আমার বাবা তোফাজ্জল হোসেন মোক্তার, কনভেনশন মুসলিম লীগের সিরাজগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহুকুমা) সভাপতি ছিলেন এবং তিনি তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পর কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা তাঁকে বাসা থেকে গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখেন ও নির্যাতন করেন, যদিও তাঁর বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারী মামলা ছিল না। ১৯৭২ সালের কোন এক সময় সেই মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে বিনাবিচার হত্যা করে লাশ গুম করে।


যুদ্ধচলাকালীন সময়ে এমন ঘটনা ঘটলে কোন কথা ছিল না। দেশ স্বাধীন হবার পর অস্থায়ী সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আইন হাতে তুলে না নেয়ার নির্দেশার পরেও তারা সেটাকে অগ্রাহ্য করে আমার বাবাকে হত্যা করে। উনার যদি কোন অপরাধ থাকতো তাহলে তাঁকে বিচার করে শাস্তি দিলে কোন দুঃখ ছিল না। বন্দী হিসেবে থাকা অবস্থায় কেন তাঁকে জেলখানার ভিতরে হত্যা করা হলো? কোন আইনে তা করা হলো? জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের তো হত্যা-নির্যাতন করার নিয়ম নেই। কিন্তু এভাবে কাউকে হত্যা করা কি কোন স্বাভাবিক ঘটনা? এটাই স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রথম বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বা জেল হত্যার সূচনা।

এতদিন পরে কেন এই আলোচনা সূত্রপাত?  

২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট আমার বাবার জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে ফেসবুকে একটি স্টেটাস দিয়েছিলাম। সেটা কোন রাজনৈতিক বিষয় ছিল না, সন্তান হিসেবে বাবার প্রতি ছিল নিতান্ত ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা-স্মরণ! সেটাই ছিল কতিপয় তথাকথিত চেতনাধারীর গাত্রদাহের কারন! সেখানে আমার বাবাকে ঘিরে কিছু চেতনাধারী ব্যক্তির আক্রমন বিষ্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি। তখনই মনে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবার অবস্থান পরিষ্কার করাটা জরুরী।

সেখানে মন্তব্যগুলো ছিল এমন, “আপনারা/তোমরা যতই প্রগতিশীল হন না কেন, আপনারা/তোমরা রাজাকারের সন্তান, আপনার বাবা একজন রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধী, তিনি অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে, বাড়ীঘর জ্বালিয়েছে, নারী নির্যাতন করেছে, লুটপাট করেছে। আপনারা যতই স্বাধীনতার কথা বলেন, প্রগতিশীল হন, আপনারা রাজাকারের সন্তান! আপনি/তুমি রাজাকার বাপের ছবি ফেসবুকে দাও লজ্জা করে না? আপনাদের ঘৃণা করি ইত্যাদি। আর লেখালেখির কারণে ”রাজাকারের বাচ্চারা বড় বড় কথা বলে” এমন কথা তো সবসময়ই শুনতে হয়

এই জুন মাসে সিরাজগঞ্জে গেলে আবারো তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখো হই। এবার রীতিমত আমার ভাইদের বিরুদ্ধে কতিপয় তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা ‘ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির’ ব্যানার নিয়ে নেমেছিলেন। যে ’নির্মূল কমিটি’ প্রতিষ্ঠায় আমরা সক্রীয় ভূমিকা রেখেছি, তারা ক্রমাগত আমাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ঘৃণা ছড়িয়েছেন, মিথ্যাচার করেছেন। ঘাতক-দালাল বিরোধী আন্দোলন করতে যেয়ে আমরা বছরের পর বছর আত্মগোপনে থেকেছি, হামলা-মামলার স্বীকার হয়েছি এবং জেল খেটেছি।

কেন তারা এই কাজ করছে? 

আমার অনুজ এডভোকেট মাহবুবে খোদা টুটুলের সাথে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটধারী ডা. জহুরুল হক রাজার প্রাইম হাসপতালের মালিকানা ও ব্যবসায়িক বিরোধ। ব্যবসায়িক বিরোধে সুবিধা করতে না পেরে- ডা: রাজা টুটুলের প্রতি তার ক্রোধের প্রতিশোধ নিতে পরিকল্পিতভাবে এই রাজাকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ইস্যুকে কাজে লাগায়।

টুটুলের পরিচয়, সে জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। প্রসূন থিয়েটারের সভাপতি। ৯০এর গণআন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। সিরাজগঞ্জের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অত্যন্ত পরিচিত মুখ। বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সাথেও যুক্ত।

সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক অন্য ভাইদের পরিচয়:

আমি মঞ্জুরে খোদা টরিক (পিএইচডি) সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদ। একজন লেখক-গবেষক ও কলামিস্ট। বর্তমানে কানাডার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত।

ফজলে খোদা লিটন, সিরাজগঞ্জ জেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ছাত্র ইউনিয়ন সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ইত্তেফাকের সাবেক জেলা প্রতিনিধি। ৯০ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক।

ডঃ কুদরতে খোদা, ৯০এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সংগঠক, জাতিসংঘের সাবেক গবেষক, জাপান ও কানাডায় দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য বেসরকারি বিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

এডভোকেট আশেকে খোদা, সাবেক আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, সাবেক পিপি ও জেলা দায়রা জর্জ, সিরাজগঞ্জ, সাবেক কর্মকর্তা রেডিও পাকিস্তান।

এখানে ভাইদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরার কারণ আপনারা যেন সহজেই বুঝতে পারছেন, আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও বিশ্বাস। আমরা সবাই এদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবতার পক্ষে কাজ করেছি ও করছি। কেউই বাবার রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত নই। বরং তার বিপরীতে আমাদের অবস্থান।

ডাঃ রাজা ও জগলু’রা আমার বাবার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো করেছেন:  

১। আমার বাবা হাজার হাজার পরিবারকে হত্যা করেছে ও তিনি নারী নির্যাতনকারী!

২। তিনি অন্যের সম্পদ লুষ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেছেন, তাঁর লুটের টাকায় আমরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে কাজ করছি,

৩। তারা বলছে, বাবাকে জেলখানায় বিচার করে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে।

৪। আমরা রাজাকারের বংশধর। আমাদেরকে ক্ষমা চাইতে হবে?

তাদের এই সব মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমার বক্তব্য:

১। হাজার পরিবার লাগবে না, তাঁর বিরুদ্ধে আনীত একটি হত্যার প্রমান দিন। হত্যা তো দূরের কথা, তিনি বরং এলাকার মানুষের জান-মাল রক্ষা করেছেন। এলাকার বয়োজ্যষ্ঠরাই সে কথা বলবে। তিনি কোথায়, কিভাবে নারী নির্যাতন করেছেন তার প্রমান দিন। সিরাজগঞ্জের দুইজন বীড়ঙ্গনার একজন এখনো জীবিত আছেন। তিনি বলেছেন যে, আমার বাবা তাঁর জীবন ও সম্ভ্রমকে রক্ষা করেছেন। তার তথ্য-প্রমান আমার হাতে আছে।

২। আমার বাবার কার কি লুট করেছে বলুন? কার সম্পদ দখল ও অগ্নিসংযোগ করেছে তার প্রমান দিন। সেটা প্রমান দিতে না পারলে এর জবাব আপনাদের দিতে হবে। বরং স্বাধীনতার পর কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বাসার সব কিছু লুট করে নিয়েছে। তার প্রমান আমাদের কাছে আছে।

৩। কোন অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে? কোন আইনে তাকে হত্যা করা হলো সে তথ্য অবশ্যই আপনাদের জানাতে হবে। স্বাধীনতা উত্তর সিরাজগঞ্জ জেলার প্রসাসনিক প্রধান ইসমাইল হোসেন আমাকে বলেছেন, এ ধরণের কোন ঘটনা ঘটেনি। (তাঁর সাক্ষাতকার আমার কাছে আছে)

৪। আমার বাবা যদি কোন অপরাধ করে থাকে তাহলে জাতির কাছ ক্ষমা চাইবো। কিন্তু তার আগে বলুন, আমার বাবাকে কেন বিনাবিচারে হত্যা করে, লাশ গুম করা হলো, পরিবারকে দেয়া হলো না?

আমার বাবা সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিবেশিদের বক্তব্য:

  • মুক্তিযুদ্ধত্তোর সিরাজগঞ্জ জেলার সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন ও আমির হোসেন ভূলু তারা উভয়েই বলেছেন যে, ”তোমার বাবা মুসলিম লীগ করতেন, স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছেন কিন্তু কোন সুনির্দিষ্ট অপরাধ (হত্যা, দখল, নারী নির্যাতন, লুটপাট) করেছেন এমন কোন বিষয় আমাদের জানা নেই।”
  • বীর মুক্তিযোদ্ধা কায়সার সরকার বলেন যে, ”তোর আব্বা কাউকে হত্যা করা তো দূরের কথা বরং মুক্তিযোদ্ধাদের ও এলাকার মানুষদের রক্ষা করেছেন।”
  • অধ্যাপক বেগমা আপা বলেছেন, ”তোর বাবার কারনেই আমার আব্বা (আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা. জসিমউদ্দিন) জীবন রক্ষা পেয়েছে।”
  • আমাদের প্রতিবেশি হিন্দু পরিবারের প্রধান অর্জুন বলেছেন, ”সেই সময় আমি দেখেছি, তোর আব্বা অনেক মানুষকে বাঁচিয়েছেন। তোদের বাসায় লোকজন কোন বিপদে পড়ে এলে তিনি তাদের রক্ষা করেছেন।”
  • আমার বাবার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা জানতে আমি সিরাজগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবেশি, এলাকাবাসী, বর্ষিয়ান মুরব্বী এবং স্থানীয় রাজনীতিকদের সাথে নানা পর্যায়ে কথা বলেছি, তাঁদের সাক্ষাতকার গ্রহন করেছি।

আমার বাবা তোফাজ্জল হোসেন মোক্তারকে বিনাবিচারে জেলখানায় হত্যা করা হলো অথচ ১৯৭৩ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শান্তি কমিটির প্রধান খাজা খায়রুদ্দিন, খান এ সবুর, ডাঃ আবদুল মুতালিব মালেক, শাহ আজিজুর রহমান, শর্ষীনার পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ, ওয়াহিদুজ্জামান, একেএম শামসুল হক, একেএম ইউসুফ, আব্বাস আলী খানসহ প্রায় ২৬ হাজার স্বাধীনতা বিরোধী মুক্তি পেলো!

পরিষ্কার করে বলছি, আমার বাবার ভূমিকার জন্য সন্তান হিসেবে আমাদের কোন দায় নেই। কেননা, সেই সময় আমরা শিশু-নাবালোক ছিলাম। আমরা যদি তাঁর সেই রাজনীতি অনুসরণ করতাম সেক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন ছিল। অথচ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও ঈর্ষার কারণে আমাদের পারিবারিক ভাবমূর্তি নষ্ট করতে উদ্দ্যেশ্যমুলকভাবে ক্রমাগত ’আমাদের রাজাকারের সন্তান’ বলে গালিগালাজ করছেন। আজন্ম স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবতা ও সমাজপ্রগতির পক্ষে- সংগ্রাম করার পরো যদি আমাদের রাজাকারের সন্তান বলা হয়, তাহলে আমিও আজ উচ্চস্বরে বলতে চাই, ’আমি হত্যা ও গুমের শিকার এক বিচার বহির্ভূত রাজাকারের সৎ, গর্বিত ও দেশপ্রেমিক সন্তান।

আজ আমার বাবার ১০৫তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানাই।

ডঃ মঞ্জুরে খোদা (টরিক),

১৪ আগস্ট ২০২৪।

[/fusion_text][/fusion_builder_column][/fusion_builder_row][/fusion_builder_container]