(প্রথম পর্ব) , (দ্বিতীয় পর্ব) , (তৃতীয় পর্ব) , (চতুর্থ পর্ব) , (পঞ্চম পর্ব) , (ষষ্ঠ পর্ব) , (সপ্তম পর্ব), (অষ্টম পর্ব)

পঁচিশে মার্চের রাতে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রোডের সেই ঘটনাবহুল বাড়িটিতে বসে শেখ মুজিব কাকে কি বলেছিলেন তা নিয়ে অনেক রকমের কথা শোনা যায়।  সবাই সবকিছু নিজ কানে শুনেছেন বা স্বচক্ষে দেখেছেন বলে দাবী করেন, যদিও একজনের কথার সাথে আরকেজনের ভাষ্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।  তবে শেখ মুজিব যে তাঁর সহকর্মীদের সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলেছিলেন এবং নিজে গ্রেফতার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন তা নিয়ে সন্দেহে থাকার কোন অবকাশ নেই।

আমি নিশ্চিত আওয়ামী লীগের নেতাদের কোন ধারণাই ছিল না, মিলিটারি সে রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে জঘন্য, পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ শুরু করবে ঢাকায়।  তখনকার আওয়ামী লীগের মতো একটা দলের ইন্টেলিজেন্স যে এতো দূর্বল হতে পারে জেনে বিস্মিত হতে হয়।  সে রাতে ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ত্যাগের খবরটাও নাকি আওয়ামী লীগ নেতারা জানতেন না।  রাত এগারোটার দিকে তাঁদেরকে এই খবরটা জানিয়েছিলেন তেজগাঁ এয়ারপোর্টে কর্মরত এয়ারফোর্সের বাঙালি অফিসার উইং কম্যান্ডার এ.কে. খন্দকার (পরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ.কে. খন্দকার)।

অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও যে খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিলেন তা নয়।  এমন কি ঝানু সাংবাদিকরাও কিছুই জানতেন না।  অনেককে পত্রিকার অফিসেই প্রাণ দিতে হয়েছে।

পাকিস্তানী মিলিটারিও ইন্টেলিজেন্সের বাঙালি অফিসারদের ওপর নির্ভর করতে পারে নি।  তাই দেখা যায় শেখ মুজিব আর কামাল হোসেন ছাড়া আওয়ামী লীগের কোন বড় নেতাই ধরা পড়ে নি।  তাঁরাও গ্রেফতার এড়াতে চান নি বলেই এমনটি ঘটেছে।

সে রাতে মিলিটারির টার্গেট ছিল, প্রথমত, পিলখানায় ইপিআর আর রাজারবাগে পুলিশের ওপর আক্রমণ – উদ্দেশ্য ছিল এদেরকে নিরস্ত্র করা।  দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ওপর আক্রমণ।  হয়তো তাদের ধারণা ছিল ছাত্রদের হাতে অস্ত্র রয়েছে।

কিন্তু শিক্ষকদের কয়েকজনকে ধরে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক হিংসাপ্রসূত ছিল বলে আমার মনে হয়।  শহীদ মিনার ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলাখ্যাত সেই ঐতিহাসিক বটগাছটাকে উপড়ে ফেলার পেছনে মাথামোটা পাকিস্তানী সৈন্যদের কি মোটিভ ছিল আমি ভেবে পাই না।  একটা মাত্র কারণ ছাড়া, আর তা হলো এদের উপরস্থ কারো মনে হয়েছে এগুলোকে ধ্বংশ করার মাধ্যমে বাঙালির সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ওপরে উপযুক্ত আঘাত হানা যাবে।

পঁচিশে মার্চের রাতেই আমরা চট্টগ্রামে খবর পেলাম ঢাকার রাস্তায় আর্মি নেমেছে।  রেডিও নিস্তব্ধ, সাড়া-শব্দ নেই।  মানুষ ভীতবিহবল, সন্ত্রস্ত।  কিছুক্ষণের মধ্যেই, রাত একটা-দেড়টা নাগাদ, শোনা যেতে থাকলো প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ।  বন্দরের দিক থেকে শব্দ আসছে মনে হচ্ছিল।  পরে জানা গেলো কামানের গোলা ছোঁড়া হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করা যুদ্ধজাহাজ ‘বাবর’ থেকে।  ভাগ্যক্রমে সে রাতটা আমরা নিরাপদেই ছিলাম।  সকাল (ছাব্বিশে মার্চ) হতেই বেরিয়ে পরলাম রাস্তায়।

শহরের বড় বড় দোকান, খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইয়ের পাইকারী বাজার, বক্সির বাজার, রিয়াজুদ্দিন বাজার, বিপনিবিতান – সব বন্ধ, কোন রকম ঘোষণা ছাড়াই। পাড়ার ছোট দোকানপাটগুলো আংশিক খোলা রেখে দোকানী কোনরকমে বেচাকেনা চালাচ্ছে।  দু’একটা রিকসার গন্তব্যহীন চলাচল, দু’চার জন মানুষের ইতস্তত পদচারণা, তাদের ভীতসন্ত্রস্ত আলাপচারিতা, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভয়ার্ত চাহনি – চিরচেনা চট্টগ্রাম শহরকে একরাতের মধ্যে ভীষণ অপরিচিত করে দিল আমার কাছে।

উৎসুক কয়েকজনকে দেখলাম ক্যন্টনমেন্টের দিকে যেতে, পায়ে হেঁটেই।  ওখানে নাকি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।  বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমানকে দেখলাম একটা হুড নামানো রিকশায়।  মনে হলো এখনো ঠিক বুঝতে পারছেন না পুরোপুরি প্রকাশ্যে আসবেন কিনা – তাঁর ওপরে হুলিয়া (গ্রেফতারি পরোয়ানা) জারী করেছিল সামরিক সরকার।

দুপুরের দিকে চট্টগ্রাম বেতার থেকে শুনতে পেলাম, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, এবং নিরাপদ অবস্থানে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।  চট্টগ্রাম বেতার তখন নিজেদের “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র” নামে পরিচয় দিচ্ছিল।

দারুণ উৎকণ্ঠা, সীমাহীন উদ্বেগ আর প্রচন্ড ভয় নিয়ে বাবা-মা ভাই-বোনদের সাথে নির্ঘুম রাত কাটালাম আমরা বাড়িওয়ালার পাকা বাড়ির ড্রয়িং রুমে।  আমাদের ভাড়ার বাসাটা ছিল ছাপড়া টাইপের, নিম্নমধ্যবিত্তের মাথা গোঁজার ঠাঁই।  এর মধ্যে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন আমার চাচাতো বোন আর তাঁর পরিবার।  দুই পরিবারে মিলে আমরা দশজন।  আমাদের গ্রাম থেকে আসা কাজের ছেলেটা, আঠারো-ঊনিশ বছর বয়স, কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেল।  আমাদের সাথে থাকাটাকে সে আর নিরাপদ ভাবতে পারছিল না।

আমারা চিন্তা করতে লাগলাম কি ভাবে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে যাওয়া যায়।

ছাব্বিশ তারিখ রাতে ইয়াহিয়া খান বেতারে ভাষণ দিলেন।  ঢাকার রেডিও স্টেশন ইতোমধ্যে চালু হয়েছে সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে।  বললেন, শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে।  আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ইত্যাদি।  চট্টগ্রামে অনেকেই তখনো বিশ্বাস করছিলেন না, শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে (পশ্চিম) পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

সাতাশ তারিখের রাতটাও আমরা কাটালাম বাড়িওয়ালার ড্রয়িং রুমে।  সে দিনেই মনে হয় দুপুর কিংবা বিকেলের দিকে, জিয়াউর রহমানের গলা শোনা গেল চট্টগ্রামের কালুরঘাটের অস্থায়ী স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে।  ইংরেজিতে পড়া হয়েছিল ঘোষণাটা।  “আই, মেজর জিয়া,…”।  এর পরে থেকে ‘শেখ মুজিব আমাদের সাথে আছেন’, এই কথাটা আর শোনা গেল না।

আটাশ তারিখে আমরা কিছুটা পায়ে হেঁটে, কিছুটা রিক্সায় নৌকার আশায় নদীর ধারে গেলাম।  নৌকা পাওয়া গেল, পটিয়া পর্যন্ত যাওয়া যাবে।  আমাদের মতো আরো অনেকেই তখন প্রাণভয়ে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে রওনা দিয়েছে।  নৌকার মাঝি সন্দেহ করে বসলো আমাদের মধ্যে দু’একজন বিহারী হতে পারে।  প্রকাশ্যেই বললো তার সন্দেহের কথা।  আমার বড়ভাই, আমারই কাছাকাছি বয়সের, কিছুটা দীর্ঘকায় – আর আমার ভাগ্নী, আমার চাচাতো বোনের মেয়ে, সেও আমারই বয়সের, কিছুটা গৌরবর্ণ – তাতেই মাঝির মনে সন্দেহ পাকাপোক্ত হয়ে গেছে – এরা, বিশেষ করে এই দু’জন বাঙালি নয়; ‘এরা আমাদের লোক নয়’।

চাটগাঁ শহরের কেন্দ্র থেকে নদীর ঘাট, দূরত্ব তিন-চার মাইলের বেশি হবে না।  কিন্তু সাংস্কৃতিক দূরত্ব, যার কারণ মূলত অর্থনৈতিক, যে কত বিশাল হতে পারে উপলদ্ধি করে বিস্মিত হলাম।  সেদিন সেই ভীতিকর পরিস্থিতিতেও এই ভাবনাটাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না।  আসলেই তো, আমরা বাঙালি হলেও নৌকার মাঝিদের জাতের (শ্রেণীর) নই, তাতে কি সন্দেহ আছে!

শেষতক বেশি কথা না বাড়িয়ে মাঝি আমাদের নৌকায় তুলে নিল।  নৌকা চলতে শুরু করলেই দেখতে পেলাম নদীতে ভাসছে লাশ -বেশ কয়েকটা।  হতভাগ্য বিহারীদের।  বিনাদোষে মরতে হলো ওদের।  শেখ মুজিব সাতই মার্চের ভাষণে এই আশঙ্কা করেছিলেন।  বলেছিলেন, আমরা যেন অবাঙালিদের জানমালের ক্ষতি না করি, আমাদের যেন বদনাম না হয়।  নেতাসুলভ দিকনির্দেশনা ছিল তাঁর এই সতর্কবাণীতে।

কিন্তু অন্তত চট্টগ্রামে তাঁর এই কথা কোন কাজে আসে নি।  আমরা আজো সেই বদনামের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি।  শুনেছি, চট্টগ্রামের ইস্পাহানি কলোনিতে বিহারীদের জবাই করে তেলের খালি ড্রামে রক্ত জমা করা হয়েছিল।  পরে সেই রক্ত বাঙালি যোদ্ধাদের কাজে লাগবে এই যুক্তিতে। বড় অদ্ভুত আর নৃশংস সেই যুক্তি!

ঘন্টা দুয়েক নৌকায় চলার পরে আমরা পটিয়া পৌঁছলাম।  সৌভাগ্যক্রমে একটা মাইক্রোবাস পাওয়া গেল আমাদের গন্তব্য গ্রামে যাওয়ার জন্য।  আরাকান রোড ধরে বাস চললো আরো প্রায় ঘন্টা চারেক কক্সবাজারের দিকে। পথে পথে ব্যারিকেড।  জয় বাংলা স্লোগানে উচ্চকিত জনপদ, হাটবাজার।  লাঠিসোটা নিয়ে তরুণ যুবকরা প্রতিটা গাড়ি থামাচ্ছে আর চেক করছে।  কারো কারো হাতে একনলা-দোনলা বন্দুকও দেখা গেল।  অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের গ্রাম হারবাং-এ।  আরো আটমাইল আগে চুনতি-তে নেমে গেলেন আমার চাচাতো বোন আর তার পরিবার।

এই সেই হারবাং, আমার প্রিয় গ্রাম, যেখানে কেটেছে আমার শৈশব, কৈশোর।  মায়ের কোলের মতোই মমতাময় স্নিগ্ধতায় ভরা হারবাং।  হারবাং-এ পৌঁছে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

আমার মতো তরুণ বয়সের ছেলেরা দেখলাম প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।  সবকিছুই অনিশ্চিত।  আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বয়স্করা উদ্বিগ্ন।  চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাবে, এমন আশঙ্কা করছেন তাঁরা।  হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রাণভয়ে ভীত।  সবকিছু মিলিয়ে একটা থমথমে ভাব।

যে কোন মূহুর্তে আর্মি এসে পড়তে পারে, সবার মনেই এই ভীতি।  এপ্রিল মাসের মধ্যেই আর্মি কক্সবাজার শহরের দখল নিয়ে নিল।  হারবাং-এর ওপর দিয়েই তাদের যেতে হয়েছে কক্সবাজারে আরাকান রোড ধরে।  কিন্তু তারা হারবাং-এ থামে নি।  কোন এক অজানা কারণে যুদ্ধের নয়মাসের মধ্যে হারবাং-এ আর্মি একবারও আসে নি।  তবুও সবাই প্রকাশ্যে পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়েছে তাদের বাড়িতে, দোকানে, বাজারে।  গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি ছাড়া সবাই ছিল স্বাধীনতার পক্ষে।

সাধারণত গ্রামে  মানুষে মানুষে পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে বা বজায় থাকে তাতে দেখলাম চিড় ধরেছে।  কেউ কারো ওপরে ঠিক আস্থা রাখতে পারছেনা।  কেউ হয়তো মুখে বলছেনা কিন্তু ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতার বিপক্ষে, আবার অন্য কেউ হয়তো সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তথ্যটা গোপন রাখছে।

সবচেয়ে বেশি মুস্কিলে পড়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা।  তাদের পৃথিবী চোখের সামনে যেন হঠাৎ করে বদলে গেল, যাদেরকে মনে হতো আপনজন, সেই বন্ধু-প্রতিবেশীদের ওপরেই আর বিশ্বাস রাখা যাচ্ছে না।  তাদের বাড়িঘর, জমিজমা, গরুছাগল, সহায়-সম্পদ, এমন কি স্ত্রী-কন্যারাও রেহাই পাবে বলে মনে হচ্ছে না এদের লোভের থাবা থেকে। তার ওপরে যে কোন মূহুর্তে আর্মির হাতে জীবন যাবার আশঙ্কাতো আছেই।

তবুও যুদ্ধের নয়মাসে দু’একটা বিচ্ছিন্ন চুরির ঘটনা ছাড়া হারবাং গ্রামটা শান্তই ছিল।  স্কুল ছাড়া সবকিছুই চলেছে, সীমিত পরিসরে ।  হাটবাজার, কৃষিকাজ, ধর্মকর্ম চলেছে মন্থর গতিতে, কিন্তু একবারে থেমে যায় নি।  আর্মির না আসাটা এর পেছনে একটা বিরাট কারণ।  তবুও হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই চুপেচাপে ভারতে পাড়ি দিয়েছিল।  আগস্ট মাস পর্যন্ত আমরা হারবাং-এ ছিলাম।  আমার অলস কিন্তু অস্থির সময় কাটছিল তখন।

আকাশবাণী আর বিবিসির খবরে জানতে পারলাম, কুষ্টিয়ার ভারতের সীমান্তে বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর নাম দিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে।  সতেরই এপ্রিল ঘোষিত হয়েছিল এই সরকার।  আওয়ামী লীগের তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্নেল ওসমানী, খোন্দকার মোশতাক, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এঁরাই ছিলেন অস্থায়ী সরকারের মূল নেতৃবৃন্দ।   কামাল হোসেনকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আগেই।

আমি যুদ্ধের ভারত-নির্ভর চরিত্রটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না।  পশ্চিম বাংলার বামপন্থীদের (নক্সাল এবং সিপিএম) ওপর ইন্দিরার কংগ্রেস সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন বাংলাদেশের জনগণের ওপর ইয়াহিয়ার বর্বর পাকসেনাদের আগ্রাসনের চাইতে কোন অংশে কম ছিল না।  হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি-সংযোগ কোনটাতেই ভারতের সিআরপি (সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ) পাক হানাদারদের চাইতে পিছিয়ে ছিল না।  সেই ভারত সরকার আর তার প্রতিভু ইন্দিরা গান্ধীর ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়লো আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ।  মুজিবনগর যে কোলকাতার থিয়েটার রোডের একটা বাড়িতে আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রও যে কোলকাতাতেই তাতো আর কারো কাছেই অজানা ছিল না।

আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে আমার আস্থা ছিল না।  সেই আওয়ামী লীগই এই যুদ্ধের নেতৃত্বে।  আওয়ামী লীগ তখন (একাত্তরে) মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও তা যে মেকি, তা বুঝতে আমার মতো অর্বাচীনেরও কষ্ট হয় নি।  ক্ষমতায় গেলে যে আওয়ামী লীগ জনগণের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করবেনা বা করতে পারবেনা তা নিয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না।

হারবাং আর আশেপাশের গ্রামে অবস্থানকারী আমাদের ছাত্র সংগঠনের দু’একজনের সাথে দেখা হলো।  তারাও আমার মতো বিভ্রান্ত।  কিন্তু দেশকে হানাদারমুক্ত করতেই হবে, এ নিয়ে কোন বিভ্রান্তি কারো মনে ছিল না।

কোলকাতায় অবস্থিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (ততদিনে ‘বিপ্লবী’ শব্দটা খসে পড়েছে) তখন পুরোপুরি চালু।  নিয়মিত শুনতাম।  এম.আর. আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম। যুদ্ধটা ততদিনে আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে।  বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকায় প্রায় প্রতিদিন এ নিয়ে খবর-আলোচনা পরিবেশিত হচ্ছে।  ভারতের আকাশবাণীতো আছেই।  বিশ্ব রাজনীতি আর কূটনীতির অঙ্গনে ঝড় তুলেছিল বাংলাদেশ পরিস্থিতি।

মাত্র ছয় বছর আগেও আমি এই হারবাং-এর প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফাইভের ছাত্র ছিলাম।  তাই আমার বয়সের অনেক বন্ধুবান্ধব তখন গ্রামে ছিল।  তাদের সাথে আড্ডা মেরে ভালোই সময় কাটছিল আমার।  কিছু বইপত্রও যোগাড় করেছিলাম এর-ওর কাছ থেকে।  সবচেয়ে বেশি উপভোগ করছিলাম বর্ষার ভরা মওসুমে গ্রামবাংলার প্রকৃতি।  হাইস্কুলে পড়ার জন্য শহরে চলে যেতে হয়েছিল, তাই এই সুযোগ থেকে গত ছয় বছর ধরে বঞ্চিত ছিলাম।  এই প্রকৃতি আমার চেনা, তবুও ষোল বছরের না-কিশোর না-যুবক হৃদয়ে ভিন্ন এক দ্যোতনা নিয়ে ওই সময়ে ওই প্রকৃতি আমার কাছে মোহময় হয়ে উঠেছিল।

বাংলাদেশের অন্য আর পাঁচটা গ্রামের মতোই হারবাং।  এর অধিকাংশ অধিবাসী ভূমিহীন কৃষক।  জমিদারের জমি বর্গায় চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে তারা।  অনেকেরই বর্গা নেয়ার মতো সহায়-সম্পদও নেই।  গতর খাটে তারা বর্গাদারের ক্ষেতমজুর হয়ে। এদের জীবনে কোন স্বপ্ন নেই।  জীবনে যে স্বপ্ন থাকতে হয় তাও এদের জানা নেই। এদের জীবন নিয়ে নিয়তি যে কি নিষ্ঠুর খেলা খেলে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

সেই এরাই একাত্তরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল।  মুক্তির স্বপ্ন। শুধু হানাদারদের থেকে মুক্তি নয়, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, অভাব থেকে মুক্তি।

তাদের চোখেমুখে আশা আর বিশ্বাস, দেশ স্বাধীন হলে সেই স্বপ্নের মুক্তি এসে ধরা দেবে হাতের মুঠোয়।  মুক্তির আকাংখায় উজ্জীবিত গ্রামের কৃষক, দেশ স্বাধীন হলেই তারা পেতে শুরু করবে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য।  ওইটুকুই ছিল তাদের চাওয়া।  দু’মুঠো ভাত আর এক টুকরো কাপড়ের জন্য মাথা কুটে মরতে হবে না আর।  স্বপ্নের ওই মুক্তির জন্য প্রাণ দিতে রাজী ছিল ওরা একাত্তরে।

২৪ মার্চ, ২০১১।

(আগামী পর্বে শেষ)