অভিজিৎ রায়ের হত্যার পর দীর্ঘ নয় বছর কেটে গেল এই নয় বছরে অভিজিতের হত্যাকারীদের মধ্যে কয়েকজনের বিচার হয়েছে এবং দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে দুজন পুলিশের হাত থেকেই পালিয়েছে, সেই ঘটনা ঘটেছে এক বছরের ওপর হবে অভিজিতের হত্যাকারীদের বিচারের মতনই এই পলায়ন বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব পায়নি, স্বচ্ছতার অভাবে পুরো বিচারপ্রক্রিয়া ও পরবর্তী ঘটনা আমাদেরকে হতাশ করেছে। আমরা এটাও বুঝতে পারছি ২০১৫-২০১৬ সনের মুক্তচিন্তার লেখক ও কর্মীদের হত্যার বিচার ও সামগ্রিকভাবে ওই সময়টির মূল্যায়ণের জন্য বাংলাদেশে কোনো সংস্থা কাজ করছে না। এটি সদিচ্ছার অভাবের জন্য নয়, বরং দেশে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সেই কাজ এখনো বিপজ্জনক, সেই জন্য।

কে ছিলেন অভিজিৎ রায়, কে ছিলেন আরো অনেক লেখক, যাদেরকে প্রাণ দিতে হলো? এই তরুণেরা অন্যায় কিছু করেননি, তাঁরা কাউকে হত্যার জন্য ডাক দেয়নি, কারাগারে কাউকে বন্দি করার জন্য আবেদন করেনি। বরং দেশের সংবিধানে উল্লিখিত ব্যক্তিস্বাধীনতার চর্চা করতে চেয়েছিলেন, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে চেয়েছিলেন। মানসিক পশ্চাদপদতা থেকে উত্তীর্ণ করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের গবেষণার মধ্যে ছিল বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য। একটি দেশ তখনই মহান হয় যখন সে বিভিন্ন মতামতকে গ্রহণ করে তাদেরকে স্থান দিতে পারে। দেশ তাদেরকে স্থান তো দেয়নি বরং মেরে ফেলেছে, অনেকেই প্রাণভয়ে দেশান্তরী হয়েছেন, আর দেশে যারা আছেন তাঁরা বাধ্য হয়েছেন তাঁদের লেখা বন্ধ করতে। দেশের জন্য এটা কোনো গর্বের বিষয় নয়, বরং লজ্জার বিষয়। দেশমাতৃকা যখন তার গুণী সন্তানদের স্থান দিতে পারে না, বরং পশ্চাদমুখী চিন্তাকে প্রশ্রয় দিয়ে সামগ্রিকভাবে দেশকে মানসিকভাবে জরাগ্রস্ত করে দেয়, তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হয়ে যায় সুদূর পরাহত আমরা খুঁজে পাই সেরকম মানুষদের যারা সেই ‘চেতনা’ কথাটা নিয়ে ঠাট্টা করে, অথচ এই মানুষদেরই রাষ্ট্র এখন প্রশ্রয় দেয়, এই মানুষেরাই ব্লগার হত্যায় উল্লসিত

আজ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিনির্ভর জ্ঞানচর্চাকে পরিহার করা হচ্ছে, অত্যাচারিত হবার আশংকায় সংবাদ মাধ্যম শাসক-স্তুতি বিনে তাঁদের মনের কথা বলতে লিখতে বা প্রকাশ করতেও ভয় পাচ্ছেন, নাগরিককে বশে রাখতে করা হচ্ছে অবাধ ধর্মীয় মৌলবাদের চর্চা। নাগরিকের নিজ অধিকারকে ভুলে যাওয়া এবং সেই অধিকার চর্চা না করা, নতুন প্রজন্মকে ধর্মান্ধতায় পতিত করা, বাঙালি জাতি বা বাংলাদেশি নাগরিক একজন মানুষ না হয়ে ধর্মান্ধ জাতীয়তার বোধ হওয়া, এমন সবকিছুই পেছন পানে চলবার পথ। দেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের সাথে সাথে কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও অর্থ রাতারাতি উধাও হয়ে যায়, পাচার হয়ে যায়, কর ফাঁকি, ধনী পুনঃ পুনঃ ঋণখেলাপিদের ক্ষমা করে দেওয়া হয় অথচ নিম্নবিত্ত ব্যক্তির ঋণমুক্তির ব্যবস্থা নেই। এগুলো হয়তো আমাদের জন্য খুব বড় ব্যাপার, এর সব কার্যকারণ আমরা বুঝতে পারি না, কিন্তু এই বিশাল চক্র একটি সূত্রে গাঁথা। ধর্মীয় অন্ধত্ব আমাদেরকে দুর্নীতি থেকে মুক্ত করতে পারেনি, আমাদেরকে মানবিক করেনি


অভিজিৎ রায় বেঁচেছিলেন ৪৪ বছর পর্যন্ত, জীবনের শেষ পনেরোটি বছরে মানুষের জীবনে বিশ্বাস ও ধর্মের স্থান বুঝতে চেয়েছেন, মহাবিশ্বের উৎপত্তি থেকে বর্তমান পর্যন্ত মহাজাগতিক ইতিহাস জানতে চেয়েছেন। লিখেছিলেন  ‘অবিশ্বাসের দর্শন’, ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’, ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’। কিন্তু অভিজিতের চিন্তার জগৎ ছিল আরো বিস্তৃত।  মনোবিজ্ঞান আর জীববিজ্ঞানের ভিত্তিতে লিখেছেন ‘ভালোবাসা কারে কয়’ আর ‘সমকামিতা’। ‘মুক্তমনা’ প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টি করে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। মুক্তমনাদের হত্যা করে, ভয় দেখিয়ে, ডিজিটাল আইন করে সেই আন্দোলনকে এখন স্তিমিত করা হয়েছে বলে মনে হলেও, চিন্তা-চেতনা উন্মেষের সেই অঙ্কুর বিনষ্ট হয়নি, বরং ইতিহাসে এর অবদান স্থায়ীভাবে রয়েছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর থেকে শিক্ষা নেবে। মানবিক হবে।

 

মুক্তচিন্তার জয় হোক।

যুক্তি আনুক মুক্তি।  

 

মুক্তমনার ই-বুকগুলো দেখতে বা ডাউনলোড করতে এখানে এবং এখানে ক্লিক করুন।