প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

লিখেছেনঃ রুশা চৌধুরী

১৯২৩ সালে (বংলা ১৩৩০) কল্লোল পত্রিকা প্রকাশের সাথে সাথে এবং তার পরে আরও নানান পত্রিকার জন্ম হয়। পত্রিকার প্রকাশ মানে নতুন নতুন কথাসাহিত্যের প্রকাশ। আসলে সেই সময়টাই ছিল এক অদ্ভুত সময়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারত বর্ষ জুড়ে আন্দোলন দানা বাঁধছে আর শিক্ষা ব্যবস্থারও আগের থেকে প্রসার ঘটেছে।

সংস্কার ভাঙার জন্য যারা প্রথম পা বাড়ায় তারা প্রথমেই বাঁধা আর নিন্দার সম্মুখীন হয় এ তো জানা কথা। মানুষ যতোই ভাবুক জঞ্জাল পরিষ্কার হয়ে যাবে পুরোপুরি তা কিন্তু হয় না।

হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক তখন বেশ টানাপড়েন শুরু হয়ে গেছে যা আগেও ছিল। অথচ সেই একই সময়ে কার্ল মার্কসের শ্রেণীহীণ, সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন অনেক তরুনের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। তাই অনেকেই জাত-পাত, ধর্ম নিয়ে ভাবনাগুলোও নতুন করে রিফর্ম বা পূনর্ণিমান করছে।

নারীজাতি সম্পর্কে চিন্তারও প্রভুত পরিবর্তন এসেছে। কিছু কিছু তরুন এমন ভাবতে শুরু করেছেন যে ”বিলেতে থিয়েটার অভিনেত্রীদের ‘শিল্পী’বলা হয় কিন্তু ভারতবর্ষে এখনও তারা শুধুই ‘নটী’ বা প্রায় ‘পতিতা’ পর্যায়ে’। কিন্তু কেন? এই সবকিছুর সাথে আছে দারিদ্র। সব মিলিয়ে শিক্ষিত তরুনেরা চাকরি ও কাজের অভাবে ঘরে-বাইরে তখন বেশ বিপর্যস্ত।

কল্লোল পত্রিকার সাথে আরও অনেক পত্রিকা প্রকাশ হতে থাকে। কল্লোলের আগে কাজী নজরুল ইসলাম ‘ধুমকেতু’ প্রকাশ করেন(১৯২২) যেখানে ইংরেজদের তুলোধোনা করার সাথে সাথে গভীর সাংস্কৃতিক চর্চাও হতো। ‘উত্তরা'(১৯২৫), কালিকলম(১৯২৬), প্রগতি(১৯২৬),মহাকাল( ১৯২৯), ‘শনিবারের চিঠি’ (১৯২৪ ), ‘কবিতা’ এই নামগুলো এখানে উল্লেখযোগ্য।

পত্রিকাগুলোর নাম বললাম কারন এই সপ্তাহিক, ত্রৈমাসিক, মাসিক নানা ধরনের পত্রিকাগুলো সেই সময়ের উদীয়মান সব তরুণদের তুলে আনছিল। প্রতিযোগিতা ছিল, এমনকি কাদা ছোড়াছুড়ি পর্যন্ত হয়েছে কিন্তু সবকিছুতেই শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের ছোঁয়া থেকে গেছে।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের জবানীতে “বহু বিচিত্র অমিলকে মেলাবার একটি পতাকা ছিল ‘কল্লোল’, সেখানে মিল ছিল না ‘শৈলজানন্দ’ আর ‘অচিন্ত্য’র লেখায়। ‘বুদ্ধদেব বসু’ আর ‘যুবনাশ্ব’ ছদ্মনামে লেখা ‘মনীশ ঘটকে’র লেখার কলমও ভিন্ন ছিল সম্পূর্ণ… তবু আমরা পটুয়াটোলা লেনের সেই ঘরে এক গভীর আকর্ষণে মিলিত না হয়ে পারিনি”।

আগের পর্বে সেই সময়ের প্রায় সব উল্লেখযোগ্য লেখক কবিদের নাম দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘প্রগতি’ পত্রিকার মূল বিষয় ছিল আধুনিকতা, বিশ্ব সাহিত্যকে ধারণ করা। এর প্রতিটি সংখ্যাতেই বিদেশি কবিতা, গল্প অনুবাদ ও বিদেশি সাহিত্য নিয়ে আলোচনা প্রকাশিত হতো। এইচ. জি. ওয়েলস, চেখভ সবার লেখার অনুবাদ সেখানে স্থান পেয়েছিল।

সেই সময়ের বিভিন্ন বই ও সাময়িকী আর সমালোচনা পড়ে বোঝা যায় , তখনকার দিনে আধুনিক সাহিত্যকে ‘অশ্লীল’ বলাই ফ্যাশন ছিল, যেমন ফ্যাশন ছিল রবীন্দ্রনাথকে ‘দুর্বোধ্য’ বলা। কবিতা ও গল্পে তখন ধীরেধীরে চারপাশের দরিদ্র মানুষ, শ্রমিক, সাধারণ পেশাজীবী, বস্তিবাসীর জীবনযাপন, মানুষের সম্পর্কের টানাপড়েন, প্রেম ভালোবাসায় দেহ, পরকীয়া এইসব বিষয় উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে। বলা যায়, ড্রয়িংরুম থেকে সাহিত্য তখন অন্দরমহলের দিকে পা বাড়াতে চাচ্ছে।

‘ফ্রয়েড’ সাহেবের তত্ত্ব পৌঁছে গেছে শিক্ষিত যুবকদের কাছে যার প্রয়োগও তারা করছে তাদের নানান লেখায়, তাই অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছে বারবার।

আরও একটা অভিযোগ উঠেছিল যে এই সব নতুন কবি-লেখকেরা সাহিত্যের ‘আভিজাত্য’ মানে না। কারণ মুটে-মজুর কুলি, খালাসী, বস্তিবাসীদের জীবন উঠে আসছিল সে সময়ের সাহিত্যিকদের কলমে। সাহিত্যের জন্য বিশাল এক পরিবর্তন ছিল এইসব বিষয়গুলো।

‘প্রেম’ থাকলেও ‘কাম’ ও কামের প্রকাশ সে সময় অকল্পনীয় ছিল, কিন্তু নবীন সাহিত্যিকেরা তাদের লেখায় ‘প্রেমে’র থেকে ‘কাম’কে আলাদা রাখেননি।

শৈলজানন্দ ‘কয়লা কুঠির দেশ’ গল্প প্রচুর সমালোচনার মুখে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সবসময় সমস্ত সুন্দর আর সৃজনশীল কাজকে শুভাশিস জানাতে। তিনি শৈলজানন্দকে তাঁর ‘কয়লা কুঠির দেশ’ গল্প নিয়ে চিঠি লিখে বলেন, “আমরা দোতালার জানালা দিয়ে গরীবদের দেখছি তুমি তাদের সঙ্গে মিশে একাত্ম হয়ে তাদের সুখ দুঃখ অনুভব করেছ গভীরভাবে। তোমার লেখা আমার ভালো লাগে।”

এভাবে সব জায়গায় দেখা যায় রবীন্দ্রনাথকে তারুন্যের সাথেই ছিলেন।যা কিছু সুন্দর আর শৈল্পিক সেরকম সবকিছুতে তিনি সাধুবাদ দিতেন। তারপরেও বলা হয় যে কল্লোল যুগ ‘রবীন্দ্র বিরোধী’! আসলে কি তা বিদ্রোহ ছিল না কী তা হয়ত এই রচনার শেষে গিয়ে বুঝতে পারব। তবে এটা সত্য যে সেই সময়ের নবীন সাহিত্যিকেরা নিজেদের আরও অভিনব ভাবে প্রকাশের আয়োজনেই ব্রতী ছিলেন।

নবীন লেখিয়েদের বিরূদ্ধে যারা দাঁড়িয়েছিলেন তারা কিন্তু ‘রবীন্দ্রনাথের দল’ ( সেসময় এমনটা বলা হতো) ছিল না।

নানা রকম ব্যাঙ্গাত্মক সমালোচনা আর সবার বিরোধিতা করবার জন্যও একদল ছিলেন, পুরোভাগে ছিলেন সেই বিখ্যাত পত্রিকা ‘শনিবারের চিঠি”র কারিগর ‘সজনীকান্ত দাস’। তিনি শক্তিধর ছিলেন একই সাথে লেখা ও ব্যক্তিত্ব দুটোতেই। সাথে ছিলেন ‘মোহিতলাল মজুমদার’, ‘সুনীতিকুমার চট্যোপাধ্যায়’, ‘নীরদ চৌধুরী’, ‘হেমন্ত চট্টোপাধ্যায়’ প্রমুখ।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, প্রমথ চৌধুরী, ‘কল্লোল’, ‘প্রগতি’ ‘কালিকলমের’ নবীন লেখক কেউ বাদ যায়নি এই শনিবারের চিঠির দলের নিন্দা ও ব্যাঙ্গের হাত থেকে। আসলে সমালোচনাও যে সাহিত্যের একটি অংশ তাও সেই সময় এভাবে নান্দনিকতা পেয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ যিনি নিজেই অনেকবার ‘শনিবারের চিঠি’র কলমে বিদ্ধ হয়েছিলেন সেই তিনিই লিখেছিলেন: “ব্যাঙ্গ করবার ক্ষমতার একটা অসামান্যতা অনুভব করছি বোঝা যায় যে এই ক্ষমতাটা আর্টের পদবীতে পৌঁছেছে… ব্যাঙ্গসাহিত্যের যথার্থ রণক্ষেত্র সর্বজনীন মনুষ্যলোকে, কোনো একটা ছাতাওয়ালা গলিতে নয়।” অথচ এই ‘শনিবারের চিঠির’ ‘ছবিতা’ নামের রেখাচিত্রে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বিদ্ধ করা হয়েছে বারংবার।

ব্যাঙ্গাত্মক রচনায় বেশীরভাগ লেখিয়েই ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। সজনীকান্তও কিন্তু একসময় ‘কল্লোলের” লোক ছিলেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ভাষায়, “আমরা সবাই একই ঝাঁকের কই, এক সানকির ইয়ার শুধু মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ”।

সবার কর্মনিষ্ঠা,সাহস, ইচ্ছে প্রায় একই ছিল আর তাঁরা সবাই সাহিত্যকে ভালোবাসতেন। অচিন্ত্যকুমারের ‘কল্লোল যুগ’ বই, প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাক্ষাতকার, বুদ্ধদেব বসুর লেখায় দেখেছি যে তাঁরা নিজেরা নিজেদের একেক দলের বলতেন। যেমন কেউ ‘কল্লোলের দল’, কেউ ‘কালিকলমের দল’, কেউ ‘প্রগতির দল’। এমন দল বলা হলেও দেখা যেত ঘুরে ফিরে সবাই সবার দলে চলে আসছেন। বুদ্ধদেব ‘প্রগতি’র লোক ‘কল্লোলে’ লেখা দিচ্ছেন, আবার ‘কল্লোলে’র প্রেমেন্দ্র, অচিন্ত্যরা প্রগতিতে লেখা দিচ্ছেন। ‘কালিকালম’ প্রতিষ্ঠা হবার পরে সেখানেও যাচ্ছেন, লিখছেন, ‘শনিবারের চিঠি’র জবাব দিতে ‘রবিবারের চিঠি’র জন্ম হচ্ছে।

একদল স্বপ্নবাজ তরুণ নানান রকম লিখছে, ভাঙতে চাইছে চলমান ধারা, আঘাত কোথায় করবে, কাকে করবে বুঝতে পারছে না আর এর ফলেই তৈরি হচ্ছে সংঘাত আর সেইসব সংঘাত মানেই নিত্য নতুন সৃষ্টি। আসলে এই সবকিছুকে সংঘাত বললেও, আজ এত বছর পরে আমার মনে হয়েছে এমন উত্তর আর প্রতিউত্তর ছিল বলেই সাহিত্যের নতুন নতুন ধারা তৈরি হয়েছিল।

আগেও বলেছিলাম আমাদের বাংলা সাহিত্যের অধুনিকায়নের যে ভিত্তি মাইকেল মধুসুদন তাঁর কলম দিয়ে করে গেছিলেন সেটা রবীন্দ্রনাথ একাই টেনে নিয়ে গেছেন হাজার, লক্ষ মাইল, আর তাতে নানানরকম বর্ণচ্ছটা যুক্ত করেছেন এই নবীনের দল।

কল্লোল পত্রিকা প্রকাশের আগেই কাজী নজরুলের ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখে পাঠিয়েছিলেন

“আয় চলে আয় রে ধুমকেতু,
আঁধার বাঁধা অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দূর্গ শিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন”।

তেমনি কাজী নজরুল যখন জেলে তখন ‘পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়’ দেখা করতে গেলে ‘নজরুল’ কল্লোল পত্রিকার জন্য লিখে দিলেন, “আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে”, এর জন্য পাঁচ টাকা সম্মানী ‘পবিত্র’ই আবার জেলে দিয়ে আসেন ‘নজরুলকে’।

‘প্রবাসী’ পত্রিকার জন্য নিজের লেখা গল্প ‘মা’ পকেটে নিয়ে যাচ্ছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, কিন্তু ‘দীনেশরঞ্জনে’র এক কথাতে শৈলজানন্দ সেই গল্প ‘কল্লোলে’র জন্য দিয়ে দেন। সম্প্রীতি আর ভালোবাসার সাথে সাথে মতভেদ তো থাকবেই, তা না হলে যে সৃষ্টির আনন্দই হয়ত ফিকে হয়ে যায়।

বাংলা সাহিত্যে সে সময়ে একটা নতুন কথা চালু হয়েছে ‘মর্বিড’। সবাই একটু তেমনি লেখার চেষ্টা করছে। তেমনি এক মর্বিড গল্প ছাপিয়ে ফেলল ‘কল্লোল’, নীতিধ্বজদের কথা চিন্তা না করে, নাম ‘রজনী হল উতলা’, লেখক ‘বুদ্ধদেব বসু’। হালের মাপকাঠিতে ‘ফিকে’ হলেও সেই সময় এই গল্প তুমুল হাহাকার আর হৈ চৈ ফেলে দিলো, ‘গেল গেল সব গেল’ রব উঠল।

এক সম্ভ্রান্ত মহিলা পত্রিকায় প্রতিবাদ ছাপলেন, “এই লেখক যদি বিয়ে না করে থাকে তবে যেন অবিলম্বে বিয়ে করে ফেলে, আর বউ বাপের বাড়ি গেলে যেন তাকে কাছে আনিয়ে নেয় চটপট।”
কল্লোলের দলের ভাষায় “তৃতীয় চিন্তাটা অর্থাৎ স্ত্রী বর্তমান ও কাছে থাকার পরেও যদি বিমুখতা আসে অন্য নারীতে আসক্তি আসে তাহলে লেখকের কী কর্তব্য তা কেন সেই প্রতিবাদকারী বললেন না”। এমন ঘটনা সেই সময় নৈমিত্তিক ছিল। ঠিক যেমন একদিন রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ ও ‘ঘরে বাইরে’ নিয়েও প্রতিবাদ আর ‘গেল গেল রব’ উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের সময়ের ‘সজনীকান্ত’ ছিলেন ‘সুরেশচন্দ্র সমাজপতি’ আর এই সময়ে সজনীকান্ত দাসের কাছে ‘নষ্টনীড়’ আর ‘ঘরে বাইরে’ যতোটুকু দরকার ততোটুকুর ছাড়পত্র পেয়ে গেল। এগুলোই যে আসলে সময়ের সাথে রুচি, জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি আর তা প্রকাশের বিচার আর কিছুই না তা এখন যতো সহজে বলে দেয়া যায় তখন মোটেও তা ছিল না।

সেই সময়ের কথাসাহিত্যিকেরা যে পরিবর্তন আনছিলেন, চেষ্টা করছিলেন সেটা কোনো চাপিয়ে দেয়া বিষয় ছিল না বরং একদম স্বতঃস্ফূর্ত একটা প্রক্রিয়া। আজ দূর থেকে দেখলে মনে হয় কী আনন্দ উৎসব আর সাজ সাজ রব ছিল যেন সেই সময়টা জুড়ে!

রবীন্দ্রনাথ সবসময় ছিলেন মাথার উপরে এবং তিনি নানান সময়ে তাঁদের উৎসাহও দিয়ে গেছেন, তারপরেও কল্লোল যুগ বললেই বলা হয় ‘রবীন্দ্রবিরোধী,’ কেনো?

আসলে এর উত্তর কি?

একজন পরিপূর্ণ সাহিত্যিক, বিশ্বকবি যিনি সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন তাঁকে অস্বীকার করবার কথা আসলে ছিল কি? না কী তাঁর অন্ধ অনুকরণ বা তাঁর নকল থেকে উত্তরণের চেষ্টা?

আমার এতো কথা লেখার মূল উদ্দেশ্য সেই সময়টাকে কিছুটা স্পর্শ করে আসা আর তা অবশ্যই সেই সময়ের আশ্চর্য মানুষগুলোর হাত ধরে। সেই সময়কার ‘কবিতা’র কথা বলতে গেলে আসলে বলতে হবে, সেই সময় কবিতা কতোটা প্রাধান্য পেত?

বুদ্ধদেব বসুর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, “আবাল্য দেখেছি বাংলা মাসিকপত্রে কবিতার সাধারণ স্থান পাদপ্রান্তিক। মানে যেখানে কোনো গদ্য রচনা শেষ তার ঠিক তলায় কবিতা শুরু। ব্যতিক্রম অবশ্য রবীন্দ্রনাথ। তারপর ‘সবুজপত্র’। ‘প্রবাসী’… ইত্যাদি পত্রিকার ইঞ্চি- কৃপণ পাদপূরণকারী অবজ্ঞা থেকে কবিতাকে প্রথম উদ্ধার করল ‘কল্লোল’- তার অনেক সংখ্যায় প্রথমেই থাকত ‘কবিতা’ – বড়ো অক্ষরে প্রবহমান এবং শুধু তা রবীন্দ্রনাথের নয় অন্যদেরও।”

এই ছিল একটা বিশাল পরিবর্তনের কথা বা নতুনের আবাহনের চেষ্টার কথা যা তখন তোড়জোড় করেই শুরু হয়েছিল।

‘কবিতা’ পত্রিকা প্রকাশের পরে বুদ্ধদেব বসু খুব ভয়ে ভয়ে এক কপি পাঠান রবীন্দ্রনাথকে আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে কবিতা চেয়ে পাঠান তাঁদের পত্রিকার জন্য! তাঁকে অবাক করে রবীন্দ্রনাথ আনকোরা নতুন এক ‘গদ্য-কবিতা’ লিখে পাঠান নাম ‘ছুটি’।

এভাবে ‘কল্লোল যুগ’ মানে সেই সময়টা বাংলা কবিতাকে পাদপ্রদীপের আলোয় টেনে আনতে থাকে। আমার কাছে তাই ‘কল্লোল যুগ’ কথাসাহিত্যের নবায়ন বা অধুনিক যুগে প্রবেশের দুয়ার। কল্লোলে যে সুরের জন্ম তা পরিপূর্ণতা পেতে শুরু করল অনেকটাই এই ‘কবিতা’ পত্রিকার হাত ধরে।

‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’, ‘বিষ্ণু দে’, ‘বুদ্ধদেব বসু’, ‘জীবনানন্দ দাস’ এমন এমন কবিতা লিখতে লাগলেন, কবিতাকে এমনভাবে নবনির্মিত হতে দিলেন যে বহুদিনের খোলনলচে বদলে যেতে লাগল। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়, “মাত্র তিন দশকের ব্যবধানে এক নতুন প্রবংশের হাতে কবিতার অর্থই দাঁড়াবে গদ্যকবিতা- আদ্যাশক্তি অক্ষরছন্দের পূজারি সারাদেশে প্রায় কেউ থাকবে না” এমনটা তিনিও ‘কবিতা’ পত্রিকার শুরুতে ভাবতে পারেননি।

“হে নুতন দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ!”

পরের পর্বে সেই নতুনের কান্ডারিদের কাছে যাব একে একে আমাদের বিশ্বকবির হাত ধরেই, আজ শেষ করছি।

(চলবে)

তথ্যসুত্র: অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, ক্লিনটন বি সিলি’র বই এছাড়া জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ এর জীবনী ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই।

ছবি: অন্তর্জাল।