লিখেছেনঃ সুজন বড়ুয়া(কিউ বি সুজন)

বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলো পুনর্জন্ম ও ন্যায়বোধ, যা বৌদ্ধ ত্রিপিটকে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। এই তত্ত্ব অনুসারে, প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর পর নতুন একটি জীবনে পুনর্জন্ম লাভ করে এবং তার বর্তমান জীবনের অভিজ্ঞতা তার পূর্বের কর্মফলের প্রতিফলন। এই ধারনাটি ধর্মীয় বিশ্বাসের ভেতর মানুষের দুঃখের কারণ ও মুক্তির পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন ও নৈতিকতার আলোকে এই ধারণাগুলো কতটুকু যৌক্তিক? সমাজ এবং মানবাধিকার কতটা সম্মানিত হয় এই তত্ত্বের অধীনে? এই প্রবন্ধে আমরা বৌদ্ধ ত্রিপিটকের পুনর্জন্ম ও ন্যায়বোধ তত্ত্বের অযৌক্তিকতা, মানবিক সংকট ও নৈতিক সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করব। আমরা দেখব কেন এই ধারণাগুলো আধুনিক মুক্তচিন্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং কীভাবে এগুলো যুক্তির আলোকে কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি।

১. বৌদ্ধ ত্রিপিটক এবং পুনর্জন্ম তত্ত্ব

বৌদ্ধ ত্রিপিটক তিন ভাগে বিভক্ত- বিনয়পিটক, সুত্রপিটক ও অভিধর্মপিটক। এখানে বৌদ্ধ ধর্মের শাস্ত্র, নৈতিকতা, দর্শন ও কর্মফল নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে।

ত্রিপিটকে পুনর্জন্ম তত্ত্ব বর্ণনা করা হয়েছে যে, প্রাণীর মৃত্যু মানেই শেষ নয়; বরং তার কর্মফল তাকে অন্য একটি জীবনে প্রবাহিত করে। এই জীবনের কাজ, চিন্তা ও আচার-আচরণ পরবর্তী জীবনের ধরন নির্ধারণ করে। এইভাবেই সৃষ্টি হয় দুঃখের চক্র, সংশার।

পুনর্জন্মের ধারণা প্রাণীর আত্মা নিরন্তর জীবনের ধারাবাহিকতায় অবতীর্ণ হয়- যদিও বৌদ্ধ দর্শনে ‘আত্মা’ বলে কিছু নেই, বরং ‘অনাত্ম’ বা আত্মহীনতা ধারণা রয়েছে। তাই পুনর্জন্ম বোঝানো হয় মানসিক অবস্থা ও কর্মের ধারাবাহিকতার মাধ্যমে।

২. পুনর্জন্ম তত্ত্বের অযৌক্তিক দিক

*স্মৃতির অভাব

একজন ব্যক্তি যখন নতুন জীবনে জন্ম নেয়, তখন তার আগের জীবনের স্মৃতি থাকে না। তাহলে প্রশ্ন, কে বা কী সেই পূর্বজন্মের ‘কর্মফল’ ভোগ করছে? যদি স্মৃতি না থাকে, তাহলে ন্যায়বিচার অর্থহীন।

জীবনের ধারাবাহিকতা বা আত্মার অস্তিত্ব ছাড়া পুনর্জন্মের তত্ত্বের ভিত্তি অজানাই। জীবনের ধারাবাহিকতা দাবি করা হলেও এই ধারাবাহিকতার কোনও শারীরিক বা মানসিক প্রমাণ নেই।

*কর্মফল ও ন্যায়বিচারের তর্ক

ত্রিপিটকে বলা হয়েছে, প্রত্যেকের দুঃখ ও কষ্ট তার পূর্বজন্মের কর্মফলের ফল। অর্থাৎ কেউ যদি আজ দারিদ্র্য, রোগ বা অন্যায় পায়, সেটা তার আগের জীবন থেকে আসা ‘পাপের ফল’।

এতে জন্মগত বৈষম্য বা সামাজিক অন্যায়ের একটি ধর্মীয় বৈধতা পাওয়া যায়। এটা ন্যায়বিচারের প্রতি মূঢ় ধারণা, কারণ একজন নির্দোষ শিশু কেন তার পূর্বজন্মের অপরাধের জন্য কষ্ট পাবে? এই তত্ত্ব মানুষের মৌলিক মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

*আত্মহীনতা ও পুনর্জন্মের দ্বন্দ্ব

বৌদ্ধ দর্শনের মূল স্তম্ভ ‘আত্মহীনতা’ যেখানে বলা হয়, কোনো স্থায়ী আত্মা বা সত্তা নেই। অথচ পুনর্জন্ম ধারণায় বলা হয়, প্রাণী মৃত্যুর পর আবার জন্মগ্রহণ করে। এটা কি সম্ভব?

যদি আত্মা না থাকে, তাহলে পুনর্জন্মের ধারণার কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা? এই মৌলিক দ্বন্দ্ব বৌদ্ধ দর্শনে অতি প্রবল সমস্যা হিসেবে রয়েছে।

৩. নৈতিক ও মানবিক সংকট

*জন্মগত বৈষম্য ও দুর্বলদের প্রতি অবিচার

পুনর্জন্ম তত্ত্বে জন্মগত দুর্বলতা, দারিদ্র্য, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা ইত্যাদি পূর্বজন্মের কর্মফল হিসেবে ধরা হয়। এতে সমাজে দুর্বলদের প্রতি সহানুভূতি কমে যায়, কারণ তাদের অসুবিধাকে ‘নিজের পাপের ফল’ বলে মনে করা হয়।

এই ভাবনা বাস্তব জীবনের নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য। এটি দারিদ্র্য ও অসুস্থতাকে স্বাভাবিক ও অপরিবর্তনীয় করে তোলে, যা উন্নয়নের পথ বন্ধ করে।

* অপরাধ ও শাস্তির দৃষ্টিভঙ্গি

পুনর্জন্মের ধারনায় বর্তমান জীবনের দুর্নীতি, অপরাধ বা পাপকে পূর্বজন্মের ‘অপরাধ’ বলে ব্যাখ্যা করা হয়। এভাবে অপরাধীদের দোষ চাপানো হয়, কিন্তু সংশোধনের সুযোগ কমে যায়। অপরাধী যে দণ্ডপ্রাপ্ত, তা পূর্বজন্মের জন্য- এখানে বর্তমান ব্যক্তির দায়িত্ব অস্বীকার করা হয়।

আধুনিক সমাজে অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু বৌদ্ধ পুনর্জন্ম তত্ত্বে এ ধারণা সীমিত।

৪. আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের আলোকে পুনর্জন্ম

*বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার অভাব

পুনর্জন্মের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। যদিও কিছু গবেষক পূর্বজন্মের স্মৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন, তা অত্যন্ত সীমিত এবং ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

মানসিক অবস্থা, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন বিজ্ঞান এখনও পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারেনি, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে অদৃশ্য পুনর্জন্মের ধারনা বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য।

* দার্শনিক সমস্যাসমূহ

পুনর্জন্ম ও আত্মহীনতার দ্বন্দ্বের পাশাপাশি, এই তত্ত্বগুলো মানুষের বোধগম্যতার বাইরে কিছু অংশে পৌছে যায়, যা যুক্তিপূর্ণ আলোচনার বাইরে। ফলে, বৌদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস হিসেবে থাকলেও, মুক্তচিন্তার বা যুক্তিবাদের জন্য উপযুক্ত নয়।

৫. সামাজিক প্রভাব ও বিপর্যয়

* সমাজে বৈষম্যের নিবিড়তা

পুনর্জন্মের ধারণার কারণে সমাজে বৈষম্য এবং শ্রেণীবিভাজন আরও প্রবল হয়। কারণ মানুষের সামাজিক অবস্থা পূর্বজন্মের ফলাফল বলে ধারণা করা হয়। এতে উচ্চবর্ণের আধিপত্য এবং নিম্নবর্ণের অবজ্ঞা বেড়ে যায়।

*নারীর অবস্থা

বৌদ্ধ ত্রিপিটকের ধারনায় নারীদের অনেক ক্ষেত্রে নিকৃষ্ট বা নিম্নস্তরের পুনর্জন্ম বলে বিবেচনা করা হয়েছে। এটি নারীর অধিকার ও মর্যাদার প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাবকে উৎসাহিত করেছে।

৬. বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাধান

বর্তমান সময়ে মানবাধিকার, বিজ্ঞান ও দর্শনের আলোকে পুনর্জন্ম তত্ত্বের বদলে জীবনের অর্থ, ন্যায় ও মুক্তির প্রশ্ন ভিন্নভাবে আলোচিত হচ্ছে।

আধুনিক ন্যায়বিচারে প্রত্যেক মানুষ সমান, তার জীবনের অবস্থা নির্ধারণ হয় তার নিজস্ব প্রচেষ্টা, সমাজের সুযোগ-সুবিধা ও পরিবেশের দ্বারা। এটি অধিক মানবিক ও যুক্তিসঙ্গত।

*উপসংহার

বৌদ্ধ ত্রিপিটকের পুনর্জন্ম ও ন্যায়বোধ তত্ত্ব ধর্মীয় ঐতিহ্য ও দর্শন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আধুনিক যুক্তি, বিজ্ঞান ও মানবাধিকারের আলোকে এর অনেক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়।

স্মৃতির অভাব, ন্যায়বিচারের অনৈক্য, আত্মহীনতা ও পুনর্জন্মের দ্বন্দ্ব, সামাজিক বৈষম্য ও নারীর প্রতি বৈষম্য- এসব কারণে এই তত্ত্বগুলো বর্তমান মুক্তচিন্তার মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নয়।

আমাদের উচিত মানবিক মূল্যবোধ ও বিজ্ঞানকে সম্মান করে, দুঃখ ও বৈষম্যের কারণ খুঁজে বের করা এবং তা দূর করার বাস্তবমুখী পথ খোঁজা।

*চিন্তার খোরাক

আপনি কি মনে করেন, একটি ধর্মীয় তত্ত্ব যা মানুষের জন্মগত বৈষম্যকে পূর্বজন্মের ‘পাপের ফল’ হিসেবে মান্য করে, সেটি কি নৈতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য?
আরও প্রশ্ন হলো- বৈজ্ঞানিক ও মানবাধিকার নীতির বিকল্প পথ খুঁজে বের করা না হলে, আমরা কি সত্যিকারের মুক্তি ও ন্যায়বিচারে পৌঁছাতে পারব?

*চূড়ান্ত প্রশ্ন

পুনর্জন্ম তত্ত্ব ন্যায়বোধ, না নৃশংসতা বৈধ করার মোড়ক?

যেখানে বিচার হয় অদৃশ্য জন্মের, শাস্তি ভোগ করে নিরীহ শিশু, অপরাধ কী- কেউ জানে না, প্রমাণ- কিছুই নেই, স্মৃতি- শূন্য!

তাহলে প্রশ্ন জাগে:

এই কি ন্যায়বিচার? নাকি এটি বর্বরতা, যা “ধর্ম” নামক পবিত্র লেবেলে ঢেকে রাখার কৌশলমাত্র?

এই যদি হয় ‘কর্মফল’, তবে তফাৎ কোথায় মধ্যযুগীয় ডাইনী-বিষবাসনা আর আধুনিক পুনর্জন্ম বিশ্বাসের মাঝে?

তবে কি বুদ্ধিজীবীর আসনে বসে থাকা এই তথাকথিত ‘ধর্মতত্ত্ব’ আসলে বিবেকহীন, কল্পনানির্ভর শাস্তির এক প্রাচীন কৌশল- যা প্রশ্ন করলে ‘পাপ’ আর মানলে ‘বিপন্ন’?