জিজ্ঞাসা
রিফাৎ আরা
টিফিন শেষের ঘন্টা পড়তেই পড়তে থাকা বইটা ব্যাগে ভরে ফেলল অরণী। এক্ষুণি মান্নান স্যার ক্লাসে আসবেন। হাতে গল্পের বই দেখলে সেটা তো কেড়ে নেবেনই, তার ওপর একগাদা বকাঝকা করবেন। এই সেদিন অরণী আর তার তিন বন্ধু মিলে যখন খুব মজা করে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ‘সায়েরা সায়েন্টিস্ট’ বইটি পড়ছিল আর পড়তে পড়তে হাসাহাসি করছিল তখনই স্যার ক্লাসে ঢুকে তাদের হাত থেকে বইটা একরকম ছোঁ মেরে নিয়ে গেলেন। তারপর তিন বন্ধুকে সে কী বকা। “বই পড়ে দিন দিন ডেঁপো হচ্ছ। কী হবে এসব গল্পের বই পড়ে? এসব গল্পের বই পড়ে কী রেজাল্ট ভাল হবে? তোমাদের বাবা-মা কেন এসব বই পড়তে দেন?” অরণী উঠে দাঁড়াতে গিয়েছিল। বলতে চেয়েছিল, “স্যার, জাফর ইকবালের বই তো অনেক মজার। পড়লে ক্ষতি কী?” কিন্তু দাঁড়ানোর আগেই প্রভা তার চুলের বেণীটা ধরে হ্যাঁচকা টানে বসিয়ে দিয়েছিল। চুলে টান পড়াতে অরণী ‘উহ্’ বলে অস্ফুট চিৎকার করে উঠেছিল। কিছুটা রাগও হয়েছিল প্রভার ওপর। একেতো স্যারের বকাবকিতে মাথা গরম তারপর আবার চুলটানা খেতে ভাল্লাগে! ছুটির পর প্রভা অবশ্য ‘সরি’ বলেছিল আর সঙ্গে বলেছিল চুল টানার কারণ। স্যারের মুখে মুখে তর্ক করলে স্যার আরো যাচ্ছে তাই বলে অপমানতো করতোই, তারপর আবার নিয়ে যেত হেডস্যারের কাছে। আর হেডস্যারের কাছে যাওয়া মানে পিটি টিচারের হাতে ঝাড়া দু’ঘন্টা শাস্তি। শুনে অরণীর রাগ উড়ে গিয়েছিল, সাথে সাথে মনে হয়েছিল, প্রভা আসলেই একজন ভাল বন্ধু।
আজ যে বইটি অরণী পড়ছিল সেটি এ জন্মদিনে মা তাকে কিনে দিয়েছে। জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’। বইটা হাতে পেয়েই অরণী পড়তে শুরু করেছিল। মায়ের কাছে আগেই শুনেছিল বইটির কথা। মুক্তিযুদ্ধে সন্তান হারানো একজন মায়ের ’৭১ এর দিনলিপি। মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলো থেকে শুরু করে মুক্তি সংগ্রামের ঘটনাগুলো দিন তারিখ দিয়ে লেখা। পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে যায়। এরই মধ্যে গত দু’দিনে বই হাতে নিয়ে কয়েকবার কেঁদেছে অরণী। দেশ স্বাধীন করার জন্য একাত্তরে মানুষ এত কষ্ট করেছে? মা ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে দিয়ে বলেছে, “যা, তোকে দেশের জন্য কোরবানি দিলাম”। কিন্তু মায়ের প্রাণ। বলে ফেলেই অনুতাপে অনুশোচনায় জ্বলে পুড়ে মরেছেন, কেন বললাম একথা? তারপর কথাটি যখন সত্যি হলো তখন মায়ের যন্ত্রণা আরো বেড়ে গিয়েছিল।
– এই অরণী, এত কী ভাবছিস? বই বের কর। স্যার তোকে দেখছেন। তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে বই বের করল অরণী। নবম শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান। মান্নান স্যার এই বইয়ের ইতিহাস অংশ পড়ান। আসলে পড়ান কি? স্যার তো ক্লাসে এসেই গপ্পো জুড়ে দেন। কোনদিন হয়তো মুঘল সম্রাটরা কীভাবে ভারতবর্ষের হিন্দুদের সুসভ্য করেছে তার মুখরোচক গল্প। কোনদিন নজরুল-রবীন্দ্রনাথের তুলনা। নজরুল কতখানি ধার্মিক ছিলেন, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রিটিশের দালাল। ইংরেজদের ঘুষ দিয়ে নোবেল প্রাইজ নিয়েছেন। অরণী প্রথম দিন শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল। এসব কি সত্যি! মা তো কখনো বলেনি। বাসায় গিয়ে সেদিন মা কখন ফিরবে সে অপেক্ষায় ছিল। তারপর মা আসতে না আসতে ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করেছিল, মা তুমি জানো না রবীন্দ্রনাথ যে ব্রিটিশদের দালাল ছিলেন? কখনো বলনিতো।
মা প্রথমে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল অরণীর দিকে। তারপর বলেছিল, এ কথা কে বলল তোকে? এতো স্রেফ প্রোপাগান্ডা।
– আমাদের মান্নান স্যার।
– ধুর, কী বলিস। একজন শিক্ষক এ কথা বলতে পারেন না।
– সত্যি মা, বলেছে। আমি মিছেমিছি বলব কেন?
– তাহলে তোর স্যারের জানার মধ্যে ভুল আছে। তুই স্যারকে বলিস, রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকারের দেয়া ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেছিলেন। ইংরেজ রাজত্বে বাস করে তাদের দেয়া খেতাব বর্জন করা অনেক সাহসের ব্যাপার ছিল এবং রবীন্দ্রনাথ সেটা করেছিলেন।
সেদিন রাতে মা তার লাইব্রেরি থেকে একটা বই বের করে রবীন্দ্রনাথের খেতাব বর্জনের চিঠিটা দেখিয়েছিল। অরণী তখন এ স্কুলে নতুন এসেছে। পরের ক্লাসে মায়ের বইটা সাথে নিয়ে প্রভা, নীতু, রিংকু, সাদিয়া সবাইকে দেখিয়েছিল। ওরা অবাক হয়ে বলেছিল, তাহলে স্যার দালাল বললেন কেন রবীন্দ্রনাথকে? হ্যাঁ, সেদিন অরণী ওদেরকে আরো বলেছিল, যদি রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশদের দালালী করতেন তাহলে তাঁর গান কি আমাদের জাতীয় সংগীত হতো?
– হ্যাঁ, তাই তো। অরণীর কথাটা সেদিন তার বন্ধুদের ভাবিয়েছিল।
– স্যারকে প্রশ্ন করব? – অরণী ওদের বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “এই বইটা যদি দেখাই?”
– না বাবা না। প্রায় সবাই একসঙ্গে বলে উঠেছিল।
– তোরা এত ভীতুর ডিম কেন? কী হয় সত্য জানতে চাইলে? যেখানে আমার হাতে প্রমাণ আছে।
ওরা চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। সত্যি বলতে কি ওদের অবস্থা দেখে অরণীরও সেদিন আর সাহস হয়নি।
আজ স্যার বলছেন দেশ বিভাগ সম্পর্কে। মেয়েরা সবাই স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্লাস নিঃশব্দ। অরণীর মনে হয় স্যারের কথা শোনার চেয়েও স্যারের ভয়ে সবাই চুপ করে আছে। অরণীও তাকিয়ে আছে স্যারের দিকে। তাড়াতাড়ি কথা বলতে গেলে স্যারের মুখ থেকে খুব থুথু ছিঁটায়। এখনও ছিঁটাচ্ছে। গায়ে থুথু পড়ার ভয়ে অনেকে ফার্স্ট বেঞ্চে বসতে চায় না। যেদিন স্যারের ক্লাস থাকে সেদিন বসা নিয়ে সবার মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। মাঝে মাঝে ঝগড়া হয়ে দু’বন্ধুর কথাও বন্ধ হয়ে যায়। অরণী আজ ফার্স্ট বেঞ্চেই বসেছে। মাঝে মাঝে দু’একটা থুথুর কণা এসে হাতে মুখে লাগছে। অরণী সন্তর্পণে মুঠোয় রাখা টিস্যু দিয়ে মুছে নিচ্ছে। ঘন্টা পড়লেই ওয়াশরুমে গিয়ে হাত-মুখ ভাল করে ধুতে হবে। একটা গা ঘিনঘিনে অস্বস্তি লাগছে।
স্যার বলছেন, “কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ না থাকলেতো এদেশের বাঙালি মুসলমানদের অস্তিত্বই থাকত না। ইসলাম ধর্মটাও মুছে যেত। তিনিই তো ভারতবর্ষের মুসলমানদের রক্ষা করেছেন।
খট্ করে কথাটা কানে লাগল অরণীর। ‘কায়েদে আযম’? কায়েদে আযম মানে তো জাতির পিতা। জিন্নাহ তো আমাদের জাতির পিতা নন। তাহলে স্যার কেন তাকে জাতির পিতা বলছেন? কেউ যেন ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিল অরণীকে। স্যারের কথার মাঝখানেই বলল,
– স্যার একটা কথা।
মান্নান স্যার চশমাটা খুলে চোখ কুঁচকে তাকালেন অরণীর দিকে।
– কী প্রশ্ন?
– স্যার, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তো পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা। আমরা এখন তাকে কেন কায়েদে আযম বলব? আমরা তো স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক।
– কী? কী বলছ? আবার বল।
অরণী বেশ দৃঢ় স্বরে ধীরে ধীরে কথাগুলো আবার উচ্চারণ করল। ক্লাসের সবাই অবাক চোখে তাকে দেখছে। স্যার চেয়ার ছেড়ে উঠে ডায়াস থেকে নেমে এলেন।
– কী নাম তোমার?
– অরণী, অরণী ইসলাম।
– তুমি মুসলমান?
অরণী হতভম্ব হয়ে উত্তর দিল, জ্বি স্যার।
– অরণী ইসলাম এটা আবার কী নাম? মুসলমানের বাচ্চার এমন হিন্দুয়ানী নাম কেন?
অরণীর গায়ে যেন জলবিছুটি লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। মাথায় জেদ চেপে গেছে। তার এত সুন্দর নামের এই অপমান। দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিল – হিন্দুয়ানী নয় স্যার, এটা বাংলা শব্দ আর আমি বাঙালি।
– তা কী অর্থ তোমার নামের?
– যে কাঠ ঘষলে আগুন জ্বলে অথবা চকমকি পাথর। ভয়হীন চোখে স্যারের চোখে চোখ রেখেই বলল অরণী।
– ও আচ্ছা। তো কে রেখেছে তোমার এ নাম?
– আমার মা।
– তিনি কি মুসলমানের মেয়ে?
এবার অরণীর মনে হচ্ছে সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এসব কী প্রশ্ন করছেন স্যার? আচমকা বসে পড়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠল সে। ক্লাস জুড়ে পিনপতন নিস্তব্ধতা। এর মাঝে স্যার বলে উঠলেন, আমি তো তোমাকে বসতে বলিনি। তুমি অনুমতি না নিয়ে বসলে কেন?
অনেক চেষ্টা করেও অরণী উঠে দাঁড়াতে পারল না। তার সে শক্তিই নেই।
দিনের শেষে ক্লাস হওয়াতে ছুটির ঘন্টা পড়ার পর পরই সবাই এসে ঘিরে ধরল অরণীকে। অন্যদিন এতক্ষণে বাসায় যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে যেত আর যেতে যেতে কত কথা, কত হাসি। কিন্তু আজ সবাই যেন বাসার কথা ভুলেই গেছে। প্রভা ডাক দিল – অরণী ওঠ্। ছুটি হয়ে গেছে। আর কাঁদিস না। স্যার এরকমই কথা বলেন। তুই নতুন এসেছিস তো তাই জানিস না।
– ওঠ্ অরণী- নীতু ডাকল। চল বাসায় যাই।
– না তোরা যা। আমি তোদের সঙ্গে যাব না। ভীতুর ডিম সব। সত্যি কথা বলতে পারিস না। স্যার বসে বসে একগাদা মিথ্যে কথা বলে আর তোরা রোবটের মত সেগুলো শুনিস। তোদের একটুও আত্মসম্মান নেই। যা- তোরা কেউ আমার বন্ধু না।
কিন্তু ওরা কেউ নড়ল না। অরণীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকল অপরাধীর মত। ওদের মনে হচ্ছিল আসলেই ওরা ভীতুর ডিম। ওরা সত্যি কথা বলতে পারে না। আর বলবে কী করে – কেউ তো ওদের সত্যকে চিনতে শেখায়নি। অরণীর মা তাকে শিখিয়েছে তাইতো সে বলতে পারে। কিন্তু ওরা তো সমব্যথী। অরণীর কষ্টে তাদেরও যে কান্না পাচ্ছে। ঐ তো রুনীর চোখ থেকে এর মধ্যে জল ঝরছে। সাদিয়ার চোখ দুটোও টলমল করছে। অথচ অরণী এসব কিছুই দেখতে চাইছে না।
বাসায় ফিরেও অরণী মায়ের অপেক্ষায় বসে রইল। বুয়া অনেক চেঁচামেচি করেও তাকে খাওয়াতে পারল না। তারপর অরণীকে ভয় দেখাল, ‘মায়েরে ফোন করুম নে। একখন দেইখো কেমুন রাগটা করে। তিনদিন কথা কইব না’। অনেক দিন ধরে আছে বলে বুয়া অরণীর নাড়ি-নক্ষত্র চিনে ফেলেছে। কিন্তু আজ অরণী অন্যরকম। কান্না ভেজা চোখ দুটো তুলে বলল, ‘বুয়া, একদম চুপ। আর একটা কথা বললে আমি ঘর থেকে বের হয়ে যাব’।
অরণীর এমন রূপ বুয়ার অচেনা। কত ভদ্র নম্র মেয়ে। আজ এমন কেন করছে কে জানে। কিছুক্ষণ অবাক চোখে দেখে তারপর গজগজ করতে করতে চলে গেল – না খাইলে না খাও। আমার কী। তোমারে মায়া করি দেইখ্যাই তো কইলাম।
বিকেলে মা এসে অবাক হয়ে যান। কী রে অরণী, একি দশা তোর। কী হয়েছে? বিছানার পাশে বসতেই মায়ের গলা জড়িয়ে তার বুকের ভেতর মুখ গুঁজে অরণী একটানা কাঁদতেই থাকে, কাঁদতেই থাকে। মা আদর করে মেয়ের কপালের চুলগুলো সরিয়ে চুমো দেন। বার বার জিজ্ঞেস করেন, বল অরণী কী হয়েছে। আমার যে কষ্ট হচ্ছে।
কান্নার দমকটা কমে এলে মা অরণীর মুখটা দু’হাতে তুলে ধরেন।
– আমি আর এই শহরে থাকব না মা।
– কেন রে। ক’দিন আগেই তো বলছিলি এখানে থাকতে তোর খুব ভাল লাগছে। ঢাকার মত যানজট নেই। নিরিবিলি কত সুন্দর। তোর বাবাকে চিঠি লিখলি। তোর বন্ধুরা কত ভাল তার বর্ণনা দিলি। আজ হঠাৎ কী হল? আমার মেয়েতো কখনো এমন করে কাঁদেনি। আচ্ছা সব শুনব। বুয়ার কাছে শুনলাম তুই দুপুরে খাসনি। আয় চল আগে কিছু খেয়ে নিই। তারপর শুনব। কিন্তু অরণী অনড়। আগে বল মা, আমরা এখান থেকে চলে যাব। কালই।
– আচ্ছা যাব। এখন খেয়ে নিই। যেতে গেলে সব বাঁধতে ছাঁদতে হবে না। তার জন্যে তো শক্তি দরকার। না খেয়ে থাকলে শক্তি পাবি কোত্থেকে। ও–ঠ।
তবুও ওঠেনা অরণী। মা উঠে যান। বাথরুম থেকে তোয়ালে ভিজিয়ে এনে অরণীর মুখ-হাত-ঘাড় মুছে দেন। ঠান্ডা পানির ছোঁয়ায় এতক্ষণে অরণীর শরীরটা একটু ঠান্ডা হয়ে আসে। সেই সাথে মনটাও। বুয়া এক গ্লাস সরবত এনে দেয়। মা মুখের কাছে ধরেন। সারাদিনের ক্ষুধা-তৃষ্ণা কাতর অরণী মায়ের হাতেই সরবতটুকু খায়। তারপর জেদ ধরে, আগে আমার কথা শোন তারপর খাব। মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে শুনতে বসেন মা। স্কুলের সেই দৃশ্যটা মনে পড়তে তার মাথাটা আবারও গরম হয়ে ওঠে। তবু নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে অরণী মায়ের কাছে ঘটনাটা বলে যেতে থাকে।
– এবার বল মা, এ স্কুলে কীভাবে পড়ব?
– কেন পড়বি না? তোর স্যার তোর সাথে যে আচরণ করেছেন সেটা খারাপ। কিন্তু তোর তো দোষ নেই। বরং তুই তো সত্যি বলার সৎ সাহস দেখিয়েছিলি।
– তবু মা। তুমি বোঝ না। স্যার ভয়ানক। এখন থেকে সব সময় আমাকে কথা শোনাবে। তারপর তোমাকে কী বলল দ্যাখো। তুমি মুসলমানের মেয়ে কি না।
– বলুক না, কী আসে যায়। আমি তো আমার মত আছি। তুই বরং তোর বন্ধুদের নিয়ে আয় আমার লাইব্রেরিতে। সবাই মিলে বই পড়ুক। বই না পড়লে, না জানলে ওদের সত্যি বলার সাহস আসবে কোত্থেকে।
– হ্যাঁ মা। আসলেই ওরা জানে না। অনেকেতো ভাষা আন্দোলন কেন হয়েছিল সেটাও জানে না। ওদের সঙ্গে গল্প করতে ভাল লাগে না। কেমন ভ্যাদভ্যাদে। প্রভা-নীতু অবশ্য জানে। কিন্তু ওদের বাবা-মা নাকি গল্পের বই পড়লে খুব বকে। তাই ওরা ভয়ে পড়ে না।
– ঠিক আছে, এমন বই দেব তোরা টিফিনের সময় একটু একটু করে পড়বে। ওদেরকে জানাতে হবে স্যার যা বলছেন তা ভুল। এভাবেই তো জনে জনে মুখে মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করে চলেছে। তুই কেন পিছিয়ে যাবি? আয় এখন খাবি।
মা জড়িয়ে ধরে অরণীকে তুলে আনেন।
অরণী এতক্ষণে বুঝতে পারে। এভাবে সবকিছু শেষ হয় না, শেষ করে দিতে দেয়া যায় না। তাহলে মিথ্যে গুলো দিনে দিনে বড় হয়ে সত্যকে গ্রাস করবে, মুছে দেবে।
সে রাতে মা অরণীকে তার লাইব্রেরি রুমে নিয়ে একটা বই তুলে দেন – স্মৃতি ‘৭১। অরণী বলে, ‘আগে তো পড়িনি মা’।
– হ্যাঁ, আস্তে আস্তে সব পড়বি। তোরা পড়বি বলেই তো এত যত্ন করে রাখছি।
– মা, তুমি তোমার ছাত্রছাত্রীদের বল না। তুমি তো বলো ওরাও তোমার ছেলে মেয়ে।
– বলি তো বলি। সুযোগ পেলেই বলি। আমার ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। আমার দুলাভাই, মামা, আরো কতজন। তাদের কত কথা যে ভুলতে পারি না। অথচ তাদের যা বলার ছিল আজ বাংলাদেশ তা ভুলে গেছে। আবার যে জাগাতে হবে সবাইকে। জানাতে হবে। সত্যকে খুঁজতে হবে বইয়ের পাতায়। বধ্যভূমিতে, নগরে-গঞ্জে-গ্রামে। সবখানে, সবখানে। বলতে বলতে মায়ের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। অরণী মায়ের হাতে হাত রাখে, শক্ত করে আঙুলে আঙুল জড়িয়ে ধরে।
প্রভা-নীতু-বন্যা-মরিয়ম এমনকি ক্লাসের সবচেয়ে চুপচাপ মেয়েটা যে মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করে বলে মন খারাপ করে থাকে সেও উত্তেজিত। প্রতিদিন টিফিন ঘন্টায় ওরা পনের মিনিট করে একেকটা লেখা পড়ে। শহীদদের আপনজনদের লেখা। তাদের রক্তাক্ত স্মৃতি যেন রক্তের অক্ষরে লেখা। কষ্টে বুক ভেঙে যেতে চায়। একজন আরেকজনের হাতে হাত রেখে কান্না চেপে রাখতে চায়। তবুও কখন যেন সবার চোখে পানি এসে যায়। পড়া শেষ হলে ওরা বসে বসে ভাবতে চেষ্টা করে ’৭১ এর সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা। স্বাধীনতার জন্য এত কষ্ট করেছে মানুষ, এত রক্ত দিয়েছে! অপেক্ষায় থাকে ওরা কাল কখন আবার পড়বে। ওরা যেন দেখতে পায়- মুনীর চৌধুরীর চোখ বাঁধা মুখ। ডাক্তার আলীম চৌধুরীকে নিয়ে যাচ্ছে রাজাকার মান্নান যাকে তিনি মাত্র ক’দিন আগে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি বুঝতে পারেন নি – এটা ছিল ঘাতকের প্রতারণা। দেখতে পায় বন্দরের প্রকৌশলী শামসুজ্জামান খান, পুলিশ অফিসার ফয়জুর রহমান আহমেদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, সাংবাদিক সাহিত্যিক শহীদ উল্লাহ কায়সার, সিরাজ উদ্দীন হোসেন, কবি সেলিনা পারভীনকে। শহীদেরা যেন ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে জানতে চায় তোমরা কি সত্যকে জানবে না? আমাদের কেন হত্যা করা হল সে বিচার করবে না? এই প্রশ্ন আর সত্যকে জানার আকাঙ্খা তাদের শিরায় শিরায় নতুন চেতনা প্রবাহ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ওরা প্রতিজ্ঞায় শানিত হচ্ছে- আমরা একদিন এ অন্যায়ের বিচার করবই করব।
আজ ক্লাসে ঢুকতে ওদের একটু দেরি হয়ে গেল। মান্নান স্যারের ক্লাস। স্যার এসে গেছেন।
– আসি স্যার?
– আস। এত দেরি কেন? আরো আগে আসতে পার না?
ওদের পনের জনের দলটা ঢুকতে বেশ সময় লাগল। হঠাৎ অরণীর হাতের বইটার দিকে চোখ গেল স্যারের।
– ওটা কী?
– কোনটা স্যার?
অরণী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানতে চাইল।
– তোমার হাতে। দেখিতো কী বই।
অরণী বইটা এগিয়ে দিল। ততক্ষণে প্রায় সবাই সিটে বসে গেছে। অরণীও বইটা দিয়ে সিটে বসল। স্যার বইটা নেড়ে চেড়ে দেখলেন। অরণী লক্ষ্য করেছে বয়স হওয়ার কারণে না কী কে জানে কোন কিছু পড়তে গেলে স্যার চশমা খুলে খুব কাছে নিয়ে চোখ কুঁচকে পড়েন। আজও সেভাবে উল্টে পাল্টে বইটা দেখলেন। তারপর বললেন, ‘স্মৃতি ‘৭১’। বোগাস। সব বাড়িয়ে বাড়িয়ে লেখা। ত্রিশ লক্ষ শহীদ! আরে ব্যাটা কে বলেছে এসব কথা? আমি নিজেও তো তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। ত্রিশ লক্ষ লোক মারা যাওয়া কি সহজ কথা? এসব শেখ মুজিবের বানানো কথা। তাকে বলা হয়েছিল থ্রি থাউজেন আর তিনি বানিয়ে ফেললেন থ্রি মিলিয়ন – ত্রিশ লক্ষ! দশ হাজারও মরেছে কিনা সন্দেহ।
অরণীর কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। প্রভার বলতে ইচ্ছে করে – অন্যায়ভাবে একজনও মরবে কেন স্যার। কিন্তু বলার সাহস না পেয়ে অরণীর হাতটা শক্ত করে ধরে।
স্যার বলে চলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ শহীদ-শহীদ করে অযথা কতগুলো লোক চিল্লায়। আরে কায়েদে আযম না হলে কি মুসলমানরা বাঁচত, না ইসলাম থাকত? শহীদ-ফহীদ সব ফালতু কথাবার্তা।
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় অরণী – একটা প্রশ্ন স্যার।
– কী প্রশ্ন, কিসের প্রশ্ন? খেঁকিয়েওঠেন স্যার।
– আপনি কি রাজাকার ছিলেন?
– হ্যাঁ স্যার বলুন, সত্যি করে বলুন আপনি কি রাজাকার?
অরণী তাকিয়ে দেখে তার সামনে পেছনে সবাই দাঁড়িয়ে। ওদের জিজ্ঞাসা একটাই। আর স্যারের মুখটা ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে। হাতটা কাঁপছে। বইটা হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে। অরণী এক লাফে ছুটে এসে পড়তে থাকা বইটা ধরে ফেলে।
রিফাৎ আরা। চট্টগ্রাম শাহীন কলেজের বাংলার অধ্যাপক।
অত্যন্ত সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ লেখাটার জন্য অনেক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। এ ধরনের লেখা যত বেশি লেখা হবে ততই আগামী প্রজন্মের জানাশোনার অস্পষ্টতাগুলো দূর হতে থাকবে।
সত্যিই, পড়ার বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি। তাই মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস পড়ার দিকে ঝোঁকানো ছাড়া গতি নেই। সেক্ষেত্রে এরকম গল্পের আঙ্গিকে কৌতুহলী করে তোলাটাও জরুরি এখন।
নিয়মিত লিখবেন এই আশা রাখি। আবারো ধন্যবাদ।
অপূর্ব।
রিফাৎ আরা, গল্পটা পড়া হয়নি আগে, নিবেদিতা, আদিল আর সৈকতের মন্তব্য দেখে পড়লাম আজকে। অপূর্ব, পাঠককে যেন টেনে নিয়ে যায় ঘটনার ভিতরে, মনে হয় যেন সবকিছু চোখের সামনে ঘটছে।
পড়ে ছোটবেলার কিছু ঘটনার কথা স্মরণ হওয়ায় মনটা বিষাদে ভরে গেল।
আমার মনে হচ্ছে এটি কোনো গল্প নয়, একেবারে সত্য কাহিনী।
রিফাৎ আরাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
চমতকার গল্প, খুবই বাস্তব ভিত্তিক বিষয়।
এরকম বাস্তব অভিজ্ঞতা মনে হয় আমাদের সবারই কিছু কিছু ঘটে থাকে। শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী বা সম্মানজঙ্ক পেশা ইত্যাদী মানুষকে প্রকৃত শিক্ষিত করে না তার প্রমান ছড়িয়ে থাকে যত্রতত্র।
লেখিকা শাহীন কলেজে পড়ান দেখে অনেক পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমিও ওখানেই ১-১০ পর্যন্ত পড়েছি, তবে ঢাকারটায়।
এককথায় দারুন !খুবই ভাল লাগলো পড়ে ।ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
ভালো লিখেছেন :sarcasm:
Very Nice………really nice………100 out of 10…..
Thanks…….
Waiting for more………
Asraf
খুব ভাল লাগল লেখাটি। এক নিশ্বাসে পড়া শেষ করলাম।
এক কথায় দুর্দান্ত !
রিফাৎ আরা,
লেখাটির জন্যে সুভেচ্ছা রইলো। প্রশ্ন হল ক’জন মা আছেন বাংলাদেশে অরণীর মায়ের মতো? এখনি সময়, আমাদের অরণীরা যেনো মুক্ত খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে বড়ো হতে পারে। মিথ্যার অন্ধ-চোরা গলিতে যেনো হাড়িয়ে না যায়।
Something the time demands most..
অসংখ্য সশ্রদ্ধ সালাম। এতো দুর্দান্ত আর চমৎকার গল্পের জন্য। আসলে গল্প বললে ভুল হবে।কারণ এই গল্প পড়তে পড়তে আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমার ছোটোবেলায়,আমার স্কুল-জীবনে।কেনো যেনো বার বার মনে হচ্ছিলো এটা আমার এ গল্প।আমি যেনো খুব পস্ট দেখছিলাম আমার সেইসব দিনগুলোকে। এমন শিক্ষক আমার জীবনেও এসেছিল দুর্ভাগ্যক্রমে।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
অসংখ্য সশ্রদ্ধ সালাম। এতো দুর্দান্ত আর চমৎকার গল্পের জন্য। আসলে গল্প বললে ভুল হবে।কারণ এই গল্প পড়তে পড়তে আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমার ছোটোবেলায়,আমার স্কুল-জীবনে।কেনো যেনো বার বার মনে হচ্ছিলো এটা আমার এ গল্প।আমি যেনো খুব পস্ট দেখছিলাম আমার সেইসব দিনগুলোকে। এমন শিক্ষক আমার জীবনেই এসেছিল দুর্ভাগ্যক্রমে।
অসংখ্য ধন্যবাদ।