ভূমিকাঃ ৪ঠা মে ২০১৪ সামহয়্যারইন ব্লগে “মাদ্রাসা শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সংঘাত, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের অশনি সংকেত” শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশ করি। এই লেখা প্রসঙ্গে ডাঃ পিনাকি ভট্রাচার্য আমার ফেসবুক ওয়ালে একটি নোট দিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন রাখেন। এবং ব্যাখ্যা দাবী করেন মাদ্রাসা শিক্ষা কিভাবে একটি উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির অন্তরায় সেই বিষয়ে। একই সাথে সেই লেখায় মাদ্রাসা শিক্ষা ইতিহাসের খন্ডিত উপস্থাপনায় তার ব্যথিত হবার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। উনার উত্থাপিত ৩টি জিজ্ঞাসা আমার সেই লেখারই অংশ বিশেষ। তিনি জানতে চান- আমার কেন মনে হলো;
১. মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সহায়ক কোন দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে গড়ে ওঠে না
২. তাঁরা একটি উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজের সহায়ক না হয়ে হচ্ছে এর অন্তরায়
৩. মাদ্রাসা শিক্ষা জাতীয় ঐক্য ও সংহতির অন্তরায়
প্রথমত, এই লেখার উদ্দেশ্য মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ ছিল না। একটি আধুনিক উদার গণতান্ত্রিক সমাজে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা বিশেষ করে সরকারের নিয়ন্ত্রনহীন কওমী বা খারিজি মাদ্রাসার শিক্ষা বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য কি ধরণের সমস্যা ও বিপদ সৃষ্টি করছে সেই আলোচনাই ছিল ঐ নিবন্ধের প্রয়াস। একটি বিষয়ের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করা মানে তার কোন অতীত গৌরব বা অর্জন থাকলে তাকে অস্বীকার করা হয় না।আমি যদি আওয়ামী লীগের অপরাজনীতি ও নানা দূর্বলতার কথা বলি তার মানে এই নয় যে, আমি তাদের অতীত গৌরব ও অর্জনকে অস্বীকার করছি। যুক্তি, তর্ক ও আলোচনার ধারা ও প্রবণতাকে প্রধান না করে এই ধরণের প্রশ্ন উত্থাপনকে যথাযথ মনে করি না। সেখানে কেবল বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা শুরু হবার বিষয়টি অতি সংক্ষেপে আলোচিত হয়েছে, বিধায় ইতিহাসের খন্ডিত প্রকাশের সচেতন দূরভিসন্ধি দেখার কোন সুযোগ নেই। আমরা উভয়ই ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিলাম উনি আমার অগ্রজ ছাত্রনেতা। এবং সেই সংগঠনের প্রধান শ্লোগান ও বক্তব্য ছিল সার্বজনীন, গণমূখী, বিজ্ঞানভিত্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা চাই, যে শ্লোগান আজও বর্তমান। এটা শুধু সেই সংগঠনের চাওয়া নয় বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক সংগঠনের চাওয়া। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষানীতিও ছিল সেই আকাঙ্খার প্রতিফলন। তিনি যদি তার অতীত অবস্থানের জায়গায় থাকেন তাহলে এই বিষয়টি বুঝতে খুব কষ্ট হবার কথা নয়। আমি আমার এই আলোচনা কওমী বা খারিজি মাদ্রাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব। কারন সেই লেখার প্রধান আলোচনার বিষয় ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রনমুক্ত কওমী মাদ্রাসা।
কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য
আলোচনার সুবিধার্থে প্রথমে নজর দেয়া যাক ‘বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড’ (বেফাক) নিয়ন্ত্রিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিক্ষার ধারা কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, যে তথ্য’ এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অনেকটা সহায়ক হবে। ১. কওমী মাদ্রাসা সমূহকে এক প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করা। ২. তা’লীম ও তারবিয়াতের মান উন্নয়ন। ৩. সমাজের দ্বীনী চাহিদা পূরণ। ৪. ইসলামের হিফাযত, প্রচার, প্রসার, দাওয়াত ও তাবলীগ এবং ইসলামের উপর আবর্তিত যে কোন হামলার সুদৃঢ় ও প্রামাণ্য জবাব দান। ৫. সমাজে উলামায়ে কিরামের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান প্রতিষ্ঠা। ৬. সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সমূহ কর্মসূচী গ্রহণ। ৭. মাদরাসা ফারেগীনদের জন্য তাখাছ্ছুছ্ কোর্স ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাকরণ। ৮. ইসলামের মূল ঘাটি মসজিদ সমূহের মান উন্নয়ন এবং পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ নির্মাণ ও মসজিদকেন্দ্রিক মক্তব প্রতিষ্ঠা ও এর মান উন্নয়ন। ৯. জনগণের ধর্মীয় চাহিদা পূরণ করার জন্য বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ। ১০. দ্বীনের হিফাযতের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় কর্মসূচী গ্রহণ। ১১. আধুনিক সমস্যাবলীর ইসলামী সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সহায়ক কোন দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে গড়ে ওঠে না
বাংলাদেশের বিশাল শ্রমশক্তি প্রধানত কৃষি, শিল্প, সেবা, এবং ইনফরমাল সেক্টরে নিয়োজিত। আমার গবেষণাপত্রের একটি বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে যে সরকার স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কত শতাংশ শ্রমশক্তি কি ধরণের কাজের সাথে যুক্ত। যেটি ইঙ্গিত করে শিক্ষা অনুযায়ী কাজের অবস্থান, যদিও বাংলাদেশের মত আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় এটাকে তত্ত্বায়ন করার সীমাবদ্ধতা আছে। সেখানে যোগ্যতার চেয়ে কাজের সুযোগ পাওয়াটাই বড় কথা হয়ে দাড়ায়। তারপরও বলতে হয় প্রফেশনাল ও টেকনিক্যাল কাজ করার জন্য (কায়িক পরিশ্রম বাদে) এক ধরণের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রয়োজন হয়।
সারণিঃ শিক্ষার স্তর অনুযায়ী বিভিন্ন শিল্প ও পেশায় নিয়োজিত বাংলাদেশের সমগ্র শ্রমশক্তি
তথ্যসূত্রঃ Labor force survey, various years, BIDS, 2007
এই ধারার সিলেবাসে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি সীমিত পরিসরে এদের নিজস্ব তৈরী বাংলা, ইংরেজী, গণিত, সমাজবিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হলেও উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও উচ্চতর পর্যায়ে আধুনিক ও স্বীকৃত কোন বিষয় এদের পাঠ্যসূচীতে নেই। যে কারনে প্রাতিষ্ঠানিক/অর্থনীতির স্বীকৃত সেকটরে সম্পৃক্ত হতে যে ধরণের সামর্থ্য ও যোগ্যতার দরকার হয় তা তারা এখান থেকে অর্জন করতে পারছে না। তার প্রধান কারন তাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ও প্রাতিষ্ঠানিকতা এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না।
১. এই শিক্ষার কোন সরকারী স্বীকৃতি নেই বলে সরকারী/বেসরকারী বিধিমালা মেনে তারা কোন চাকুরী ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় (লেখাপড়া ও চাকুরীতে) অংশ নিতে পারে না।
২. একই কারণে এরা কোন টেকনিক্যাল-ভকেশনাল ও প্রফেশনাল শিক্ষা নিতে পারে না, বিধায় কোন পেশাগত দক্ষতা বা যোগ্যতা গড়ে ওঠারও সুযোগ নেই।
৩. সামগ্রিক ভাবে এই বিশাল শ্রমশক্তিকে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত অর্থনৈতিক ধারা ও প্রবণতার সাথে খাপ খাইয়ে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না কেবল ধর্মীয় রক্ষনশীলতার কারণে।
৪. তাহলে এই বিশাল শ্রমশক্তির কর্মের প্রধান জায়গাটি কোথায়? পরিসংখ্যান পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে জানা যায় তাদের একটি বড় অংশ মাদ্রাসার শিক্ষকতা, মসজিদের মুয়াজ্জিন-ইমামতি করা সহ ধর্মীয় বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত। কেবল এই কাজ গুলো করতে পারার সুযোগ ও সামর্থকে যদি দক্ষতা ও যোগ্যতা বলে তাহলে তা নিয়ে বিতর্ক করার ইচ্ছে আমার নেই।
ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের যে কাজ সেই ক্ষেত্রে তাদের এক ধরণের যোগ্যতা থাকলেও সে বিষয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির ফরমাল সেক্টরের কোন তথ্য নেই। যদিও এই বিষয়ে কোন গবেষণা আমার চোখে পড়েনি, সাধারণ শিক্ষার উপর যে গবেষণা হয়েছে তার ফলাফলের ভিত্তিতে এই প্রসঙ্গে এ কথা বলা অন্যায্য হবে না যে এই ক্ষেত্রে যে পরিমান মেধা, শ্রমশক্তি, সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করা হয় সেই তুলনায় রেট অব রিটার্ন হবে নেতিবাচক। এই শিক্ষা শেষ করে কেউ যদি উপার্জনমূখী কোন পেশায় যুক্ত হতে চায় তাহলে তাকে আবার নতুন করে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ অর্জন করতে হবে। সেক্ষেত্রে সময় ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় ব্যয় বেড়ে যায় বহুগুন, যা এই প্রান্তিক আয়ের জনগোষ্ঠীর (৮৫%) জন্য একটা বিশাল চাপ।
তাঁরা একটি উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজের সহায়ক না হয়ে হচ্ছে এর অন্তরায়
একটু দেখে নেয়া যাক একটি উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজের নীতি ও বৈশিষ্ট্য কেমন? উদার রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক দর্শন আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা, সাম্য ও সুযোগের উপর গুরুত্ব আরোপ করে যা ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও অবাধ অর্থনৈতিক উদ্যোগকে সমর্থন করে। এক কথায় বলা যায় এই ব্যবস্থা ব্যক্তির স্বায়ত্বশাসনে বিশ্বাস করে যা ব্যক্তির সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায় বদ্ধপরিকর। অধ্যাপক Hobhouse এর মতে “Liberalism is the belief that society can safely be found on the self-direction power of personality, that is only on this foundation that a true community can be built.” এখানে তিনটি স্তর লক্ষ্য করা যায় ১. ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ এবং রাষ্ট্র ধর্মের প্রশ্নে কোনরুপ হস্তক্ষেপ করবে না। ২. ব্যক্তির আয়ের সামর্থ, মালিকানা ও উপাদfনকে সমর্থন করা ৩. প্রত্যেক নাগরিকের রাজনৈতিক ও মত প্রকাশের স্বাধীন অধিকার থাকবে।
এবার দেখা যাক ইসলামী সমাজের ভাবনা কেমন। ১. সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় মানুষের সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্বের পরিবর্তে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্ব মানার ঘোষণা ২. মানব রচিত আইন-বিধানের পরিবর্তে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর আইন-বিধানের আনুগত্য করার অঙ্গীকার ৩. মানব রচিত ব্যবস্থার ধারক-বাহক নেতৃত্বের আনুগত্য ত্যাগ করে আল্লাহর সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) শর্তহীন আনুগত্য-অনুসরণ ও অনুকরণ ৪. ইসলামের পথে চলা এবং আল্লাহর রাসূলের অনুসরণে, তাঁরই প্রদর্শিত পদ্ধতিতে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধিত্বকারী নেতা’র নেতৃত্বে সমাজ ও রাষ্ট্রে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা “ইসলাম” প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
মূলত উদার গণতান্ত্রিক ও ইসলামী সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈশিষ্ট্য বিপরীতিমূখী। ধর্মভিত্তিক শিক্ষার (উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ৬,১০,১১) কারনে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূখী কর্মসূচী/পদক্ষেপ অগ্রসর হতে পারেনি/পারছে না তার কয়েকটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ এখানে উল্লেখ করছি
১. ২০০৯/১০ সালে সরকার কর্তৃক উত্থাপিত নারী নীতি ও নারী অধিকার সনদ বাস্তবায়ন করা যায় নি।
২. ২০১০ এ বর্তমান শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের সময় তারা এর বিরোধিতা করেছে এবং শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন এনে তাদের আস্থায় নেয়া না গেলেও সরকার তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে শিক্ষানীতি গ্রহন করেছে।
৩. তাদের বিরোধীতার কারনে ইউনিফর্ম ফ্যমিলি কোড বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না
৪. গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা হয় কিন্তু এরা যে শিক্ষা পায় তাতে জনগণের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ছাড়া কোন কিছুকে সমর্থন করা হয় না। তারা ইসলামী আইন তথা শরীয়া আইন চালু করতে চায় যে ব্যবস্থা আধুনিক ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
৫. তারা ধর্মনিপেক্ষতাকে সমর্থন করে না তাদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা। ধর্মভিত্তিক সমাজে অন্য ধর্মের/সম্প্রদায়ের নাগরিকদের সমান অধিকার থাকে না। উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজের একটি প্রধান ধারণা হচ্ছে রাষ্ট্র হবে একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, মানে ধর্ম যার যার- রাষ্ট্র সবার।
৬. দেশের বর্তমান সংবিধান ও আইন অনুযায়ী তারা রাজনীতি ও বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করছে ঠিকই কিন্তু ধর্মীয় মতাদর্শ অনুসারে মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতিকে তারা সমর্থন করে না।
৭. ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে নারীদের চলাফেরা ও পোষাক-পরিচ্ছদের কোন স্বাধীনতা থাকবে না। সেখানে পর্দা মানা বাধ্যতা মুলক করা হবে।
৮. একটি গণতান্ত্রিক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য সুস্থ সংস্কৃতি, শিল্পকর্ম ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা যেটিকে তারা সমর্থন করে না। যে কারনে হত্যা, হামলা, হুমকি, মামলা, দেশান্তরের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৮ সালে বিমানবন্দরে নির্মানাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্বলিত লালন স্থাপত্যকে ইসলাম বিরোধী বলে মাদ্রাসা ছাত্ররা একে ভেঙ্গে ফেলেছে। পরে সরকার সেটি অপরসারণ করে। মতিঝিলের বলাকা স্থাপত্য কর্মটি তারা হামলা করে ভেঙ্গে ফেলেছিল। তারা প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছে তারা বাংলাদেশের সব শিল্পকর্ম ধ্বংস করতে চায়। লালন আখড়া, শহীদ মিনার, মেলা, উৎসব, আয়োজনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হামলা চলিয়েছে। এই সব কর্মকান্ড পরিষ্কারভাবে বলে দেয় তাদের তৎপরতা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের সহায়ক না হয়ে হচ্ছে এর অন্তরায়।
মাদ্রাসা শিক্ষা জাতীয় ঐক্য ও সংহতির অন্তরায়
জাতীয় ঐক্য হচ্ছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐক্যমতের ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে সমঝোতা। দেশ স্বাধীন হবার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে সংবিধান রচিত হয়েছে তার রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতিকে আমি জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি মনে করি। বাংলাদেশের প্রধান গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলসমুহও সংবিধানের মূলনীতিকে স্বীকার করে। সেখানে বিরোধ ও সমস্যাগুলো হচ্ছে ক্ষমতাকেন্দ্রীক অপরাজনীতির প্রতিযোগিতা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মাদ্রাসার শিক্ষা ও দর্শন সংবিধানের এই মূলনীতির সাথে কি সঙ্গতিপূর্ণ? তাদের তত্ত্ব ও বাস্তব কর্মকান্ড সে কথা বলে না। মাদ্রাসাভিত্তিক যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে তাদের নীতি ও কর্মসূচীও এর বিপরীত। বাংলাদেশের কয়েকটি প্রধান দিবস-উৎসব-উদযাপনের দিকে নজর দিলেই দেখা যাবে অবস্থাটা কেমন পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিক। একটি স্বীকৃত রীতি-নীতির বিপরীতে সমাজের একটি অংশ যে শিক্ষা লাভ করছে তা কোনভাবেই জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্য সহায়ক না।
বিজয়, স্বাধীনতা, শহীদ দিবসে দল বেঁধে ফুল দেয়া, প্রভাতফেরী, কুচকাওয়াজ ও মাঠে যাওয়া, জাতীয় সংগীত গাওয়াসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চেতনামুলক কর্মসূচী-আয়োজনকে তারা ইসলামবিরোধী মনে করে। বাংলদেশের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের ধারণা একমুখী (অনেকটা এই উপমহাদেশে ইসলাম বিকাশের সাথে সম্পর্কিত)। ভাষা ও স্বাধীনতা সম্পর্কে তাদের ধারণা খন্ডিত। নববর্ষ, নবান্ন, চৈত্রসংক্রান্তি, মেলাসহ ইত্যাদি উৎসব-আয়োজন তাদের কাছে অনৈসলামিক ও হিন্দুয়ানী বিষয়। দেশাত্ববোধক গান, রবীন্দ্রসংঙ্গীত, নজরুলগীতি, পল্লীগীতি, আধুনিক, ভাটিয়ালী, গণসংঙ্গীত, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, লতা, হেমন্ত, আব্বাস আলী, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি, চলচ্চিত্র, পালাগান, যাত্রা ইত্যাদি অপসংস্কৃতি। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মু্ক্তবুদ্ধির চর্চাকে মনে করে নাস্তিকতা। ভাষা-স্বাধীনতা-গণতন্ত্র প্রভৃতির স্মরণে ভাষ্কর্য ও বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়া শিরক। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা ও নান্দনিকতা বর্ধনের যে কোন শিল্পকর্ম ও ভাষ্কর্যের এরা ঘোর বিরোধী। এগুলো তাদের কাছে মূর্তি পুজার সামিল!
কওমী মাদ্রাসার রাজনৈতিক সংযোগ
পূর্বের লেখায় এই ধারার ছাত্র ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক, সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম। এখানে কওমী মাদ্রাসার রাজনৈতিক সংযোগের তথ্যটি তুলে ধরছি। বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগের কার্যক্রম পরিচালিত হয় কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকে। এই দলগুলোর অন্যতম ইসলামী ঐক্যজোটের জোটভুক্ত সাতটি দল, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস (ইসহাক), খেলাফতে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতাকর্মী সবাই কওমি মাদ্রাসার। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, দেশের শীর্ষ এমন দুই আলেম সমকালকে বলেন, যত বড় মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রক, তত বড় নেতা। যে নেতার মাদ্রাসায় যত বেশি ছাত্র, তিনি তত ক্ষমতাবান।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কার্যক্রমও পরিচালিত হয় কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকে। দলীয় কার্যালয়ও মাদ্রাসা ভবনে। ইসলামী ঐক্যজোটের কার্যালয় লালবাগ জামেয়া আরাবিয়া কোরানিয়া মাদ্রাসায়। দলটির শীর্ষ নেতাদের সবাই এ মাদ্রাসার শিক্ষক। খেলাফত আন্দোলনের কার্যালয় কামরাঙ্গীরচরের জামেয়া নূরানী মাদ্রাসায়। এ দলটির নেতারাও এই মাদ্রাসার শিক্ষক। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা দলীয় কর্মী। বাংলাদেশে খেলাফত মজলিসের পল্টনে একটি দুই কামরার কার্যালয় থাকলেও মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসা থেকে দলের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। খেলাফতে ইসলামের কার্যক্রম পরিচালিত হয় লালবাগ মাদ্রাসা থেকে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পরিচালিত হয় ফরিদাবাদের মাদ্রাসা থেকে। এসব দলের জেলা কার্যালয়ও ওই সব জেলার বিভিন্ন মাদ্রাসায় অবস্থিত। যেমন ময়মনসিংহের জমিয়া ইসলামী মাদ্রাসা ব্যবহৃত হয় ইসলামী ঐক্যজোটের কার্যালয় হিসেবে। ধর্মভিত্তিক সর্ববৃহৎ সংগঠন হেফাজতে ইসলামও পরিচালিত হয় চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে। সংগঠনের মহানগর, জেলা ও উপজেলা শাখার কার্যক্রম পরিচালিত হয় ওই সব এলাকার মাদ্রাসাগুলো থেকে।
পরিশেষে
বিভিন্ন ধারার শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, দর্শণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানে বিরোধ, সমন্বয়হীনতা ও সাংঘর্ষিক অবস্থা স্পষ্ট। রাষ্ট্র হচ্ছে একটি ইহলৌকিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তার চরিত্র হবে সার্বজনীন এবং ধর্মের প্রশ্নে তার অবস্থান হবে নিরপেক্ষ। কিন্তু সেই নীতির লংঘন করে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতায় বেড়ে চলেছে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার ধারা। নিজ ধর্মের চর্চা আর একটি জাতির ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতির সাম্প্রদায়িকীকরণ এক কথা নয়।
সেখানেই প্রশ্ন রেখেছিলাম, অভিন্ন ধারার শিক্ষাপদ্ধতি চালু হবে কি না? ধর্মীয় শিক্ষা যদি রাখতেই হয় সেখানে কি শিক্ষা দেয়া হবে, এবং তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে? সাম্প্রদায়িক শিক্ষার অপরিকল্পিত বিকাশ দেশের যতটুকু অর্জন তাকেও বিপদগ্রস্থ করছে নানাভাবে। বিভিন্ন ধারার শিক্ষা বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পথে বড় বাধা ও উন্নয়নের অন্তরায়। একটি দেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্রের পরিচয়টিও ফুটে উঠবে তার শিক্ষাব্যবস্থার উপর। ইসলামি রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এক বিষয় নয়। উভয়ের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বিপরীত। এখানেই প্রধান বিবেচনার বিষয় বাংলাদেশে যে সব রাজনৈতিক দল ‘উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী’ তাদের সিন্ধান্ত নিতে হবে তারা কোন পথে হাঁটবে।
দোহাই
ড. মঞ্জুরে খোদা, মাদ্রাসা শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সংঘাত, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের অশনি সংকেত
যে কারণে কওমী মাদ্রাসার স্বীকৃতি চান না ধর্মীয় নেতারা, দৈনিক সমকাল/বাংলাকাগজ ৮ অক্টোবর ২০১৩
ড. সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ২০০৮
বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) http://befaqbd.com/
বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের ঘোষণা ও কর্মসূচী
Rushidan Islam Rahman, Labour market in Bangladesh changes, inequalities and challenges, Bangladesh Institute of Development Studies, Dhaka, 2007
আবু সাঈদ খান, কওমী মাদ্রাসা প্রাথমিক পাঠক্রম, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ, দৈনিক সমকাল, ১৩ মার্চ ২০১৪
——————————————————————————————–
ডঃ মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। লেখাটি ২০১৪ সালে লিখিত, এখানে সংরক্ষণ করছি। কিছু বিষয়ের আপডেট প্রয়োজন, শীঘ্রই তা করা হবে।
Leave A Comment