পাহাড়ে ডিসেম্বরের ভোর সকালে ঘন কুয়াশা যখন ধোঁয়াশায় রূপ নেয়, তখন হাত তিনেক দূরেও দৃষ্টি চলে না। সবই ধোঁয়া, ধোঁয়া, ধোঁয়া। কুয়াশা জমে বৃষ্টির মতো টুপটাপ ঝরে পড়ে গাছের পাতা থেকে। ভিজিয়ে দেয় জামা-কাপড়, আপাদ-মস্তক।
…এরই মধ্যে রেস্ট হাউজ নামক বাঁশের তৈরি মাচাং ঘর থেকে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়েছি একাই, হাতে তিন ব্যাটারির টর্চ। সকালের আলোয় বগালেক দেখবো। কিন্তু টর্চের আলো ফ্যাকাশে বলে ভ্রম হয়, তখনো সকালই ফোঁটেনি। চারপাশের ধোঁয়াশার দেয়ালে বাধা পায় চোখ। আমি চামড়ার জ্যাকেট ও তাঁতে তৈরি চাকমা সুতি মাফলার দিয়ে শীত তাড়াতে চাই। একটি সিগারেট ধরিয়ে আবার ফিসে আসি এক কামরার মাচাং ঘরের ডেরায়। তীব্র শীতে রক্ত হিম হয়ে আসতে চায়।
সহযাত্রী সাংবাদিক বন্ধু বুদ্ধজ্যোতি চাকমা তখনও রেস্ট হাউজের কামরায় ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমের ঘোরেই ও আমাকে শুয়ে পড়তে বলে। আমি খাটের ওপর আধ শোয়া হয়ে বালিশে হেলান দেই। বম’দের তাঁতের তৈরি উলের কম্বলে মুড়ে নেই পুরো শরীর। শীত তাড়াতে খাটের নীচ থেকে ছোট্ট পানীয়র বোতল বের করে চুমুক লাগাই মারমা-মদ প্রাইং’এ। কয়েক ঢোক পান করার পর বুদ্ধ ওর খাট থেকেই হাত বাড়ায় বোতলটির দিকে। সে-ও কয়েক চুমুক দিতেই বোতল খালি হয়ে যায়। টর্চের ম্লান আলোয় আমরা ক্রেওকাডং যাওয়ার পরিকল্পনা করি। …
লোকালয় বিচ্ছিন্ন বান্দরবানের রুমার দুর্গম বগালেকের পাড়ের রেস্ট হাউজটিকে আমার প্রাচীণ কোনো গুহা বলে ভ্রম হয়। যেনো পথহারা দুই অভিযাত্রী অবিরাম পরিকল্পনা করে চলেছে উদ্ধারের আশায়। রাত জাগা কোনো পাখি তীব্র চিৎকারে উড়ে যায় মাচাং ঘর বা রেস্ট হাউজের ছনের চালের ওপর দিয়ে। আমাদের আলোচনায় ছেদ পড়ে।
এমনি করে বেলা খানিকটা চড়লে সকাল নয়টা নাগাদ সূর্যের দেখা মেলে। আস্তে আস্তে দৃষ্টি সীমানায় আসে বম পাড়া। আরেকদিকে বগালেক। আমরা আড়মোড়া ভেঙে ঘরের বাইরে আসি। জগের পানিতে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে মাইনস-সিক্স চশমাটি এঁটে আমি তাকাই নীলাভ রঙা সুবিশাল প্রাকৃতিক জলাশয়– বগালেকের অপার বিস্ময়ের দিকে। বেশ কয়েক সেকেন্ড আমার মুখে বাক্য সরে না। এই লেক, লেক ঘেরা সুবজ পাহাড়ের দেয়াল, বম পাড়া– সবই বুদ্ধর খুব চেনা। তবু আমার মুগ্ধতাটুকু ওকেও ছুঁয়ে যায়।
আমি ঝটপট অটোমেটিক অলিম্পাস অটো-জুম ক্যামেরার শাটার টিপে চলি। তখনো কুয়াশায় মোড়া লেকের দূর পাড়ে যেনো সাদা রহস্য-ঝাঁক উড়ে যায়। বুদ্ধ বলে, সেগুলো সাদা বকের ঝাঁক। লেকের মাছ শিকারে নেমেছে।…
আমরা মাচাং ঘরের সিঁড়ি বেয়ে লেকের পাড়ের বড় বড় পাথরের বোল্ডারের একটি দখল করে বসি। পায়ের নীচে বরফ শীতল স্বচ্ছ পানিতে ভাসছে লাল শাপলা-শালকু। সেখানে ঘাঁই মারে ট্যাংরা-পুঁটির ঝাঁক। বুদ্ধ কোথা থেকে একটি বাঁশের কঞ্চি নিয়ে শাপলা-শালুক লতা টেনে নেয়। বলে, শাপলা লতার সঙ্গে খানিকটা সিঁদোল শুটকি দিয়ে ঝোল করে আজ সকালে ভাত খাবো আমরা। তারপর বম গ্রাম প্রধান সাংলিয়ান কার্বারিকে গাইড বানিয়ে উঠে যাবো ক্রেওক্রাডং-এর চূড়ায়।
আরো পরে সকালের আহার শেষে ক্রেওক্রাডং-এর পথে সাংলিয়ান দা’র কাছে শুনি বগালেক নিয়ে বম উপকথা। বম ভাষায় বগা লেক হচ্ছে ‘বগা রেলি’। ‘বগা’ মানে অজগর, আর ‘রেলি’ হচ্ছে লেক। লেকের উত্তরে বাস ছিলো এক ম্রো পাড়ার। সেটি ব্রিটিশ আমলেরও আগের কথা। একবার ম্রো’রা বিশাল এক অজগর সাপ জ্যান্ত ধরে আনেন। পাড়ার সবচেয়ে বুড়ো লোকটি অনুরোধ জানান সাপটিকে যেনো আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ এটি হচ্ছে পাহাড় দেবতা। বুড়োর কথায় কেউ কান দেয়নি।
সবাই মিলে রাতের বেলা সাপটি আগুনে পুড়িয়ে মদ দিয়ে খায়। কিন্তু বুড়ো লোকটি সাপের মাংস ছুঁয়েও দেখেন না।
ওই রাতে পাহাড়ি ঢল নেমে পুরো ম্রো পাড়াটি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পানির স্রোতে মারা পড়েন সবাই। বেঁচে যান একমাত্র সেই বুড়ো। সেই থেকে লেকটির সৃষ্টি।
এখনো নাকি ওই ম্রো বুড়োর ভিটে আর অজগরটির গুহা আছে।…
—
*ছবি: লেখক। এক. বগালেক, দুই. সাংলিয়ান কার্বারি, তিন. বুদ্ধজ্যোতি ও লেখক।
ইচ্ছা থাকলেও ঘোরাঘুরি খুব একটা সুযোগ হয়নি। তাই এধরণের লেখা পড়লে মন খারাপ হয়ে যায়, মনে হয় পিসি ফেলে দূরে কোথাও ঘুরে আসি 🙁 ।
@রামগড়ুড়ের ছানা,
অবশ্যই যাবেন। দরকার সামান্য সময়, অর্থ ও কষ্ট সহিষ্ণুতা। 🙂
@ বিপ্লব রহমান, ক্রেওক্রাডং-এ কি উঠেছিলেন এর পরে?
@বন্যা দি,
অবশ্যই। এ নিয়ে আমার ই-বুক রিপোর্টারের ডায়েরি: পাহাড়ের পথে পথে বইটিতে ‘বাঙাল বিপ্লব লঙ্খিল গিরি’ নামে একটি আলাদা লেখা আছে। ওই লেখাটি অনেক বিস্তারিত। :yes:
ভাইয়া, আমার খুব ইচ্ছা করছে, আপনার দেখা মুগ্ধতা জাগানিয়াকে দেখে আসি!
এতো ঝটপট শেষ হয়ে গেলো লেখা। 🙁
@নীল রোদ্দুর,
লেখাটি ছোট্ট হলেই বা ক্ষতি কী? আপনার ভাল লেগেছে– এটিই বড় কথা। ধন্যবাদ। 🙂
আপনার লেখায় কি যেন আছে। হঠাৎ কুয়াশার স্পর্শ মনটাকে ঘিরে ধরল :rose:
@রৌরব,
তাই? 🙂
হ্যাঁ আমি পাহাড়ি রাজ্যে থাকার সুবাধে লেখকের বর্ণনাকৃত চিত্রের সংঙ্গে সুপরিচিত। উপজাতিদের মধ্যে অনেক উপকথা চালু আছে যার একটি লেখক তুলে ধরলেন। বিপ্লব ভাইকে ধন্যবাদ লেখাটি উপস্থাপন করার জন্য। :rose:
@সুমিত দেবনাথ,
পাঠের জন্য, লেখাটি পছন্দ করার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ। :rose:
তবে আদিবাসীদের ‘উপজাতি’ বলায় আমার আপত্তি রয়েছে। ভাষাগত সংখ্যালঘু আদিবাসীরাও নেতিবাচক এই অভিধা অনেক আগেই বর্জন করেছেন। :deadrose:
ওখানে হয়ত কোনদিনই যাওয়া হয়ে উঠবে না। তবে আপনার লেখার মাধ্যমে ওখানকার অনেক দৃশ্য মনে মনের ভেতর গেঁথে রইল। ধন্যবাদ।
@মোজাফফর হোসেন,
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। :rose:
থেকে
পরেই লেখা শেষ । এত চমৎকার বর্ণনা যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। বিপ্লব রহমান চিত্রকল্পের মত পাহাড়ি ভোর দেখাচ্ছিলেন।সূর্য উঠার সাথে সাথে কি বিপ্লব রহমানের নেশা ছুটে গেল!রূপকথাটি / লোকগাঁথাটি আরও পরে শুনালেও হত।
বগালেকের কথা মন ভরে শোনার জন্যে আফসোস রয়ে গেল।
@গীতা দি,
বগালেকের অপার রহস্য কী আর ভাষা বা ছবিতে প্রকাশ করা যায়? এ জন্য চাই সরেজমিন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।
আপনার পাঠের জন্য ধন্যবাদ। :rose: