লিখেছেনঃ অনুপম সৈকত শান্ত
আদর্শ শরীর বলে কোন কিছু নেই। এ নিয়ে ফান্টাসি বা হীনমন্যতায় ভুগারও কিছু নেই! টিভিতে, ইন্টারনেটে, বিজ্ঞাপনে আদর্শ শরীর বলে যা কিছু দেখানো হয়, তা অনেক সময়ই ভুয়া এবং বিভ্রান্তিকর।
নেদারল্যাণ্ডের মাধ্যমিক স্কুলের বায়োলজি বইয়ের প্রজননতন্ত্র বা রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেম নামের অধ্যায়টি দেখছি। অধ্যায়টি মাধ্যমিক স্কুলের ক্লাস টু-তে সব ছাত্রছাত্রীকে পড়তে হবে। এখানে প্রাথমিক স্কুলে গ্রুপ ওয়ান থেকে গ্রুপ এইট, সাধারণত ১২-১৩ বছর বয়স পর্যন্ত পড়ে, তারপরে তারা মাধ্যমিক স্কুলে যায়। সে হিসেবে ১৩-১৪-১৫ বছর বয়সের ছাত্রছাত্রীরা এই অধ্যায়টি পড়ে। মাধ্যমিক স্কুলের ক্লাস থ্রি পর্যন্ত সবাই বায়োলজি পড়ে, ক্লাস থ্রি’র পরে আমাদের সায়েন্স, আর্টস, কমার্সের মত ছাত্রছাত্রীরা এই চার ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়: ক. সংস্কৃতি ও সমাজ, খ. অর্থনীতি ও সমাজ, গ. প্রকৃতি ও স্বাস্থ্য, ঘ. প্রকৃতি ও প্রযুক্তি!
মাধ্যমিক স্কুলের বায়োলজি বইয়ের প্রজনন (রিপ্রোডাকশন) নামের অধ্যায়ের সূচির দিকে তাকানো যাক। অধ্যায়টি ১ থেকে ১০ নাম্বারে, ১০ টি সেকশনে বিভক্ত। প্রতি সেকশনেই আবার একাধিক সাবসেকশন রয়েছে। এবং সেগুলোর পাশাপাশি বক্স করে বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও প্রতিবেদন যুক্ত করা হয়েছে। সেকশন, সাবসেকশন ও বক্স ইনফরমেশনগুলো পড়লে একজন ছাত্র/ছাত্রী মানব শরীরের প্রাথমিক ও সেকেণ্ডারি যৌন বৈশিষ্ট, বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক তথা যৌনাঙ্গের পরিবর্তন, আবেগ – অনুভূতির পরিবর্তন, পুরুষ ও নারীর প্রজননতন্ত্র ও যৌনাঙ্গের বিস্তারিত ও সচিত্র বর্ণনা, হাইমেন বা সতীচ্ছেদ, প্রেম-ভালোবাসা, যৌনতা বা সেক্সুয়ালিটি, যৌন চাহিদা – সেক্স ড্রাইভ বা লিবিডো, সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স (হেটারোসেক্সুয়াল – হোমোসেক্সুয়াল গে – লেজবিয়ান – বাইসেক্সুয়াল – এসেক্সুয়াল রিলেশন), নারী ও পুরুষের বাইরেও ট্রান্সজেণ্ডার , ট্রান্সভেস্টাইট, ট্রান্সসেক্সুয়াল, এণ্ড্রোজিনাস বা উভলিঙ্গ, সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স (এসল্ট – হ্যারাসমেন্ট – রেপ), জন্ম নিয়ন্ত্রণ – অনিরাপদ পদ্ধতি ও কনডম, পিল সহ বিভিন্ন পদ্ধতি, ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপ্টিভ, প্রেগনেন্সি, সন্তানের জন্মদান, এবং যৌনবাহিত বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে সায়েন্টিফিকালি বিস্তারিত জানতে পারবে।
এই পুরা অধ্যায়ে কয়েকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছেঃ
১/ পারফেক্ট শরীর বলে কোন কিছু নেই। আদর্শ স্তন (ছোট বা বড়) বা আদর্শ শিশ্ন বলেও কিছু নেই (ফলে, এ নিয়ে ফান্টাসি বা হীনমন্যতায় ভুগারও কিছু নেই)! টিভিতে, ইন্টারনেটে, বিজ্ঞাপনে – আদর্শ শরীর বলে যা কিছু দেখানো হয়, তা অনেক সময়ই ফেক বা ম্যানিপুলেটেড।
২/ পুরা অধ্যায়ে “বিয়ে”, “স্বামি”, “স্ত্রী” – এই শব্দগুলোর কোন উল্লেখ নেই। যৌন সম্পর্ক বা সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের আলোচনাতেও এই তিন শব্দের কোন উল্লেখ নেই।
৩/ ১ম সেকশনে বয়:সন্ধিকালে নানা পরিবর্তনের যে আলোচনা, সেখানে মানসিক পরিবর্তনের আলোচনায় প্রথম সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের কথা বলা হয়েছে। ধাপে ধাপে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের আলোচনাটা এসেছে এভাবে – এসময়ে আরেকজনের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হতে পারে > একজন আরেকজনের প্রেমে পড়তে পারে > অন্যজনও যদি তার প্রেমে পড়ে, তাহলে দুজনের মাঝে রিলেশনশিপ তৈরি হতে পারে > এই রিলেশনশিপে একে অপরের হাত ধরা, চুমু দেওয়া, আলিঙ্গন করে আদর করা প্রভৃতি হতে পারে > এবং এসব কোন কোন ক্ষেত্রে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের দিকেও ধাবিত করতে পারে! পরবর্তীতে সেক্সুয়ালিটি সম্পর্কিত আলোচনায়, স্পেশাল রিলেশনশিপ বজায় রাখা নিয়ে বড় আলাপ রয়েছে। সেখানেও দুইজনের পক্ষ থেকেই প্রেমে পড়াটা প্রথম শর্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে রিলেশনশিপের। তারপরে তা সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের দিকেও যেতে পারে।
৪/ নারীর বহির্যৌনাঙ্গ সম্পর্কিত আলোচনায় আলাদাভাবে সতীচ্ছদ বা হাইমেন নিয়ে আলোচনা আছে। তিনটি যোনীর ছবি দিয়ে দেখানো হয়েছে, একেকজনের হাইমেন এর আকার বা ধরণ একেক রকম। কারো কারো ক্ষেত্রে প্রথমবার যৌনক্রিয়াতে ব্লিডিং বা রক্ত পড়তে পারে, কিন্তু সকলের ক্ষেত্রেই এরকম রক্ত পড়ার ঘটনা ঘটে না।
৫/ যৌনতা বা সেক্সুয়ালিটি নিয়ে আলোচনায় লিবিডো বা সেক্স ড্রাইভ নিয়া আলোচনায় স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে, যৌনতা মানুষকে অনেক আনন্দ বা প্লেজার দেয়, এটা তাদেরকে যৌনভাবে উত্তেজিত করে (এরাউজ দেম / টার্ণ দেম অন)!
৬/ সেক্সুয়ালিটির আলাপে পর্ণো ও প্রস্টিটিউশন সম্পর্কেও জানানো হয়েছে।
৭/ যার প্রতি আকৃষ্ট তার সাথে লাভমেকিং বা সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স যৌনভাবে উত্তেজিত করে, যৌন আনন্দ দিতে পারে। আবার নগ্ন শরীরের ছবি, অন্যের যৌনাঙ্গের ও যৌনক্রিয়ার ছবি ও ভিডিও দেখেও এরকম যৌন উত্তেজনা, যৌন আনন্দ তৈরি হতে পারে। এসবকে বলা হয় পর্ণোগ্রাফি। এরপরে পর্ণোগ্রাফি সম্পর্কে তিনটা সমালোচনা রাখা হয়েছেঃ ১/ পর্ণোগ্রাফি আর প্রকৃত পার্টনারের সাথে যৌন সম্পর্ক এক নয়। ফলে, পর্ণোগ্রাফি দেখার মাধ্যমে অনেক সময়ই যৌনতা সম্পর্কে অবাস্তব ইমেজ, ধারণা মাথায় চলে আসতে পারে। ২/ পর্ণোগ্রাফিতে অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের প্রতি অবন্ধুসুলভ আচরণ প্রকাশ পায়, ৩/ পর্ণোগ্রাফি অনেক ক্ষেত্রেই মেল ফ্যান্টাসিকে প্রকাশ করে।
৮/ সেক্সুয়ালিটি বা যৌনতা সম্পর্কিত আলাপে স্পেশাল রিলেশনশিপ বজায় রাখা, লিবিডো, ডিফারেন্ট সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স, হেলদি সেক্সুয়াল রিলেশনশিপ, সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স – এই আলোচনাগুলোর ফাঁকে খুব ছোট করে রিপ্রোডাকশন নিয়ে আলোচনায় জানানো হয়েছে, প্রজননে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স তথা সেক্সুয়ালিটির বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু অনেকেই সন্তানের জন্মদানের উদ্দেশ্য ছাড়াই সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সে অংশ নিতে পারে। সেজন্যে দরকার কন্ট্রাসেপ্টিভস।
৯/ ডিফারেন্ট সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স এর আলোচনায়, হেটারোসেক্সুয়াল, হোমোসেক্সুয়াল, বাইসেক্সুয়াল সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। একইভাবে কারা ট্রান্সজেণ্ডার, ট্রান্সভেস্টাইট, ট্রান্সসেক্সুয়াল, এণ্ড্রোজিনাস- সেই আলোচনাও আছে। একই সাথে জানানো হয়েছে, সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স ও সেক্সুয়ালিটির ভিন্নতার জন্যে হোমোসেক্সুয়াল, লেজবিয়ান, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেণ্ডার যারা তারা নানারকম ডিস্ক্রিমিনেশন, হয়রানি, নির্যাতন, এমনকি সেক্সুয়াল ভায়োলেন্সের শিকার হয়। এর বিরুদ্ধে অসংখ্য মানুষ প্রতিবাদও করে!
১০/ সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স সম্পর্কিত আলাপে বিস্তারিতভাবে সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স, এসল্ট, রেপ, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট এর সংজ্ঞা দিয়ে জানানো হয়েছে, এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এমনকি জেল পর্যন্ত সাজাও হতে পারে।
১১/ জন্ম নিয়ন্ত্রণের আলোচনায় কনডম নিয়ে বিস্তারিত ও সচিত্র আলোচনা আছে। এবং আলাদাভাবে ইয়ং পিপল যে এখনো নিরাপদ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে, সে সম্পর্কে একটা প্রতিবেদনের উল্লেখ আছে। এর বাইরে ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল নিয়েও বড় আলোচনা আছে।
১২/ অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের ক্ষেত্রে একজন নারীর নানারকম ডিলেমা তৈরি হতে পারে, সে আলোচনা আছে। সে সন্তানকে জন্ম দিতে প্রস্তুত কি না, সন্তান জন্ম দেয়ার পরে নিজে লালন পালন করতে পারবে নাকি কোন ফস্টার প্যারেন্টের কাছে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিবে, সে কি টার্মিনেট করবে, সে কি সন্তানের বায়োলজিকাল বাবার সাথে একত্রে মুক্তভাবে আলোচনা করতে ও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে … ইত্যাদি!
১৩/ গর্ভপাত বা এবর্শনের ক্ষেত্রেও – দুই ধরণের যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছেঃ কেউ কেউ মনে করেঃ “Everyone has the right to life, liberty and security of person” এর সাথে সাথে ভালোভাবেই বলা হয়েছে, অনেকেই মনে করে নারীর নিজের শরীরের সম্পূর্ণ রকমের অধিকার আছে (“Boss of her own body”)।
তুলনাঃ
বাংলাদেশের নবম-দশম শ্রেণীর জীববিজ্ঞান ২য় পত্র এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর জীববিজ্ঞান ২য় পত্র বই দুটোতে থাকা যৌনতা ও মানব প্রজনন সম্পর্কিত আলোচনার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। নবম-দশম শ্রেণীর জীববিজ্ঞান ২য় পত্রের অধ্যায়টির নাম “জীবের প্রজনন”। সেখানে প্রথমে ১১.১ অনুচ্ছেদে ‘জীবে প্রজননের ধারণা ও গুরুত্ব’ দিয়ে অধ্যায় শুরু হয়। অর্থাৎ জীবের বংশবৃদ্ধির জন্যে এই প্রজনন খুব যে জরুরি একটা প্রকৃয়া সেটা জানানো হয়। প্রজনন দুই রকমের যৌন ও অযৌন প্রজনন। এরপরে ১১.২ এ অনেক বিস্তারিত ও সচিত্র আলচনা আছে উদ্ভিদের প্রজনন নিয়ে। তারপরে ১১.৩ অনুচ্ছেদের আলোচনা প্রাণির প্রজনন নিয়ে, সেখানে যৌন ও অযৌন প্রজননের আলাপ শেষে ১১.৩.১-এ প্রাণির নিষেক বা ফার্টিলাইজেশন নিয়ে আলোচনায় শুক্রাণু – ডিম্বাণু মিলে জাইগোট তৈরি- এসবের আলাপ। এরপরেই হুট করে ১১.৩.২ অনুচ্ছেদে চলে গিয়েছে – মানুষের প্রজননের আলাপে। অনুচ্ছেদের নামঃ “মানব প্রজননে হরমোনের ভূমিকা”! মানুষের প্রজনন বিষয়ক একটা আলাপ জীববিজ্ঞান বইয়ে শুরু হচ্ছে, হরমোনের ভূমিকা দিয়ে! সেখানে হরমোন, হরমোন গ্রন্থি – এসবের আলাপ শেষে- বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর কিশোরিদের শরীরে কি কি পরিবর্তন ঘটে- সেই আলাপ আছে, কিন্তু নতুন কোন অনুচ্ছেদের নামে না! কোন ছবি টবি নাই। তারপরে রজঃস্বাব, ঋতুচক্র নিয়ে একটু আলোচনা আছে, তারপরেই যৌন সম্পর্ক নিয়ে ছোট দুই প্যারায় আলাপ করা হয়েছে। এই সমস্ত আলোচনা সেই “মানব প্রজননে হরমোনের প্রভাব” নামক অনুচ্ছেদের আড়ালেই করা হয়েছে।
যৌনতা বা যৌন সম্পর্ক নিয়ে আলাপটাও খুব মজার। এটা শুরুই করা হয়েছে, বিয়ে নামক সামাজিক, ধর্মীয় ও পারিবারিক বন্ধনের কথা বলে। তারপরে, পুরা আলোচনাটা হচ্ছে স্বামি ও স্ত্রীর মধ্যে প্রেম ভালোবাসা, নির্দ্বিধায় মেলামেশা,তারপরে দৈহিক সম্পর্ক। দৈহিক সম্পর্ক বলতে কি বুঝিয়ে, কোন অঙ্গ সেখানে ভূমিকা নেয়, সেসব আলাপ নাই, তবে স্বামি ও স্ত্রীর দৈহিক সম্পর্কের আলাপের পরেই আছে, শুক্রাণুতে লেজ থাকে, ফলে শুক্রাণু সাঁতরিয়ে স্ত্রীর প্রজননতন্ত্রে ঢুকে, স্ত্রীর ডিম্বনালীতে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন বা নিষেক ঘটে, জাইগোট তৈরি হয়। মানে, শুক্রাণু কেবল স্বামির শরীর থেকে তার স্ত্রীর ডিম্বনালীতে যেতে পারে, বা কেবল স্ত্রী ডিম্বাণুকেই নিষিক্ত করতে পারে! আর, শুক্রাণুটা কোথা থেকে কিভাবে আসছে, অর্থাৎ ইজাকুলেশন (বীর্যপাত) বা বীর্য – এসবেরও কোন উল্লেখ নেই! বাস, এখানেই মানব প্রজননের আলাপ শেষ। এরপরে, ভ্রুণের বিকাশ, সন্তানের জন্মদান সম্পর্কিত আলোচনা এবং তারপরে যৌনবাহিত রোগ সম্পর্কে আলোচনা বেশ ভালোভাবে আছে। নারীর প্রজননতন্ত্রের যে স্কেমেটিক ছবিটা আছে, তার চাইতে ফুলের গর্ভাশয় – গর্ভদণ্ড এসবের ছবি অনেক ডিটেইলড, পরিস্কার ও রঙ্গিন।
বাংলাদেশে এই অধ্যায়টি সাধারণত ক্লাস টেনে পড়ার কথা, যখন গড়ে ছাত্র/ ছাত্রীর বয়স থাকে ১৪। এতটুকু আলোচনা পড়ে কেবল বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা। দ্বাদশ শ্রেণীর ১৬-১৭ বছর বয়সের ছাত্রছাত্রীরা জীববিজ্ঞান ২য় পত্রে (এটিও বিজ্ঞান বিভাগের একটি ঐচ্ছিক বিষয়) যে অধ্যায়টি পড়ে তার নাম, “মানবজীবনের ধারাবাহিকতা”। এই অধ্যায়ে যে যে বিষয় আছে, সবই অনেক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, এমনই বিস্তারিত ও সায়েন্টিফিক আলোচনা যে – প্রতি লাইনে লাইনে নানান খটমটে বাংলা ও ইংরেজি টার্ম কয়েকটা করে পাওয়া যাবে। শুরুই করা হয়েছে, পুরুষ প্রজননতন্ত্র ও স্ত্রী প্রজননতন্ত্র দিয়ে, সেখানে পুরুষ ও নারীর বিভিন্ন যৌনাঙ্গের সাথে ও হরমোনাল ক্রিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন যৌনাঙ্গের সংজ্ঞা ও কাজ নিয়ে আলাপ আছে। তারপরে, প্রজননের বিভিন্ন পর্যায় ও দশা নিয়ে আলোচনা। প্রথমে বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে আলোচনা, সেখানে একটি ছকে দৈহিক, শরীরবৃত্তিক ও মানসিক পরিবর্তন দেখানো হয়েছে। তারপরের পর্যায়ে রজঃস্রাব নিয়ে অনেক বিস্তারিত এক আলোচনা আছে। তারপরে তৃতীয় পর্যায় হচ্ছে, গ্যামেট সৃষ্টি বা গ্যামেটোজেনেসিস। এখানে আছে শুক্রাণুজনন ও ডিম্বাণুজনন নিয়া বিশাল আলোচনা। সেই সাথে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর গঠন, তাদের বিভিন্ন অংশের আলোচনা আছে। চতুর্থ পর্যায় হচ্ছে, নিষেক। আশ্চর্যজনকভাবে নিষেকের আলাপটা শুরু করা হয়েছে, প্রাণিদেহের নিষেক এর আলাপ দিয়ে, প্রাণিকূলে কয়রকম নিষেক হতে পারে, সেই আলাপ শেষ করে মানবদেহের নিষেক নিয়ে আলাপ শুরু করা হয়েছে। সেই নিষেকের ৬ টি ধাপের প্রথমটি শুরুই করা হয়েছে স্খলিত শুক্রাণু থেকে। এই শুক্রাণু কোত্থেকে কিভাবে বা কোন প্রকৃয়ায় স্খলিত হলো, সে সম্পর্কে আলাপ নেই। তারপরে, নিষেক প্রকৃয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা আছে। এরপরে একে একে গর্ভধারণ বা ইমপ্লান্টেশন, মানব ভ্রূণের পরিস্ফুটন, ভ্রূণ ও ফিটাসের বিকাশ, শিশু প্রসব, গর্ভাবস্থার পরিচর্যা – ইত্যাদি নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা রয়েছে। এরপরে জন্ম নিয়ন্ত্রণের আলোচনা, বাংলায় দেখলাম গর্ভনিরোধক পদ্ধতি করা হয়েছে। কিন্তু এই সম্পর্কিত অনুচ্ছেদের নাম, “গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ও পরিবার পরিকল্পনা”। এখানে জন্মনিয়ন্ত্রণের অস্থায়ী ও স্থায়ী নানান পদ্ধতির সাথে সংক্ষেপে পরিচয় করে দেয়া হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনার আলোচনার পুরাটাই হচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত। এমনভাবে এই অনুচ্ছেদের আলোচনা সাজানো হয়েছে, মনে হবে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রধান বা একমাত্র দরকারই হচ্ছে, দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। তারপরে নারী ও পুরুষের প্রজননতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে আলোচনা আছে। প্রজনন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা নিয়ে আলাপ শেষে যৌনবাহিত রোগগুলোর লক্ষণ, নির্ণয়, প্রতিকার, প্রতিরোধ সম্পর্কিত আলাপ করে অধ্যায় শেষ। একটা জায়গাতেও প্রেম-ভালোবাসা, সেক্সুয়ালিটি, সেক্স ড্রাইভ – সেক্সুয়াল প্লেজার, কিংবা সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স ও সেক্সুয়ালিটির বৈচিত্র, সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স – যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, নিয়ে কোন আলোচনা নেই। নারী বা পুরুষের শরীরকে চেনানোর জন্যে কোন ছবি নেই, যৌনাঙ্গের ছবি নেই। পুরো অধ্যায়ের আলোচনাটি এমনই খটমটে কঠিন কঠিন সব টার্মোলজিতে এবং এত বেশি পয়েন্টে ভর্তি যে, বিভিন্ন টার্মোলজি, সেগুলো সংজ্ঞা ও কাজ, বৈশিষ্ট – এসব পড়ে মুখস্থ করা – মনে রাখা ছাড়া এই অধ্যায়টির আর কোন কাজ আছে বলে মনে হয় না! মানব প্রজননের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে, বংশ বিস্তার বা মানবজীবনের ধারাবাহিকতা, সেখানে যৌনতা, যৌন উত্তেজনা তথা যৌন আনন্দের কোন অবস্থান বা ভূমিকা নেই, আর জন্ম নিয়ন্ত্রণের মূল কারণ বা উদ্দেশ্যই হচ্ছে, দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। এই হচ্ছে, এই অধ্যায়ের মোদ্দাকথা!
নেদারল্যাণ্ডের মাধ্যমিক স্কুলে পাঠ্য জীববিজ্ঞান বইয়ের বিভিন্ন সেকশন, সাবসেকশন ও বক্স ইনফর্মেশন এবং সেগুলোতে থাকা ছবিগুলো এখানে সংযুক্ত করছি।
সেকশন ১ঃ তোমাদের পরিবর্তন হচ্ছে …
(চিত্র ১ঃ প্রাথমিক যৌন বৈশিষ্ট)
সাবসেকশনঃ
– শারীরিক পরিবর্তন
(চিত্র ২ঃ বালক ও পুরুষের যৌন বৈশিষ্ট, বালিকা ও নারীর যৌন বৈশিষ্ট)
– ইমোশনাল পরিবর্তন
– সামাজিক পরিবর্তন
বক্সড ইনফর্মেশনঃ আদর্শ শরীর বলে কোন কিছু কি আছে?
(চিত্র ৩ঃ প্রকৃত ও ম্যানিপুলেটেড ছবি)
(চিত্র ৪ঃ পুরুষের শরীর)
(চিত্র ৫ঃ পুরুষ প্রজননতন্ত্র)
(চিত্র ৬ঃ পুরুষের শিশ্ন)
(চিত্র ৭ঃ শিশ্ন (বাহ্যিক দৃশ্য এবং প্রস্থচ্ছেদ))
সাবসেকশনঃ
- বীর্যপাত বা ইজাকুলেশন
(চিত্র ৮ঃ একটি শুক্রাণু কোষ)
সেকশন ৩ঃ নারীর প্রজননতন্ত্র
(চিত্র ৯ঃ নারীদেহ)
(চিত্র ১০ঃ নারী প্রজননতন্ত্র)
সাবসেকশনঃ
- ওভুলেশন
- নিষেক বা ফার্টিলাইজেশন
(চিত্র ১১ঃ উপরে- শুক্রাণুর প্রতিযোগিতা, নীচে – একটি ডিম্বাণুর নিষেক)
- গর্ভধারণ বা ইমপ্লান্টেশন
(চিত্র ১২ঃ কোষগুচ্ছ ইউটেরাসের দিকে যেতে থাকে যেখানে ইউটেরাস লাইনিং-এ গিয়ে গর্ভধারণ হয়)
- নারীর এক্সটার্ণাল যৌনাঙ্গ
(চিত্র ১৩ঃ যোনী, নারীর বহির্যৌনাঙ্গ)
বক্সড ইনফর্মেশনঃ হাইমেন (বাংলা সতীচ্ছেদ শব্দটি আপত্তিকর। বাংলায় একে বলা যায় যোনিদ্বারপর্দা)
(চিত্র ১৪ঃ বিভিন্ন রকমের হাইমেন)
সেকশন ৪ঃ রজঃস্রাব বা মেন্সট্রুয়েশন
(চিত্র ১৫ঃ প্যাড ও টাম্পনের ব্যবহার)
সাবসেকশনঃ
- ঋতুচক্র বা মেন্সট্রুয়াল সাইকেল
(চিত্র ১৬ঃ ঋতুচক্র – পাঁচ সপ্তাহে একজন নারীর ইউটেরাস লাইনিং)
সেকশন ৫ঃ যৌনতা বা সেক্সুয়ালিটি
সাবসেকশনঃ
- বিশেষ সম্পর্ক বজায় রাখা
- লিবিডো/ সেক্স ড্রাইভ
(চিত্র ১৭ঃ যৌনতা এবং লিবিডো)
- প্রজনন
- ডিফারেন্ট সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স
(চিত্র ১৮ঃ বিভিন্ন সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স)
- স্বাস্থ্যকর সেক্সুয়াল রিলেশনশিপ
- সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স
বক্সড ইনফর্মেশনঃ
- রেকর্ড সংখ্যক স্কুল পার্পল ফ্রাইডেতে অংশ নিয়েছে
- সেক্সুয়াল ভায়োলেন্সঃ প্রতি ক্লাসে তিনজন ছাত্র/ছাত্রী
সেকশন ৬ঃ জন্ম নিয়ন্ত্রণ
সাবসেকশনঃ
- আনরিলায়েবল পদ্ধতি
- কনডম
(চিত্র ২০ঃ কনডমের ব্যবহার)
(চিত্র ২১ঃ কনডম)
- পিল
- অপ্রত্যাশিত গর্ভাবস্থার বিপরীতে জরুরি ব্যবস্থা
বক্সড ইনফর্মেশনঃ ফার্টাইল পিরিয়ড কি মানুষকে বেশি আকর্ষণীয় করে?
সেকশন ৭ঃ গর্ভাবস্থা ও শিশুজন্ম
(চিত্র ২২ঃ গর্ভাবস্থার পরীক্ষা)
সাবসেকশনঃ
- গর্ভাবস্থা
(চিত্র ২৩ঃ ইউটেরাস লাইনিং ও গর্ভে ভ্রুণ)
- শিশুর জন্ম (প্রসব)
(চিত্র ২৪ঃ প্রসারণ বা ডাইলেশন)
(চিত্র ২৫ঃ প্রসব বা ডেলিভারি)
(চিত্র ২৬ঃ মায়ের পেটে সন্তানের অবস্থান)
(চিত্র ২৭ঃ জন্মের পরে)
বক্সড ইনফর্মেশনঃ ধাত্রী (মিড ওয়াইফ)
সেকশন ৮ঃ যৌনবাহিত রোগ
সাবসেকশনঃ
- ক্ল্যামিডিয়া
- এইডস
বক্সড ইনফর্মেশনঃ
- ক্ল্যামিডিয়া নিয়ে মেজর স্টাডি
- বিশ্বব্যপি এইডস
- অল্পবয়সীরা এখনো নিরাপদ যৌন সম্পর্কে অভ্যস্ত নয়
সেকশন ৯ঃ জন্মনিয়ন্ত্রণের অন্যান্য পদ্ধতি
সেকশন ১০ঃ অন্যান্য যৌনবাহিত রোগসমূহ
সাবসেকশনঃ
- জেনিটাল ওয়ার্টস
(চিত্র ২৮ঃ জেনিটাল ওয়ার্টস)
- হার্পিস
(চিত্র ২৯ঃ জেনিটাল হার্পিস)
- গনোরিয়া
(চিত্র ৩০ঃ গনোরিয়া)
এখানে নেদারল্যাণ্ডের পাঠ্যবইয়ের যে আলোচনা করা হয়েছে, তা কিন্তু কেবল জীববিজ্ঞান বা বায়োলজির আলোচনা। এর বাইরে আরো ছোট ক্লাসেই (প্রাথমিক স্কুলেই), আলাদাভাবে যৌনশিক্ষা দেয়া হয়ে। যেখানে মূলত বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক, মানসিক নানা পরিবর্তন, রজঃস্রাব ও ঋতুচক্র (মেন্সট্রুয়েশন ও মেন্সট্রুয়াল সাইকেল), বিভিন্ন রকম সেক্সুয়াল প্রেফারেন্স, দুজনের মাঝে স্পেশাল রিলেশন, এবং সন্তান জন্মের ওভারল প্রকৃয়া – এসবের উপরে একটা ধারণা দেওয়া হয়! বাংলাদেশে নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেনীতে জীববিজ্ঞান কেবল বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা পড়লেও, নেদারল্যাণ্ডে এই বায়োলজি ক্লাস টু-তে সবাইকেই পড়তে হয়। ফলে, এখানে কিশোর কিশোরিদের এ সম্পর্কে ট্যাবু নিয়ে বড় হয়ে উঠতে হয়, বন্ধু-বান্ধব কিংবা পর্ণোগ্রাফি বা চটি পত্রিকাগুলো থেকে যৌনতা বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করতে হয়! বাংলাদেশে যে এখনো যৌনতা নিয়ে মারাত্মক ট্যাবু কাজ করে, তারই নজির তার পাঠ্যবইয়ে পাওয়া যাচ্ছে। যৌনশিক্ষা নিয়ে আলাদা কোন পাঠ তো নাই’ই, জীববিজ্ঞানের বইতেও যৌনতা নিয়ে সহজ সুন্দর ভাষায় কোন রকম আলোচনাও নেই!
শুধু বাংলাদেশ ই নয় ভারতেও এই এক অবস্থা। কিন্তু কত যুগে আমাদের চেতনা জাগবে জানি না। এই সব লেখা লিখে বা মন্তব্য করে অনেক কিছু জানছি কিন্তু এর কোনো এফেক্ট কি কস্মিনকালে ও দেখা যাবে এই সমাজ এ ?
বাংলাদেশের সমাজে প্রেম ভালোবাসা নিষিদ্ধ, ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে কথা বলা নিষিদ্ধ, বাংলাদেশে ধর্ষণ একভাবে সিদ্ধ কারণ সমাজ পুরুষতান্ত্রিক।
রক্ষণশীল বাংলাদেশের সমাজে যৌনতা বিষয়টা ট্যাবু (taboo) এটা একটা সমস্যা; এই জন্যেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও রক্ষণশীল ভাবে তৈরি করা।