লিখেছেনঃ সুমন বিশ্বাস
১৮৫৬ সালের কথা – জার্মান শহর ডুসেলডর্ফের কাছে ডুসেল নদীর একটি ছোট উপত্যকা, নিয়ান্ডারের ফেল্ডহোফার গুহায়(Feldhofer) চুনাপাথর কাটছেন খনি শ্রমিকরা। ঘর্মাক্ত শ্রমিকেরা তখন পর্যন্ত জানতেন না যে তারা মানব বিবর্তেনের এক গুরুত্বপূর্ণ রহস্য উন্মোচন করতে যাচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা কিছু মানবসদৃশ কঙ্কাল খুঁজে পান। শারীরস্থানবিৎদরা (Anatomists) তখন হাড়গুলি নিয়ে বিভ্রান্ত ছিলেন কেননা সেগুলির মধ্যে একটি খুলির টুকরো অন্তর্ভুক্ত ছিল যা দেখতে মানুষের মতো ছিল কিন্তু পুরোপুরি মানুষের নয়। তাঁরা এটি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে থাকেন কিন্তু তখন সেটা তেমন কোন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে নাই।
পরবর্তীতে গবেষণাটি ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত চার্লস ডারউইনের “অন দ্য অরিজিন অফ স্পিশিজ” (বইটি বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের ভিত্তি বলে বিবেচিত হয় যেখানে ডারউইন, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রবর্তন করিয়ে দেখিয়েছেন যে জনসংখ্যা ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিবর্তিত হচ্ছে) প্রকাশের পর এক সাড়া জাগানো বৈজ্ঞানিক রূপ পায়। আর ১৮৬৪ সালে এসে আইরিশ ভূতাত্ত্বিক উইলিয়াম কিং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে রহস্যময় এই কঙ্কাল আমাদের মতো মানুষের নয় বরং অন্য কিছুর এবং তিনি এটিকে “হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস” (Homo neanderthalensis) নামে নামকরণ করার সুপারিশ করেছিলেন। যাদেরকে আমরা নিয়ান্ডারথাল বলে চিনি যারা কিনা বর্তমান সময়ের মানব প্রজাতির নিকটতম বিবর্তিত আত্মীয় এবং যারা প্রায় ৪০-৩০ হাজার বছর আগে এই পৃথিবী থেকে কোন কারণবশত বিলুপ্ত হয়ে যায়। হারিয়ে যাবার আগে এরা ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া, দক্ষিণ সাইবেরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বসবাস করত। পূর্বের জীবাশ্ম আবিষ্কারগুলি, (১৮২৯ সালে বেলজিয়ামের এনগিসে এবং ১৮৪৮ সালে ফোর্বস কোয়ারি, জিব্রাল্টার) পরে জানা যায় এগুলোও নিয়ান্ডারথাল এর ছিল৷ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায় তারা প্রায় ৪.৫ লাখ হতে ৪০-৩০ হাজার বছর আগ পর্যন্ত এই ধরণীতে (মধ্য থেকে শেষ প্লাইস্টোসিন যুগের মধ্যে) বসবাস করত। কার্বন-১৪ ডেটিং কৌশলের সীমাবদ্ধতার কারণে নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তির বিষয়টি চিহ্নিত করা বেশ কঠিন ছিল। কারন সমস্ত জীবন্ত বস্তু বায়ুমণ্ডল এবং তাদের খাদ্য থেকে কার্বন শোষণ করে, যার মধ্যে রয়েছে তেজস্ক্রিয় ধাঁচের কার্বন-১৪, যা সময়ের সাথে সাথে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। আর যখন হাড়ের কথা আসে, বিজ্ঞানীরা কোলাজেন (Structural protein) দিয়ে তৈরি অংশটি বের করেন কারণ এটি জৈবঅণুর মিশ্রণ। এখন একটি নতুন ডেটিং কৌশল- অ্যাক্সিলারেটর মাস-স্পেকট্রোমেট্রি রেডিওকার্বন ডেটিং (Accelerator mass-spectrometry radiocarbon dating) ব্যবহার করে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের থমাস হাইহামের (Thomas Higham) নেতৃত্বে দলটি দেখেছেন যে কয়েক হাজার বছরে মধ্যে ধীরে ধীরে নিয়ান্ডারথাল ভূদৃশ্য থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং আরও নিশ্চিত করেছেন যে নিয়ান্ডারথালরা সম্ভবত ৪১,০০০ থেকে ৩৯,০০০ বছর আগে এ ধরণী থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। হাইহাম একজন প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞানী এবং রেডিওকার্বন ডেটিং বিশেষজ্ঞ। তিনি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। তবে নিয়ান্ডারথালরা সবাই একই সময়ে বিলুপ্ত হয়নি। গবেষণায় দেখা গেছে তাদের অন্তর্ধান স্তম্ভিত ছিল। কিছু নিয়ান্ডারথাল সাইটগুলিতে এখনও সঠিকভাবে তাদের জীবাশ্মের তারিখ বের করা হয়নি তাই সেখানে আরও দীর্ঘদিন জীবিত জনগোষ্ঠী সনাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা ইউরোপ এবং এশিয়ায় বসবাস করেছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না বিবর্তনীয় মানগুলির দ্বারা আকস্মিক পরিবর্তনে এই পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। এটি প্রায় একই সময়ে হয়েছিল যখন আফ্রিকা থেকে শারীরিক আধুনিক মানব হোমো সেপিয়েন্সের আবির্ভাব হয়েছিল। তারা আমাদের মতো দুই পায়ে হেঁটেছে, সামাজিক বন্ধনে বসবাস করেছে, হাতিয়ার ব্যবহার করেছে এবং শিল্প ও সঙ্গীত তৈরি করেছে, আবার আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে এর ব্যবহার করে শিকার ধরে রান্নাবান্না করে খেয়েছে। তাছাড়া নিয়ান্ডারথালরা বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম তৈরি ও ব্যবহার করতে জানত, আশ্রয়কেন্দ্রে থাকত, পোশাক তৈরি করত এবং পরিধান করত এবং মাঝে মাঝে প্রতীকী বা শোভাময় বস্তু তৈরি করত বলে জানা যায়। তারাই প্রথম হোমিনিন যারা হাড় (পাথড়, গাছের পরিবর্তে)দিয়ে অস্ত্র তৈরি করেছে। অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে মাটিতে নিয়ান্ডারথালদের কঙ্কালের সুবিন্যস্ত অবস্থান প্রমাণ করে যে নিয়ান্ডারথালরা তাদের মৃতদের সমাধি দিয়েছে এমনকি মাঝে মাঝে তাদের সমাধিগুলিকে ফুলের মতো নৈবেদ্য দিয়ে তারা চিহ্নিত করেছে। পূর্বের কোন মানব প্রজাতি এই পরিশীলিত এবং প্রতীকী আচরণের অনুশীলন করেনি। এটি পূর্ববর্তী মানব প্রজাতির তুলনায় নিয়ান্ডারথালদের জীবাশ্ম রেকর্ড এত সমৃদ্ধ হওয়ার একটি কারণ হতে পারে কেননা সমাহিত করায় এটিকে সঠিকভাবে রক্ষিত জীবাশ্ম হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে। এমনকি তারা অস্ত্রোপচার, গাছের ঔষধি ব্যবহার করতেও জানত বলে প্রমাণ পাওয়া যায়! সেই সময়ে পৃথিবীতে তারাই একমাত্র হোমিনিড (মানব-সদৃশ) প্রজাতি ছিল না। অন্যান্য প্রাচীন মানব গোষ্ঠী যেমন হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস (Homo floresiensis) এবং ডেনিসোভানরাও (Homo Denisovans) পৃথিবীতে হেঁটেছিল। হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস হল আর একটি বিলুপ্ত প্রজাতির মানব যারা প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষের আগমনের আগ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস (Flores) দ্বীপে বসবাস করত। ২০০৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপের লিয়াং বুয়াতে এ প্রজাতির একজন ব্যক্তির দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে যার উচ্চতা প্রায় ১.১ মিটার ছিল।
নিয়ান্ডারথালদের সম্ভবত কিছু কৌশলগত সুবিধা ছিল। যেমন তারা সহস্রাব্দ ধরে মধ্যপ্রাচ্য দখল করেছিল। যার সুবাদে তারা সেখানকার ভূখণ্ড, ঋতু, প্রকৃতি, কীভাবে স্থানীয় গাছপালা এবং প্রাণীদের থেকে বাঁচতে হয় সে সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিল। যুদ্ধে তাদের বিশাল পেশীবহুল গঠন অবশ্যই তাদের মুখোমুখি যুদ্ধে বিধ্বংসী যোদ্ধা করে তুলেছিল। তাদের বিশাল চোখ সম্ভবত নিয়ান্ডারথালদের কম-আলোতে দেখার দৃষ্টি দিয়েছে যেটা তাদের অন্ধকারে অতর্কিত হামলা এবং ভোরের অভিযানের জন্য কৌশল নির্ধারণ করতে সহযোগিতা করেছে। জেনেটিক বিশ্লেষণ দেখায় যে নিয়ান্ডারথালরা ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীতে বসবাস করত যাদের একে অপরের সাথে খুব কম যোগাযোগ ছিল। পূর্ণবয়স্ক নিয়ান্ডারথাল পুরুষ ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং মহিলারা ৫ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা হতো এবং ওজন হতো ৬৪-৮২ কেজি। বিবর্তনের প্রক্রিয়া, প্রজাতির শ্রেণীবিভাগে যে অসুবিধাগুলি যোগ করে তার কারণে নিয়ান্ডারথালদের প্রাথমিক উপস্থিতির জন্য কোনও স্পষ্ট তারিখ জানা যায় না। বরং এটা স্বীকার্য যে প্রথম নিয়ান্ডারথাল-সদৃশ বৈশিষ্ট্যগুলি ৬ থেকে ৪ লাখ বছর আগে তাদের অঙ্গসংস্থানবিদ্যার একটি ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী অভিব্যক্তি সহ সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হতে থাকে। আর প্রায় ২ থেকে ১ লাখ বছর আগে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলি স্পষ্ট হতে থাকে যাদেরকে আমরা “ক্লাসিক” নিয়ান্ডারথাল হিসাবে দেখি। যাদের মধ্যে রয়েছে বর্ধিত মস্তিষ্ক (তাদের মস্তিষ্কের কেসগুলি আমাদের চেয়েও বড় ছিল) এবং তাদের অনেক পূর্বের প্রাচীন মানুষের চেয়েও কম প্রসারিত মুখ ছিল। তাদের ঢালু কপাল, বড় শ্রোণী সহ নিয়ান্ডারথালরা তাদের প্রেক্ষাপটে মানব বিবর্তনের অন্যতম রহস্য রেখে গেছে। তাদের মাথার খুলির কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে, মুখের মাঝখানের বড় অংশ, কোণযুক্ত গালের হাড় এবং ঠান্ডা ও শুষ্ক বাতাসকে আর্দ্র ও উষ্ণ করার জন্য একটি বিশাল নাক। তাদের দেহগুলি আমাদের তুলনায় খাটো এবং মজবুত ছিল। তারা অনেক কঠোর এবং বিপদজনক জীবনযাপন পরিচালনা করেছে। কেননা প্রায় সম্পূর্ণ সংরক্ষিত প্রাপ্তবয়স্ক নিয়ান্ডারথালদের কঙ্কালগুলিতে সাধারণত মাথা বা ঘাড়ের অঞ্চলে আঘাতের কিছু চিহ্ন দেখা যায় যেগুলো সম্ভবত শিকারের কৌশলগুলির সাথে সম্পর্কিত কেননা তাদের প্রায়ই বড় শিকারের মুখোমুখি হতে হত এবং প্রায়শই শিকার করতে গিয়ে আহত হতে হত। এই ক্ষতগুলির সম্পূর্ণ নিরাময় বা আংশিকভাবে নিরাময় করার অর্থ হল যে তাদের আহত ব্যক্তিদের সামাজিকভাবে পরিচর্যা করা হয়ে থাকত। নিয়ান্ডারথাল প্রাপ্তবয়স্কদের আয়ু খুব কম ছিল। সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী এরিক ট্রিনকাস (Erik Trinkaus) জীবাশ্মের রেকর্ড বিশ্লেষণ করেছেন যাতে নিয়ান্ডারথাল এবং প্রথম দিকের আধুনিক মানুষের প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনকালগুলি পাওয়া যায়। তিনি নিয়ান্ডারথালের প্রায় ২০-৪০ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে কিছু ৪০ বছরের বেশি বয়স্ক এবং প্রথম দিকের আধুনিক মানব জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু ৪০ বছরের বেশি বয়স্কদের খুঁজে পেয়েছিলেন এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন যে আয়ু সম্ভবত উভয়ের একই রকম ছিল। নিয়ান্ডারথালরা আফ্রিকার আধুনিক মানুষের সাথে তাদের পূর্বপুরুষ ভাগ করে নেয় প্রায় ৫,৫০,০০০ হতে ৭,৫০,০০০ বছর আগে, যাদেরকে হোমো হাইডেলবার্গেনসিস (Homo heidelbergensis) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তবে অনেকের মতে এটা অন্য কোন প্রজাতি থেকে আগত। আর হোমো হাইডেলবার্গেনসিস হল আদিম মানুষের একটি বিলুপ্ত প্রজাতি যাদের প্রায় ৭ লাখ বছর আগে থেকে প্রায় ২ লাখ বছর আগে পর্যন্ত মধ্য প্লাইস্টোসিনের যুগে আফ্রিকা এবং পশ্চিম ইউরেশিয়া উভয় অঞ্চলেই শনাক্ত করা হয়েছে। জার্মানির হাইডেলবার্গের কাছে পাওয়া চোয়ালের হাড়ের একটি অংশের জন্য এদের এরকম নামকরণ করা হয়েছে। এই হোমিনিনরা মানব বিবর্তনের গোলমালে কৌতূহলী এবং বহুল আলোচিত স্থান দখল করে আছে। এরা এদের পূর্বসূরিদের তুলনায় একটু বেশি বুদ্ধিমান এবং উদ্ভাবক ছিল। এরা সম্ভবত হোমো ইরেক্টাস (Homo Erectus) থেকে বিকশিত হয়েছে এবং অনেকের মতে এই হোমো ইরেক্টাসই আফ্রিকার হোমো সেপিয়েন্স এবং ইউরোপের নিয়ান্ডারথালদের বিবর্তিত করেছে। ঠিক কিভাবে, কেন এবং কোন প্রজাতি হতে এটি ঘটেছিল সেটি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে প্রজাতির এই বিবর্তনের খেলায় জেনেটিক পরিবর্তন বা মিউটেশন মুখ্য ভুমিকা পালন করেছে। তাই বিষয়টি বোধগম্য হবার জন্য মিউটেশন এবং জিনোম সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা এখানে মোটেও অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তাহলে প্রথমে জানা যাক মিউটেশন কি? মিউটেশন হল একটি জীবের ডিএনএ এর ক্রম পরিবর্তন। অন্যভাবে বলতে গেলে মিউটেশন হচ্ছে ডিএনএ-এর মধ্যে ক্ষারক অক্ষরের (A,T,G,C) অনুক্রমের পরিবর্তন যাকে বেস বলা হয়, যেটা মিউটেজেন (Mutagen) এর সাথে সম্পর্কিত আর মিউটেজেন হল এমন একটি পদার্থ বা এজেন্ট যা ডিএনএ তে দুর্বলতা সৃষ্টি করে যার ফলে ডিএনএ তার ক্রম পরিবর্তন করে নিজেকে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খায়ানোর জন্য। ডিএনএ সিকোয়েন্সের এই পরিবর্তনটিই মিউটেশন নামে পরিচিত। বিষয়টি একটু পরিষ্কারভাবে বুঝার জন্য DNA গঠনের দিকে একটু আলোকপাত করা যাক। ডি অক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (DNA) হচ্ছে সজীব কোষে অবস্থিত স্বপ্রজননশীল,পরিব্যক্তিতে সক্ষম, বিভিন্ন প্রকার জৈবিক কাজের নিয়ন্ত্রক এবং বংশগত বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক- নিউক্লিক অ্যাসিড কে DNA বলে। ডিএনএর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এটি নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। এই নিউক্লিক অ্যাসিড কে আর্দ্রবিশ্লেষণ (Hydrolysis) এর পর কিছু উপাদান পাওয়া যায় যেমন (১) পেন্টোজ সুগার (২) নাইট্রোজেন ক্ষারক (৩) ফসফোরিক অ্যাসিড। আবার নিউক্লিক অ্যাসিডে বিদ্যমান পেন্টোজ সুগারটি রাইবোজ না ডিঅক্সিরাইবোজ তার উপর ভিত্তি করে নিউক্লিক অ্যাসিড কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে (১) ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড বা DNA এবং (২) রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা RNA। আবার এক খন্ড DNA কে আর্দ্রবিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় ফসফোরিক অ্যাসিড ও নিউক্লিওসাইড। নিউক্লিওসাইড বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় নাইট্রোজেন ক্ষারক এবং ডিঅক্সিরাইবোজ সুগার। আবার নাইট্রোজেন ঘটিত ক্ষারক সমূহকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় অ্যাডিনিন (Adenine) (A), থাইমিন (Thymine) (T), সাইটোসিন (Cytosine) (C), এবং গুয়ানিন (Guanine) (G) নামক ক্ষারক (Nitrogen base)। আবার DNA এর রাসায়নিক গঠন উপাদান হল (১) পাঁচ কার্বনবিশিষ্ট ডিঅক্সিরাইবোজ সুগার (২) ফসফোরিক অ্যাসিড (একটি ফসফেট) (৩) একটি নাইট্রোজেন ক্ষারক। DNA সাধারণত ২ হেলিক্সযুক্ত এবং প্রতিটি হেলিক্স হচ্ছে একটি পলিনিউক্লিয়োটাইড শৃঙ্খল। সিঁড়ির মত প্যাঁচানো সূত্র ২ টি একটি কাল্পনিক মধ্যঅক্ষকে ঘিরে থাকে। হেলিক্স ২ টি পেক্টোনোমিক পদ্ধতিতে পরস্পর কুন্ডলিত থাকে। সিঁড়ির দুই দিকের ফ্রেম তৈরী হয় সুগার ও ফসফেটের পর্যায়ক্রমিক সংযুক্তির মাধ্যমে। দুই দিকের ফ্রেমের মাঝখানে প্রতিটি ফ্রেম তৈরী হয় একজোড়া নাইট্রোজেন ঘটিত ক্ষারক (Nitrogenous bases) দিয়ে। আমরা পূর্বে জেনেছি যে নাইট্রোজেন বেসগুলি হল অ্যাডিনিন, গুয়ানিন, থাইমিন এবং সাইটোসিন (RNA-তে থাইমিন, উরাসিল Uracil দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে)। আর দুটি নাইট্রোজেন বেস হাইড্রোজেন বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে। DNA এর চারটি ভিত্তির প্রত্যেকটির নিজস্ব আকার এবং আকৃতি রয়েছে যা এদেরকে সঠিকভাবে ঘাঁটিতে বসতে সাহায্য করে। অ্যাডিনিন (A) সর্বদা থাইমিন (T) এর সাথে যুক্ত হয় এবং সাইটোসিন (C) সর্বদা গুয়ানিনের (G) সাথে যুক্ত হয়। দুটি “ওয়াটসন-ক্রিক” বেস পেয়ার A-T এবং C-G সমস্ত জীবনের DNA ক্রম গঠন করে যেমনটি আমরা জানি। যদি G কোনোভাবে T-এর সাথে ভুল করে যুক্ত হয় তাহলে এটি একটি মিউটেশন হবে। প্রকৃতপক্ষে, জি-টি মিউটেশন মানব ডিএনএ-তে একক সবচেয়ে সাধারণ মিউটেশন। এটি প্রতি ১০ হাজার থেকে ১ লক্ষ বেস জোড়ার মধ্যে একবার ঘটে। মানুষের জিনোমে প্রায় ৩ বিলিয়ন বেস জোড়া রয়েছে আর এই বেসের ৯৯ শতাংশেরও বেশি সমস্ত মানুষের মধ্যে একই রকম। একজন মানুষের শরীরের প্রায় প্রতিটি কোষে একই ডিএনএ থাকে। বেশির ভাগ ডিএনএ কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত (যেখানে একে নিউক্লিয়ার ডিএনএ বলা হয়) তবে মাইটোকন্ড্রিয়াতেও অল্প পরিমাণ পাওয়া যায় (যেখানে একে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বলে)। ডিএনএ রক্ত, বীর্য, ত্বকের কোষ, টিস্যু, অঙ্গ, পেশী, মস্তিষ্কের কোষ, হাড়, দাঁত, চুল, লালা, শ্লেষ্মা, ঘাম, নখ, প্রস্রাব, মল ইত্যাদিতে থাকে। বর্তমান সময়ের মানুষ এবং নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে জিনোমিক পার্থক্য বোঝার জন্য, গবেষকরা নিয়ান্ডারথাল জিনোমের সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলিকে মানুষের ডিএনএতে পাওয়া জিনোমের সাথে, সেই সাথে শিম্পাঞ্জির ডিএনএর সাথে তুলনা করেছেন। জেনেটিক বৈচিত্র্যের বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে নিয়ান্ডারথালদের ডিএনএ বর্তমান সময়ের মানুষের ডিএনএর সাথে ৯৯.৭ শতাংশ এবং শিম্পাঞ্জির ডিএনএর সাথে ৯৮.৮ শতাংশ অভিন্ন! বলা বাহুল্য বর্তমান সময়ের মানুষের ডিএনএ শিম্পাঞ্জির সাথে ৯৮.৮ শতাংশ মিল রয়েছে। এবার আসা যাক জিনোম সিকোয়েন্স সম্বন্ধে আলোচনায়। জিনোম হচ্ছে কোনও কোষ বা জীবের মধ্যে উপস্থিত জিন বা জিনগত উপাদানগুলির সম্পূর্ণ সেট। আর জিন (বংশাণু) হল ডিএনএর ছোট অংশ যা নির্দিষ্ট জেনেটিক তথ্য বহন করে এবং ক্রোমোজোমে অবস্থান করে। কার্যত দেহের প্রতিটি কোষে যে ৩ বিলিয়ন ডিএনএ বেস জোড়া রয়েছে সেগুলি মানব জিনোম তৈরি করে। মূলত এনজাইমগুলির (উৎসেচক) একটি জিনের ডিএনএ সম্পর্কিত তথ্য মেসেঞ্জার রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড অণুতে (mRNA) অনুলিপি করে। তারপরে এটি তথ্য বহন করে নিউক্লিয়াসের বাইরে সাইটোপ্লাজমে ভ্রমণ করে, রাইবোসোমগুলি দ্বারা পড়ার জন্য। এই তথ্যটি রাইবোসোমগুলিকে ছোট ছোট অ্যামিনো অ্যাসিডগুলিকে একসাথে একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন গঠন করার জন্য নির্দেশ দেয়। প্রোটিনগুলি হাজার হাজার অ্যামিনো অ্যাসিড দিয়ে গঠিত এবং দীর্ঘ শৃঙ্খলে একে অপরের সাথে পেপটাইড বন্ধন(Peptide bonds) এর মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। ২০ টি বিভিন্ন ধরণের অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে যা প্রোটিন তৈরি করতে একত্রিত হতে পারে। মূলত অ্যামিনো অ্যাসিড কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং সালফার দিয়ে তৈরি জৈব যৌগ। অ্যামিনো অ্যাসিডের ক্রম প্রতিটি প্রোটিনের অনন্য ত্রি-মাত্রিক কাঠামো এবং এর নির্দিষ্ট কার্যকলাপ নির্ধারণ করে। আবার প্রোটিনগুলি হরমোন এবং এনজাইম গঠন করে যা বিভিন্ন কোষের মধ্যে সংকেত বহন করার পাশাপাশি শরীরে রাসায়নিক বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। জিনোমের প্রতিটি জিন (প্রায় ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ জিন) প্রোটিনের জন্য সংকেত লেখে। জিনোমটি জীবনের ধারাবাহিকতার জন্য, প্রজাতি সংরক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য প্রজন্মের মাধ্যমে কোষের প্রতিরূপ গঠন করবার সময় এক কোষ থেকে অন্য কোষে স্থানান্তরিত হয়। তাই বলা চলে জিনোমের কার্যকরী, কাঠামোগত এবং অভিযোজনযোগ্যতার ভূমিকা রয়েছে। ইউক্যারিওটসের (Eukaryotes) জিনোম ক্রোমোজোমের একক হ্যাপ্লয়েড (Haploid) সেটে রয়েছে। ব্যাকটেরিয়ার জিনোম একটি একক ক্রোমোজোমে থাকে, যেখানে ভাইরাসগুলির জিনোম ডিএনএ বা আরএনএ তে থাকে। মানুষের জিনোম কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমে ডিএনএ দিয়ে গঠিত। একটি জিনোমে কোন জীবের বিকাশ এবং কার্যকারিতা করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য থাকে। আমাদের প্রতিটি কোষের ভিতরে আমাদের জিনোমের একটি অনুলিপি রয়েছে। তাই বলা যেতে পারে জিনোম সিকোয়েন্সিং হল একটি জিনোমে ডিএনএ নিউক্লিওটাইড বা বেসের ক্রম নির্ধারণ করা। দুই ডজনেরও বেশি নিয়ান্ডারথালেরর জীবাশ্ম থেকে ডিএনএ উদ্ধার করা হয়েছে, পুরোটাই ইউরোপ থেকে। যেগুলো ‘নিয়ান্ডারথাল জিনোম প্রজেক্ট’ তৈরি করেছে এবং যেটি এখন মানব উৎপত্তি গবেষণার একটি উত্তেজনাপূর্ণ নতুন ক্ষেত্র বলে বিবেচিত।
নিওকর্টেক্সের সম্প্রসারণ মানব মস্তিষ্কের বিবর্তনের একটি মূল ঘটনা ছিল। TKTL1 নামক একটি জিন মানুষ এবং নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে কিছুটা আলাদা। তবে এই ক্ষুদ্র পার্থক্যটি মানুষের এবং নিয়ান্ডারথালদের মস্তিষ্কের আকার ও আকৃতির পার্থক্যের জন্য দায়ী হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ মলিকুলার সেল বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স-এর গবেষক অ্যানেলিন পিনসন (Anneline Pinson) এবং তাঁর সহকর্মীরা TKTL1 জিনটি পরীক্ষা করেছেন যেটি ভ্রূণের নিওকোর্টেক্সের অপরিণত নিউরনে সক্রিয় এবং মস্তিষ্কের টিউমার কোষের বিস্তারের সাথেও জড়িত। TKTL1 জিন টি, ৫৯৬টি অ্যামিনো অ্যাসিডের অবশিষ্টাংশ সমন্বিত একটি এনজাইমকে এনকোড করে এবং এটি মাত্র কয়েকটি জিনের মধ্যে একটি যার ডিএনএ ক্রম মানুষ এবং বিলুপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক হোমিনিনের মধ্যে আলাদা। নিয়ান্ডারথাল জিনোমে, ৩১৭টি অ্যামিনো অ্যাসিডের অবশিষ্টাংশ হল লাইসিন কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এটি আরজিনাইন (Arginine) দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই ধরনের ক্ষুদ্র পার্থক্য ব্যাপকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অবশেষে পিনসন এবং তাঁর সহকর্মীরা TKTL1 জিনের কার্যকারিতা নির্ধারণ করেন। তাঁদের পরীক্ষায় দেখা গেছে যে এটি ফ্যাটি অ্যাসিডের সংশ্লেষণকে উৎসাহিত করে যেটা নিউরাল স্টেম সেল মেমব্রেনে ঢোকানো হয় যেটা তাদের ফাইবারগুলির বৃদ্ধি এবং তাদের বিস্তারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা যখন ইদুরের ভ্রূণে মানব জিন প্রবেশ করান তখন এটি স্টেম সেলের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয় যা ফ্রন্টাল কর্টেক্স নিউরনের জন্ম দেয়, যার ফলে বিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে আরও নতুন নিউরন তৈরি হয়। কিন্তু নিয়ান্ডারথালের TKTL1 জিন ঢোকানোর পরে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। আবার মানুষের ভ্রূণের মস্তিষ্কের টিস্যু থেকে TKTL1 মুছে ফেলার ফলে নিউরাল স্টেম সেলের সংখ্যা কমে যায় এবং ল্যাব-উত্থিত সেরিব্রাল “অর্গানয়েডস”-এ নিয়ান্ডারথাল ভেরিয়েন্ট ঢোকানো পর তাদের স্টেম সেল এবং নিউরনের সংখ্যা কমিয়ে দেয়। এই ফলাফলগুলি দেখায় যে TKTL1 জিনের ডিএনএ ক্রম-এর একটি পরিবর্তন (Mutation) মানুষের প্রোটিন অনুক্রমে একটি একক অ্যামিনো অ্যাসিড প্রতিস্থাপনের কারণ যা নিউরাল স্টেম সেল আচরণের উপর পর্যবেক্ষণ করা প্রভাবগুলির জন্য দায়ী। গবেষকরা উপসংহারে পৌঁছেছেন যে এই সাধারণ জিনোমিক পরিবর্তনটি মানব এবং নিয়ান্ডারথালদের নিওকর্টেক্সের আকার এবং আকৃতির পার্থক্যে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। তবে এটাও ঠিক যে মস্তিষ্কের বিকাশ একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। এটি অসম্ভাব্য ব্যাপার যে একটি একক জেনেটিক ঘটনা মানব মস্তিষ্কের বিবর্তনের জন্য দায়ী ছিল। প্রকৃতপক্ষে মানুষের মস্তিষ্কের বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সম্ভবত শত শত জিন একাধিক বিভিন্ন ধরনের জেনেটিক ঘটনায় জড়িত ছিল যার মধ্যে রয়েছে নন-কোডিং ডিএনএ সিকোয়েন্সের পরিবর্তন, জিন মুছে ফেলা এবং নকল করা, “জাম্পিং জিন” এবং অন্যান্য বড় আকারের জিনোমিক পরিবর্তন।
নিয়ান্ডারথালরা কি মাংসাশী না সর্বভুক ছিল? মূলত তারা মাংসাশী ছিল। আইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে ব্যক্তিদের ডেন্টাল টার্টার সম্পর্কে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে তারা উদ্ভিদের প্রধান গ্রাহক তবে আইবেরিয়ার বাইরের সাইটগুলিতে পরিচালিত অন্যান্য গবেষণাগুলিতে মনে হয় যে তারা মাংস ছাড়া আর প্রায় কিছুই ভক্ষণ করত না। তাছাড়া স্পেনের গাবাসা,ফ্রান্সের কাউর (Kaur) সাইটের নিয়ান্ডারথালগুলি মাংসাশী ছিল বলে গবেষণায় এসেছে। এখানকার নিয়ান্ডারথালেরা পশমী ম্যামথ(Wolly Mammoth),পশমী গন্ডার, বাইসন, রেইনডিয়ার এর মতো বড় বড় শিকার করবার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। কেননা নিয়ান্ডারথালরা দক্ষ হাতিয়ার প্রস্তুতকারক ছিল, ওদের ব্যবহৃত বর্শা এবং চকমকি হাত কুড়াল এর মতো উদ্ধারকৃত বস্তুগুলো এটা প্রমাণ করে। খাদ্য শৃঙ্খলে কোনও ব্যক্তির অবস্থান নির্ধারণের জন্য বিজ্ঞানীদের এখন পর্যন্ত রক্ষিত প্রোটিনগুলি বের করতে এবং হাড়ের কোলাজেনে উপস্থিত নাইট্রোজেন আইসোটোপগুলি বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে। তবে এই পদ্ধতিটি প্রায়শই কেবল নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে ব্যবহৃত হতে পারে এবং ৫০ হাজার বছরের বেশি পুরানো নমুনাগুলিতে খুব কমই ব্যবহৃত হয়। সি,এন,আর,এস গবেষক ক্লেভিয়া জৌন (Klevia Jaouen) এবং তাঁর সহকর্মীরা দাঁতের এনামেলে উপস্থিত দস্তা আইসোটোপ অনুপাত বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে এটি এমন খনিজ যা সমস্ত ধরণের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী। তাই এই প্রথম এই পদ্ধতিটি নিয়ান্ডারথলের খাদ্যাভ্যাস শনাক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। যেমন হাড়ের জিংক-৬৬ আইসোটোপের অনুপাত যত কম হবে তাদের মাংসাশী হওয়ার সম্ভাবনা ততো বেশি। বিশ্লেষণটি একই সময়কাল এবং ভৌগলিক অঞ্চল থেকে প্রাণীদের হাড়ের উপরও পরিচালিত হয়েছিল যেমন লিংকস এবং নেকড়ে মতো মাংসাশীদের এবং খরগোশ এবং চামোসের মতো তৃণভোজীদের উপর। ফলাফলগুলি দেখিয়েছিল যে গাবাসা সাইটের এই পেষণদন্ত যে নিয়ান্ডারথালের ছিল সে সম্ভবত একজন মাংসাশী ছিল যারা তাদের শিকারের রক্ত গ্রহণ করেনি। আইসোটোপিক ডেটা সহ সাইটে পাওয়া ভাঙা হাড়গুলি ইঙ্গিত দেয় যে এই ব্যক্তি হাড় সেবন না করে তাদের শিকারের অস্থি মজ্জাও খেয়েছিল। অন্য রাসায়নিক চিহ্ন অনুসন্ধানকারী দেখায় যে দুইবছর বয়সের আগেই তাদের মায়ের দুধ ছাড়ানো হয়ে থাকত। বিশ্লেষণগুলি এও দেখায় যে এই নিয়ান্ডারথালরা ছোটবেলায় যে জায়গায় বাস করেছিল সেখানে তারা মারা গিয়েছিল। যদিও নিয়ান্ডারথালেরা যাযাবর এর মতো জীবনযাপন করত। পূর্ববর্তী কৌশলগুলির সাথে তুলনা করে এই নতুন দস্তা আইসোটোপ বিশ্লেষণ পদ্ধতিটি সর্বভুক এবং মাংসাশীদের মধ্যে পার্থক্য করা সহজ করে তোলে। তাদের সিদ্ধান্তগুলি নিশ্চিত করার জন্য বিজ্ঞানীরা অন্যান্য সাইটগুলি, বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের পায়ের(Payre) সাইট থেকে ব্যক্তিদের উপর পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করার আশা করছেন যেখানে নতুন গবেষণা চলছে। জীবাশ্মবিদরা (Paleoanthropolosists) দক্ষিণ সাইবেরিয়ার আলতাই পর্বতমালার দুটি সাইট – চাগিরস্কায়া (Chagyrskaya) এবং ওকলাদনিকভ (Okladnikov) গুহা থেকে উদ্ধারকৃত ১৩টি ব্যক্তির দেহাবশেষ থেকে প্রাচীন Y-ক্রোমোজোমাল এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ডেটা ব্যবহার করে নিয়ান্ডারথালদের সামাজিক সংগঠন অনুসন্ধান করেছেন৷ “সামাজিক সংগঠন বলতে আমরা একটি সম্প্রদায়ের আকার, যৌন গঠন এবং স্থানিক সামঞ্জস্য বোঝাতে চাই” বলেছেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের (Evolutionary Anthropologist) বিবর্তন-সম্বন্ধীয় নরবিজ্ঞানী ড. লরিটস স্কোভ (Dr. Laurits Skov)৷ তিনি আরো বলেন মাইটোকন্ড্রিয়া মা থেকে সন্তান উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয় এবং Y ক্রোমোজোম পিতা থেকে পুত্র উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়। যদি মহিলারা পুরুষদের চেয়ে চলাফেরা বা কার্যক্রম বেশি করে তবে তাদের মাইটোকন্ড্রিয়ার সিকোয়েন্সের বৈচিত্র্য Y ক্রোমোজোমের চেয়ে বেশি হবে।
এবার আসা যাক সেই বিখ্যাত গুহার কথায় যেটা ভৌগলিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত। সাইবেরিয়ার আলতাই পর্বতমালায় আধুনিক রাশিয়া, কাজাখস্তান, চীন এবং মঙ্গোলিয়া যে বিন্দুতে মিলিত হয়েছে তার কাছেই এই ডেনিসোভা গুহা। গুহাটি সিলুরিয়ান চুনাপাথরে গঠিত এবং তিনটি চেম্বার নিয়ে গঠিত – প্রধান চেম্বার, পূর্ব চেম্বার এবং দক্ষিণ চেম্বার – যা একসাথে প্রায় ২৭০ বর্গ মিটার জুড়ে রয়েছে। যেটা ১৯৭০-এর দশকে বিজ্ঞানীদের দ্বারা প্রথম অন্বেষণ করা হয়েছিল। গুহার গড় বার্ষিক তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস যা আবিষ্কৃত অবশেষগুলির মধ্যে প্রাচীন ডিএনএ সংরক্ষণে বিশেষ অবদান রেখেছে। এই গুহার মধ্যে পলির নিচ থেকে যে সকল ডেনিসোভান ব্যক্তিদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে তার মধ্যে একটি লম্বা হাড়ের টুকরো পাওয়া গেছে যা একজন মহিলার যার নিয়ান্ডারথাল মা এবং ডেনিসোভান পিতা ছিল! প্রকৃতপক্ষে ডেনিসোভা গুহা থেকে অন্যান্য প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ান্ডারথালদের দেহাবশেষও উদ্ধার করা হয়েছে এবং প্রমাণগুলি থেকে বোঝা যায় যে উভয় গোষ্ঠী আনুমানিক ১.৫ লাখ বছর সময়কাল ধরে একে অপরের সাথে বসবাস করত, দেখা করত এবং মাঝে মাঝে একে অপরের সাথে মিলিতও হয়েছিল। দুঃখজনকভাবে বিজ্ঞানিরা এখনও পর্যন্ত ডেনিসোভানদের মুখ বা দেহ পুনর্গঠন করতে পারেননি। তবে যে তিনটি পেষণদন্ত (Molar) পাওয়া গেছে তা দেখায় যে ডেনিসোভানদের খুব বড় এবং শক্ত দাঁত ছিল যা তাদের চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক হোমিনিন যেমন হোমো ইরেক্টাস এবং অস্ট্রালোপিথেসিনের (Australopithecine)সাথে অনেক বেশি মানানসই। নিয়ান্ডারথালরা স্পষ্টতই একটি জটিল দল ছিল। আনুমানিক ১,৭৬,৫০০ বছর আগে ফ্রান্সের ব্রুনিকেল গুহায় নিয়ান্ডারথালদের দ্বারা নির্মিত স্ট্যালাগমাইট রিংগুলি পরিকল্পনা, ভূগর্ভস্থ পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ এবং সম্ভবত প্রতীকী ব্যবহার বোঝায়। মজার ব্যাপার হল প্রায় ৬০ হাজার বছর আগে থেকে যখন হোমো সেপিয়েন্সরা ইউরেশিয়া জুড়ে আরও বেশি সংখ্যায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল তখন তারা দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত নিয়ান্ডারথাল এবং ডেনিসোভানদের সাথে প্রজনন করে জেনেটিক্যালি উপকৃত হয়েছিল। হোমো সেপিয়েন্স কিছু ত্বক এবং চুলের রঙের জিন চুরি করেছিল যেগুলি বিশ্বের উত্তর রেঞ্জের জন্য উপযুক্ত ছিল। কারণ প্রমাণ রয়েছে যে কিছু নিয়ান্ডারথাল, হোমো সেপিয়েন্সের অনেক আগে থেকে ফ্যাকাশে ত্বক এবং লাল চুল নিয়ে বিবর্তিত হয়েছিল। তাই বোঝা যাচ্ছে এই প্রাচীন মানুষের সাথে সংঙ্কর-প্রজননের ফলে হোমো স্যাপিয়েনদের এমন জিনগুলি অর্জন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল যা পরবর্তীতে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে উন্নত করেছিল এবং এই জিনগুলির মধ্যে কিছু আজও আমাদের অনেকের মধ্যে রয়ে গেছে। আধুনিক মানুষের মধ্যে নিয়ান্ডারথাল ডিএনএর শতাংশ আফ্রিকান জনসংখ্যার লোকেদের মধ্যে শূন্য বা শূন্যের কাছাকাছি এবং ইউরোপীয় বা এশিয়ান পটভূমির মানুষের মধ্যে প্রায় ১ থেকে ২ শতাংশ। অন্যদিকে মেলানেশিয়ান জনসংখ্যার মধ্যে ডেনিসোভান ডিএনএর শতাংশ সর্বাধিক (৪ থেকে ৬ শতাংশ) অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপবাসীদের মধ্যে কম এবং বিশ্বের অন্য কোথাও খুব কম বা শনাক্ত করা যায় না। আধুনিক গবেষণায় এসেছে নিয়ান্ডারথালদের এবং ডেনিসোভানদের সাথে এই সংঙ্কর-প্রজনন (Interbreed) করে আমাদের পূর্বপুরুষরা তাদের থেকে চমৎকার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও অর্জন করেছিল। অধিকন্তু নিয়ান্ডারথালদের সাথে সঙ্কর-প্রজনন আধুনিক মানুষকে ইউরোপের ঠান্ডা জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করেছিল। আবার ডেনিসোভান মিশ্রণের সৌজন্যে আরও বৈশিষ্ট্যগুলিও সামনে আসছে যেমন তিব্বতীয়দের চমকপ্রদ উচ্চতার সাথে মোকাবিলা করার ক্ষমতা। উদাহরনস্বরূপ EPAS1 জিন তিব্বতিদের কম অক্সিজেন পরিবেশে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের সেল বায়োলজি, মাইক্রোবায়োলজি এবং ইমিউনোলজির অধ্যাপক পিটার পারহাম (Peter Parham) এবং তার দল HLA এবং এ জাতীয় জিনগুলির উপর তাদের বিশ্লেষণকে কেন্দ্রীভূত করেছেন, যা মানুষের ইমিউন সিস্টেমের দ্রুত বিকশিত করবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তিঁনি মনে করেন যে তাদের সাথে যৌনমিলন আধুনিক মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত HLA জিনটি প্রবর্তন করেছে যা আমাদের জিনগত কার্যকারিতা এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে বাড়িয়েছে। যদিও কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে নিয়ান্ডারথাল এবং প্রাথমিক আধুনিক মানব গোষ্ঠীগুলি ঘনিষ্ঠভাবে একসাথে বাস করত।
ভাষা একটি অনন্য মানবিক বৈশিষ্ট্য যা মানব সংস্কৃতির বিকাশের পূর্বশর্ত হতে পারে। তাই মনে প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক যে নিয়ান্ডারথালরা কি আমাদের মতো ভাষা জানত? “ভাষা জিন” FOXP2 যেটা ভাষা প্রতিবন্ধী কিছু ব্যক্তির মধ্যে পরিবর্তিত হয়। স্পষ্টত বক্তৃতা বিকাশের ক্ষমতা যেমন- স্বরযন্ত্র এবং মুখের সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে যা শিম্পাঞ্জি এবং অন্যান্য বনমানুষের মধ্যে অনুপস্থিত। নিয়ান্ডারথালের জিন অধ্যয়নরত গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন যে তারা আধুনিক মানুষের সাথে FOXP2 জিনের একই সংস্করণ ভাগ করেছে। FOXP2 হল একমাত্র জিন যা এখন পর্যন্ত পরিচিত ভাষার ক্ষেত্রে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে কেননা FOXP2 হল প্রথম জিন যা মানুষের ভাষা বিকাশের ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। আর এই ভাষা কখন বিকশিত হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। দুটি প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে – কিছু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে ভাষাটি হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়েছে এবং এটি আমাদের নিজস্ব প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অন্যরা দাবি করেন ভাষা গত ২০ লাখ বছরে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে এবং আমাদের নিজস্ব প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। যারা দাবি করেন ভাষা ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে তারা কঙ্কালের অবশেষ এবং বক্তৃতা উৎপাদন সম্পর্কিত কাঠামোর উপর ভিত্তি করে তাদের যুক্তি দাড় করান। কথ্য ভাষার সাথে যুক্ত কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য যেমন কণ্ঠনালীর অবস্থান, মস্তিষ্কের গঠন এবং মেরুদণ্ডের আকার, ধীরে ধীরে আধুনিক মানব আকারে বিবর্তিত হয়েছে। এই ফলাফলগুলির উপর ভিত্তি করে বেশিরভাগ গবেষক সম্মত হন যে নিয়ান্ডারথালরা জটিল কণ্ঠস্বর নির্গমন এবং শুনতে সক্ষম ছিল। তাছাড়া একটি নিয়ান্ডারথালের জীবাশ্মযুক্ত হায়য়েড (Hyoid) হাড়ের বিশ্লেষণ (ঘাড়ে একটি ঘোড়ার খুরের নালের আকৃতির গঠন) প্রস্তাব করে যে এ প্রজাতির কথা বলার ক্ষমতা ছিল৷ হাইয়েড হাড় কথা বলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি জিহ্বার মূলকে সমর্থন করে৷ তবে এটা নিয়ে সবাই মোটামুটি একমত যে তাদের ভাষা আমাদের মতো এতো সমৃদ্ধ ছিল না।
হোমিনিন জিনোম এবং মানব বিবর্তনের উপর যুগান্তকারী গবেষণার জন্য, সোয়ান্তে পাবোকে (Svante Pääbo) ২০২২ সালে চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তিঁনি একজন সুইডিশ জিনতত্ত্ববিদ যিনি বিবর্তনীয় জেনেটিক্সের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। প্যালিওজেনেটিক্সের (Palaeogenetics) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং তিঁনি নিয়ান্ডারথালের জিনোমের উপর বিগত বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে কাজ করেছেন। তিঁনি জার্মানির লিপজিগে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভোল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজি-তে জেনেটিক্স বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আণবিক বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান (Molecular Evolutionary Biology)পড়ান। ১৯৯০ এর দশকে মানুষের জেনেটিক কোড এর উপর গবেষণা যখন দ্রুত গতিতে চলছিল তখন সেটি মূলত আদিম ডিএনএর তাজা নমুনার উপর নির্ভর করে। কিন্তু অধ্যাপক পাবোর আগ্রহ ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের পুরানো, ক্ষতিগ্রস্ত এবং দূষিত জেনেটিক উপাদানের প্রতি। তখন অনেকে ভেবেছিলেন এটি একটি অসম্ভব চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তিঁনি হচ্ছেন নিয়ান্ডারথালের জিনোম গবেষণার একজন সুপরিচিত অগ্রগামী। তিঁনি দেখিয়েছিলেন যে কোষের নিউক্লিয়াস যা মিশরীয় মমিগুলির টিস্যুতে অক্ষত আছে তাতে এখনও ডিএনএ সিকোয়েন্স রয়েছে। তিঁনি তাঁর ‘নিয়ান্ডারথাল ম্যান’ বইতে লিখেছেন, অ্যাসিড অবস্থার কারণে ডিএনএ স্ট্র্যান্ডগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যে কারণে উত্তর ইউরোপে অ্যাসিড বগগুলিতে পাওয়া ব্রোঞ্জ যুগের লোকদের কাছ থেকে কখনও কোনও ডিএনএ পাওয়া যায়নি। কিন্তু চুনাপাথরের উপর দিয়ে পানি গেলে তা সামান্য ক্ষারীয় (Alkaline)হয়ে যায়। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমাদের চুনাপাথরের গুহায় পাওয়া নিয়ান্ডারথাল অবশেষগুলিতে মনোনিবেশ করা উচিত। তিঁনিই প্রথম মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ (mtDNA) থেকে নিয়ান্ডারথাল জিনোমের একটি অংশ ক্রমানুসারে তৈরি করেছিলেন যার ফলাফল থেকে জানা যায় যে মানুষ (হোমো সেপিয়েন্স) এবং নিয়ান্ডারথাল (হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস) পৃথক প্রজাতি যা প্রায় ৫ লাখ বছর আগে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। অবশেষে ২০১০ সালে অধ্যাপক পাবো, নিয়ান্ডারথালের প্রথম জিনোম সিকোয়েন্স করতে সফল হন। তিঁনি দেখতে পান যে প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে আফ্রিকা থেকে অভিবাসনের পরে এই বিলুপ্ত হোমিনিন থেকে হোমো সেপিয়েন্সে জিন স্থানান্তর ঘটেছে। তাছাড়া ২০১০ সালে ড.পাবো এবং তাঁর সহকর্মীরা সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহায় পাওয়া একটি আঙুলের হাড়ের ডিএনএ বিশ্লেষণ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ফলাফলগুলি নির্দেশ করে যে হাড়টি হোমো প্রজাতির একটি বিলুপ্ত সদস্যের অন্তর্গত যা এখনও পর্যন্ত স্বীকৃত হয়নি, তাঁরা এই হোমিনিন জনসংখ্যাকে ‘ডেনিসোভান’ হিসাবে চিহ্নিত করেন এবং পরামর্শ দেন যে এরা প্লাইস্টোসিন যুগের শেষের দিকে এশিয়াতে বিস্তৃত হতে পারে। তাঁরা তিনজন ব্যক্তির কাছ থেকে ৪ বিলিয়নেরও বেশি নিউক্লিওটাইড নিয়ে গঠিত নিয়ান্ডারথাল জিনোমের একটি খসড়া ক্রম উপস্থাপন করেন।
কথায় বলে না রক্তের সম্পর্ক না থাকলে আত্মীয় হওয়া যায় না, তাই এবার দেখা যাক আমাদের এই বিবর্তনীয় খুড়তুত ভাইদের সাথে আমাদের কতটুকু রক্তের সম্পর্ক। ফ্রান্সের Aix-Marseille বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিদ সিলভানা কনডেমি (Silvana Condemi) এবং তাঁর সহকর্মীরা তিনটি নিয়ান্ডারথাল জিনোম এবং একটি ৬৪ হাজার বছর বয়সী ডেনিসোভান জিনোমের তথ্য, তাদের রক্তের ধরন পরীক্ষা করার জন্য ব্যবহার করেছেন৷ অতীতে শুধুমাত্র একটি নিয়ান্ডারথালের রক্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং আধুনিক মানুষের রক্তকে শ্রেণিবদ্ধ করতে ব্যবহৃত ABO(A, B, AB, এবং O রক্তের ধরন নির্ধারণ) সিস্টেমের অধীনে O টাইপ পাওয়া গিয়েছিল। যেহেতু সমস্ত শিম্পাঞ্জিরা টাইপ A এবং সমস্ত গরিলারা টাইপ B, তাই ধরে নেওয়া হয়েছিল যে সমস্ত নিয়ান্ডারথালদের টাইপ O হবে। কিন্তু নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে ডেনিসোভা গুহা থেকে নিয়ান্ডারথাল মহিলার ১ লাখ বছর বয়সী দেহাবশেষে টাইপ A রক্ত ছিল, সাইবেরিয়ার চাগিরস্কায়া গুহা থেকে নিয়ান্ডারথাল মহিলার ৪৮ হাজার বছর বয়সী দেহাবশেষেও টাইপ A রক্ত ছিল, কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার ভিন্ডিজা গুহা থেকে নিয়ান্ডারথাল মহিলার ৬৪ হাজার বছর বয়সী দেহাবশেষে টাইপ B রক্ত ছিল। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে এই প্রাচীন হোমিনিনগুলি ইতিমধ্যেই আধুনিক মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত ABO পরিবর্তনশীলতার সম্পূর্ণ পরিসর প্রদর্শন করেছে। তবে তিনটি নিয়ান্ডারথালই এখন বিরল একটি রিসাস (Rehsus) টাইপ বহন করে যা অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম মরুভূমির আদিবাসীদের একজন সদস্যের ডিএনএ-তে এবং পাপুয়া নিউ গিনির কিছু মানুষের মধ্যে পাওয়া গেছে। কনডেমি বলেন সেই সময়ে এটিকে অস্ট্রেলিয়ায় উদ্ভূত একটি নতুন রিসাস টাইপ বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন আমরা জানি যে এটি অতীতে বিদ্যমান ছিল এবং বর্তমানে সেটা হারিয়ে গেছে।
এবার একটু কল্পনা করা যাক যেখানে নিয়ান্ডারথালদের উদ্বিগ্ন মায়েরা তাদের বাচ্চাদের আলিঙ্গন করছে এবং কাদার মধ্যে খেলছে এমন চিন্তাহীন শিশুদের আগলে রাখার চেষ্টা করছে। পরিবারের কষ্টসহিষ্ণু অভিজ্ঞ পুরুষেরা তুষারাবৃত অরণ্য চষে বেড়াচ্ছেন খাদ্যের সন্ধানে। অভুক্ত পরিবারের সদস্যরা তাকিয়ে আছে পরিবারের বলিষ্ঠ অভিজ্ঞজনদের দিকে। মেজাজী যুবকরা সমাজের হুকুমের বিরুদ্ধে ছটফট করছে এবং ক্লান্ত প্রবীণ যারা কেবল শান্তিতে থাকতে চেয়েছিল তারা কেবল জ্ঞানী বৃদ্ধ মাতৃতান্ত্রিকদের মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে যারা ইতিমধ্যে এটি সব দেখেছে। এরা ভালবাসত, খেলত, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব তৈরি করত এবং মর্যাদা এবং ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা করত। তাদের মধ্যে ধারণা ছিল না যে পৃথিবীর মানুষ একদিন চাঁদে হাঁটবে, পরমাণুকে বিভক্ত করবে, জেনেটিক কোড বুঝবে। তো কি এমন হল যে তাদের এ গ্রহ থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে হয়েছিল?
নিয়ান্ডারথাল বিলুপ্তির কারণগুলির উপর বিভিন্ন অনুমান জড়িত যেমন প্যাথোজেন, প্রতিযোগিতামূলক প্রতিস্থাপন, আদি আধুনিক মানুষের সাথে সংঙ্কর-প্রজননের মাধ্যমে বিলুপ্তি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তন, ইনব্রিডিং ডিপ্রেশন ইত্যাদি। তারা একসাথে কাছাকাছি বসবাস করার কারণে হোমো স্যাপিয়েন্সরা নিয়ান্ডারথালদের সংক্রামিত করতে পারে যেটা নিয়ান্ডারথালদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় মহামারীটিকে অবাধে জ্বলতে দিতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রখ্যাত অধ্যাপক ক্রিস স্ট্রিংগারের(Chris Stringer) মতে, মানব বিবর্তনের সবচেয়ে বড় রহস্যগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে কীভাবে এই নিয়ান্ডারথালরা বিলুপ্ত হয়ে গেল? তিঁনি মনে করেন হোমো স্যাপিয়েন্স নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তির জন্য দায়ী হতে পারে সহিংসতার কারণে নয় বরং যৌনতার মাধ্যমে। তিঁনি বলেন হোমো সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে যৌনতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান গত কয়েক বছরে আরও জটিল হয়ে উঠেছে। গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সংঙ্কর-প্রজনন আসলে ঠিক কীভাবে ঘটেছিল তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনা এখনও পর্যন্ত অপর্যাপ্ত। আর আমরা প্রস্তাব করেছি যে এই আচরণটি নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যেতে পারত যদি তারা নিয়মিত হোমো সেপিয়েন্সের সাথে প্রজনন করত। আবার অনেকে মনে করেন অন্যকোন ভাবে মানুষের দ্বারা প্রেরিত রোগ-জীবাণু (Pathogen) নিয়ান্ডারথালদের কাছে চলে যায় যেটা তাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। কেননা নিয়ান্ডারথালদের এমন অসুখের জন্য দুর্বল সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল। তাই হোমো সেপিয়েন্সের প্রতিরোধী রোগগুলি তাদের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে। অভিনব মানব রোগ সম্ভবত আফ্রিকা থেকে ইউরেশিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এই কথিত “আফ্রিকান সুবিধা” ইউরেশিয়ায় ১০ হাজার বছর আগে কৃষি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত রয়ে গেছে। তারপরে গৃহপালিত প্রাণীরা নতুন মানব সংক্রমণের সবচেয়ে প্রচলিত উৎস হিসাবে অন্যান্য প্রাইমেটদের ছাড়িয়ে গেছে। ঐতিহাসিক অতীতে নেটিভ আমেরিকান জনসংখ্যার উপর ইউরেশিয়ান ভাইরাসের বিপর্যয়কর প্রভাব আমাদের একটি ধারনা দেয় যে আধুনিক মানুষ ৪০ হাজার বছর আগে ইউরেশিয়ায় হোমিনিন পূর্বসূরী গোষ্ঠীগুলিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাছাড়া সেসময় আধুনিক মানুষের কুকুরের সাথে জোট সম্পাদনা করাটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্যাট শিপম্যান (Pat Shipman) তাঁর ‘দ্যা ইনভেডরস’ বইতে যুক্তি দেন যে কুকুরের গৃহপালন আধুনিক মানুষকে শিকার করার সময় একটি বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। আর প্রমাণ দেখায় যে গৃহপালিত কুকুরের প্রাচীনতম অবশেষ (বেলজিয়াম-৩১,৭০০ এবং সাইবেরিয়া-৩৩,০০০ বছর আগের) পাওয়া গেছে। আবার অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন আধুনিক মানুষ তাদের হত্যা করেছে এবং যুক্তি দেন যে আধুনিক মানুষের আগমনের সময় এবং তাদের বিলুপ্ত হবার সময়টা মোটামুটি একই সময়কার। তাছাড়া কয়েকজন গবেষক যুক্তি দিয়েছেন, ইতালির নেপলসের কাছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তিতে অবদান রাখে। এরকম অসংখ্য কারনকে তাদের বিলুপ্তির জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। তবে কারন যাইহোক তাদের এই ধরাধাম থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়াটা সত্যই বেদনাদায়ক।
লেখাটিতে ভাষাগত,বিজ্ঞানের পরিভাষাগত বা অন্য কোন ত্রুটি থাকতে পারে, যেটা গুণী পাঠক নিজ গুণে শুধরিয়ে নিবেন। যারা বিবর্তন নিয়ে একটু বেশি জানতে চান তারা আমাদের মাতৃভাষায় রচিত অসাধারণ বই, বন্যা আহম্মদের ‘বিবর্তনের পথে’ পড়তে পারেন। আর লেখাটি যেহেতু কিছু স্বনামধন্য বিজ্ঞানীদের গবেষণার ভিত্তিতে লেখা,তাই এটা কোন অনুভূতিতে আঘাত করবার উদ্দেশ্যে নয়। যদি এটা হয়ে থাকে তাহলে সেটা হবে অনভিপ্রেত কাকতালীয় ব্যাপার।
লেখাটি অনেক তথ্যপূর্ণ এবং এখান থেকে নিয়ান্ডারথালরা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে সক্ষম হলাম । সত্যিই অনেক অবাক লাগছে যে আমাদের পূর্বেও এমন সৃষ্টি ছিল পৃথিবীতে এমনকি শুধু নিয়ান্ডারথাল নয়, আরও অনেক জাতি প্রজাতিও বিরাজ করে গেছে যার সম্পর্কে হয়তো বিজ্ঞানও এখনও রহস্য খুঁজে পায়নি। তবে বিজ্ঞান আমাদেরকে এরকম অনেক রহস্য সামনে এনে দিয়েছে যা সত্যি অকল্পনীয় ।