কদিন ধরে সোসাল মিডিয়ায় ‘যৌনকর্মীর সন্তান’ বলে একটি অশোভন আপত্তিজনক শব্দ অনেকের লেখাতেই ব্যবহার হতে দেখছি। কোনো মানুষের জন্ম পরিচয় নিয়ে মন্তব্য করা কোনো মর‍্যাল স্ট্যান্ডার্ডেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না এর কারণ কোনো মানুষই তার নিজের ইচ্ছায় জন্মগ্রহণ করে না। আবার যিনি জন্ম দিলেন তিনি যদি যৌনকর্মীও হন তবুও এজন্য তাকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ দোষারুপ করা অসভ্যতা। যৌনকর্মী বলে তার মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা থাকবে না ? থাকতে পারে না ? আবার যৌনকর্মীকে এতটা খারাপ ভাবারই কারণ কী ? আমরা কি ভেবে দেখি নিরবে নিভৃতে এই সমাজকর্মীরা সমাজের কী উপকার করে যাচ্ছে ? এদেরকে কাকের সাথে তুলনা করা যায়। পচা ময়লা দূষিত বর্জ খেয়ে কাক যেমন প্রকৃতিকে নির্মল আর বসবাস উপযোগী রাখছে তেমনি যৌনকর্মীগণ বেসামাল বা নিরুপায় পুরুষের শারিরীক চাহিদাকে মিটিয়ে সমাজকে নির্মল রাখতে সহায়তা করছে।

মানুষ জীবজগতের অন্তর্ভুক্ত বলেই স্বাভাবিকভাবে তার যৌনকামনা থাকবে আর তার এই যৌন কামনা চরিতার্থ করার প্রাকৃতিক উপায় হল বিপরীত লিঙ্গের সাথে মিলিত হওয়া। মানুষ বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন বলে তার লাজ লজ্জা আছে যেজন্য সে কিছু সামাজিক আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষ ইচ্ছে করলেই পশু পাখির মত মিলনে অংশ নিতে পারে না। এজন্য বিবাহের মাধ্যমে তাকে এই ক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতে হয়। পাশ্চাত্য বা উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতে বিবাহ বহির্ভূত যৌন মিলন স্বীকৃত হলেও আমাদের দেশে তা অপরাধ বলেই গণ্য হয়। আমাদের দেশে আটারো বছরের নিচের বয়সীরা শিশু শ্রেণিভুক্ত। শিশু বিয়ে করলে তা আবার বাল্য বিবাহের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যা কি না বে-আইনী। আবার কৈশোরকালেই অনেকের মাঝে যৌন আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। অনেকের মাঝে তা প্রবল আকার ধারণ করে। সেই যৌনতাড়িত কিশোরটি তখন কী করবে ? সে কি তখন ধর্ষণ করবে ? হাঁ, যখন প্রবল যৌনাকাংখী কিশোর তার আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার কোনো পথ খুঁজে পাবে না তখন সে সুযোগ পেলেই ধর্ষণের চেষ্টা করবে। তখন ধর্মের বাণী আর আইনের খড়গ কিছুই তাকে দমাতে পারবে না। এই যে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড, সেই মৃত্যুদন্ডের ভয়ও তার কাছে তখন নস্যি বলে গণ্য হবে। আপনার কিশোর সন্তানটির কথা একবার ভাবুন। সেও যদি এই অপ্রতিরোধ্য কামনাতাড়িত হয়ে ক্ষণিকের আবেগে তেমনি কিছু একটা করে ফেলে আপনি মেনে নিতে পারবেন তার মৃত্যুদন্ডের শাস্তি ? অথচ একজন যৌনকর্মীই তাকে এই মৃত্যুর পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। শুধু তাকেই নয় তার সাথে ধর্ষণের হাত থেকে আরেকজন নারীকেও সে নিরাপদ রাখবে। তাহলে যৌনকর্মী বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ঘৃণা উদ্গারের কারণ কী? পাশ্চাত্যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী ব্যয়বহুল শিক্ষার খরচ যোগাতে গিয়ে পার্টটাইম যৌনকর্মী হয়ে অর্থ উপার্জন করে সেই টাকায় সেমিস্টারের ফি দেয়। এতে তাদের কোনো পাপবোধ নেই। তার নিজের শরীর, একে ব্যবহারের এখতিয়ার একমাত্র তারই। পড়ালেখা শেষ করে এরা ভাল চাকরী বাকরী করে প্রতিষ্টিত হচ্ছে। পেছনের জীবনটাকেও তারা আরেকটি পার্ট টাইম জব বলেই মেনে নিচ্ছে। পাপতো শরীরে থাকে না পাপ থাকে মনে আর মগজে।

আমাদের দেশে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড নির্ধারণের পরও কি ধর্ষণ কমছে ? কমেনি বরং বেড়েছে। প্রকৃতির নিয়মেই মানুষ তার জৈবিক চাহিদা মেটাতে চাইবে। চাহিদা যখন বাঁধভাঙ্গা হয়ে যাবে তখন সে নৈতিকতার ধার ধারবে না। মৃতুদন্ডের ভয় করবে না। এই যে মাদ্রাসার হুজুরদের বালক মৈথুনের কুখ্যাতি এর ব্যখ্যাও একই। এরা বিবাহ বহির্ভুতভাবে অন্য নারীতে গমন করতে পারে না কারণ সেটা জিনা হয়ে যাবে, মাস্টারবেসন করতে পারবে না শেষ বিচারের কালে যে হাত দিয়ে মাস্টারবেসন করেছে সে হাত গর্ভধারণ করে ফেলবে, আবার ধর্মীয় খোলস দাড়ি টুপি পাঞ্জাবির কারণে পতিতালয়েও যেতে পারে না তাহলে সে তার চাহিদা মেটাবে কী দিয়ে? হাতের কাছে অতি সহজলভ্য যা তা দিয়েইতো দুধের স্বাদ গুলে মেটাবার চেষ্টা করবে। সমাজ থেকে যৌনতাবিষয়ক অপরাধ দূর করতে ধর্মালয় বা আইনের কঠিন কঠোর বিধান থেকে পতিতালয়ের উপযোগীতা অনেক বেশি। আইন যদি সার্জারি হয় তবে পতিতালয় হল প্রতিষেধক। চিকিৎসার চেয়ে প্রতিষেধক বেশি গ্রহণযোগ্য নয় কি?

আর আপনি যে অন্যকে যৌনকর্মীর সন্তান বলে বাহাদুরী ফলাচ্ছেন বৃহদার্থে আপনিও কি যৌনকর্মীর সন্তান নন ? প্রাণীমাত্রই যদি যৌনকর্মের ফসল হয় তবে এই সৃষ্টির সকল প্রাণীই যৌনকর্মীর সন্তান। বিপরীত লিঙ্গের দুটি প্রাণী যখন মিলিত হয় তখন কি রাজা কি প্রজা কি উঁচু কি নিচু কি পয়গম্বর কি অবতার কি কুকুর কি বিড়াল বাঘ সিংহ বা অন্য সকল পশু পাখি কীট পতঙ্গ সেই মিলনক্ষণে সবাই নিষ্টাবান যৌনকর্মী ছাড়া আর কিছুই নয়। একই পদ্মতি, একই প্রক্রিয়া। একই আনন্দ একই উত্তেজনা। সন্তান উৎপাদনের এটাই একমাত্র উপায় ( যদিও বিজ্ঞান এখন যৌন মিলন ছাড়াই সন্তান উৎপাদনের একাধিক পদ্মতি আবিষ্কার করেছে) তাহলে উৎপাদিত সন্তানের ক্ষেত্রে বৈষম্য কেন ? পৃথিবীর শ্রেষ্ট মানুষগণ কি বলতে পারবেন সাধারণ নিয়মের বাইরে অন্য কোনো মহৎ পদ্মতিতে তাদের জন্ম হয়েছে ? তবে হাঁ, পার্থক্য একটা আছে আর সেটা হল লাইসেন্স বিষয়ক। আমরা যারা একজন প্রফেশনাল যৌনকর্মীর সন্তানকে আলাদা করছি তার মূলে হল লাইসেন্স। আমরা লাইসেন্সধারী অর্থাৎ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ দুজন নরনারীর মিলনের ফসল আর ওরা লাইসেন্সবিহীন দুজনের। কেরোর ড্রাইজিন যখন বারে বসে লাইসেন্সধারীরা খায় তখন তা বৈধ একই মদ যখন সাধারণে টানে তখন তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই বৈষম্য, বৈধ অবৈধের মাফকাঠি তৈরি করেছে সমাজ এবং রাষ্ট্র।

লাইসেন্সধারীদের সন্তান হিসেবে আমাদের একটি বাড়তি সুবিধা হল আমরা  একজনকে আমাদের জনক হিসেবে মেনে নিয়ে উত্তরাধিকারসূত্রে তার স্নেহ ভালবাসা পৃষ্টপোষকতা এবং তার স্থাবর অস্থাবর সম্পদের মালিকানা ভোগ করি কিন্তু লাইসেন্সবিহীনরা সেই সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এইজন্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতে মাতার চেয়ে পিতার পরিচয় নেহায়েতই গৌণ বলে ধরে নেয়া হয়। আমি পঁচিশ বছর ধরে আমেরিকাতে আছি কিন্তু কোনোদিন কোনো অফিসিয়েল কাজে পিতার নাম ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি পক্ষান্তরে রাষ্ট্রীয় সকল কাজে কর্মে এমনকি একটি ক্রেডিটকার্ড করতে গিয়েও মায়ের নাম প্রয়োজন হয়। মাকে দিয়েই সন্তানের পরিচয়। মা ই আদি এবং আসল। পিতা যে কোনো জন হতে পারে। কিন্তু মা বদলায়না। মায়ের গর্ভে নয়মাস থেকেই সন্তানের বেড়ে ওঠা এমন কি বয়ঃসন্ধির পূর্ব পর্যন্ত সে মা ই সন্তানকে বুকের দুধ দিয়ে কুলে পিঠে করে  বড় করে পৃথিবীতে সারভাইব উপযোগী করে ছেড়ে দেয়। সুতরাং যৌনকর্মীর সন্তান বলে কিছু নেই সেও আপনার আমার মত একজন মায়েরই সন্তান। আপনি হয়তো পিতার পরিচয়ে গর্বিত  সে একই পরিচয়ে সংকুচিত। কিন্তু বিজ্ঞান সেই অজানাকেও জানার পথ করে দিয়েছে। ডি এন এ টেস্টের মাধ্যমে শুধু পিতা কেন চৌদ্দগুষ্টির সূত্র বের করাও এখন মানুষের আয়ত্বে। পরিশেষে নজরুলের বিখ্যাত ‘বারাঙ্গনা’ কবিতার কয়েক পংক্তি উদ্ধৃত করে শেষ করছি

দেড় শত কোটি সন্তান এই বিশ্বের অধিবাসী-

কয়জন পিতা-মাতা ইহাদের হয়ে নিষ্কাম ব্রতী

পুত্রকন্যা কামনা করিল? কয়জন সৎ-সতী?

ক’জন করিল তপস্যা ভাই সন্তান-লাভ তরে?

কার পাপে কোটি দুধের বাচ্চা আঁতুড়ে জন্মে’ মরে?

সেরেফ্‌ পশুর ক্ষুধা নিয়ে হেথা মিলে নরনারী যত,

সেই কামনার সন্তান মোরা! তবুও গর্ব কত!

শুন ধর্মের চাঁই-

জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই!

অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়,

অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!