লিখেছেনঃ অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

২০১২ সালের সকাল, ভারতীয়রা দাঁত মাজতে মাজতে নির্ভয়া কাণ্ডের খবর শুনেছিল। হাড় হিম করে দিয়েছিল সেই ঘটনা। স্তব্ধবাক হয়েছিল আসমুদ্রহিমাচল। তারপর ২০১৭ উন্নাও, ২০১৮ কাঠুয়া, ২০১৯ হায়দ্রাবাদ, ২০২০ হাথরাস, ২০২১ দিল্লী(সম্প্রতি মুম্বই) – ঘটেই চলেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরের রিপোর্ট অনুযায়ী দৈনিক প্রায় ৮৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ভারতমাতার শরীরে। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন তাই জানিয়ে দিয়েছে যে, মহিলাদের নিরাপত্তার বিষয়ে ভারত সবচেয়ে ভয়ংকর দেশ। পক্ষান্তরে শুধুমাত্র ভারতে নয়, সমগ্র পৃথিবীতেই – কী উন্নত দেশ কী অনুন্নত সর্বত্রই – ধর্ষণের ঘটনা ক্রমবর্ধমান। মহিলাদের ওপরেই মূলত ধর্ষণ ঘটে থাকে, তবে আজকাল পুরুষের ওপরেও ধর্ষণের ঘটনা বিরল নয়, তেমনই শিশু ও বৃদ্ধাদের ওপরেও এর প্রকোপ দিন-দিন বেড়েই চলেছে। ধর্ষণের নৃশংসতার মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হত্যার ঘটনাও। অতীতের দৃষ্টান্ত থেকে বিচার করলে, বিভিন্ন যুদ্ধ ছাড়াও ধর্ষণের ভয়াবহতার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য নিতান্ত কম নয়। মানুষ যুগ যুগ ধরে বহুবিধ শাস্তির আয়োজন করেও একে ঠেকাতে পারেনি, আবার শিক্ষাবিস্তারের ফলেও ধর্ষণ নির্মূল হয়নি, এমনকি নীতিকথা বা ধর্মের প্রভাবেও এর সবিশেষ হেরফের হয়নি। ফলে ধর্ষণ আসলে কী এবং কেন তা সংগঠিত হয়, তা নিয়ে মানুষের প্রচলিত ধারণা, তত্ত্ব ও সংজ্ঞাগুলি পুনর্বার প্রশ্নচিহ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন নয়তো যে, মানুষ কেবলমাত্র উপসর্গ নিরাময়েই মনযোগী হয়ে ব্যাধির প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে দিক্‌ভ্রান্ত হয়েছে, কিংবা ধর্ষণ যে আদৌ কোনো ব্যাধি বা উপসর্গ কিছুই নয়, শুধুমাত্র একটা অভিব্যক্তির প্রক্রিয়া সেইটা বুঝতেও ভুল হয়নি তো(যেমন ধরা যাক মৃত্যু, সেটা তো ব্যাধি বা অন্যকিছু নয়, একটা প্রক্রিয়া যা ব্যাধি-নিরেপেক্ষভাবেই সকলের জীবনে অবশ্যম্ভাবী)! মৃত্যুকে ঠেকানোর উপায় যেমন আপাতত নেই, কিন্তু জীবনকালকে দীর্ঘায়িত করার উপায় কিছু কিছু অবশ্যই আছে। একইভাবে যদি ধরে নেওয়া হয় যে, ধর্ষণ নামক ‘তথাকথিত’ অপরাধকে(?) নির্মূল(কোনো অপরাধকেই তো সমূলে উৎখাত করা যায়নি) করার আপাতত কোনো উপায় মানুষের জানা নেই, তবে অবশ্যই তাকে প্রতিহত করার পদ্ধতি নিশ্চয় থাকবে। পরীক্ষামূলকভাবে এখনও অব্দি যা-যা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলি কিছুটা সফল হলেও গুরুভাগই ব্যর্থ। তাই আরও একবার ধর্ষণের কারণ ও ব্যাখ্যাগুলিকে নিয়ে চিন্তা করা জরুরি, নইলে একে প্রতিরোধ করাও ধীরে-ধীরে অসম্ভব হয়ে যাবে। 

ধর্ষণ কেন হয়?

আলোচনার প্রথমেই একটা কথাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিতে হবে যে, প্রকৃতির জীববিদ্যাগত ও বিবর্তনবাদী অবস্থান মানুষের তৈরি নৈতিকতা বা উপদেশমালার ওপরে নির্ভরশীল নয়। ফলে প্রকৃতির নিয়মে যা আছে কিংবা যা হয়েছে, সেখানে তা থাকা কিংবা তা হওয়ার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অযথা উপদেশ বিতরণ অর্থহীন। জৈববাদের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক অবস্থানের বিক্রিয়ায় মানুষের আচরণবিধিকে নির্মাণ করা যায় ঠিকই কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি? যায় না। আর তাই নির্মাণের কাঁচামালের সঙ্গে যুক্ত করতে হয় এমন কিছু আয়ুধ যা মানুষকে সংযত হওয়ার ধারণা দেয়। সেগুলিকেই চক্রাকারে বিবর্তিত ও বিবর্ধিত করতে হয় সময়োপযোগী নিয়মের অন্তরালে যাকে আইন কিংবা নীতিও বলা হয়। সেখানে ফাঁক থেকে গেলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। ধর্ষণ শব্দটির অভ্যন্তরে অনেকগুলি ধারণা সংশ্লিষ্ট হয়ে মূর্ত, আর বহিরঙ্গে কিছু বিমূর্ততাও বর্তমান। তাই প্রথমে অভ্যন্তরীণ অর্থগুলিকে বিশ্লেষণ ও পরে বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে এসে চেতনাগুলিকে অনুধাবন করতে হবে। ‘ধর্ষণ’ কথাটি একইসঙ্গে মানসিক ব্যাধিগ্রস্ততার ও পুরুষতান্ত্রিক(বা অন্যকিছুর) ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসাবে যেমন বিদ্যমান, তেমনই আবার ধর্ষণের পরিবর্তে ব্যবহৃত ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগ’ শব্দবন্ধটি জৈববিবর্তনবাদের স্মারক হয়ে অটল দণ্ডায়মান। ফলে সবকটি প্রেক্ষিতেই মানবসভ্যতার এই ঘটমান বিষয়টিকে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। 

ধারণা ১ (মনোবিকার তত্ত্ব)

পথচলতি মানুষের মধ্যে কিংবা পাড়ার আড্ডার আসরগুলিতে ধর্ষণের কারণ হিসাবে যে ধারণা মূলত প্রতিফলিত হয় তা হল মানসিক বিকারগ্রস্ততার। অর্থাৎ ধর্ষক হয় কোনো মানসিক বা স্নায়ুঘটিত রোগের শিকার নয়তো তার অল্পবয়সের স্মৃতিতে থেকে যাওয়া কোনো অত্যাচারের দৃশ্য বা সম্পর্কের ভেঙে যাওয়ার ঘটনা, যা তাকে সামাজিকতা ও নৈতিকতার বোধহীন প্রাণী হিসাবে গড়ে তুলেছে। ফলে সে যা থেকে সুখানুভূতি বা কামনাতৃপ্তি ঘটাচ্ছে তা যে অন্য কারও প্রতি আক্রমণ, নৃশংসতা ও অন্যায় সেই চিন্তাই তার বোধগম্য হয় না। ফলে নির্বিকারভাবে সে ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলে। এমনকি এও নাকি দেখা গিয়েছে যে, শাস্তিপ্রাপ্তির পরেও ধর্ষক বুঝতেই পারেনি সে কেন শাস্তি পেল! কিন্তু এই ধারণা সর্বাগ্রে সঠিক নয়। কেননা যুদ্ধ-ধর্ষণ বা প্রণয়ীর দ্বারা ধর্ষণে এই তত্ত্ব খাটে না। সেখানে একেবারে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষেরাই ধর্ষক হয়ে ওঠে।

ধারণা ২ (নারীবাদী তত্ত্ব)

যেহেতু একথা সত্য যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ফলে উদ্ভূত ক্ষমতার অসাম্য নারীকে রাজনৈতিক, আর্থনীতিক ও সামাজিক সিদ্ধান্তগ্রহণ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে ও এক দীর্ঘকালীন শোষণের ইতিহাসের ইমারতে নারীকে অবদমিত করে রাখার উত্তরাধীকারও লাভ করেছে। ফলে ধর্ষণ আর সেখানে যৌনসুখপ্রাপ্তির ভাবাবেগ থাকেনি, তা ক্ষমতা কায়েম রাখার পন্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু সমাজের সর্বত্র পুরুষেরই কর্তৃত্ব, তাইই নারীদের বিরুদ্ধে ঘটে চলা এইসব অত্যাচারগুলির বিরুদ্ধে সবিশেষ কঠোর উদ্যোগ তারা দেখায়নি। কেননা পুরুষরা চেয়েছিল যে, ধর্ষণ নারীকে ভয় দেখিয়ে তটস্থ রাখার একটা উপায় হিসাবে চিরকাল বিদ্যমান থাকুক। তাই ধর্ষণ কেবলমাত্র একটি যৌন-অত্যাচার নয়, পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতায়ণের রাজনৈতিক ও সামাজিক পদ্ধতিও বটে। আর এখন তার প্রয়োগ আরও বেড়ে যাচ্ছে, কেননা নারীর ক্ষমতায়ণের নয়া সমাজব্যবস্থায় পুরুষরা নিজেদের কর্তৃত্ব সম্পর্কে আরও ভীত হচ্ছে। ফলে অফিস কিংবা অন্যান্য কাজের জায়গাগুলিতে ধর্ষণের সংবাদ প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। পক্ষান্তরে যদিও সেই দৃষ্টান্ত খুবই সামান্য, তবুও দেখা গিয়েছে যে নারীশাসিত সমাজেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এমনকি নারীর প্ররোচনাতেই অন্য নারীকে ধর্ষণ করার উদাহরণও আছে।

ধারণা ৩ (পণ্যায়ণ তত্ত্ব)

ধনতন্ত্রে নারীকে পণ্য হিসাবে শুধু নয়, পণ্য সংস্কৃতির উপাদান হিসাবেও প্রদর্শন করা হয়েছে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির বিজ্ঞাপনে নারীদের যৌন-উপাচাররূপে ব্যবহার করা হয়েছে। পুরুষদের শেখানো হয়েছে যে, যৌনতা হল একপ্রকার ক্ষুধা ও নারীরা হল সেই ক্ষুধা নিবারণের সামগ্রীমাত্র। ফলে ইচ্ছা করলেই তাকে কিনে সম্ভোগ করে ফেলা যায়। এক্ষেত্রে যৌথ সুখভোগের ধারণার বদলে আত্মতৃপ্তিকেই প্রধান করে তোলা হয়েছে। এই সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্যান্য বিনোদনের সামগ্রীও – মদ কিংবা অন্যান্য নেশাদ্রব্য। দেখা যায় যে, বেশিরভাগ ধর্ষণই তাই নেশাগ্রস্থ অবস্থাতেই ঘটে থাকে। একইসঙ্গে পণ্যায়ণ সংস্কৃতির বিপরীতে যৌনশিক্ষাকে ততটাই আড়ষ্ট করে রাখা হয়েছে। কেউই সচরাচর যৌন-বিষয়ক অনুভূতিগুলিকে নিয়ে কথা বলতে রাজি হয় না। তারা মনে করে যে এটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়, সর্বসমক্ষে এই আলোচনা অশালীন। যে-কারণে মানুষের অন্তরে যৌন-চাহিদা কীভাবে কোন্‌ রূপ নিচ্ছে তা নির্ধারণ করা অসম্ভব হয়ে যায়। তাই যখন কেউ পণ্যায়ণ সংস্কৃতির কবলে পড়ে যৌনপল্লীতে যায়, তখন প্রায় তার সঙ্গে একজন ধর্ষকের মনের তত্ত্বগত কোনো ফারাক থাকে না। যদিও সে জানে যে পণ্যের জন্য প্রয়োজন ক্রয়ক্ষমতার, এবং, কারও কাছে সেই মূল্য চোকানোর ক্ষমতা যদি না থাকে ও সে যৌনচাহিদার দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত হয় তখন কিছুক্ষত্রে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আবার আর্থিক সংগতি থাকলেও যদি কেউ যৌনকর্মীর কাছে যেতে সামাজিক সম্মানহানির আশঙ্কা করে তখনও অনিয়ন্ত্রিত যৌনলিপ্সার কারণে সে ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। তাই বলাই যায় যে পণ্যায়ন তত্ত্ব এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবুও সমাজের বেশিরভাগ মানুষই যেহেতু ধর্ষক হয়ে উঠছে না, তাই এই তত্ত্বেও কিছু অধরা সত্য থেকেই যাচ্ছে।

ধারণা ৪ (সামাজিক শিক্ষার তত্ত্ব)

মানুষ সমাজ থেকেই আহরণ করে তার আচরণবিধি। একথা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত যে, কোনো বস্তু বা দৃশ্য বা ব্যক্তিকে ক্রমাগত দেখতে থাকলে তার সম্বন্ধে মানুষ ধীরে-ধীরে অনুভূতিপ্রবণ হয় ও আকৃষ্ট হয়। বেশিরভাগ সময়েই সিনেমায় কিংবা ওয়েবসিরিজে ধর্ষণের ঘটনাকে এক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখানো হয়। যেমন – প্রেম-প্রস্তাবের পরে মেয়েরা রাজি না হলে ক্রমাগত তাকে ধাওয়া করা, লেগে থাকা বা জোর করে দখল করার ঘটনাকে পৌরুষের বিষয় হিসাবে দেখানো হয়েই থাকে কিংবা খোলামেলা পোশাক পরিহিত বা ধূমপান-মদ্যপান করা নারীরা যেন অবাধ যৌনমিলনে উৎসাহী হয়, আবার অনেকক্ষেত্রে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে অন্যের নারীকে ভোগ করার অধিকার অর্জনের মধ্যেও যে বীরত্ব আছে সেটাও অহরহ প্রচারিত হয়। এই ধারণার সঙ্গে প্রজ্ঞাপিত হয়েছে যে প্রত্যেক নারীই মনে-মনে এই ধাওয়া করা বা জোরপূর্বক দখল করার মানসিকতাকে বিশেষ পছন্দ করে থাকে, কিংবা সে চায় যেন বহুপুরুষ তার জন্য লড়াই করে ও বহুপুরুষের দ্বারা একত্রে যৌনাচারের প্রতি নারীদের বিশেষ টান থাকে অথবা যৌনতার সময় অত্যাচার(যেমন- কামড়া-কামড়ি, পায়ুমিলন, আঘাত করা ইত্যাদি) নারীকে বিশেষ আনন্দ দেয়। ফলে পর্ণোগ্রাফি বা সফট-পর্ণগ্রাফিক চলচ্চিত্রে দেখানো আগ্রাসনের দৃশ্যগুলির দ্বারা বহুজনের(এমনকি কিছুক্ষেত্রে নারীরও) মানসিকতায় নারীর যৌনতা সম্বন্ধে এক অন্য ধারণা(ফলে তারাও সবসময় প্রতিবাদ করে না, টোন-টিটকারিকে উপেক্ষা করে যায়) বদ্ধমূল হয় যা বেশিরভাগ সময়েই ভবিষ্যতে প্রতিফলন হয় ধর্ষণের ঘটনায়। পক্ষান্তরে সিরিয়ালে বহু নারীর সঙ্গে পুরুষের সম্পর্কগুলির উপস্থাপনও পুরুষকে নৈতিক সমর্থন জানায় যে, পুরুষের ক্ষেত্রে এইসব বিষয়গুলি মামুলি, প্রায়ই হয়ে থাকে। ফলে পুরুষের অবচেতনে সামাজিকভাবে ভুল বার্তা রোপন করে তাকে ধর্ষণপ্রবণ করে গড়ে তোলা হয়। আবার উল্টোদিকে এও তো সত্য যে, সমাজে অনেক নীতিকথামূলক কিংবা সুশিক্ষার উপাদানও আছে। সেগুলি কেন ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে না – এই প্রশ্নও জরুরি। তাই শুধু একপ্রকারের শিক্ষাকে দিয়েই সামগ্রীকতাকে বিচার করা বোধহয় সঠিক নয়।     

ধারণা ৫ (জনসংখ্যাগত তত্ত্ব)      

পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই যদিও পুরুষ প্রতি মহিলা সংখ্যার ধারণা প্রদর্শিত হয়, কিন্তু ভারতে মহিলা প্রতি পুরুষকেই বিচার করা হয়। ২০১১সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতে ৯৪০ জন মহিলা প্রতি ১০০০জন পুরুষের তথ্য পাওয়া যায়। সুতরাং, প্রায় ৬০জন পুরুষ নারীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত, যদি একজন নারীর সঙ্গে একজনই মাত্র পুরুষের সম্পর্ককে স্বীকার্য ধরে নেওয়া হয়। ফলে ১৩৫কোটির দেশে নারীসঙ্গহীন পুরুষের সংখ্যাটা নিতান্ত কম নয়। এইসব নারীসঙ্গহীন পুরুষের শারীরিক চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে হয় গণিকাপল্লী, পর্ণোগ্রাফি নয়তো অবদমন প্রধানতম ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে যদি বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যায় তবে সেখানে বিস্মিত হওয়ার বিশেষ কিছু থাকে না। কিন্তু অন্যদিকে এও তো সত্য যে অপরিচিতের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনার থেকে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে পরিচিত কিংবা পারিবারিক সম্পর্কগুলির দ্বারা। আবার যে-সব দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাধীক্য আছে সেখানেও ধর্ষণমুক্ত সমাজ গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে কেউ কেউ সমাজের দরিদ্র ও নিচু অংশের দিকে, অর্থাৎ খালাসি, ট্রাকচালক বা অন্যান্য শ্রেণির মানুষ, আঙুল তুলে থাকেন ও বলেন যে এই শ্রেণির মধ্যে থাকা অশিক্ষা, দারিদ্র ও নারীসঙ্গহীনতার জন্য ধর্ষণ বেশি ঘটে। কিন্তু এই তত্ত্ব সর্বৈব ভুল। কেননা এমন বহু ঘটনা আছে, বরং এটাই বেশি হয়তো, যেখানে ধনী, শিক্ষিত ও নারীসঙ্গে বঞ্চিত নয় এমন মানুষের দ্বারা ধর্ষণ ঘটে থাকে। আর তাইই বহুজনের প্রদত্ত জনসংখ্যাগত তত্ত্বের সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনাকে চট করে মিলিয়ে দেওয়া যায় না। 

ধারণা ৬ (বিবর্তনবাদের তত্ত্ব)

ডারউইনের বিবর্তনবাদ পৃথিবীর ইতিহাসে এক অমোঘ পথনির্দেশ। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস’-এর নামকরণে উপশিরোনাম হিসাবেই লেখা হয়েছে মূল কথাটি। তিনি প্রজাতির উদ্ভবের অন্তরালে রেখেছেন এক অসামান্য তত্ত্ব, ‘বাই মিনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন অর দ্য প্রিজারভেশন অফ ফেভারড রেসেস ইন দ্য স্ট্রাগল ফর লাইফ’। একইসঙ্গে তিনি সংযুক্ত করেছেন ‘অভিযোজনবাদ’-এর ধারণাকে যা প্রাকৃতিক নির্বাচন ও জীবনে টিকে থাকার সংঘর্ষের আয়ুধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর কোটি-কোটি প্রজাতির মধ্যে মানুষও একজন। ফলে সামগ্রিক চৈতন্য থেকে সে একেবারে আলাদা হয়ে যেতে পারে না। অন্যান্য শ্রেণির প্রাণী অর্থাৎ অন্যান্য স্তন্যপায়ী, পাখি, পতঙ্গ, মাছ প্রভৃতি প্রাণীদের মধ্যে ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ চরিত্র কী প্রকারের তা বিচার করলেই মানুষের মধ্যে যাকে ‘ধর্ষণ’ নামে অভিহিত করা হয় তার প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যাবে, বোঝা যাবে জীবনে টিকে থাকার সংঘর্ষে প্রাকৃতিক নির্বাচনে ‘জোরপূর্বক যৌনমিলনে’ মানুষ কতটা স্বীকৃত। প্রথমে ধরা যাক, আর্থোপোডা শ্রেণিভুক্ত প্রাণী ওয়াটার স্ট্রাইডারের কথা। এদের মধ্যে যৌনমিলনের জন্য স্ত্রীলিঙ্গের প্রতি বলপ্রয়োগ করতে দেখা যায়। পুংলিঙ্গ পতঙ্গটি স্ত্রীলিঙ্গ পতঙ্গটিকে জোর করে আটকে রেখে জলের মধ্যে পদচালনার মাধ্যমে তরঙ্গ সৃষ্টি করতে থাকে, যাতে মাছের মত প্রাণীরা আকৃষ্ট হয়। ফলত স্ত্রীলিঙ্গের কাছে থেকে যায় দুটি উপায় – এক, মাছের খাদ্য হওয়া; দুই, পুংলিঙ্গের কাছে আত্মসমর্পন করা। স্ত্রীলিঙ্গের কাছে নির্বাচন স্পষ্ট, সে বেঁচে থাকতেই পছন্দ করবে। এছাড়াও বহু অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে, যেমন – ছারপোকা, মাকড়সা ইত্যাদি, ট্রমাটিক ইনসেমিনেশনের ঘটনা দেখা যায়। ট্রমাটিক ইনসেমিনেশন হল শরীরে ক্ষত করে শুক্রাণুর প্রবেশ ঘটানো। এর লাভ দুটো- এক, যেহেতু অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে মুক্ত-সংবহনতন্ত্র বর্তমান, ফলে শরীরে যেভাবেই শুক্রাণু প্রবেশ করুক তা সঠিক জায়গায় পৌঁছে যায়; দুই, শরীরের ক্ষত দেখে অন্যান্য পুরুষ প্রাণীরা আকৃষ্টও হয় না আর। অন্যদিকে পাখিদের মধ্যেও ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ দৃষ্টান্ত কম নেই। একধরণের দলবদ্ধভাবে থাকা মাছরাঙাদের মধ্যে দেখা যায় যে, স্ত্রী-পাখি যদি একা কোথাও যায় তবে অন্য পুরুষ পাখিরা আক্রমণ করে। কিংবা ম্যালার্ড হাঁসের ক্ষেত্রে দম্পতি হাঁসের স্ত্রীটি গর্ভবতী হলে পুরুষদলের আক্রমণ দেখা যায় অন্য সঙ্গীহীন বা দুর্বল সঙ্গীযুক্ত স্ত্রী-হাঁসের ওপরে। ভোঁদড়ের ক্ষেত্রেও একইরকম অত্যাচারের ঘটনা দেখা যায়। আবার মানুষের সঙ্গে একই বর্গভুক্ত প্রাণী ওরাংওটাং বা শিম্পাঞ্জীদের মধ্যে ‘জোরপূর্বক যৌনমিলনের’ ঘটনাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। ডলফিনের মধ্যেও এই ধরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং, মানুষের মধ্যেও ‘জোরপূর্বক যৌনমিলনের’ প্রবৃত্তি থাকা প্রাকৃতিকভাবে অসম্ভব কিছু নয়। নারীশরীর ও পুরুষশরীরের মধ্যে আছে বিশেষ পার্থক্য – অনেক মানসিক পার্থক্যও আছে। এই ফারাককে তিনটে প্রেক্ষিতে বিচার করা সম্ভব – এক, যৌন নির্বাচন; দুই, জীবনসত্তার সংঘর্ষ ও তিন, যৌন চাহিদার স্তর। ফলে পুরুষের সঙ্গে নারীর যে পার্থক্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল, 

  • পুরুষরা নারীদের থেকে আকৃতিতে বড়সড় হয়।
  • নারীদের থেকে পুরুষদের জন্মহার বেশি হয়।
  • পুরুষদের জীবনকাল নারীদের থেকে কম হয় (আন্ডার ফাইভ মর্টালিটি নারীদের বেশি হলেও প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় মর্টালিটিতে নারীরা বেশিদিন বাঁচে ও নারীদের শারীরিক ত্রুটি অনেক কম হয়)।
  • পুরুষরা অনেক বেশি হিংসাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজকর্মের প্রতি আগ্রহ অনুভব করে।
  • নারীদের থেকে পুরুষরা বেশি আক্রমণাত্মক হয়।
  • পুরুষদের যৌনসঙ্গী নির্বাচনে বাছবিচার নারীদের তুলনায় অনেকাংশে কম হয়। 
  • পুরুষদের মধ্যে স্বমেহনের পরিমাণ নারীর থেকে বেশি।  

এইসব ঘটনার ব্যাখ্যা হিসাবে বলা যায় যে, যেহেতু একজন পুরুষের শুক্রাণু উৎপাদনক্ষমতা(সেকেন্ডে প্রায় ১৫০০টি করে প্রায় ৬০বছর বয়স অব্দি) নারীদের ডিম্বাণু উৎপাদনের(২৮দিনে একটি করে প্রায় ৪৫বছর বয়স অব্দি) চেয়ে অনেক অনেক বেশি তাই পুরুষ যতটা বহুনারীসঙ্গের প্রতি উৎসাহী হয় নারীরা ততটা বহুপুরুষগামীতা দেখায় না। কেননা জিনের ধর্মই হচ্ছে নিজেকে যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব রেপ্লিকেট করা। আবার একজন পুরুষের সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রযুক্ত বল ও সময়(১৫মিনিট মতন) নিতান্তই মামুলি এবং সেখানে উপভোগ ছাড়া প্রায় আর কিছুই থাকে না। পক্ষান্তরে নারীদের ক্ষেত্রে সন্তান উৎপাদনের ঝুঁকি অনেক তীব্র ও সময়সাপেক্ষ(৯মাস প্রায়)। এরপরে থেকে যায় সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব ও পরবর্তী সন্তান জন্ম দেওয়ার শারীরিক প্রস্তুতি। ফলে পুরুষ প্রাকৃতিকভাবে যেখানে লাভ করে বাছবিচারহীন বহুগামীতার উত্তরাধিকার, সেখানে নারীর থাকে একজন যোগ্য পুরুষকে নির্বাচনের আকাঙ্খা যে তাকে সামাজিক সুরক্ষা দেবে ও তার প্রতি সৎ থেকে সন্তানের প্রতি কর্তব্য পালন করবে। তাইই যেখানে নারী কর্তৃক পুরুষ বাধাপ্রাপ্ত হয় সেখানেই পুরুষ ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ পথ বেছে নেয় সহজেই। কিন্তু ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ ফলে যেসব প্রাণীর ক্ষেত্রে অস্তিত্ব সংকটের সম্ভবনা দেখা দিয়েছে সেখানে আবার প্রকৃতিই নারীকে দিয়েছে বিশেষ প্রতিহত ক্ষমতা। যেমন – ম্যালার্ড হাঁসের ক্ষেত্রে অভিযোজনের প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে ‘কর্ক-স্ক্রু’ যৌনতন্ত্র কিংবা অলীক গহ্বর যা ওভারিতে পৌঁছয় না। ডাঁশমাছির ক্ষেত্রে আছে ৮০টির মত গ্ল্যান্ড প্রোটিন যা তার জীবনকাল কমিয়ে দেয় বা যৌন উত্তেজনাকে হ্রাস করে দেয়। মৌমাছি বা কাঠবেড়ালিতে দেখা যায় মেটিং প্লাগ যা সেমিনাল ফ্লুইডের দ্বারা যৌনদ্বার বেশ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে এইরকম কিছু দেখা যায় না। এখন যদি মানুষের মধ্যে বিবর্তবাদ অনুযায়ী অভিযোজনগতভাবেই ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ ঘটনাকে মান্যতা দেওয়া হয়, তবে বিশেষ কিছু সীমাবদ্ধতাও প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে,

  • যদি ধরে নেওয়া যায় যে পুরুষরা যেহেতু কম দিন বাঁচে ফলে সে বেশি সন্তান উৎপাদন করে যেতে চায় তার জীবনকালে, সেক্ষেত্রেও ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ ফলে সন্তান জন্মের সম্ভবনা নিতান্তই ক্ষীণ। তাছাড়া যদি সন্তানসম্ভবা হয়ও নারীটি সেই সন্তানের বেঁচে থাকার প্রশ্নটিও উপেক্ষা করা যায় না। অন্যদিকে মানুষের টিকে থাকার জন্য ‘জোরপূর্বক যৌনমিলন’ বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া নয়।
  • নারীটির যদি যৌনরোগ থাকে বা আক্রমণাত্মক হয় তাহলেও পুরুষের পক্ষে সুস্থ জীবনকাল কমে যাওয়ার সম্ভবনা থেকেই যায়। ফলে পুরুষের পক্ষে এই অভিযোজনে ঝুঁকি অনেক বেশি। 
  • পক্ষান্তরে সমাজে বিবাহজনিত ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ ঘটনাই যথেষ্ট বেশি ও অচেনা লোকের চেয়ে পরিচিত এবং পারিবারিক পুরুষের দ্বারাই ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগ’ বেশি ঘটে। তাই বলা যায় না সব পুরুষ মহিলা দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। 
  • ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ বিবর্তনবাদের তত্ত্ব শিশু(পুরুষ ও নারী উভয়ই) ও বৃদ্ধাদের মধ্যে ঘটা ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে অপারগ। যুদ্ধকালীন ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ ঘটনার ক্ষেত্রেও এই তত্ত্ব খাটে না। 
  • আবার অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে যাকে মানুষ ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগ’ বলে ব্যাখ্যা করে ধর্ষণকে বিচার করার কথা ভাবছে, সেক্ষেত্রে কি ওইসব প্রাণীদের যৌন-অভিব্যক্তির প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষ সম্পূর্ণ অবহিত হতে পেরেছে? হতেই তো পারে মানুষের সংস্কৃতি যেটাকে ধর্ষণ বলছে সেটাই সেইসব প্রাণীদের স্বাভাবিক সম্মতি প্রদর্শনের প্রক্রিয়া। 
  • বিবর্তনবাদ তত্ত্ব যেখানে পুরুষকে বাছবিচারহীন ও নারীকে নির্বাচনপ্রবণ বলছে তার ব্যতীক্রম নিতান্ত কম নেই। ধরে নেওয়া যাক ল্যাঙ্গারের(একপ্রকার বাঁদর) কথা। সেখানে দেখা গিয়েছে যে স্ত্রী-বাঁদরটি বহু পুরুষের সঙ্গ করে। কেননা দলগত অবস্থানের জন্য দলপতির রকমফেরে স্ত্রী-বাঁদররা সন্তানের স্বার্থে নির্বাচনপ্রবণ হতে পারে না। আবার ল্যাঙ্গার ছাড়াও অনেক বাঁদর আছে যেখানে স্ত্রী-বাঁদরাই উদ্যোগী হয়ে পুরুষকে উত্তেজিত করতে থাকে যৌনমিলনের জন্য। পুরুষরা সেখানে নির্বাচনপ্রবণ হয়। শিম্পাঞ্জীর ক্ষেত্রেও স্ত্রীরা দলের প্রায় প্রত্যেক পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে বহুগামীতার প্রমাণ দেয়। পক্ষান্তরে বহু প্রাণীর মধ্যে নারীদের ক্ষেত্রে স্বমেহনের সংখ্যায় প্রাচুর্যও দেখা যায়।

তাই একথা মেনে নিতেই হবে যে, ধর্ষণের পেছনে বিবর্তনবাদের ধারণাকে প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণ করা অসম্ভব।  

ধর্ষণ কেন অপরাধ?

“ধর্ষণ কেন অপরাধ”- এই শব্দবন্ধের ব্যঞ্জনা ততটা সহজ নয় যতটা প্রতিভাত। একথা সত্য যে, প্রায় সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই অপরাধমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার ব্যাপারে একমত ও পক্ষপাতী। কিন্তু একইসঙ্গে একথাও মেনে নিতে হবে যে শত-সহস্র আন্তরিক প্রচেষ্টার পরেও সেই স্বপ্ন সফল হওয়া অসম্ভব বলে বর্তমানে প্রতিভাত। যেন মানুষের পক্ষে শুধু ধর্ষণ কেন, অন্য যে-কোনো প্রকারের অপরাধকেই সমূলে উৎখাত করা না-মুমকিন। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় পুরাণকথার আদম ও ইভের গল্পটি। ঈশ্বর তাঁর লাগু করা নিয়মের ব্যত্যয় দেখেই বেহেশত থেকে নির্বাসনের শাস্তি শুনিয়েছিলেন আদম ও ইভকে। আদম ও ইভ সেই হিসাবে দুনিয়ার প্রথম অপরাধী। দুজনে জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে যেমন একটি ঈশ্বরসৃষ্ট আইনের লঙ্ঘন করেছিলেন, তেমনই তাঁরা মিলিত হয়েছিলেন মানবপ্রজাতি সৃষ্টির সম্ভোগক্রীড়ায়। তাহলে তো বলাই যায় যে, মানুষ হল ঈশ্বর-নির্দিষ্ট যৌনতাবিধি অবমাননাজনিত অপরাধের সন্তান। সুতরাং মানুষের মধ্যে যে অপরাধ মনোপ্রবৃত্তি ধমনীতে বহমান থাকবেই তা অনস্বীকার্য। তবে অপরাধপ্রবণতাকে হ্রাস করা অবশ্যই যায়। আর তাইই এক্ষেত্রে ভাবতে হবে যে, কেবলমাত্র ধর্ষণ বা ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগ’ কি আদৌ অপরাধ নাকি তার সঙ্গে যুক্ত নৃশংসতা, শারীরিক-মানসিক ক্ষতি ও পারিবারিক-সামাজিক অবস্থানের মাত্রাবনমনের ঘটনাগুলি একে অপরাধের তকমা দিয়েছে? কেননা সমস্ত ধর্ষণের জন্য একইপ্রকারের প্রতিবাদ বা তর্ক তো সমাজে দেখা যায় না। যেখানে নারকীয়তা বেশি সেগুলির জন্য ‘মোমবাতি মিছিল’ বের হয়, অন্যগুলো কোণঠাসা হয়ে থেকে যায়। তাই যদি ধরে নেওয়া যায় যে, কোনো একটি অসম্মত যৌনমিলনের ঘটনায় নৃশংসতা, শারীরিক-মানসিক ক্ষতি, পারিবারিক-সামাজিক অবস্থানের মাত্রাবনমন ও পরবর্তীতে বিবাহের ব্যাপারে সমস্যা ইত্যাদি কিছুই হল না, অথচ সকলেই ঘটনাটির কথা জানতে পারল, সেখানেও কি ধর্ষণকে সঙ্গীন অপরাধ বলা যাবে? সুতরাং, এইসব প্রেক্ষিতগুলি সম্পর্কে আরও একবার গভীর অনুসন্ধান করা জরুরি।

   

অপরাধের কোনো দেশ-কাল নিরপেক্ষ সার্বিক সংজ্ঞা নেই। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রশাসকের মতাদর্শের ভিত্তিতে নাগরিকবিধি নির্দিষ্ট করা হয়। সময়ে সময়ে সেগুলির পুনর্মার্জনও হয়ে থাকে। মানুষের মৌলিক অধিকার ছাড়াও সেই নাগরিকবিধি বা আইন গোষ্ঠী, সমাজ ও ব্যক্তিকে জীবনযাপনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রদান করে। যদি কারও দ্বারা সেই বিধির প্রতিপালন না করা হয় ও অন্তিমে তা রাষ্ট্রপ্রদত্ত গোষ্ঠী, সমাজ ও ব্যক্তির অধিকারগুলিকে আহত করে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তবে সেই ব্যক্তিকে রাষ্ট্র অপরাধী হিসাবে শনাক্ত করে ও শাস্তির বিধান দেয়। কিছু কিছু ঘটনা আছে যা দেশ-কাল-সংস্কৃতি নিরপেক্ষভাবে সর্বত্রই অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়, যেমন – হত্যা, ধর্ষণ এবং চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি। ধর্ষণকে চিরকাল সব দেশেই অপরাধ বলে মেনে নেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু, হত্যা, আক্রমণ কিংবা চুরি-ডাকাতি যেমন বিনা-বিতর্কে অপরাধ হিসাবে মান্যতা পায়, ধর্ষণকে সরাসরি কি সেই মর্যাদা দেওয়া যায়? যায় না। আর তার প্রধান কারণ হল, রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্ষণের জন্য নির্ধারিত সংজ্ঞাটি। ব্রিটানিকার মতে,    

“Rape, unlawful sexual activity, most often involving sexual intercourse, against the will of the victim through force or the threat of force or with an individual who is incapable of giving legal consent because of minor status, mental illness, mental deficiency, intoxication, unconsciousness, or deception. In many jurisdictions, the crime of rape has been subsumed under that of sexual assault.”

অর্থাৎ, সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনমিলনকে ধর্ষণ বলা হয় যা যৌন “নিপীড়নজনিত” একটি অপরাধের অন্তর্গত, যেখানে কিছু সময়ে বলপ্রয়োগ থাকতেও পারে আবার নাও পারে। কিন্তু “নিপীড়ন” যদি এমন হয় যেখানে শারীরিক-মানসিক ক্ষতি হল না(পরিচিত বা প্রণয়ী কিংবা পারিবারিক কারও দ্বারা যদি ঘটে ঘটনাটি এবং নিপীড়িতাও যৌনমিলনে অনভিজ্ঞ না হয়) ও নিপীড়িতা কোনো কারণে অসম্মত(সম্পূর্ণ বা আংশিক) হয়েই আত্মসমর্পনে বাধ্য হলেন, সেক্ষেত্রে ঘটনাটিকে কতখানি অপরাধ বলা যাবে? যে-কারণে WHO-এর একটি তথ্যে দেখা গিয়েছে যে, যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় “Have you ever been forced to have sexual intercourse against your will?” তার যা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে, তার চেয়ে অনেক কম প্রতিক্রিয়া মিলেছে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছে, “Have you ever been abused or raped?” প্রশ্নটি। সুতরাং, একথা স্পষ্ট যে, একপক্ষের সম্মতিই যেখানে যৌনমিলনের মত স্বর্গীয় সুন্দর অভিব্যাক্তিকে ধর্ষণের মত নারকীয় অভিজ্ঞতার পরিণতি দিতে সক্ষম, সেখানে, এক, কোনটা মিথ্যা(সম্পূর্ণ বা আংশিক) অভিযোগ আর কোনটা সত্যি ধর্ষণ ও দুই, শারীরিক-মানসিক ক্ষয়ক্ষতিহীন অসম্মত যৌনমিলন ও শারীরিক-মানসিক ক্ষয়ক্ষতিযুক্ত অসম্মত যৌনমিলন – এর মধ্যে অপরাধের তফাৎ করা যাবে কী উপায়ে? বোধহয় এই কারণেই ম্যাথিউ হেল বলেছিলেন, ‘ধর্ষণ হল এমন একটি বিষয় যার অভিযোগ করা খুবই সহজ কিন্তু প্রমাণ করা ভীষণ কঠিন”। তাই রাষ্ট্রও ধর্ষণকে অপরাধ হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োগ করেছে অমোঘ অস্ত্র – নির্যাতিতার গোপন অঙ্গে ক্ষতচিহ্নের পরিমাণ বা পুরুষের বীর্যের উপস্থিতি ও অভিযুক্তের শরীরে প্রতিরোধের দরুন থাকা চিহ্নগুলি। ফলে এমন একটি যৌনমিলন যেখানে অভিযুক্তের কাছে ছিল এমন কোনো হাতিয়ার যার দ্বারা সে প্রাণহানির ভয় দেখিয়েছিল কিংবা ব্ল্যাকমেল করেছিল, কিংবা পরিচিত কারও দ্বারা সম্মতিব্যতীত যৌনমিলন হয়েছিল, যেখানে প্রায়ই ক্ষতচিহ্ন কিছুই না থাকার সম্ভবনা বেশি – সে-সব ক্ষেত্রে ধর্ষণকে অপরাধ বলে স্বীকার করতে রাষ্ট্রও অবশ্যই যেন দ্বিধান্বিত। আবার যদি যৌনমিলন না হয়ে পায়ুমিলন(পুরুষ কর্তৃক পুরুষের ধর্ষণে প্রায়ই ঘটে) বা অন্যকিছু(পুরুষের সম্মতিব্যতীত নারীর দ্বারা নিগ্রহের ঘটনা) ঘটে থাকে সেটা কি ধর্ষণের আওতার বাইরে(সম্প্রতি লোকেশ পাওয়ারের ঘটনা স্মরণ করা যায়) থাকবে – এইরকম হাজার-হাজার নজিরের কারণে ঠিক কোন্‌ ঘটনাকে বিনা-বিতর্কে ধর্ষণ বলে নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়, আর কোথায় ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ তত্ত্বকে মান্যতা দিতে হয়, এক জটিল বিতর্কের জন্ম দেয় বইকি। 

আবার সেক্ষেত্রে সমাজে ঘটে চলা ধর্ষণ কিংবা ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ আড়ালে যে-কটি কারণের কথা আলোচনা করা হয়েছে তার মধ্যে প্রথমটি অর্থাৎ মনোবিকার তত্ত্বটি হল ব্যাধিজনিত দুর্ঘটনা, নারীবাদী ও সামাজিক শিক্ষার তত্ত্ব হল সমাজ-সংস্কৃতিগত প্ররোচনা, পণ্যায়ণ তত্ত্ব হল মানুষের যাপনচিত্রে বাজার-অর্থনীতির অনুপ্রবেশ, জনসংখ্যাগত তত্ত্বটি হল সমাজ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত ও অন্তিমটি অর্থাৎ বিবর্তনবাদ তত্ত্বটি হল প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ। প্রথম পাঁচটি কারণকে প্রক্সিমেট ও অন্তিমটিকে আলটিমেট কারণ বলা যেতে পারে। এর বাইরেও নানা তত্ত্ব থাকতেই পারে। কিন্তু যে মূল প্রশ্ন প্রদত্ত তত্ত্বগুলি থেকেও ক্রমাগত আত্মপ্রকাশ করছে তা হল, ধর্ষণ বা ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগ’ তাহলে ব্যক্তিমানুষের অপরাধ হবে কেন? কেননা একদিকে যে-সংস্কৃতি এবং সমাজ-রাজনৈতিক অবস্থা মানুষই তৈরি করেছে ও যার কুফল হিসাবে ধর্ষণ বা ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগ’ সমাজে আত্মপ্রকাশ করেছে, সেখানে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তন না করে কেবলমাত্র কোনো ব্যক্তিমানুষকে অপরাধী বলে কীভাবে দাগিয়ে দেওয়া যায়? আবার পক্ষান্তরে যদি অভিযোজনগত কারণেই ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ ঘটনা ঘটে, যেখানে পুরুষের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে থাকা বহুগামীতাকে রাষ্ট্রই আইন করে বন্ধ করেছে, তখন সেখানে যদি কোনো পুরুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে তাহলে কোনটাকে অপরাধ বলা হবে – প্রাকৃতিক স্বভাবে ও মানুষের সঙ্গী নির্বাচনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে নাকি হস্তক্ষেপের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হওয়া ধর্ষণকে? আরও প্রশ্ন ওঠে যে, ধর্ষণ বা ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ ফলে যদি নির্যাতিতার সামাজিক সম্মানিহানি কিংবা পরবর্তীতে বিবাহ করে সুখী হওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক সমস্যাগুলি না থাকত, তাহলেও কি রাষ্ট্র ধর্ষণকে অপরাধ হিসাবে ততটা গুরুত্ব দিত এখন যতটা দেওয়া হয়, নাকি, সেক্ষেত্রে ধর্ষণ নয় কেবলমাত্র শারীরিক অত্যাচারের জন্য অভিযুক্তকে নির্দিষ্ট করা হত(যা প্রতিশোধস্পৃহার দরুন কিংবা চুরি-ডাকাতির দরুন বা গৃহস্থালি কারণে আক্রমণের অন্তর্গত আরেকটি উপভাগ হিসাবে বিচার্য হত)। কিন্তু এতগুলি তর্কের পরেও একথা তো ঠিক যে, ধর্ষণ যে অপরাধ সেটা স্বীকার করতেই মানুষের মন সিদ্ধান্ত শোনায়। তাই ধর্ষণ কেন অপরাধ, এবার সেই নিয়েই দুটি কথা আলোচনা করা যাক।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, সম্মতি-বলপ্রয়োগ-প্রতিরোধ এই ত্রয়ীর বাইরে থেকে গিয়েছে এক সুবিশাল প্রশ্নাতীত ক্ষেত্র যা ধর্ষণকে অপরাধ হিসাবে শনাক্ত করতে পারে। ধর্ষণের ফলে  স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত সমস্যা, প্রজনন ব্যাধি, অন্যান্য যৌনরোগ, বন্ধ্যাত্ব, গর্ভাবস্থার জটিলতা, গর্ভপাত, যৌন অক্ষমতা, মৃত্যু, আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া, দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ব্যথা, সাইকোসোমেটিক ডিসঅর্ডার, অবাঞ্ছিত গর্ভাবস্থা ও সামাজিক সম্মানহানি ছাড়াও ঘটে একটি মারাত্মক ঘটনা। তা হল একজন মানুষের আত্মার হত্যা। ধর্ষণ বা ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ সময়ে নারীর দেহটি থেকে নারীর সত্তা পৃথক হয়ে যায়। যে-কারণে ধর্ষণ, ভালোবাসা ও অসম্মত যৌনতার মধ্যে বাস্তবিক কিছু পার্থক্য অবশ্যই থেকে যায়। রবিন ওয়েস্ট লিখেছেন, 

“”[t]here is a fine line between the feeling of being threatened by an implied threat of force and the feeling of the sheer inevitability of sex. Nevertheless they are … distinctly different experiences.”

এই ‘ফাইন লাইনটি’কেই অপরাধের আধার হিসাবে ধরতে হবে। বাকিগুলি নিয়ে বিচার করলে ধর্ষণ কিংবা জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগকে কিছুতেই অপরাধ হিসাবে নির্দিষ্ট করা যাবে না। ধর্ষণ(যার আদি অর্থ ‘জোর করে কেড়ে নেওয়া’) ব্যক্তিকে তার সত্তা থেকে আলাদা করে তার অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ জানায়, কেড়ে নেয় তার যৌনসঙ্গী নির্বাচনের অধিকারটিও। কিন্তু ভালোবাসাতে ঠিক এর উল্টোটা হয়, ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব পূর্ণতা লাভ করে। পক্ষান্তরে অসম্মত যৌনমিলন অবস্থান করে ঠিক মাঝামাঝি – সেটি আংশিকভাবে ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব স্বীকার করে। তাই যেখানে পরিচিত, বন্ধু বা প্রণয়ী কিংবা অপরিচিত যে-কারও দ্বারাই কোনো ব্যক্তিমানুষের সত্তাটিকেই আক্রান্ত করা হয় একমাত্র সেটিকেই ধর্ষণ হিসাবে ধরতে হবে ও তাকে নির্দ্বিধায় অপরাধের (আর অন্যগুলিকে এমনভাবে বিচার করতে হবে যাতে অন্তত কারও প্রতি অবিচার না করা হয়) তকমা দিতে হবে। কেননা একজন মানুষের কাছ থেকে তার সত্তাকে কেড়ে নেওয়ার অর্থ মানুষটিকে ভিতরে ভিতরে মানসিকভাবে হত্যা করা। শারীরিক-মানসিক ক্ষয়ক্ষতি কিংবা সামাজিক সম্মানহানি কিংবা পরবর্তী জীবনে বিবাহে সমস্যার সম্ভবনা ইত্যাদি প্রেক্ষিতগুলি না থাকলেও এটিকে সেজন্য গুরুতর অপরাধ হিসাবেই দেখতে হবে। তাই যেখানে ওসব কিছুই ঘটছে না, সেখানেও নির্যাতিতার প্রতি রাষ্ট্রকে সংবেদনশীল হতে হবে। রাষ্ট্রকে বিশেষ ব্যবস্থার দ্বারা ধর্ষিতার মনের মধ্যে চলা পরিবর্তন ও প্রভাবগুলিকে সূক্ষভাবে আবিষ্কার করতে হবে। যে-কারণে আজকাল অনেক দেশেই বিবাহজনিত ধর্ষণকে শাস্তির আওয়াধীন করা হচ্ছে(যদিও সেখানে অভিযোগকারিনীর উদ্দেশ্যর দিকটিও উপেক্ষা করার মত নয়, সেটা ভুললেও চলবে না। ধর্ষণের অভিযোগ যেন অসৎ নারীর হাতে অস্ত্রে পরিণত না হয় সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে)। 

এছাড়াও মনে রাখতে হবে যে, সমাজ-সংস্কৃতিগত কারণে কিন্তু সমাজের বৃহদংশ ধর্ষক হয়ে যাচ্ছে না। একইসঙ্গে বিবর্তনবাদের ধারণাকে (বিবর্তনবাদ তো নারীকে নির্বাচনের অধিকারও দিয়েছে, সভ্য পুরুষ যদি সেই অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করে তবে তা অবশ্যই স্বভাবিক নয়, প্রকৃতিকেও অস্বীকার করা হয় সেখানে) মান্যতা দিলেও একথা অনস্বীকার্য যে, অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে যে জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিলে যেখানে সবিশেষ ক্ষতি হয় না, সেখানে মানুষের মত উন্নত ও সভ্য প্রাণীর ক্ষেত্রে এইসব আদিম প্রবৃত্তির টিকে থাকা মোটেই সমাজের পক্ষে শুভ নয়। তাই মানুষের ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই ধর্ষণ, যাকে একটি গুরুতর অপরাধ বলে স্বীকার করতেই হবে। কেননা, সাংস্কৃতিক প্রভাবের পরেও সমাজের বৃহদংশ যেখানে সংযত ও বিবর্তনবাদ থাকা সত্ত্বেও মানুষ যেখানে বহু আদিম প্রবৃত্তির ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছে সেখানে ধর্ষণের ঘটনাও মানুষ ইচ্ছা করলেই প্রতিহত করতে পারে – এটাই সত্য। কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজের দায়ও কিছু কম নয়, কেবলমাত্র ব্যক্তিমানুষকেই এখানে অপরাধী বলে ঠাউরানো যায় না। ধর্ষণ নামক অপরাধটির সঙ্গে তাই প্রত্যেকবার ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। আর তাইই ফিরে যেতে হবে গান্ধীজির অমোঘ বাক্যে, তিনি বলেছিলেন যে,  

“In independence India of the non-violent type, there will be crime but no criminals. They will not be punished. Crime is a disease like any other malady and is a product of the prevalent social system. Therefore, all crime including murder will be treated as a disease… All criminals should be treated as patients and the jails should be hospitals admitting this class of patients for treatment and cure. The prisoners should feel that the officials are their friends. They are there to help them regain their mental health and not to harass them in any way. ”  

গান্ধীজির এই অপরাধতত্ত্বকে মেনে নিলে বলতে হবে যে, অপরাধ ঘৃণার ঘটনা হলেও অপরাধী নয়। তাই কেবল অপরাধীকে কঠোরতম শাস্তির বিধান দিয়ে অপরাধকে থামানো যাবে না, অপরাধের কারণগুলিরও অবসান ঘটাতে হবে। যেখানে ধর্ষণের মতো একটি সামাজ-রাজনৈতিক-আর্থনীতিক-সাংস্কৃতিক-প্রাকৃতিক স্বরে ক্রিয়াশীল জটিল বিষয় সংশ্লিষ্ট তাকে রোধ করতে গেলে প্রয়োজন আরও ভিন্নতর প্রক্রিয়া। রাষ্ট্রকে তাই অপরাধীর প্রতি প্রচলিত শাস্তির পরিবর্তে এমন কিছু ভাবতে হবে যা অল্পবয়সেই মানুষের মন থেকে ধর্ষণ নামক অপরাধ প্রবণতাকে দূর করবে ও সমাজের মধ্যে এমন বার্তা দেবে যা আগামিদিনের এই অপরাধমনস্কতাকে প্রতিরোধ করবে।  

ধর্ষণ প্রতিহত করার সম্ভাব্য উপায় কী?

ধর্ষণ একটি আদিমতম ঘটনা। অন্যান্য বহু সমস্যার মতোই মানবসমাজে দীর্ঘদিন ধরে এটি থেকে গিয়েছে। আজও মানুষ এমন কোনো ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারেনি যা ধর্ষণকে নির্মূল করতে পারে। মানুষ কেবলই তত্ত্বকথা কিংবা নানান শিষ্টাচারের বিধি আরোপ করে একে এড়িয়ে গিয়েছে। এভাবে বালিতে মুখ গুঁজে থাকা তো সমাধান হতে পারে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টি নিরসনের উপায় ভাবা জরুরি। সেই আলোচনায় যাবার আগে একটা অন্য গল্পে যাওয়া যাক, কিংবা বলা যাক গল্প নয় একটি ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার কথা। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, 

“১৯১৭সালে বিপ্লব হলো – আর ১৯৪১-এ সোভিয়েত যুবকরা নিউ ইয়র্ক আর টরেন্টোর রাজপথে পা দিয়ে প্রথম দেখতে পেল গণিকা বলে জিনিসটা আসলে কীরকম! গত তিন হাজার বছর ধরে সভ্য দুনিয়ায় যে কদর্যতম গ্লানির একটানা ইতিহাস, সোভিয়েত সমাজের মাত্র ২৪ বছরের ইতিহাস সেই গ্লানিকে অতীত ইতিহাসের সামিল করে তুলল! অথচ সোভিয়েতের ওরা সত্যিই তো কোনোরকম জাদুমন্ত্র জানে না; কিংবা যা একই কথা, যদিই বা কোনো জাদুমন্ত্র জানা থাকে তাহলে তার একমাত্র নাম হল বিজ্ঞান।”

অর্থাৎ ভাবতে অবাক লাগলেও একথা সত্য যে, সোভিয়েত দেশ থেকে মাত্র ২৪ বছরে তিন হাজার বছর পুরানো একটি প্রথার(গণিকাবৃত্তির) অবসান সম্ভব হয়েছিল। অথচ আজও আমাদের দেশে গণিকাবৃত্তি থাকার সুফল হিসাবে ধর্ষণ কম হওয়ার যুক্তিকে বহুজন ব্যবহার করে থাকেন, তাঁরা বুঝতেই পারেন না, নারীজীবনের প্রতি এই প্রথা কতবড় শোষণের ইস্তেহার বহন করে। ফলে তাঁরা গণিকাবৃত্তিকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে নানা তর্ক-বিতর্ক করে থাকেন। কেউ কেউ বলেন যে, আদিকাল থেকে যা আছে তাকে সমাজগাত্র থেকে মুছে ফেলা অসম্ভব। যুক্তি হিসাবে বলেন, 

  • মেয়েদের মধ্যে গণিকা হবার প্রবৃত্তি মজ্জাগত।
  • পুরুষতান্ত্রিক যৌনপ্রবৃত্তি পরিতৃপ্তির জন্য গণিকাপল্লী অবশ্যম্ভাবী।
  • গণিকাপল্লী আছে বলেই সমাজে ধর্ষণের সংখ্যা কম।
  • গণিকাপ্রথা একটি প্রাচীন সংস্কৃতি।
  • পতিতা ও খদ্দের উভয়ের জন্য কঠোর শাস্তিবিধান করেও তাই একে আটকানো যাবে না, ইত্যাদি।

কিন্তু ১৯২৩সাল থেকে সোভিয়েত গণিকা প্রথার সঙ্গে সংগ্রাম শুরু করে একে নির্মূল তো করতে পেরেছিল। প্রথমেই তাঁরা বাস্তবের ভূমিতে অনুসন্ধান করে আবিষ্কার করেছিল গণিকাপ্রথার অন্তরালে থাকা আসল কারণগুলিকে, যেগুলি হল মূলত,

  • দারিদ্রের চাপ অর্থাৎ আর্থনীতিক কারণ (কিন্তু দারিদ্র তো বহুজনের থাকে সবাই তো গণিকা হয় না, তাই হয়তো মনের গড়নে পার্থক্য থাকার জন্য কেউ কেউ এই পথ বেছে নেয়, কিন্তু এটাকেও সোভিয়েত মানতে রাজি হয়নি। সোভিয়েত বলেছিল, দারিদ্রের জন্য যারা গণিকা হয়েছিল তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সমাজে ভদ্রস্থ কোনো কাজ পায়নি যেখানে সসম্মানে স্বাধীনভাবে টিকে থাকা যায়।)
  • ব্যবসার স্বার্থ অর্থাৎ, সমাজের বুকে থাকা নারী সংক্রান্ত বিশাল ব্যবসার ফাঁদ যা দরিদ্র মেয়েদের ছলে-বলে-কৌশলে এই পথে নিয়ে আসে। আর একবার চলে এলে আর রেহাই নেই। সেইখানেই আটকে যায় জীবন। 
  • সমাজে থাকা পণ্যায়নের ধারণা অর্থাৎ, নারী ও ব্যবসায়ীদের বাইরে থেকে যাওয়া খদ্দেরদের শ্রেণি যারা নারীকে অর্থের বিনিময়ে কিনে নিয়ে ভোগ করে। 

ফলে সোভিয়েত দেশ এই তিনটি কারণের বিরুদ্ধেই একসঙ্গে লড়াই শুরু করেছিল। সোভিয়েত দেশ,

  • পতিতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিবিধান না করে আন্তরিক সহানুভূতি ও সাহায্যের দ্বারা সমাজে সম্মানজনকভাবে মেহনতী মানুষের মর্যাদায় দারিদ্র থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার উপায়ের প্রয়োগ করেছিল। 
  • লাগাতার প্রচার ও শিক্ষাবিস্তার করে সমাজের মধ্যে থাকা গণিকাদের সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে সমাজকে এই নারীদের শোষণের বিভীষিকা সম্বন্ধে সজাগ করেছিল। ফলে গণিকা ও অ-গণিকা সকল দরিদ্র নারীই সমাজে ধীরে-ধীরে সাধারণ নাগরিকের মর্যাদা লাভ করেছিল। এই কাজে ‘গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে শ্রমিক বাহিনীর কর্তব্য’ নামের নতুন আইনও জারি করা হয়েছিল।
  • প্রকাশ্য ও গোপনে থাকা পতিতালয়গুলি থেকে পতিতাদের উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ও স্বাভাবিক জীবনে কাজে যোগ দেওয়ার উপযুক্ত হিসাবে তৈরি করার জন্য নানান কারিগরী ও শিল্পবিদ্যা বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়েছিল।  
  • গণিকাদের নিয়ে ব্যবসা করা যাবতীয় লোকজন শনাক্ত হলেই তাদের জন্য কঠোরতম শাস্তি দেওয়ার আইন প্রয়োগ করা হয়েছিল। ফলে ধীরে-ধীরে দালালগোষ্ঠী সমাজ থেকে উধাও হতে শুরু করেছিল। 
  • খদ্দেররা, যারা না ছিল শোষিত গোষ্ঠী, না ছিল অপরাধী ব্যবসায়ী, তাদের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল এক অভিনব ব্যবস্থা। গণিকাপল্লী থেকে যে-সব খদ্দেরদের পাওয়া যেত তাদের বিরুদ্ধে না ছিল অর্থদণ্ড না ছিল শাস্তি। বরং শুধুমাত্র তাদের নাম আর পরিচয় টুকে নিয়ে পরেরদিনের এক বিশেষ ইস্তেহারে প্রকাশ করা হত। এই ইস্তেহারের মাথায় বিগ অ্যান্ড বোল্ডে লেখা থাকত, ‘Buyers of the Bodies of Women’। আর এই ইস্তেহারগুলিকে বাড়ির দেওয়াল, পাড়ার মোড়ে কিংবা কারখানার দরজায় লাগিয়ে দেওয়া হত। 

এইভাবেই সোভিয়েতরা সেদিন পেরেছিল, চীনও সোভিয়েতকে সামনে রেখে নিজেদের দেশের সংস্কৃতি ও সমস্যা অনুযায়ী ভিন্নতর প্রয়োগে একই সাফল্য অর্জন করেছিল। ফলে ধর্ষণ বিলোপের চেষ্টাও প্রকৃত অন্তরিকভাবে হলে রাষ্ট্র যে ব্যর্থ হবে এমনটা বোধহয় নয়। হয়তো প্রথমেই ধর্ষণকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা সমাজ থেকে সম্ভব হবে না। কিন্তু প্রাথমিকভাবে যেটা সম্ভব তা হল ধর্ষণের পরিমাণ কমিয়ে প্রায় শূন্যের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। এখানেও একইভাবে মনে রাখতে হবে যে, ধর্ষণ হল একটি উপসর্গমাত্র, যার অন্তরালে কারণ হিসাবে সামাজিক-সংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-আর্থনীতিক ও জিনঘটিত বিবর্তনবাদ সংক্রান্ত নানান ধারণাগুলি ক্রিয়াশীল। তাই প্রথমে ধর্ষণের সংখ্যা হ্রাস করার জন্য প্রচলিত ও অপ্রচলিত সমস্ত ধারণাকে সম্যকভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে উপলব্ধি করতে হবে। যে-কোনো একটি তত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়ে বাকিগুলিকে অবহেলা করলে হবে না, সবকটিকেই একত্রে বিচার করতে হবে। কেননা ধর্ষণ হল বহুমুখী কারণের দ্বারা সংগঠিত একটি কার্য। তাকে সেইভাবেই বুঝতে হবে। উপসর্গের কারণগুলিকে নির্মূল করলেই তবে উপসর্গ আর দেখা দেবে না। এই প্রসঙ্গে লী এলিসের ‘সিন্থেসাইজড (বায়োসোস্যাল) থিয়োরি অফ রেপ’ এখনও অব্দি যথার্থ বলেই মনে হয়। তিনি বলেছেন যে, 

“Because of variations in exposure of brain to male-typical sex hormone regimens, individual differ in (a) their sex drives (যা নিউরোহরমোন ও জিনের বিবর্তনের ফসল) and (b) their sensitivity to the threat of punishment and to the sufferings of others. Those with the strongest sex drives and the lowest (এই নিম্নতমের আড়ালে আছে পণ্যায়ন বা সামাজিক শিক্ষার মত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবগুলি) sensitivity to punishment and other people’s sufferings will be more prone toward sexual assault.” 

এই তত্ত্ব ও নারীর থেকে তার সত্তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার যে অপরাধতত্ত্ব, দুটিকেই একত্রে দাঁড় করিয়ে বিচার করলে সমাজে ধর্ষণ প্রতিরোধের সম্ভাব্য কিছু নিদান অবশ্যই দেওয়া যায়। তাই,

  • যেহেতু এইসব মানুষগুলিকে, যাদের সেক্স-ড্রাইভ বেশি ও সংবেদনশীলতা কম তাদের, অল্পবয়সেই শনাক্ত করা সম্ভব নয়, তাই প্রথম থেকেই সমাজের সর্বস্তরে যৌনতা বিষয়ে মুক্তমনে কথাবার্তা বলার পরিসর প্রস্তুত করতে হবে। নরনারীর সম্পর্ক বিষয়ে সোজাসুজি ও খোলাখুলি আলোচনার পরিসর সমস্ত বয়সের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। অভিভাবকরা যেমন ভাবেন যে এইসব আলোচনা সন্তানদের বিপথগামী করে দেয়, এই ধারণা নির্মূল করতে হবে। কেননা অল্পবয়সে নরনারীর শরীর ও যৌনতত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞানতা থেকেই সমাজে টোন-টিটকারি-ধর্ষণ শুধু নয়, বিবাহিত জীবনেও নানান সমস্যার সম্মুখীন হয় দম্পতিরা। অনেকক্ষত্রে যা গার্হস্থ্য অপরাধের ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলে। 
  • যৌনতা যে কোনো ট্যাবু নয়, একেবারে স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া সেই ধারণাকে বদ্ধমূল করতে হবে। যৌনতার সঙ্গে যুক্ত থাকে নারী ও পুরুষ উভয়ের সম্মতি ও সুখ, তা যে একপাক্ষিক ভোগের বিষয় নয় – এটাকেও শিক্ষার অন্তর্গত করা জরুরি। 
  • যৌনতা শুধুমাত্র পুরুষ ও নারীর ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। সেখানে সম্মতিক্রমে যদি দুজন মিলিত হতে চায় তবে সেখানে নৈতিকতার দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের পরিমাণটিকেও পুনর্বার বিচার করা প্রয়োজন। একজন দম্পতির ক্ষেত্রে যদি স্বামীর বা স্ত্রীর পরকীয়ার ঘটনা ঘটে তবে সেখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা হবে অন্যজনের প্রতি সুবিচারের বন্দোবস্ত করা। এই নয় যে, যে পরকীয়ার সঙ্গে যুক্ত তাকে প্রথমেই অপরাধী হিসাবে শাস্তি দেওয়া। বরং আর্থনীতিক নির্ভরশীলতা, সন্তান প্রতিপালনে সুচারু দায়িত্বপালন ও ঝঞ্ঝাটহীন সম্মানজনক অবস্থানে বেঁচে থাকার বিচারে অন্যজনের আগামি জীবনযাপনে যেন কোনোরকম সমস্যা না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। সৌভাগ্যের বিষয় যে ভারতীয় আইন এইদিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ শুরু করেছে। 
  • একেবারে অল্পবয়স থেকেই নারী ও পুরুষের যৌনতা বিষয়ক পাঠ হিসাবে পুরুষের চরিত্রে থাকা বহুগামীতার প্রবণতা ও নারীদের মধ্যে থাকা নির্বাচনের অধিকারের ধারণাগুলিকে সমকালীন সমাজের সাপেক্ষে যুক্তি ও বিপক্ষ যুক্তি দিয়ে আলোচনার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া প্রয়োজন। 
  • নারীকে ভোগ্যবস্তু হিসাবে বা পণ্য হিসাবে যে প্রজ্ঞাপনগুলি ক্রিয়াশীল সেগুলিকে মুছে ফেলতে হবে। 
  • নারীসম্মান, নারী অধিকার ও নারীমুক্তির বিষয়ে রাষ্ট্রকে অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। 
  • পুরুষ যদি নারীর ওপরে জোর করে তাহলে তা যে পৌরুষের পক্ষে কতটা লজ্জার ও অবমাননাকর সেটা সম্বন্ধে অবহিত করেই, সংশোধনাগারে থাকাকালীন পরিজনহীনতা ও বাইরের দুনিয়ার অন্যান্য তাবড় সুখ থেকে বঞ্চিত থেকে যাওয়ার মূল্য কতখানি চোকাতে হবে সমাজমনস্কতায় তাও স্পষ্ট করে দিতে হবে। একইসঙ্গে শাস্তির বিধানও নির্দিষ্ট করতে হবে। এমন শাস্তি যা ধর্ষককে প্রতিমুহূর্তে বিবেকের সামনে দাঁড় করিয়ে তার কৃতকার্যের জন্য আত্মদংশনের পরিসর প্রস্তুত করবে। এছাড়া সংশোধনাগারে রাষ্ট্র অন্য কী ধরণের শাস্তির বিধান রাখবে তা রাষ্ট্রকেই জনমতানুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে। 
  • ধর্ষণের দরুন শারীরিক-মানসিক ক্ষতি, পারিবারিক-সামাজিক অবস্থানের মাত্রাবনমন ও পরবর্তীতে বিবাহের ব্যাপারে সমস্যা ইত্যাদি কিছুই না হলেও যে নারীর সত্তা থেকে তাকে পৃথক করা একটি ভয়াবহ অপরাধ সে-বিষয়ে সকল বয়স ও সকল শ্রেণির নাগরিককে শিক্ষিত করতে হবে। 
  • সমাজকেও প্রস্তুত করতে হবে এমনদিকে যাতে সমাজে ধর্ষিতার প্রতি থাকে সহানুভূতি ও সাহায্যের অভিপ্রায় এবং ধর্ষকের প্রতি থাকে নিন্দার দৃষ্টি। নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্যের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক চেতনা জাগ্রত করার প্রয়াসটিও জরুরি। ধর্ষিতাদের কাহিনিগুলিকে লাগাতার প্রচার করতে হবে, যদি কোনো ধর্ষিতা নিজেই সেসব বলতে রাজি হয়ে থাকেন তবে সেক্ষেত্রে তাঁর মুখ ঢেকে বলার রীতি ত্যাগ করতে হবে, কেননা তিনি এখানে বিন্দুমাত্র লজ্জার কাজ করেননি। 
  • নারীদের অন্তরে সামান্য টিটকারী থেকে অবমাননাসূচক মন্তব্যের প্রতি অসহনশীলতার ধারণা প্রোথিত করতে হবে। একইসঙ্গে নারীদের প্রস্তুত করতে হবে আচমকা আক্রমণের প্রতি লড়াকু ক্ষমতার প্রতিভূ হিসাবে। 
  • পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ধর্ষণের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালাতে হবে।

 

সবশেষে বিস্মৃত হলে হবে না যে, সমাজমনস্তত্বকে অনুধাবন করার জন্য বিজ্ঞান কার্যকরী ঠিকই, কিন্তু সে ঠিক-ভুলের কৈফিয়ত দিয়ে নৈতিকতার মার্গনির্দেশ করতে পারে না। বিজ্ঞান উপসর্গের কারণগুলিকে নির্ধারণ করতে পারে মাত্র, কিন্তু তার উপশম কীভাবে হবে তা নির্দিষ্ট হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের দ্বারাই। এখানে কিছু সম্ভাব্য উপায়ের কথা আলোচনা করা হয়েছে মাত্র, কিন্তু এর বাইরেও যতকিছু পদ্ধতি আছে সমস্ত দিক বিচার করে রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজকেই নির্দিষ্ট করতে হবে ধর্ষণ প্রতিরোধের উপায়গুলি। পক্ষান্তরে এই উপায় বা আইনগুলির মধ্যে থাকেবে যুগোপযোগী গতিশীলতা অর্থাৎ সময়ের প্রয়োজনে যেন তাকে বদল করা যায়। এতকিছুর পরেও যদি কেউ ধর্ষক হয়ে ওঠে তার দায় বর্তাবে অবশ্যই ব্যবস্থাপনার ত্রুটির ওপরে। বুঝতে হবে বিদ্যমান ব্যবস্থাটির মধ্যে এমন কিছু গলদ থাকছে যাকে আপডেট করে শুধরে নেওয়ার সময় এসে গেছে। ফলে সেটাকে শনাক্ত করে দ্রুত নিষ্পত্তি ঘটাতে হবে। যদি এই সামগ্রীকতাকে অর্জন করা যায় তবেই আগামিতে প্রায় ধর্ষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। আর এই উদ্যোগ যত দ্রুত সম্ভব ততটাই তাড়াতাড়ি গ্রহণ করতে হবে। কেননা দিনের শেষে মানবিকতার জয়ই যে প্রকৃত লক্ষ্য।

সূত্রনির্দেশঃ-

  1. Susan Estrich – Rape, 1986
  2. Lynne Henderson – What Makes Rape a Crime? 1987
  3. Lee Ellis – Theories of rape: Inquiries into the causes of sexual aggression, 1989
  4. Lee Ellis – A Synthesized(Biosocial) Theory of Rape, 1991
  5. Randy Thornhill, Craig T. Palmer – A Natural History of Rape, Biological Bases of Sexual Coercion, 2000
  6. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – নিষিদ্ধ দেশ নিষিদ্ধ কথা
  7. মুহম্মদ মাজ্‌হারুল ইসলাম – ধর্ষণ: জৈববিবর্তনের পথ ধরে 
  8. অন্যান্য

বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ-

  • অভীক সিনহা –একজন মুক্তমনা, যুক্তিবাদী ও তর্কপ্রিয় ভারতীয় যিনি প্রতি মুহূর্তে বিশুদ্ধ এবং শাণিত মগজাস্ত্রের দ্বারা ঋদ্ধ করেছেন। সৌভাগ্য যে তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধুজনও, তাই অসীম প্রশ্রয়ও দিয়েছেন।