আজ আমার দু’জন প্রিয় মানুষের জন্মদিন। একজন জাপানে পিএইচডিকালীন আমার সুপারভাইজার অধ্যাপক মাতসুগি তাকাসি, অন্যজন অধ্যাপক, সমাজতাত্ত্বিক সলিমুল্লাহ খান। আমার বড় ভাইয়ের সুবাদে এ দুইজন মহতপ্রাণ মানুষের সাথে আমার পরিচয় ও কাজের সূত্রে ঘনিষ্ঠতা।
সলিমুল্লাহ খানের সাথে আমার পরিচয় স্কুলজীবনে। বড়ভাই ড. কুদারাতে খোদা’র সাথে তিনি আমাদের সিরাজগঞ্জের বাড়ীতে এলে তখনই তাঁর সাথে প্রথম আলাপ-পরিচয় হয়। তখন অবশ্য অনেক বোঝার বয়স হয়নি। বয়স বাড়ার সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের খোঁজ ও আগ্রহের কারণে তাঁর সন্ধান-সম্পর্ক অনিবার্য হয়। তারপরও নানা কারণে গুরু সলিমুল্লাহ খানের কাছে থেকে যথেষ্ট তালিমের সুযোগ হয়নি। আমি যখন দেশে তখন তিনি উচ্চশিক্ষার কারণে বিদেশে, আর এখন তিনি দেশে আমি বাইরে। কিন্তু প্রযুক্তিক সুবিধায় নিজেকে ধারাবাহিক যুক্ত রেখেছি। তাঁকে যত জানছি, বিষ্ময়বোধ তত বাড়ছে এবং নিজের জানা-অজানাগুলো স্পষ্ট হয়ে- ঝালাই হয়ে যাচ্ছে।
বাঙালি পাঠকের কাছে সলিমুল্লাহ খানকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া তিনি। মানুষের শ্মরণশক্তি, জানার পরিধি কতটা বিস্তৃত হতে পারে সে কথা মনীষীদের জীবনী পড়ে জেনেছি। সে মিথের জীবন্ত ধারণা দেয় আমাদের সময়ের কিংবদ্বন্দ্বী গুরু সলিমুল্লাহ খান। কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস, নানা ঘটনার সন-তারিখ-চরিত্র, অজস্র বই-লেখকের নাম ও তার পৃষ্ঠা-অধ্যায় মনে রাখার কাজটি স্বাভাবিক কোন ঘটনা নয় যেটা তিনি করেন অবলীলায়।
আহমদ ছফার প্রথম বই পড়ি বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, তারপর গাভি বৃত্তান্ত, অলাতচক্র, অঙ্কার, বাংলাদেশের রাজনৈতিক রাজনৈতিক জটিলতা ও অন্যান্য, কিছু পাঠ অবশ্য অবশিষ্ঠ আছে। আমরা ভাগ্যবান আমাদের তরুণ্যে আহমদ ছফাকে পেয়েছি। ছফাভাই চোখে পরার মত কোন ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, কিন্তু কথায় এবং আচরণে সবার নজর কাড়ার মত অবশ্যই ছিলেন। শাহবাগ আজিজ মার্কেটে উনার আড্ডায় বেশ কয়েকদিন হাজির ছিলাম। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে তাঁর সাথে দেখাও হয়েছে। ছফাভাইকে পড়ে যতটা না জেনেছি, তার চেয়ে অধিক জেনেছি খান ভাইয়ের গল্পে-আড্ডায়-লেখায়।
এই কথাগুলো বলার কারণ হচ্ছে, আহমদ ছফা ও অধ্যাপক রাজ্জাকের বিষয়ে খানভাইয়ের কাছে যতটা শুনেছি, তখন মনে হয়েছে লোকটা অকৃপন ও কৃতজ্ঞজন। জ্ঞানীদের মধ্যে অন্যের ঢোল পেটানো মানুষের সংখ্যা খুব একটা দেখা যায় না। আমাদের দেশে একই সাথে জ্ঞানী এবং বিনয়ী মানুষের সংখ্যা অপ্রতুল! তিনি যাঁদের প্রতিভা, কাজের প্রশংসা করেন তাঁকেও কখনো তাঁদের চেয়ে কম জ্ঞানী মনে হয় না। রাজ্জাক স্যারকে অতটা জানার সুযোগ না হলেও, ছফাভাইকে অন্তত অনেকাংশে পড়েছি। সেক্ষেত্রে মনে হয়েছে সলিমুল্লাহ খানের ক্ষিপ্রতা-তীব্রতা-গভীরতাও অধিক। তাহলে প্রশ্ন আসে, তিনি কি তাঁর সেই মেধা ও সামর্থের সবটা খরচ করতে পারছেন? তিনি যে মাত্রার স্মরণশক্তির জ্ঞানী মানুষ এমন প্রতিভা বাঙালি বাংলা সাহিত্যে খুব বেশী নেই। সে বিবেচনায় মনে হয় তিনি মৌলিক গবেষণামুলক একাডেমিক কাজ সামান্যই করেছেন। অবশ্য তাঁর বক্তৃতাগুলো বিষয় বিবেচনায় সম্পাদনার মাধ্যমে সংকলন করা গেলে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শনের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করবে।
সলিমুল্লাহ খানকে নিয়ে এ প্রসঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের সহকর্মী লেখক-চিন্তক ফিরোজ আহমেদের একটি সংক্ষিপ্ত মুল্যায়ন আমার নজরে পড়েছিল। ফিরোজের সাথে আমার এ বিষয়ে কিছুটা কথাও হয়েছিল। খানভাইকে নিয়ে তার পর্যবেক্ষনটা আমার সুবিবেচক মনে হয়েছিল। তার মতে, “সলিমুল্লাহ খানের মত ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে তার সম্ভাবনার পুরোটা বিকশিত করতে পারেননি। কারন বুদ্ধিবৃত্তির জগতে প্রতিপক্ষতাও দারুণ প্রয়োজন, বিকাশের জন্য। কিন্তু তিনি বহু বিষয়ে সাহসের সাথে উত্থাপন করেছেন, কথা বলেছেন, কাজ করেছেন নিজের বিচার অনুয়ায়ী, সেই প্রশংসা গোপন করা অন্যায় হবে। তার মত মানুষ যদি কোন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকতো, যেখানে তিনি অন্যদের মুখাপেক্ষী না হয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় নিমগ্ন থাকতে পারতেন, অজস্র শিক্ষার্থী ও গবেষক তিনি তৈরি করতে পারতেন। আমার কাছে এটা একটা বড় ক্ষতি মনে হয়, তার মত এত বড় একজন জ্ঞানী মানুষের আসল যে গুন, শিক্ষা দেবার ক্ষমতা, সেটা কিছুটা আধাপেশাদারী কায়দায় খরচ হলো।“ এক্ষেত্রে আমরা ভাবনা তাঁর নিজের যেমন দায় আছে, একই সাথে রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠানেরও তাঁর মেধা-প্রতিভাকে কাজে লাগাতে না পারার ব্যর্থতা আছে।
দেশের প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে শিক্ষকতায় নিয়োগ না দিয়ে তাঁর প্রতি অবিচার করেছেন। তাঁর মেধা ও সক্ষমতাকে বুঝতে ও মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমন অনেক অনন্য প্রতিভা এ ভূখন্ডে জন্মগ্রহন করেছেন কিন্তু সমাজ তাঁদের মেধার পুরোটা নিতে পারেনি। খানভাই একবার দুঃখ করে বলছিলেন, সরকারপ্রধান আমাকে শীতের পিঠা খেতে আমন্ত্রন জানায়, আমি সেখানে যাইনি, কারণ সেটা হবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। আমাকে যদি রাষ্ট্রের কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে-প্রয়োজনে ডাকতো আমি যেতাম।‘ তিনি যাননি, কিন্তু আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা সরকার প্রধানের চা-পানি পান ও পুজা-পার্বনের আমন্ত্রণের জন্য মুখিয়ে থাকেন। প্রকৃত জ্ঞানী ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ এগুলোর পরোয়া করেন না। যে কারণে শাসকরা তাঁদের এড়িয়ে চলে, একঘরে করে, জেলে পোরে, দেশছাড়া করে। আড়াই হাজার বছর আগে দার্শনিক ডায়োজিনাস বলেছিলেন, সমাজে একজন জ্ঞানী মানুষকে আবিষ্কার করতে আরেকজন জ্ঞানী মানুষই দরকার! কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য মহাকালের বর হয়ে আসা এমন দূর্লভ প্রতিভাবরণে আমাদের শাসক ও সমাজ কোনটাই প্রস্তত নয়।
কথিত আছে, মহাবীর আলেকজান্ডার একবার দরিদ্র দার্শনিক ডায়োজিনাসের জন্য কিছু করার অভিপ্রায়ে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে পথের ধারে তার বস্তিতে গেলেন। তিনি পথের ধারেই ডায়োজিনাসকে দেখতে পেলেন। মহাবীর জিজ্ঞেস করলেন, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি? ডায়োজিনাস বললেন, তুমি যা দিতে পারবে না, তা তুমি আটকে রেখো না। তুমি আমার সামনে থেকে সরে দাড়াও। তোমার জন্য আমি রোদ পোহাতে পারছি না।“ সেটা ছিল আলেকজান্ডারের প্রতি ডায়োজিনাসের এক নিষ্ঠুর রশিকতা। আড়াই হাজার বছর আগের এমন একটা ঘটনার কথা আজকেরও দিনেও আমরা কল্পনা করতে পারি না! শাসকরা আইন তৈরী করেছেন, স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের ক্ষেত্রে বাধা তৈরী করেছেন, মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র সীমাহীন সংকুচিত করছেন। এমন আবদ্ধ একটি পরিবেশে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ও বিকাশ সহজ নয়, কঠিন। সলিমুল্লাহ খান সেই কঠিন সময়ে আলো হাতে নির্ভয়ে দৃঢ়তায় ছুটছেন।
গতবছর খান ভাইয়ের সাথে তাঁর বাসায় ও ল্যাবে একটা লম্বা সময়ের সঙ্গী ছিলাম। দেশের শিক্ষা-সাহিত্য-রাজনীতি নিয়ে অনেক কথা হয়। তখন তাঁর সাথে কথাকালে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করি। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে তাঁর বলা-বক্তব্যের বিষয়ে অনেক কথা বলার আছে। এমন আরো কিছু বিষয়ে তাঁর ভাবনা যথার্থ মনে হয় না, কিন্তু অধিকাংশ বিষয়েই তার আলাপ সময়ের চাওয়াকে ধারণ করে ও যথার্থ মনে করি। অন্তত আমাদের দেশের জাতীয় স্বার্থের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনেক বুদ্ধিজীবী দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, নিরব-প্রতিবাদহীন থাকেন, শাসকের মনোভাবে চলেন, লতাপাতা নিয়ে কথা বলেন, সলিমুল্লাহ খান সে পথে হাটার লোক নন, বরং তিনি এই বৈরী সময়েরই প্রতিনিধিত্ব করছেন।
সেদিন কথা প্রসঙ্গে এক পর্যায়ে তিনি বললেন, মানুষ আমার কথায় সামান্য অসঙ্গতি পেলে তীব্র সমালোচনা করে, কিন্তু আমি তো অনেক ভাল কথাও বলি সেগুলোর কেউ প্রসংশা করে না। অভিমানের তীরটা আমার দিকেও ছিল। এবং সঙ্গতও মনে হয়েছিল। কিন্তু এই সব ভিন্নমত সত্ত্বেও তার ছাত্র হতে মোটেই আপত্তি নেই বরং গর্ব ও আনন্দ আছে। সমাজে বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব হলো ঘটমান বাস্তবতায় নিজের চিন্তাকে উপস্থাপন করা। সলিমুল্লাহ খান প্রায় সব ক্ষেত্রেই সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। আমরা তার সাথে একমত বা ভিন্নমত যাই হই না কেন। কার কাছ থেকে কে কতটুকু গ্রহন করবে, সেটাও মানুষ ও সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরের উপর অনেকটা নির্ভর করে।
বর্তমান বাংলাদেশে যে কয়জন আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তাবিদ আছেন তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সলিমুল্লাহ খান অগ্রগন্য। তিনি একাধারে একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, আলোচক, লেখক, গবেষক, দার্শনিক, আইনবীদ, সাহিত্য সমালোচক, রাজনীতি বিশ্লেষক ও অগ্রসর চিন্তক। এত গুনের অধিকারী হলেও তাঁর মধ্যে কোন অহঙ্করবোধ দেখিনি। তিনি কথা বলতে পছন্দ করেন, অনেক বিনয়ী ও উপকারী একজন মানুষ। যে কোন বয়সের, পর্যায়ের মানুষের সাথে তিনি সহজেই মিশে যেতে পারেন। সমাজবিজ্ঞানের সকল শাখায় তার বিচরণ থাকায় তিনি অবলিলায় প্রায় সব বিষয়ে আলাপও করতে পারেন, আসর জমিয়ে সবার প্রিয়জন হতে পারেন।
সলিমুল্লাহ খান কখনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় চট্রগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে প্রথম হয়েছেন। অসম্ভব পড়ুয়া মানুষ, সব বিষয়েই তার আগ্রহ। বই সংগ্রহের তাঁর প্রিয় স্থান নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকান। সময় হলেই নীরবে চলে যান সেখানে। ছেচে আনেন জ্ঞানের মূল্যবান মনিমুক্তা! তাঁর কাছ থেকে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, জ্যাক লাকা, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, শার্ল বোদলেয়ার, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, মিশেল ফুকো, আন্তনিও গ্রামসি, ফ্রানৎস ফানোঁ, লেভি স্ত্রস, এডওয়ার্ড সাইদ, নোম চমস্কি, তালাল আসাদ, একবাল আহমেদসহ অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তিদের কর্মের অনেক জটিল আলোচনা সহজ করে শুনেছি। তার সর্বাধিক আলোচিত বই ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’ আমার টেবিলেই থাকে সমসময়। আজ তাঁর জন্মদিনে শতত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাই!
————————————————————————————————-
– ড. মঞ্জুরে খোদা (টরিক) ১৮ আগস্ট ২০২০।
Leave A Comment