত তৈরীর স্বপ্ন দেখে। এবং বিশ্বাস করে সেটা সম্ভব মার্ক্সের প্রলাতেরিয়েতের শাসন দ্বারা।
যা হোক আপনার লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
@লাইজু নাহার,
আপনার প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে স্বঠিক। তাই বিস্তারিত কিছু বলার বা লেখার জন্য আমার দিক থেকেও অনুরোধ রইল।
@আফরোজা আলম,
ধন্যবাদ আফরোজা আলম!
চেষ্টা করব!
ধন্যবাদ ইরতিশাদ ভাই| এই লেখাটিও ভাল লেগেছে বরাবরের মতোই| আপনার লেখা তেমন পাই না আজকাল! বেশী বেশী লিখুন, এটা পাঠকের প্রত্যাশা!!!
@ভজন সরকার,
ধন্যবাদ, উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্যের জন্য।
সবকিছু আমরা এক চোখ দিয়ে দেখতে অভ্যস্ত। দুই চোখ দিয়ে দেখতে গেলে, “শ্যাম রাখি না কূল রাখি” এর ঝামেলায় পড়তে হয়। আপনার এই দুই চোখ দিয়ে দেখা, অতীতটাকে যেভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন,তাতে মনে হচ্ছে, অন্ধকার এখনো কিছুটা দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করছে।
@স্বপন মাঝি,
অনেক ধন্যবাদ আপনার সদয় মন্তব্যের জন্য।
@ইরতিশাদ,
খুব ভাল লাগলো লিখাটি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আপনার মত একজন বাম আদর্শের ব্যক্তির জন্য আওয়ামী লীগের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি অনাস্থা থাকাটাই স্বাভাবিক। এতে কোনো বিস্ময় দেখছি না আমি। কিন্তু ,আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে অনাস্থার বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারলাম না। কারণ, আওয়ামী লীগ তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়েই অগ্রসর হচ্ছিল, যার সাথে সমস্ত বাংলাদেশের মানুষই সংশ্লিষ্ট ছিল।
আপনার মত এরকম দূরদর্শিতা মনে হয় খুব কম লোকেরই ছিল সে সময়। দেশ স্বাধীন করার আশু বিষয়টাতেই খুব সম্ভবত মানুষের সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রিভূত ছিল।
@ফরিদ আহমেদ,
অনাস্থাটা বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতেতে নয়, সামগ্রিকভাবে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে। এ নিয়ে আগের কোন একটা পর্বে আমি লিখেছি।
জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ফলশ্রুতিতে মানুষের সামগ্রিক অর্থনৈতিক মুক্তি আসে না, অনাস্থাটা সে কারণেই। আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে অনাস্থার মানে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বা তার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাফল্যকে অস্বীকার করা নয়, তা আমি করছি না।
আমিও তো বলেছি, একাত্তরে মুষ্টিমেয় কিছু বামপন্থী ছাড়া সবাই আওয়ামী লীগের পেছনে ছিল। যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ শেখ মুজিব আর জয়বাংলার নামে যুদ্ধ করেছিল। এটাতো ঐতিহাসিক বাস্তবতা, এই বাস্তবতা প্রসঙ্গে আমি আমার উপলদ্ধি, যা হয়তো অনেকের সাথেই মিলবে না, তাই বলতে চেয়েছি। আশা করি বোঝাতে পেরেছি।
না, আমার শুধু নয়। দূরদর্শিতা সাধারণ ভাবে বামপন্থীদের ছিল, সংগঠন করার মতো কর্মনিষ্ঠতা ছিল না। দুঃখজনক হলেও সত্যি, তাদের ভূমিকা ছিল জ্যোতিষির মতো, ভবিষ্যদবাণী করার ক্ষমতা থাকলেও ভবিষ্যতকে প্রভাবান্বিত করার যোগ্যতা তাদের ছিল না।
আর একটা কথা, দেশ স্বাধীন করার আশু বিষয়টাতো পঁচিশে মার্চ থেকে সবার, মানে সব বাঙ্গালির, জীবনমরণ সমস্যা হয়ে গেল। কিন্তু যুদ্ধটাকে এভাবে বিশ্লেষনের আমি বিরোধী – আমি মনে করি, যুদ্ধের পটভূমিটাকে ঠিকমতো বুঝতে না পারলে একে আমাদের গৃহযুদ্ধই মনে হবে, মুক্তিযুদ্ধ নয়।
এই যুদ্ধটা শুধু ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতার জন্য ছিল না। ছিল মুক্তির জন্য। তাই আমার এই সিরিজের মাত্র শেষ দুই পর্ব লিখেছি মার্চের পঁচিশ থেকে ডিসেম্বরের ষোল তারিখ পর্যন্ত ঘটনাবলী নিয়ে। প্রথম আট পর্বে লিখেছি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
ভাল লাগল!
মনে হোল মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলো যেন চোখের সামনে ঘটে গিয়েছে!
আমারও কিছু একাত্তরের স্মৃতি আছে!
মনে হয় ঐ সময়ের গল্প গুলো সবারই কম বেশী একইধরনের।
ভাল লাগল।
তবে কামাল হোসেন গ্রেফতার হয়েছিলেন এ ধারনা মনে হয় সঠিক নয়।
২৫শে মার্চ সন্ধ্যাবেলায় বংগবন্ধু সবাইকে পালিয়ে যেতে বলার পর ডঃ কামাল, তাজউদ্দিন আহমেদ, ও ব্যারিষ্টার আমীরুল ইসলাম এক সাথে পালানো শুরু করেন। ডঃ কামাল বাকি দুজন থেকে এক পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। পরে তিনি যুদ্ধের পুরো ন’মাস পশ্চীম পাকিস্তানে তার শ্বশুড় বাড়িতে কাটান বলে জানা যায়। গ্রেফতার মনে হয় হননি।
আপনার বাড়ি হার্বাং তাতো জানা ছিল না। সে যায়গার দই খেতাম এক কালে। অধ্যাপিকা মাহফিল আরা নামের কাউকে চেনেন নাকি? আপনারও অনেক বড় অবশ্য উনি, তবে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে অনেকেই চেনে।
@আদিল মাহমুদ,
অনেক ধন্যবাদ।
না, কামাল হোসেন শ্বশুর বাড়িতে ছিলেন না, জেলেই ছিলেন। তবে জেলে শ্বশুর বাড়ির সমাদর পেয়েছিলেন কি না, তিনিই বলতে পারবেন। পঁচিশে মার্চের দু’দিন পরেই তিনি ধরা পড়েন। আর্মি জানতো তিনি কোথায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁকে গ্রেফতার করতেই গিয়েছিল ওরা।
কিছুদিন আগে ‘সাপ্তাহিক’-এ তাঁর সাক্ষাতকার বেরিয়েছিল, পড়ে দেখতে পারেন। কামাল হোসেনের গ্রেফতার হওয়াটা একটা রহস্যঘেরা ঘটনা। আমার কেন যেন মনে হয় একটা অলিখিত বোঝাপড়া ছিল ওনার সাথে সামরিক জান্তার।
হারবাং-এর দইএর কথা মনে করিয়ে দিলেন, আপনার মন্তব্যে মাইনাস। আর শুনুন এখানকার (নর্থ আমেরিকায়) গ্রোসারি স্টোরের গ্রিক দই খেয়ে দেখতে পারেন – ফুল ক্রিম কিনবেন কিন্তু। হারবাং-এর দই এর স্বাদ পাবেন না, তবে মন্দ না।
অধ্যাপিকা মাহফিল আরাই, স্ম্রৃতিকথায় উল্লেখিত আমার চাচাতো বোন। বেশ কিছুদিন আগে মারা গেছেন।
@ইরতিশাদ,
আপনি তো দেখি আমার আত্মীয় হয়ে গেলেন। মরহুমা অধ্যাপিকা মাহফিল আরা আমার বোনের শ্বাশুড়ি।
হারবাং এর দই বহু বছর খাইনি, তবে স্বাদ এখনো লেগে আছে। আমেরিকান দই (বাজারের ইয়োর্গাট) খেয়ে ঠিক পুরো মজা পাই না।
কামাল হোসেনের গ্রেফতার খুবই রহস্যময় ঘটনা। উনি যে জেলে ছিলেন আমি তাও জানতাম না। ওনার কথা আসলেই প্রসংগক্রমে সব সময় শুনি যে উনি যুদ্ধের পুরো ন’মাস পাকিস্তানে জামাই আদরে শ্বশুড় বাড়িতে ছিলেন। পরে বংগবন্ধুর সাথে ফিরে আসেন।
@আদিল মাহমুদ,
[email protected] এই ঠিকানায় লিখুন কুটুম্বিতা করা যাবে।
আপনার এই ইতিহাসের সূত্রকি মনগড়া কল্পনা?
পশ্চিম বাংলাতে ১৯৭১ সালের আগে নক্সালদের ওপর দমন পীড়নের চেয়ে নক্সালরাই সাধারন মানুষ মেরেছে বেশী। নক্সালদের ওপর দমনের জন্য, যে ব্যাক্তির নাম উঠে আসে-তিনি সিদ্ধান্ত শঙ্কর রায়-যার জমানা ১৯৭২-৭৭।
@বিপ্লব পাল,
আপনিও বলছেন, ‘নক্সালদের ওপর দমন পীড়নের চেয়ে…’ তার মানে তাদের ওপর দমন পীড়ণ হয়েছিল। অন্যকথাগুলো এখানে অবান্তর
সুমন্ত ব্যানার্জীর ‘ইন দ্য ওয়েক অফ নক্সালবাড়ি’ বইটা আমার কাছে আছে। ইন্দিরা সরকারের সি আর পি-র অত্যাচারের কথা ওখানে বিবৃত আছে। আর একাত্তরের অনেক কথাই আমার মনে আছে। তখনকার পত্রপত্রিকাতেই এ নিয়ে খবর বেরিয়েছিল।
বাই দ্য ওয়ে, শর্মিলা ঠাকুর নামে একজন বাংলাদেশে পাক আর্মির অত্যাচারকেও মনগড়া কল্পনা বলে দাবী করেছেন। তাতে কি আসে যায়?
@ইরতিশাদ ভাই,
শর্মিলা ঠাকুর ছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী। আপনি বোধ হয় শর্মিলা বোস মিন করতে চেয়েছেন। গত কয়েকদিন ধরেই এই নির্লজ্জ মহিলার কথা শুনছি। এ মহিলাকে নিয়ে আর কি বলব? সুভাষ চন্দ্র বোস ফ্যামিলির কলঙ্ক। গবেষণার নাম করে তিনি শুরু করেছেন লাগাতার ইতিহাস বিকৃতি। নিজে নারী হয়েও যিনি মনে করেন মুক্তিযুদ্ধে নাকি পাক বাহিনীদের দিয়ে সেরকম কোন নারী ধর্ষণ ঘটেনি। আর তার ধারণার সাফাই তিনি গান পাকিস্তানী জেনারেলদের বই পত্তর থেকে। ইফদানিং নাকি আবার একটা বই-ও বের করেছেন তার গার্বেজকে সংকলিত করে।
@অভিজিৎ,
অবশ্যি শর্মিলা বোস হবে, ঠিক করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। শর্মিলা ঠাকুর আমার একজন প্রিয় অভিনেত্রী – ভুল হয়ে গেছে যখন বুঝতে পারলাম, তখন আমি প্লেনে, হংকং-এর পথে। এই মন্তব্যগুলো লিখছি হংকং এয়ারপোর্ট বেসে।
শর্মিলা বোসের মতো আরো অনেকেই আছেন, এদের রিফিউট করা আমাদের (মুক্তমনা সদস্যদের) দায়িত্ব।
@বিপ্লব পাল,
বই পড়লে নকশালদের যে অত্যাচার করা হয়েছিল তা কিছু জানা যায় বা জেনেছি। আসলে কোনটা সত্য কোনটা ন বানাবো বোঝা মুশকিল।
ইরতিশাদ,
খুব মননশীল এবং মর্মস্পর্শী লেখা। বিশেষ করে নীচের লাইনগুলোতে একজন সত্যিকার বিবেকবান মানুষকে দেখতে পাচ্ছি্।
বিবেক অত্যন্ত স্বচ্ছ না হলে এবং সত্যিকার মানবতাবাদী না হলে কেউ পরাজিত শত্রুপক্ষের যে মানুষগুলো নিরপরাধ হওয়া সত্যেও অন্যায়ভাবে বলি হয়েছেন তাদের কথা এত দরদ দিয়ে বলেনা। পৃথিবীতে এবং বিশেষকরে বাংলাদেশে আপনার মত মানুষের ভীষন দরকার আছে। কারন আমাদের দেশে বিবেকবান মানুষ এখন একটা লুপ্তপ্রায় প্রজাতি।
@মোঃ হারুন উজ জামান,
অনেক ধন্যবাদ আপনার সহৃদয় মন্তব্যের জন্য।
@ইরতিশাদ,
আপনাকে ধন্যবাদ আমার মন্তব্যগুলোক “সহৃদয়” বলার জন্য।
এখন ফরিদ আহমেদের মন্তব্যের প্রতিউত্তরে দেওয়া আপনার মন্তব্যগুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা করছি।
আপনি বাম দৃস্টিকোন থেকে জাতীয়তাবাদে আপত্তি করছেন; আমার আপত্তি আছে মানবতাবাদী দৃস্টিকোন থেকে। আমার মতে মানুষের বিভাজন শুধুমাত্র একটা ভিত্তিতেই হওয়া উচিত; সেটা হল ন্যায়নীতি। ধর্ম, ভুগোল, ভাষা ভিত্তিতে কিংবা নৃতাত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজন এবং তৎসম্পর্কিত জাতিসত্তার রাজনীতি (politics of identity) শেষ পর্যন্ত মানুষের কোন কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসেনা। মুক্তিযুদ্ধের খুব মজবুত একটা নৈতিক ভিত্তি ছিল; সেটা হল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম। এর জন্য বাংগালী জাতীয়তাবাদ নামক রাজনৈতিক মতাদর্শের কোন দরকার ছিলনা। এই ভুল জাতীয়তাবাদী চিন্তা থেকেই শেখ মুজিব মানবেন্দ্র লারমাকে “এখন থেকে বাংগালী হয়ে যা” জাতীয় কথা বলেছিলেন।
জাতীয়তাবাদি রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী না হলেও আমি বাংগালীর সাংস্কৃতিক জাতিসত্তায় সম্পুর্ন বিশ্বাসী। যে সংস্কৃতির রুপকার হলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ এবং আরো অনেকে।
বিশ্লেষনের দুটো দিক আছে: কি হয়েছে এবং কি হওয়া উচিত ছিল। অধিকাংশ লোকের কাছে যুদ্ধটা জীবনমরণ সমস্যা হিসেবেই এসেছে। কিন্তু উচিত ছিল পুর্ব বাংলার মানুষের সার্বিক মুক্তির সংগ্রাম হিসেবে উপস্থাপিত হওয়া।
@মোঃ হারুন উজ জামান,
ধন্যবাদ, সুচিন্তিত আলোচনার জন্য।
আমার মূল্যায়নে বাম দৃষ্টিকোণ আর মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণের মধ্যে সম্পর্ক দ্বন্দমূলক নয়।
আমার অবস্থানের সপক্ষে আপনার এই উদাহরণটা যথার্থ। অনেক ধন্যবাদ।
সাংস্কৃতিক জাতিসত্বা হচ্ছে বাস্তবতা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপার নয়। প্রয়োজন হলো সব সাংস্কৃতিক জাতিসত্বার প্রতি শ্রদ্ধা।
খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছেন। যুদ্ধটা আসলেই পূর্ব বাংলার মানুষের সার্বিক মুক্তির সংগ্রাম ছিল, এবং যুদ্ধের পরিণতিতে সেই আরাধ্য মুক্তি বাংলার মানুষের পাওনা ছিল। নানা কারণে যা হওয়া উচিত ছিল তা হয় নি। আমার লেখায় সেই কারণগুলোই খোঁজার চেষ্টা করেছি।
অনেক ধন্যবাদ।
@ইরতিশাদ,
মোঃ হারুন উজ জামান সাহেব লিখেছেন,
আপনি বলছেন,
এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ যখন সাংস্কৃতিক জাতিসত্বা মনের মধ্যে লালন করে তা কি একসময় জাতীয়তাবাদি মতাদর্শে পরিনত হয়না? মানে আমি বলতে চাচ্ছি, একজন লোকের সাংস্কৃতিক জাতিসত্বা এবং তার জাতীয়তাবাদি মনোভাবের মধ্যে পার্থক্য কি হতে পারে? এটা কি এমন যে প্রথমটা হলো অরাজনৈতিক আর পরেরটা হলো রাজনৈতিক? কিন্তু তারপরেও কথা থেকে যায়, মানুষ কি তার মনোভাবকে সবসময় রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বিশ্লেষণ করে চলতে সক্ষম?
@ব্রাইট স্মাইল্,
হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। মানুষের স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে মনে অহংকার জন্ম নিতে পারে, কিন্তু অহংকারের জন্ম হতেই হবে বা তা লালন করতেই হবে এমন কোন কথা নেই, এবং থাকা উচিতও নয়। একই যুক্তিতে সাংস্কৃতিক জাতিসত্বা এং তার জাতীয়তাবাদী মনোভাবের মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে এবং থাকা উচিত।
এর মধ্যে একদিক থেকে চিন্তা করলে রাজনীতির কিছুই নাই, আবার অন্যদিকে পুরো তর্কটাকেই রাজনৈতিক বলা যায়। মানুষ যে ‘পলিটিক্যাল এনিম্যাল’ তাতো আর অস্বীকার করা যায় না।
ভালো একটা প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ।
ইরতিশাদ,
খুব মননশীল এবং মর্মস্পর্শী লেখা। (Y)
বিশেষ করে নীচের লাইনগুলোতে একজন সত্যিকার বিবেকবান মানুষকে দেখতে পাচ্ছি্।
বিবেক অত্যন্ত স্বচ্ছ না হলে এবং সত্যিকার মানবতাবাদী না হলে কেউ পরাজিত শত্রুপক্ষের যে মানুষগুলো নিরপরাধ হওয়া সত্যেও অন্যায়ভাবে বলি হয়েছেন তাদের কথা এত দরদ দিয়ে বলেনা। পৃথিবীতে এবং বিশেষকরে বাংলাদেশে আপনার মত মানুষের ভীষন দরকার আছে। কারন আমাদের দেশে বিবেকবান মানুষ এখন একটা লুপ্তপ্রায় প্রজাতি।
ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। আমার জন্ম স্বাধীনতার বেশ অনেক বছর পর। তারপরও সেই একাত্তরের গল্প শুনেছি অনেকের কাছ থেকে। যখনই শুনি শিহরিত হই।
আমার বাবার গ্রাম ছিল বোয়ালখালীতে। আপনার লেখা পড়ে বুঝতে পারছি আপনি চট্টগ্রাম থেকে। তাহলে অবশ্যই শুনে থাকবেন, বোয়ালখালী, কানুঙ্গোপাড়ার কি অবস্থা ছিল তখন। আমার দাদু কানুঙ্গোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। কলেজের অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর এবং অধ্যাপক দীলিপ চৌধুরীকে মার্চেই হত্যা করা হয়, একইসাথে গুলিতে আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন ইংরেজীর অধ্যাপক মণিলাল ভট্টাচার্য। আমার দাদু অনেকদিন অবধি ভারতে আশ্রয় নিতে যেতে চাননি। তাঁর হয়তো মনে হয়েছিল, দেশে থেকে বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর সাথে তিনিও যুদ্ধের কোনো কাজে আসতে পারবেন। একটি পা খোঁড়া ছিল বলে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা ভাবতে পারেননি। পরবর্তীতে রাজাকারেরা সমস্ত শিক্ষকদের শর্টলিস্ট করে একে একে মেরে ফেলার জন্য। সেইসময় জান হাতে নিয়ে পালাতে হয় সবাইকে। দাদুও অক্টোবরের শেষের দিকে ভারত পালিয়ে যান। রাজাকারেরা শিক্ষকদের না পেলেও তাদের অনেকের পরিবার ও মহল্লা থেকে প্রচুর যুবক ও মধ্যবয়স্কদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের পরিবারের ৪/৫ জন ব্যাক্তি রাজাকারের হাতে ব্রাশফায়ারে নিহত হন। উল্লেখ্য, কানুঙ্গোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজ অনেক প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি কলেজ ছিল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের শত সাথীর প্রায় অনেকেই এই কানুঙ্গোপাড়ার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বোয়ালখালী, কানুঙ্গোপাড়া আবারো বিপ্লবী হয়ে উঠতে পারে, সেই ভয়ে রাজাকার ও পাকআর্মির সম্মিলিত আক্রমণ ছিল এখানের গ্রামগুলোতে।
অন্যদিকে আমার মায়ের গ্রাম ছিল সাতকানিয়ায়। সেইখানের কালিয়াইচ, ধর্মপুর গ্রামগুলোতে তখন ভাল রাস্তা হয়ে উঠেনি। জল-জঙ্গল-আগাছা ভরা ছিল। আর্মিট্রুপ ওইসব গ্রামে যাওয়ার সাহস করেনি। মজার ব্যাপার, পাকআর্মি নিষ্ঠুরতায় তুলনাহীন হলেও কাপুরুষ ছিল মারাত্মক রকমের। কোনো জঙ্গলাকীর্ণ জায়গার ধার মাড়াতোনা তারা, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভীষিকার মত ভয় করত। এইসব জায়গা দিয়ে অতিক্রমের সময় পারতপক্ষে ট্যাঙ্ক বা ট্রাক ছেড়ে নামতোনা। সেই সুযোগ নেয় ওই সব গ্রামের কিছু লোক। তারা অশিক্ষিত, মানসিক ভাবে পশ্চাতপদ ছিল, যুদ্ধে যোগ দেওয়ার মত সাহস বা ইচ্ছে ছিলনা। কিন্তু গ্রামের মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার বাঁচানোর জন্য তারা রাজাকার বনে যাওয়াকে সহজ ভেবেছিল। এই গ্রামে কোনো হিন্দু নেই, কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, পাইলে জানে মেরে ফেলব পাকিস্তানের নামে- এই রকম কিছু একটা ভান করে পাকআর্মিকে গ্রামে ঢোকা থেকে নিবৃত্ত করেছিল তারা। পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের গ্রাম থেকে খুব বেশী মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যায়নি, কিন্ত এও ঠিক, একটা লোকও মারা পড়েনি, বহাল তবিয়তে ছিল আমার মায়েদের পরিবার।
আমার ঠাকুমা(দাদী), নন্দনকানন অপর্ণাচরণ স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। পাকিরা ওই স্কুলে ক্যাম্প বসায়। শিক্ষকদের বাধ্য করে স্কুল চালু রাখতে। তখনকার জাঁদরেল হেডমিস্ট্রেস প্রণতি সেন, সাথে তাঁর চিরকুমারীসভার আরো ৬ জন শিক্ষিকা, স্কুল চালিয়েছিলেন। পড়তে আসা ছাত্রীরাই ক্যাম্পের খবর বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নিয়ে যেত। এইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার পথ খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁরা।
যুদ্ধের সময় আমার বাবার বয়স ১৪-১৫। উনিও পরিবারের কয়েকজনের সাথে ভারত পালিয়ে গেছিলেন। ছোটোবেলায় এই ব্যাপারটা আমাকে খুব কষ্ট দিত। আমার বাবা’কি পারতেননা দেশে থেকে যুদ্ধে অংশ নিতে। কত ছোটো কিশোর যুদ্ধে ছিল। এখনও মাঝে মাঝে এই ব্যাপারটা আমাকে গ্লানি দেয়। বাবাও আমাকে এর কোনও উত্তর দেননি, বরাবর মৌন থেকেছেন। জানিনা উনি নিজে এখন তার জন্য গ্লানিবোধ করেন কিনা।
@পাপিয়া চৌধুরী,
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। আপনার স্মৃতিচারণও ভালো লাগলো।
@পাপিয়া চৌধুরী,
আগে আপনার দীর্ঘ মন্তব্যের জবাবটা খুব ছোট্ট করে দিয়েছি। মনে হয় না সুবিচার করেছি। তাই আপনার মন্তব্যটা আবার পড়লাম। আপনার শেষের কথাটা আমার মনে দাগ কেটেছে। তাই আবার ফিরে আসলাম।
আমার মনে হয় না আপনার বাবার বা আপনার গ্লানি বোধ করার কোন কারণ আছে। ১৪-১৫ বছরের একজন কিশোরের জন্য শরণার্থী হয়ে ভিন্ন দেশে যাওয়াটাও একধরনের যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ আমরা সেই একাত্তরে অনেকভাবেই করেছি, কারো অবদান-ত্যাগ কারো চেয়ে কম নয়। শুভেচ্ছা রইলো।
@পাপিয়া চৌধুরী,
যারা খোদ ঢাকা শহরে ছিল অনেকটা বাধ্য হয়ে। অনেক জ্ঞানী গুনী বলেন এসব মানুষ যে পরবর্তিতে বেঁচে যায় এই বাচা মনে হয় দ্বিতীয় জন্ম নেবার মত। দেশে থেকে গিয়েছিল যারা তাদের যুদ্ধে কিছু অবদান ছিল বৈকি।
যেমন আপনার সেই টিচার বাধ্য হয়ে স্কুলে যেতেন। আবার সেই খবরগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাচার হত। এমন ভাবেই আমার বাবাও সরকারি চাকরি করতেন বিধায় অফিসে না গিয়ে উপায় ছিলনা। প্রতিদিন জান হাতে অফিস করা যে কত দুরূহ কাজ। তাই আপনার বাবা তো মাত্র অল্প বয়সি ছিলেন তাকে কি করে ভাবা যায় যে যুদ্ধ মাঠ পর্যায়ে করতেই হবে। মন কষ্টের কারণ নাই।
মুক্তিযুদ্ধ একাধারে আমাদের গৌরব ও ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত অধ্যায়। যুদ্ধের কাহিনী যখনই পড়ি তখনই একদিকে গৌরবে বুক ভরে যায়, অন্যদিকে দুঃখে অপমানে বুক ভেঙে যায়। সুন্দর লেখা ধন্যবাদ।
@তামান্না ঝুমু,
ধন্যবাদ, তামান্না।
২৫-২৬ মার্চ রাত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যা ঘঠেছে তা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। তখন আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলাম।
এই কাল রাত্রির পর পাকিস্তানি ইসলামি বাহিনী আমাদের উপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছিল তাও আমার সময়ের সবাই দেখেছে এবং শুনেছে। এই ব্যাপারে কিছু লেখা মুক্তমনার পুরানো অঞ্চলে আছে।
আপনার লেখা পড়ে আবার সেইসব বিভিষিকাময় দিনরাত্রির স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
@আবুল কাশেম,
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। আপনিও লিখুন না, একাত্তরের অভিজ্ঞতা নিয়ে!
@ইরতিশাদ,
একাত্তরের অভিজ্ঞতা নিয়ে কাশেম ভাইয়ের একটি লেখা-
স্বাধীনতার প্রায় ১৩ বছর পরে আমার জন্ম হওয়ায় আমি যুদ্ধের পটভূমি ও পরিস্থিতি আমার অভিজ্ঞতার বাইরে। যখন আমি বুঝতে শিখেছি তখন বাংলাদেশে সেই মহানযুদ্ধের আমেজ এবং গৌরবগাঁথা ইতিহাসগুলি প্রায় বিলীন হতে বসেছে। যা জেনেছি তা বইপত্র পড়ে এবং আমার দাদুর মূখে শুনে। কক্সবাজারে উল্লেখযোগ্য কোন সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়নি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকারদের গাইড লাইনে আওয়ামীলীগ নেতা কর্মিদের বাড়ীঘর, সম্পদ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। দাদু আওয়ামীলিগ করতেন। খবর পেয়ে নিরাপত্তার জন্য দাদু তার পরিবারকে নিয়ে বার্মায় পলায়ন করেছিল। আর হানাদার বাহিনীরা এসে বাড়ীঘর, মজুদ শষ্য ও গৃহপালিত প্রাণীসহ সব জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে বার্মা থেকে ফিরে এসে সেই শূন্য ভিটায় আর বাড়ী করা হয়নি। এখনো সেখানে কোন বাড়ী হয়নি। যখন এসব গল্প শুনতাম তখন মনের ভিতরে একটা হাহাকার টের পেতাম। প্রশ্ন করতাম আমাদের এলাকায় রাজাকার কারা কারা ছিল ? যাদের নাম বলা হয়েছিল তাদের অনেককেই আমি জীবিত দেখেছি। দেখলে কেন যেন একটা ঘৃণা জন্মাত।
অনেকদিন পর আপনার এই অভিজ্ঞতার গল্প পড়ে সেই পুরোনো হাহাকারটা আঁচ করতে পারছি। আপনার এই লেখাটায় কোন ইতিহাসের ছোঁয়া টের পেলাম না, এমন ভাবে বললেন যেন আপনাদের পরিস্থিতিটা আমার নিজের চোখে ভাসছে। অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের এধরনের লেখাগুলি অন্তত আমাদের জন্য খুবই দরকার।
@বাদল চৌধুরী,
লেখাটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারো ভাল লাগলো।
নবম পর্বটির জন্য অনেক দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হল।
যাহোক, তবুও পেলাম। ভাল লেগেছে। নতুন তথ্য জানলাম যে —
আপনি আপনার এ লেখায় আরও লিখেছেন–
আপনার লেখার উদ্ধৃতিতে আমি যে টুকু বোল্ড করেছি অর্থাৎ এ.কে. খন্দকার ব্যক্তি হিসেবে, পুলিশ বিভাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবার স্বাধীনতা পদক পেয়েছে। ধন্যবাদ তাদের কথা আপনার এ লেখায় উপস্থাপনের জন্য।
দশম পর্ব শীঘ্রই জানানোর অনুরোধ রইল।
@গীতা দাস,
আসলেই অনেক দেরীতে এই পর্বটা নামালাম। সেই গতবছরের মার্চে পুরো সিরিজটা শেষ করার ইচ্ছে ছিল, হয়ে ওঠে নি। তবে শেষ পর্বটা কিছুদিনের মধ্যেই দেবার চেষ্টা করবো। এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি ভাবতেই একটু হাল্কা বোধ করছি।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, খন্দকার সাহেব, পুলিশ বিভাগ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা পদক পাওয়ার কথা উল্লেখ করার জন্য। লেখার সময় এই সংযোগটার কথা আমার মাথায় ছিল না।
ভালোলাগলো। অনেক কথা মনে পড়ে গেল। আমি ৭১ মার্চ এবং পরবর্তীতে কী- কী দেখেছিলাম সেই সময়, সেই ছোট বয়সে তার আলোকে
লেখা দিয়েছিলাম যদি ইচ্ছে এবং সময় দুটো হয় পড়তে পারেন অনেক খন্ডে আছে
এখানে-
@আফরোজা আলম,
অনেক ধন্যবাদ।
খুব ভাল লাগলো ইরতিশাদ ভাই। আমারও অনেক স্মৃতি জাগরিত হলো আপনার এই লেখা পড়ে। ওই সময় আমি টু তে পড়ি গোপালগঞ্জের হরিদাস পুর গ্রামে। ওই সময় টু তে পড়া ছেলেরা মেয়েরা বেশ বড় হত এবং সব কিছুই বু্ঝত। ওই পুরানো দিনের স্মৃতি যখন জাগরিত হয় তখন সুখ দু্খ মিলিয়ে কেমন যেন এক ভাবের সৃষ্টি করে তা ভাষাতে প্রকাশ করতে পারি না।
@সেন্টু টিকাদার,
ধন্যবাদ পড়ার জন্য, মন্তব্যের জন্য।