লিখেছেন: মেঘবতী রাজকন্যা
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যারা পরিচিত তারা সবাই জানেন যে, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যৌনতার উপস্থাপন রক্ষণশীলভাবে করা হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠিত যৌন শিক্ষা বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে নেই। সমাজে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেরা পুরুষতন্ত্রবাদ এবং বখাটেপনায় দীক্ষিত হয় আর মেয়েরা হয় অহেতুক ছেলেবিদ্বেষী এবং লজ্জাশীল। সমাজে ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যকার বন্ধুত্বের উপর নিষেধাজ্ঞা তো রয়েছেই সেই সঙ্গে রয়েছে মানুষের শরীর গোপন এবং নিষিদ্ধ, শারীরিক কামনা চরিতার্থ করতে গেলে ছেলেরা মেয়েদেরকে ধর্ষণ করতে বাধ্য হয় যেহেতু বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা অনেক রক্ষণশীল এবং অসুস্থ। বাংলাদেশের অনেক বিদ্যালয়তেই gender-segregation বা লিঙ্গ পৃথকীকরণ ব্যবস্থা আছে যেটাতে ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে একই ক্লাসে বসতে পারেনা, কথা বলতে পারাটা আরো দূরের জিনিস।
আমরা বাংলাদেশের সমাজে ছেলে এবং মেয়েদের জীবন যদি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ছেলেরা কিশোর এবং মেয়েরা কিশোরী জীবনে পদার্পণ করে। ছেলেদের বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মেশার প্রবণতা সহ পর্নোগ্রাফি দেখার প্রবণতা এবং মেয়েদের শরীর নিয়ে চিন্তা করা শুরু হয় এই সময়কালেই, তারা মেয়েদের সঙ্গ পাওয়ার জন্য মনোঃকামনায় ভুগতে থাকে, আবার মেয়েদের জীবনেও এইসময় ঋতুস্রাব আসে, এবং তাদেরও ছেলেদের সঙ্গ পাওয়ার কামনা ওঠে; এই ছেলে এবং মেয়েদের উপরে সামাজিক নিষেধাজ্ঞা এতোই ভারি থাকে যে তারা চাইলেই একে অপরের সঙ্গ পেতে পারেনা। আবার অন্যদিকে আছে সত্যিকারের যৌন শিক্ষার অনুপস্থিতি যে ছেলে এবং মেয়েদেরকে যৌনতা বিষয়ক আসল এবং সত্যিকারের শিক্ষাটা দেবে।
আমাদের দেশের সমাজে চলা ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক ছেলের জীবনেই খৎনা বা মুসলমানি নামক বিধি চেপে ওঠে, কোনো ছেলের মুসলমানি হয় কিশোর বয়সের আগে আবার কোনো ছেলের মুসলমানি হয় কিশোর বয়সে। ছেলেরা এখানেও যৌনতার আঁচ নেয়, তারা পরবর্তী জীবনে এই মুসলমানির চিন্তা করেও যৌন ফ্যান্টাসিতে ভোগে, যেখানে মেয়েদের মুসলমানি করানোর নিয়ম আমাদের সমাজে নেই এবং অনেক মেয়েই ছেলেদেরকে ছোটো বয়সে উলঙ্গ দেখার সুযোগ পায়, উল্টোদিকে ছেলেরা মেয়েদেরকে ওভাবে পায়না, এভাবে ছেলেদের অবচেতন মনে মেয়েদের প্রতি অনেক কামনা এবং মেয়েদেরকে না পাওয়ার ফলে হতাশা জাগ্রত হয়।
ছেলেদের মেয়েদের প্রতি এবং মেয়েদের প্রতি যৌন উত্তেজনা জাগাটা অস্বাভাবিক কিছু না; জাগবেই কিন্তু এই যৌনতা বিভিন্ন সামাজিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আটকিয়ে রেখে দেশের সমাজে অনেক অশান্তি সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। ছেলে এবং মেয়েদের বন্ধুত্বটা সময়ের দাবী, এটা সমাজে এখনই চালু করা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনেক হতাশা অপেক্ষা করে আছে বিশেষ করে ছেলেদের জন্য।
বাংলাদেশের সমাজে ছেলেরা যৌনতা সম্পর্কে কি কি ভাবে জানতে পারে, প্রথমেই আসি ছেলেদের ছেলে বন্ধুদের ব্যাপারে, ছেলেদের বখাটে ছেলে বন্ধু থাকে, তারা বিভিন্ন পর্নোগ্রাফিক ভিডিও, অশ্লীল বই, হিন্দি বা পশ্চিমি চলচ্চিত্র থেকে যৌনতা বিষয়ে অস্পষ্ট জ্ঞান লাভ করে সেগুলো তাদের বন্ধুদের কাছে সরবরাহ করে; ছেলেরা পরে যৌন ফ্যান্টাসি এবং মেয়েদের সঙ্গ পাবার তাড়নায় ভোগে। কিন্তু বাস্তব জীবনের কাঠিন্য তাদের জীবনে অনেক দুশ্চিন্তা আর হতাশা নিয়ে আসে একটা পর্যায়ে। এবার আসা যাক মেয়েদের ব্যাপারে, মেয়েরাও অনেকটা ছেলেদের মতোই তাদের বান্ধবীদের কাছ থেকেই যৌনতা নিয়ে প্রাথমিক জ্ঞান প্রাপ্ত হয়, শুধু পার্থক্য হলো মেয়েরা বখাটে হয়না আর মেয়েরা সাধারণত পর্নোগ্রাফি দেখলেও ছেলেদের মতো অতো নেশাগ্রস্ত হয়না, মেয়েরা গর্ভ ধারণের মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে এবং ছেলেদেরকে ঘৃণা করা শুরু করে ছেলেদের পুরুষতান্ত্রিক এবং যৌন-আক্রমণাত্মক আচরণ সম্পর্কে অবগত হয়ে। এখানেই তো সমস্যা, একদিক দিয়ে ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গ চাচ্ছে এবং মেয়েরা ছেলেদেরকে ঘৃণা করছে, এই দ্বিমুখিতা আমাদের সমাজে কি রকম অশান্তি ডেকে আনে তা আমরা প্রায় সবাই জেনেও না জানার এবং না বোঝার ভান করি। অল্প কিছু ছেলে মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করতে সমর্থ হয় – এটা দেখে অনেক ছেলে যারা মেয়েদের সঙ্গ পায়না তারা হিংসা এবং বিষণ্ণতায় ভোগে।
প্রাকৃতিক ভাবে ছেলে এবং মেয়ে একে অপরের ওপর অনেক আকর্ষণ অনুভব করে এবং এই প্রাকৃতিক নিয়ম বাংলাদেশের সমাজে এখনো অস্বীকার করা হচ্ছে, ফলে সামাজিক ক্ষতি যা হবার তাই হচ্ছে। ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই যথাক্রমে হস্তমৈথুন এবং স্বমেহন করে, এখানেও রয়েছে নিষিদ্ধতা এবং ভয়, যদিও ছেলেরা ইচ্ছে মতো এই কাজটি করে বিশেষ করে বখাটে কামুক ছেলেরা। পর্নোগ্রাফি আমাদের সমাজে এখনো মানানসই নয়, এটা সামাজিক উদারপন্থা আসার পরে বৈধ করা যেতে পারে, এটা পরে দেখবার বিষয় কিন্তু এখন পর্নোগ্রাফি যেভাবে ছেলেদের চিন্তা-চেতনায় ঢুকে গেছে এবং ঢুকছে সেটা আমাদের দেশের মেয়েদের জীবনে অপূরণীয় মানসিক ক্ষতি ডেকে আনছে কারণ ছেলেরা এভাবে মেয়েদেরকে ভোগ্যবস্তু ভাবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক উজ্জ্বল নাম, তিনি প্রেমমূলক কবিতা, উপন্যাস লিখেছেন, তার লেখা বাংলাদেশের কতোজন তরুণ-তরুণী পড়ে? এই প্রশ্নের উত্তর খুবই সোজা, আজকালকার যুগের খুব অল্প তরুণ এবং তরুণীই রবীন্দ্রনাথের প্রেমমূলক লেখা পড়ে; রবীন্দ্রনাথ যদিও ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব নিয়ে সাহিত্য লিখেননি, তিনি লিখেছিলেন প্রেম নিয়ে, আমাদের সমাজে প্রেম-ভালোবাসা জিনিসটা কি সেটা মানুষ এখনো বোঝেনা ভাল করে। আমাদের সমাজ হচ্ছে শরীর-সর্বস্ব, কারণ সহজেই অনুমেয়, মেয়েদের সঙ্গে ছেলেদের মেশার নিয়মের অনুপস্থিতি এবং পুরুষতান্ত্রিক মতবাদ যে মেয়ে মানেই হচ্ছে ভোগ্যবস্তু, এখানে মেয়েরাও অনেক আছে যারা পুরুষতন্ত্রবাদে দীক্ষিত এবং এই মতবাদের ধারক এবং বাহক। প্রশ্ন আসতে পারে যে, নারী হয়ে কিভাবে পুরুষতান্ত্রিকতাবাদে দীক্ষিত হয়; সবই সম্ভব, নারীরা পুরুষদের পদতলে আত্মসমর্পণ করে, তারা রক্ষণশীল মতবাদে দীক্ষিত হয়, তারা নতুন প্রজন্মের মেয়েদেরকে রক্ষণশীল দীক্ষা দেয়। নারীরা পুরুষদের বিধানে তৈরি পোশাক পরে।
এবার আসা যাক বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গে, ঢাকায় বলুন, আর ঢাকার বাইরে বলুন, বিশ্ববিদ্যালয় বা ডিগ্রী কলেজ লেভেলের মেয়েরা তাদের সহপাঠী ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, কিন্তু এই বন্ধুত্বটা কি সত্যিকারের বন্ধুত্ব? এবং এই বন্ধুত্বটা কতোদূর আগায়, এই বন্ধুত্বে কি যৌনতা অবদমিত নয়, এই বন্ধুত্বটা কি নামেমাত্র নয়, এই বন্ধুত্বের মধ্যে কি পুরুষতান্ত্রিকতা নেই, এই বন্ধুত্বের স্থায়ীত্ব কতো কাল; এমন আরো বহু প্রশ্ন জাগে মনে, বাংলাদেশের মতো একটি রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা সম্পন্ন দেশে ছেলে এবং মেয়ের বন্ধুত্ব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হয়, যদিও এই বন্ধুত্বটা ঋণাত্মকতাবাদী, কারণ মেয়েদের সঙ্গে ছেলেদের আজকাল তুই তুকারি সম্পর্ক থাকলেও এটাতে অনেক কিছুই অবদমিত হিসেবে থেকে যায়, এবং যাচ্ছে; ছেলেরা তাদের ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে যতোটুকু স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারে মেয়েদের সঙ্গে ওভাবে পারেনা। ছেলে এবং মেয়ের মধ্যকার বন্ধুত্ব বিংশ শতাব্দীর আগে পৃথিবীর কোনো দেশেই ছিলোনা; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিমি দেশগুলোতে আন্তঃলিঙ্গ বন্ধুত্ব চালু হয় এবং এখন এটি একটি প্রতিষ্ঠিত অবস্থানেই আছে। আমাদের দেশ এখনো ছেলে এবং মেয়ের বন্ধুত্বের ব্যাপারে রক্ষণশীলতা অবলম্বন করে, যে দেশের সমাজে যৌনতা নিষিদ্ধ, যে দেশের সমাজে ছেলেরা কামুক হয়ে যায়, যে দেশের সমাজে মেয়েদের যৌনতা এবং শরীর রক্ষণশীল এবং পুরুষতান্ত্রিক যাঁতাকল দ্বারা আটকানো সে দেশে ছেলে-মেয়ের বন্ধুত্ব আসলেই খুব কঠিন একটা বিষয়।
এমন যুগোপযোগী বস্তুনিষ্ঠ লেখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
বেশ লিখলেন।
আপনার পোষ্টের সাথে প্রায় আমি একমত।
আপনি কি অবাধ যৌনাচারকে সমর্থন করছেন?যদি কিশোর এবং কিশোরীর মধ্যে অবাধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তবে অপ্রত্যাশিত সন্তান জন্মদান অসম্ভব কিছু নয়।যেখানে কিশোর-কিশোরীর কেউ-ই মানসিকভাবে পূর্ণাংগ পিতা-মাতা হবার উপযুক্ত নয়। কৈশোরে একজন কিশোর কিংবা কিশোরী ভবিষ্যৎ পিতা বা মাতা হবার উপযুক্ততা অর্জন করা শুরু করে মাত্র!
অল্প বয়সে গর্ভধারণ আমি সমর্থন করিনা, আমি সেরকম কিছু বলিনি, পশ্চিমি সমাজে যৌনতা অবদমিত নয়, স্কুলে পড়া অবস্থায় কিশোররা কিশোরীদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্মতিতে যৌন সম্পর্কে জড়ায়, এক্ষেত্রে মেয়েরা কিন্তু সবাই গর্ভবতী হয়না; আমি যদিও পশ্চিমি সমাজের সব কিছু অনুকরণ করার পক্ষে নই, কিন্তু যৌনতা যে সমাজে অবদমিত থাকে এবং নারীশরীর যে সমাজে নিষিদ্ধ সে সমাজের ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গ না পেয়ে কি কি করে তা আপনার জানার কথা, দেখেছেন না, কামুকতা, বলাৎকার, মেয়েদেরকে নিয়ে ঋণাত্মক মন্তব্য সহ আরো অনেক কর্ম বাংলাদেশের সমাজে দেখা যায়, এই সব কিছুর পেছনে নারীদের সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুপস্থিতিই কাজ করে। বাংলাদেশের মেয়েরা এখনো উন্নত দেশগুলোর মেয়েদের চেয়ে অনেক অনেক পেছনে পড়ে আছে।
অবদমিত যৌনতা বিশিষ্ট সমাজে ধর্ষণ হয় সেটা আপনারও বোঝার কথা আর বাংলাদেশের সমাজের মানুষ প্রেম জিনিসটা বোঝেনা এটা বলতে আমি বুঝিয়েছি যে বাংলাদেশ এখনো এক্ষেত্রে পরিপক্কতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি, এখনো বাংলাদেশের সমাজে প্রেম নিষিদ্ধই বলা যায়।
ভাল লিখেছেন।
আমার লেখাটিকে আমি তখনই সার্থক মনে করবো যখন পাঠকরা আমার এই লেখাটির আসল উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে পারবে।