লিখেছেন: মোহাম্মদ রুবেল

খ্রিষ্টান ভূমি ইয়োরোপকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে বহুপথ হাঁটতে হয়েছে। ক্যাথলিক গির্জা যখন মানুষের দান- খয়রাতের কল্যাণে অর্থ-ভূমি- প্রতিপত্তির দানবীয় রুপ ধারণ করে তখনই সংঘাত বাধে রাস্ট্রের সাথে। গির্জার দৌরাত্ম এতো বেশি ছিল যে, রাস্ট্র নিজেই গির্জার প্রজা হয়ে গিয়েছিল। এক পর্যায় রাস্ট্রের সাথে গির্জার সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। সমান্তরালে টাকার ভাগাভাগি নিয়ে খ্রিস্ট ধর্মের বিভিন্ন সিলসিলার মধ্যে রক্তাক্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।এই যুদ্ধে শুধুমাত্র ১৬১৮ সাল থেকে ১৬৪৮ সালে মাএ ৩০ বছরে জার্মানি ও কেন্দ্রীয় ইয়োরোপে স্থানভেদে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা হ্রাস পায়।জার্মানির ওটেমবার্গ রাজ্যে জনসংখ্যা কমে ৭৫ শতাংশ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কোন দেশে যদি শতভাগ নাগরিক এক ধর্মের লোক হয় তবুও সে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রয়োজন।কারণ একটি ধর্মের বিভিন্ন মাজহাব রয়েছে, সবাই সবার মাজহাবকে সঠিক মনে করে এবং এর নীতি প্রয়োগ করতে চায়।এর ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। আধুনিক রাস্ট্রে বহু জাতি ধর্মের লোকজন বসবাস করে। ফলে অসংখ্য ধর্মীয় দল- উপদল সৃষ্টি হয়। তাদের মধ্যে রক্তারক্তি বন্ধের জন্য রাস্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মনিরপেকক্ষতার বিকল্প কি আর হতে পারে?

এখন অনেকে যুক্তি দেখাবেন যে যুক্তরাজ্যে তো কোন লিখিত সংবিধান নেই এবং আইন অনুযায়ী যুক্তরাজ্য ধর্মনিরপেক্ষ রাস্ট্র নয়।রাস্ট্র প্রধানের দায়িত্ব যখন রাজা বা রাণী গ্রহন করেন তখন তাকে শপথ নিতে হয় যে তিনি চার্চ অব ইংল্যান্ডের ধর্ম রক্ষা করবেন, কারণ চার্চ অব ইংল্যান্ডের ধর্ম হলো ইংল্যান্ডের রাস্ট্রীয় ধর্ম।হাউস অব লর্ডসে ২৬ জন অনির্বাচিত যাজক পদাধিকার বলে সদস্য হন যারা তাদের পছন্দ না হলে আইন অনুমোদনের বিরোধিতা করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো যুক্তরাজ্য সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ না হলেও ব্যাক্তি পর্যায়ে যুক্তরাজ্যে যত নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা রয়েছে তা পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে কিনা তা আমার জানা নাই। এক্ষেএে আমরা বলতে পারি নাগরিকের যাবতীয় স্বাধীনতা শুধু আইনের ওপর নির্ভর করে না,নির্ভর করে আইনের শাসনের ওপর।সারকথায় বলা যায়,যুক্তরাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি হলো মানুষের সংস্কৃতি যা অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। বৃহৎ গণতান্ত্রিক ভারতের সংবিধান শতভাগ সেক্যুলার ও ধর্মনিরপেক্ষ।তবুও সেখানে ধর্মীয় দাঙ্গা ও জাতি ভিত্তিক কলহ কেন? এর কারণ আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় রাস্ট্রীয় ব্যার্থতা।ভারতে বর্ন হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের আর্থসামাজিক অবস্থা তুলনায় অনেক নিচে আর বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায় নানা অজুহাতে এাসের রাজত্ব কায়েম করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করছে। ভারতের মতো বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক অবস্থান নিচের দিকে।দুইদেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ হলেও আইনের শাসন ও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে সংখ্যালঘুরা বঞ্চিত হচ্ছে ও আইনের শাসনের আওতায় আসছে না।

 

অনেকে রাস্ট্রীয় অশান্তিতে শান্তির ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মকে টেনে আনেন। মুরতাদকে শুধু ইসলাম ধর্মই মৃত্যুদন্ড দেয় না, আমাদের মহামতি অশোকও এমন কার্য করেছিলেন।বিশ্বের মূল ধারার সকল ধর্মই অবিশ্বাসিদের বেলায় চরম নির্দয় ও নির্মম।স্পেনের ইনকুইজিশন ক্যাথলিক মতবাদে যারা বিশ্বাস করতো না, ক্যাথলিক চার্চ তাদের মৃত্যুদন্ড দিতো।বৌদ্ধ গ্রন্থ অশোকবদানে বলা হয়েছে, সম্রাট অশোক ‘আজিবিক’ নামক বৌদ্ধ উপদলের একটি গ্রন্থে গৌতম বুদ্ধকে জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীরকে প্রণামরত অবস্থায় দেখানো হয়েছে শুনে এত বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে, তিনি পুন্ডুবর্ধনের সব আজিবিককে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন। ১৮ হাজার আজিবিককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় উত্তরবঙ্গে।

লেজ বিশিষ্ট পাকিস্তান রাস্ট্রের জনক জিন্নাহ সাহেব ১১ই আগস্ট গণপরিষদের পতি হিসেবে যে ভাষণ দেন তার যথাযথ প্রয়োগ হলে আমাদেরকে এখন বারো ঘাটের জল খেতে হতোনা,যদিও এই ভাষনের ফলাফল হিসেবে তার দেশের সামরিক উর্দিওয়ালারা তারই পশ্চাতদেশে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করে রাজনীতির মূল মঞ্চ হতে তাকে সরিয়ে দেয়।জিন্নাহ সেদিন বলেছিলেন,”আপনারা স্বাধীন এই পাকিস্তান রাস্ট্রে স্বাধীনভাবে আপনাদের মন্দির – মসজিদ – গির্জা বা যেকোন ভজনালয়ে যেতে পারেন। আপনারা যেকোন বর্ণ বা আদর্শের অনুসারী হতে পারেন,আমরা এক রাস্ট্রের সমঅধিকার সম্পন্ন নাগরিক, এই নীতির কোন বিরোধিতা নেই।ধর্ম হচ্ছে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, রাস্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক দিক থেকে হিন্দু – হিন্দু থাকবে না,মুসলমান – মুসলমান থাকবে না।” রাজনীতির দবায় বাজিমাত করা লোকটা ধর্মকে আফিম না বানালে তার এই আহ্বানে তারই শিষ্যরা সাড়া দিতো,কিন্তু তিনি তো আগেই তার বিশ্বাসের নৈতিক চরিত্র হারিয়েছিলেন।এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানকে উর্দিওয়ালারা সাফারি পরে বুটের তলায় পিষ্ট করেছে, যদিও কারোই শেষ পরিণতি ভালো হয়নি।এ সত্য আমাদের রাজন্যবর্গ যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে ততই দশের মঙ্গল। আর সবচেয়ে অপ্রিয় সত্য হলো, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য প্রয়োজন পরমত সহিষ্ণু গণতন্ত্র, যে দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র আছে সেদেশে আইন করে এটা প্রতিষ্ঠার দরকার হয়না।গণতন্ত্রহীনতায় আইন করেও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্ভব নয়।পাকিস্তান পারেনি,বাংলাদেশেও হবেনা,ভারতেও নয়।