অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

“WHAT A JUMBLE! What a jumble! I must tidy up my mind. Since they cut out my tongue, another tongue, it seems, has been constantly wagging somewhere in my skull, something has been talking, or someone, that suddenly falls silent and then it all begins again—oh, I hear too many things I never utter, what a jumble, and if I open my mouth it’s like pebbles rattling together. Order and method, the tongue says, and then goes on talking of other matters simultaneously—yes, I always longed for order.”

Albert Camus (The Renegade)

ছবি: ইন্টারনেট থেকে

ভিটে-মাটির টান বা শিকড়ের মায়া – জীবনের দ্বন্দ্বময়তা বা পরিত্যক্ত স্মৃতিঘর – সত্যজিতের সঙ্গীতাবহ বা ঋত্বিকের বাস্তবতন্ত্র ইত্যাদি সমস্ত কালযাপনের অন্তরালে লুক্কায়িত আছে একটি বোধ যা ধারণ করে রেখেছে (ছিল?) আদি ও সনাতনের প্রতিমূর্তিটিকে । সহজ-সরল, শান্ত, নিয়ন্ত্রিত ও অনুমেয় যাপনের স্বজ্ঞা যার আধার । বাহ্যিকরূপে বহুমাত্রিকতার সতত জটিলতর পরিবর্তন সাধনে তা বিবর্তিত হলেও তার অভ্যন্তরের আত্মাটি সদা-সর্বদা একটি শাশ্বত পরম্পরার মাতৃমূর্তিকে অর্ঘ্যপ্রদান করেছেই । একবিংশ শতাব্দি সেখানে যেন একটি ব্যতিক্রম । সে কোমলতর সেই আঁচলের আশ্রয়টিকে টেনে-ছিঁড়ে চৌচির করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত । রক্ত-ঘাম এক করে সকলেই যুঝে নিতে চাইছে, কখনোবা প্রতিহত করতে চাইছে সেই ছদ্মশক্তিকে । কিন্তু পেরে উঠছে না । আর তাই, সময়ের সঙ্গে অতীতজাত যা কিছু আচ্ছাদন ইতিউতি লব্ধ, মানুষের কাছে আজ সেসব প্রিয়তর হয়ে উঠছে ক্রমাগত । প্রকৃতপ্রস্তাবে, এই যে অমোঘ বিস্তার যা একুশ শতকের আকাশজুড়ে ক্রমবিবর্ধিত আঙ্গিকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে হয় তাকে ধারণ করতে হবে অন্য পন্থায়, নতুবা সে যাবতীয় অহেতুকতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে অতলস্পর্শী মহাশূণ্যে নিক্ষেপ করবে । মানবসভ্যতার ইতিহাসে আদিযুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ ও উত্তরাধুনিক যুগ পেরিয়ে একেবারে এই মুহূর্তে যে সময়বিন্দুতে মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে তাকে বিশৃঙ্খলার যুগ বলা যেতে পারে । এই যে যাত্রাপথ তা ক্রমোন্নয়নের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে ঠিকই কিন্তু তা একইসঙ্গে অতিমানবিকতর বুদ্ধিমত্তার শৃঙ্খলার গূঢ়ৈষার একটি প্রতিভূও বটে অর্থাৎ ‘জটিল’ শব্দ-বৃত্তের পরিধি থেকে সহস্র-অযুত আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত কোনও এক তীব্রতম অন্বেষা । বিশৃঙ্খলা বলতে আপাতভাবে বোঝানো হয় সেই তন্ত্রকে যা অপ্রত্যাশিত ও অনিশ্চিত ভঙ্গিতে আত্মপ্রকাশ করে । জনজীবনের রোজনামচায় একে বিভ্রান্তি বা ক্রমহীনতার আখ্যান বলে দাগানো যায় । একটি আবহ যা মননে ক্রমাগত জানান দেয় কোটি-কোটি উপায় ও উপাদানের, ইংরেজিতে যাকে নোটিফিকেশন বলে, এবং দিনের শেষে ক্ষমতা ও অক্ষমতার দ্বন্দ্বে অর্জিত হয় অথবা হয় না কিছু আনন্দ-অভিলাষ-উল্লাস কিংবা হতাশা-যন্ত্রনা-ক্রোধক্লান্তি । এই চেতনাস্তর যা, একদিকে ভোগসর্বস্বতার অভাবনীয় অতিব্যবস্থায় নিজেকে সঁপে দিয়ে মগ্নমুখর হতে চায় ও অন্যদিকে সব কিছু ছেড়েছুড়ে নিরালম্ব উপাসক হয়ে ত্যাগের একাকিত্ব চায়, তা জীবনের অন্ত্যমিলে জন্ম দেয় এক অচেনা-অপরিজ্ঞাত শ্রান্তির বোঝা । সর্বপরি চর্তুদিকে অন্তর্জলী সানাইয়ের উচ্চগ্রামে ধ্বনিত হয় একটি অনিয়মের প্রতিমান । সর্বত্র, অর্থাৎ, ধর্মজীবন-বিজ্ঞানচেতনা সকলই আবর্তিত হতে থাকে ভ্রাম্যমাণ উদ্দেশ্যহীনতার হিংস্র আঁতাতে যেখানে পৌরাণিক প্রোটাগনিজম-অ্যান্টাগনিজম বা অধিসত্ত্বাগত দ্বিষৎ মূল নিয়ন্ত্রকের মত করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যত হয় । এই চক্রাকার অভিসন্ধিই হল একুশ শতকের অভিধা, চেনাজানা অভিধানিকতা দিয়ে যাকে ব্যবচ্ছেদ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব ।

প্রসঙ্গক্রমে সেটা ’৭০-এর দশক । জেমস গ্লিক ও এডওয়ার্ড লরেঞ্জ আবিষ্কার করেন একটি নতুন তত্ত্ব । নাম দেন বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব বা ক্যাওস থিয়োরি (Chaos Theory) । মরিয়ম-ওয়েবস্টার অভিধানের মতে, Chaos-এর অর্থ হল the inherent unpredictability in the behaviour of a complex natural system । লক্ষ্য করার মত শব্দবন্ধটি হল, ‘inherent unpredictability’ অর্থাৎ সহজাত অনির্দেশ্যতা, অথচ এতটাকাল ধরে অনিয়মের মধ্যে নিয়মের সন্ধানই ছিল বিজ্ঞানের লক্ষ্য। কিন্তু যেখানে অনিয়মটাই সহজাত সেখানে নিয়মের রূপক অনুসন্ধানে গবেষণার অর্থ কী ? ওই যে প্রবন্ধারম্ভেই সংজ্ঞায়িত হয়েছিল ‘আপাতভাবে’ শব্দটি, তাকে খুঁটি করে রাখলে এই প্রশ্নের উত্তর হবে সোজা-সাপটা স্পষ্ট, যে কোনও অর্থ নেই কিন্তু ‘প্রকৃতভাবে’ বললে আছে নিগূঢ়তম অভিজ্ঞান, তা উপলব্ধি করা শ্রমসাধ্য ও দুরূহ হলেও বাহ্যিক দোলাচলে কাটিয়ে সে যে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই উন্মুখ। প্রত্যাশা, অনুধাবন, দূরদৃষ্টি ও অন্তিমে নিয়ন্ত্রণের যোগসূত্রটি রচনা করার মধ্যেই আছে নয়ানিয়মতন্ত্রটিকে ঠাহর করার বীজ । আর এটাই হল একুশ শতকের আসল পাঠতন্ত্র । গণিতের শাখায় যেমন ফাজি অ্যানালাইসিস বা অস্পষ্টতার বিশ্লেষণ, জীবনের মানচিত্রে তাই-ই সাতরঙের অসীম ছায়াযান বা ইনফাইনাইট শেডস অফ ভিভগিয়র ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল থেকে রাশিয়ার পতনের মধ্যে রোপিত হয়েছিল এই বর্তমানের ভবিষ্যতত্ত্ব । করোনা অতিমারি যাকে সুনিশ্চিততম অধ্যায়ে রূপান্তরিত করেছে । চারটি দশকজুড়ে যে উদার গণতন্ত্রের বিজয়কেতন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র বিশ্বে উড়িয়ে সুখ-সমৃদ্ধি-ঐশর্যের টেকসই স্বপ্নে বিভোর করে রেখেছিল মানুষকে এবং আড়ালে চালিয়েছিল মুক্ত বাণিজ্য ও অবারিত পুঁজিতন্ত্রের কুৎসিত একাধিপত্য, তা এখন সংপ্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে । বিংশ শতাব্দি থেকে একবিংশ শতাব্দি – এটাই হল অন্যতম মৌলিক উত্তরণের ইতিবৃত্ত । কী ছিল আর কী হল – এর মধ্যবর্তীকালে অবগুণ্ঠনের পরতে পরতে অবস্থান করে আরও একটি প্রশ্ন, কীভাবে হল । উনিশ শতকের শেষার্ধ অব্দি আদর্শবাদের বিড়ম্বনার দরুন উদ্ভূত উদারতান্ত্রিক নিরঙ্কুশবাদ জন্ম দিয়েছিল দুটি দ্বন্দ্বতায়িত শক্তির – বলশেভিক ও মেনশেভিক । বিশ শতকের গোড়াতে যা মন্থনরত সুর ও অসুরের নাট্যরূপ বলে প্রতিস্পর্ধিত হলেও তা পরমক্ষণে উন্মোচিত করেছিল ফ্যাসিবাদের পরাকাষ্ঠা । পারমাণবিক শক্তির নৃশংস আস্ফালনে সারা বিশ্ব যখন প্রাথমিকভাবে তটস্থ, তখন বিজ্ঞানভিত্তিক সময়ের ক্রমান্বয় তা রুখে দিয়ে ইতিহাসে বিরল দীর্ঘ ৭০ বছরের শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল । মানবিকতার অকল্পনীয় বিরাটত্ব নিয়ে আঁকড়ে ধরেছিল দুনিয়ার সমস্ত অস্তিত্বকে, অন্তত প্রকাশ্যে প্রকটরূপে । কিন্তু সেখানেও আদতে প্রচ্ছন্ন ছিল একটি উদ্দেশ্য, অর্থনৈতিক ঔদার্যের ছাতার তলায় বাজার দখলের মাধ্যমে চালানো অপার্থিব সাম্রাজ্যবাদের পাশাখেলা । ভোক্তাবাদের নির্বন্ধাতিশয় বিপ্লবের দরুন সমগ্র বিশ্বে জাগ্রত হয়েছে ব্যক্তিতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের দাদাঠাকুরপনা যা এখন একেবারে শেষ করে দিয়েছে আদর্শবাদের চেতনাটিকে । একে পতন হিসেবেও দেখা যায় আবার উত্থান হিসেবেও । পতন এই হিসেবে যে মানবজীবন তথা সমাজের মাধ্যাকর্ষণ বলটি এখানে আর কার্যকরী নয় যার ফলে ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বাতন্ত্রবোধের মধ্যে থাকা অন্তর্বস্তুটি অন্তর্ধান করেছে । আর উত্থান এই হিসেবে যে, মহাবিশ্বের অনৃজু স্থানিক-সময় তলে মানবের সমগ্র সত্ত্বাটি এখন গতায়াতে খুঁজে চলেছে অস্তিত্বের পরম কণা । সহজভাবে বললে, নিউটনীয় সারল্য থেকে আইনস্টানীয় জটিলতায় দৈনিক যাপন পরিবৃত্তি লাভ করেছে । ‘সর্বজনীন সমজাতীয় রাষ্ট্র’-এর যে-ধারণায় মানুষকে বিশ্বাসী করে গড়ে তোলা হয়েছিল যেখানে স্বাচ্ছন্দ্যময়তা, সমৃদ্ধি, সন্তুষ্টি ইত্যাদি অব্যবস্থচিত্ত প্রস্তাবের আড়ালে ছিল খোলা ও সাধারণ বাজার তৈরির উদ্দেশ্য অর্থাৎ কিনা চিরকালীন বিরোধ ও দ্বন্দ্বময় প্রাকারে, তা মুনিব-দাস হোক বা সর্বহারা-পুঁজিবাদী কিংবা প্রকৃতি-প্রাকৃত, নির্দিষ্টকৃত মানুষের অস্তিত্ব সন্ধান ও প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, সেখানে এক উদ্ভট আত্মজ্ঞানবাদ প্রাধান্য লাভ করেছে । মালিক-শ্রমিক, শোষক-শোষিত প্রভৃতি সবই এক্ষণে বেমালুম হাফিস হয়ে গিয়ে পরিচয়হীনতার সাকারত্ব বিশেষরূপে প্রতিশ্রুতির মঞ্চসজ্জা করছে । মানুষ খুঁজছে কয়েকটি বিশেষ ধারণা, যেমন, (১) সম্ভ্রমের রাজনীতি (২) অস্তিত্বের অন্য সত্ত্বা (৩) গণতান্ত্রিক বিচিত্রতার মধ্যে স্বাতন্ত্রবাদ (৪) ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরে অন্য মুক্তির আস্বাদ (৫) অবাস্তববাদী বাস্তবতা (৬) ক্ষমতায়ণের স্বাধীনতর প্রকাশমাধ্যম (৭) মিথ্যারহিত অগ্রদূত (৮) অধিকারের কৌলিন্যহীনতা (৯) স্বজ্ঞাপ্রবণ বাগ্মিতা ইত্যাদি

ইতস্তত বিক্ষিপ্ত যে সমস্ত লক্ষণগুলি একুশ শতকে অপরিচিত এক শক্তির টানে যেভাবে একত্রিত হচ্ছে তাতে আপাতত আবছা হলেও ক্রমশ স্পষ্টতর আকারে একটি অবয়ব ধারণ করবেই । ভারতবর্ষে নয় শুধু, সমগ্র বিশ্বেই এই পরিবর্তনের দিগন্তরেখা নিকটবর্তী । গণতন্ত্রের বেনজির পতনের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে রাষ্ট্র নয়, বরং তার চেয়েও শক্তিশালী কোনও শক্তি এখন নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ যার সম্মুখে বা যাকে পূর্বাভাসের দ্বারা নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব । কেননা তার সময়সারণির অন্তরগুলি নিতান্তই ক্ষুদ্র আর পরিবর্তনের হার তীব্র । বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব অনুযায়ী ‘বাটারফ্লাই এফেক্ট’-এর যা রহস্য জীবনের চলমানতায় সেটাই এখন প্রযোজ্য হয়েছে । অর্থাৎ মানবসভ্যতা একুশ শতকে রৈখিক বা লিনিয়ার পরিবর্তনের রুজ্জুপথে নয়, সূচকীয় বা এক্সপোনেনসিয়াল তাৎপর্যে ধাবমান । সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিমাপের মানের সামান্যতম বদল বা দিকভ্রান্ততার ফল এখানে বহুগুণে বৃহত্তর ।

প্রথমেই ধরা যাক ইতিহাসগত পরিবর্তনের ধারাটিকে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবী ছিল মূলত একমেরুকেন্দ্রিক । সেই মেরুই সেখানে সমস্ত নিয়ন্ত্রণের হোতা । কিন্তু সেই নায়কের সিংহাসন টলোমলো করছিল বহুদিন । করোনাকালের আগমণ তাকে যেন প্রায় ভেঙে ফেলে দিয়েছে । মার্কিনি অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের একাধিপত্যের অবসানে নিহিত আছে একটি অন্য উত্থানের উপন্যাস । ২০১২ সালে যখন জাই জিনপিং চিনদেশের ক্ষমতাসনে অধিষ্ঠিত হন তখন তিনি চিনের সামনে যে দুটি লক্ষ্য রেখেছিলেন তার দ্বিতীয়টি ছিল ২০৪৯ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ উন্নত, ধনী এবং সর্বশক্তিমান দেশ হিসেবে চিনের জয়ধ্বজা প্রতিষ্ঠা । ১৭ই জুন, টাইমস নাও-এর একটি প্রতিবেদন “South China Sea, Taiwan, Hong Kong, Ladakh – Is the dragon stretching itself in too many directions?” –এ লেখা হয়েছে, “Xi, it appears, has made up his mind that 2020 is the year when China will push the accelerator on its road to global dominance. With the pandemic wreaking havoc around the world, Beijing sees this as a once-in-a-generation opportunity to make rapid territorial gains and become the undisputed hegemon of Asia, from where it can then look at the ultimate prize – challenging the US for sole superpower status” । সুতরাং, জিনপিং-এর এই লক্ষ্য যে দিবাস্বপ্ন নয় সেকথা এখন সুস্পষ্ট হয়ে গেছে । এবং এর মধ্যে দিয়েই ক্ষমতার একমেরু মুরুব্বিয়ানা ধ্বংস হয়ে সূচনা করেছে দ্বিমেরুর কিংবা নির্দিষ্টভাবে বলা হলে বহুমেরুর । এই দুই শক্তির মধ্যে বোঝাপড়ার দিন শেষ । আর এই সুযোগে সমগ্র দুনিয়া এখন মার্কিন আধিপত্যের অনুসরণ ছেড়ে চৈনিক প্রযুক্তিবিজ্ঞানের অংশীদারিত্বের দাবিদার । ইত্যবসরে রাশিয়া, ব্রাজিল, ইউরোপ ও ভারতবর্ষও নিজেদের বিশাল বাজারের দিকে আকর্ষণ করে পুঁজিকে দখল করার লড়াই চালাচ্ছে । মার্কিনিরা সেখানে কিছুতেই যে আর টিকতে পারছে না একথা অনুধাবন করা আর কঠিন নয় । বৈশ্বিক ধনসম্পদ ও ক্ষমতা যেন সভ্যতার শুরুর দিনগুলি অর্থাৎ ব্যবিলনীয়-আসুরীয় সময়ের বিন্দুতে কোনভাবে মিলিত হয়ে বৃত্ত সম্পূর্ণ করে এশিয়াকেই পুনর্বার সম্রাটের মর্যাদায় ভূষিত করতে চায় । মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবও এখন নিজের এলাকা বিস্তারে যথেষ্ট তৎপর । ফলে শক্তি এখন আর সহজ সরল এককেন্দ্রিকতায় স্থির নেই, বৃত্তের ভিতর বৃত্ত, তার বাইরের পরাবৃত্ত ও অন্য কোনও অধিবৃত্তের অদ্ভুত সংমিশ্রণে এখন তা দোদুল্যমান । একে দুনিয়াব্যপী বিশৃঙ্খলতা ও দ্বন্দ্বময়তার জন্য যথেষ্ট শর্ত বলা যায় ।

দ্বিতীয়ত প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতি সমীহ করেই বর্তমানের পুঁজি দিশা নির্ধারণ করে । পিটার ফ্রাসের ‘Four Futures: Life After Capitalism’, মিশিও কাকুর, ‘The Future of the Mind: The Scientific Quest to Understand, Enhance, and Empower the Mind’ ও রেই কুরজয়েলের ‘The Singularity Is Near: When Humans Transcend Biology’ ইত্যাদিতে একটি করে ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন আছে । তা হল ইতালিয় রেনেসাঁসের প্রভাবে যে মানবতাবাদ এতদিন দুনিয়াকে বেঁধে রেখেছিল, তার দিন সমাগতপ্রায় । নয়া যুগে মানবতাবাদ নয়, ট্রান্সহিউম্যানিজম, রোবোটিক্স ও আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মধ্যে দিয়ে সভ্যতার রথের চাকা গড়াচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে । ফাইভ-জি আন্তর্জালিক স্পৃহা যাকে দিচ্ছে ক্লাউডের বাস্তবতা । আর এটাই নয়া শ্রমের সংজ্ঞায়ন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । একে হয় গ্রহণ করতে হবে, প্রতিটা মুহূর্তে নিজের মেধা, জ্ঞান ও কর্ম সক্ষমতাকে আপডেট করে চলতে হবে । জীবনে লাইফ ইনস্যুরেন্সের শান্তির যুগ পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হচ্ছে বা হয়ে গেছে । নিজেকে অতীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখার অর্থ বর্তমানে স্রেফ বাতিল হয়ে যাওয়া । কেননা পুঁজি যেখানে স্বশাসিত বাজার সৃষ্টি করতে ও তার দাবি মেটাতে সক্ষম সেখানে মানবিক শ্রমের অধিকারের পুঁথি অবশ্যই মূষিকখাদ্যমাত্র । আসলে দুনিয়া সংকুচিত হচ্ছে, কিন্তু তার আদলটা বহরে ক্রমবর্ধমান । এমতাবস্থায় বিভ্রান্তি ব্যতীত অন্য কোনও সম্ভবনার স্থান নেই ।

তৃতীয়ত, এই যে অবস্থা সেখানে সামগ্রিক সমতার প্রতি দায়বদ্ধতা প্রায় কারও নেই । অসাম্যের বিশ্বরূপদর্শনেই যুদ্ধের পন্থা নির্ণয় করতে হবে । উদার গণতান্ত্রিকতার সঙ্গে কর্পোরেট শক্তির বোঝাপড়া হয়ে গেছে বহু আগে, তা মানুষ মানুক বা না মানুক । নির্বাচনের অধিকার এখানে একটি সাদা ভাঁওতামাত্র । তাকিয়ে দেখলেই বিভিন্ন রাষ্ট্রের নেতা বা নেত্রীদের আচরণে তার রাখঢাক নেই । দক্ষিণপন্থা ও বামপন্থা – কোনও একটারও গ্রহণযোগ্যতা বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই । মানুষ চৈতন্যরহিত কখনও এদিকে কখনোবা ওদিকে দৌড়দৌড়ি করছে । দারিদ্র, মৌলবাদ, সন্ত্রাসী হামলা, দৈনন্দিন হিংস্রতাবৃদ্ধি, অসহিষ্ণুতা, বেকারত্বের সমস্যা ইত্যাদি যেমন বেলাগাম, অন্যদিকে বিপন্ন স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া ও নিরাপত্তার আশ্রয়হীনতার মধ্যে প্রায় এমন এক সময়ের যাত্রাপথ স্থির হয়েছে যে অর্থ, প্রতিপত্তি ও বিলাসের কতিপয়তন্ত্রের সূর্য মধ্যগগণে । তথ্য বলছে, ১৯৮৯ সালে যেখানে ১০% মার্কিনির দখলে থাকত ৬১% সম্পদের অধিকার, সেখানে বর্তমানে তা প্রায় ৭০% তে পৌঁছে গেছে, আর দরিদ্রদের মধ্যে ৫০%এর হাতে আছে মাত্র ১% সম্পদ । বাকিটা মধ্যবিত্তের মারামারির বিষয় । সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের এই লজ্জাহীন দূরত্ব জনসমক্ষে একটি নিরূপায়ভাব ছাড়া কিছুই বাকি রাখছে না । সেখানে একুশ শতকের রাজনৈতিক ক্ষমতার বহুমেরুত্বপ্রাপ্তি ও প্রযুক্তিবিজ্ঞানের রাজমুকুট অস্থিরতা ছাড়া কীইবা নিশ্চিত করবে !! এ যেন একেবারে ব্রাউনিয়ান মোশন । গণতন্ত্র-গণতন্ত্র বলে চেঁচামেচি করা নিরর্থক সেখানে, মানুষ ক্রমাগত অশান্তি-অসন্তুষ্টি-বিক্ষুব্ধ হওয়া ছাড়া কিছুই হাতড়ে পাচ্ছে না ।

আর এভাবেই একুশ শতক পরিণত হচ্ছে বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি ও দ্বন্দ্বময়তার যুগে । পঞ্চাশবছরব্যাপী যে একমেরু শাসনের শৃঙ্খলে দুনিয়া আবদ্ধ ছিল বর্তমানে বহুমেরুকরণের প্রভাবে তা বাধ্য হচ্ছে অন্যত্র বানিজ্যসম্পর্কস্থাপনে কর্তৃত্ববাদের বদলে সুর মোলায়েম করতে । ফলত জনমানসেও এর অবস্থান্তর লক্ষ্য করা যাচ্ছে । মানুষের সচেতনতা ভোক্তাবাদের মাধ্যমে আবার এগুলিকেও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পাচ্ছে । আবার অপার্থিব সামাজিক মাধ্যমগুলির দ্বারা ভোক্তাবাদকেও সচতুরভাবে পরাজিত করার চেষ্টা চলছে । ফলে দুশ্চিন্তা, অননুমেয়তা ও ধ্বংসবাদের পেয়াদারা নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধরত অবস্থায় অগ্রসরমান । এটাকে ক্যাওস ছাড়া আর কী বলা যায় ? বোঝাই যাচ্ছে না হচ্ছেটা কী, অথচ সময় এগিয়ে যাচ্ছে, চারপাশ বদলে যাচ্ছে এবং প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন খেয়াল এসে দক্ষতাকে প্রতিস্থাপন করে দিচ্ছে । সেখানে একটি ‘সামান্য কম ঠিক’ সিদ্ধান্ত জীবনের গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে দিচ্ছে। ফ্রেডেরিক কুও-এর মতে,

“The rising chaos of external factors such as great-power competition that many societies will face in this less stable world order will be matched by the rising chaos of internal factors driven by technological disruption, political dysfunction and increasing social inequality. As technological progress continues unabated with the unprecedented advancement of artificial intelligence, connectivity and automation, the threat of social displacement and an extrapolated rise in wealth inequality is real. Combined with frustration over the paralysis of our political systems and social division, the catalyst for chaos and disorder is potent. What this means is that the forces that have already begun gnawing against the foundations of liberal democracy will be significantly reinforced. Unfortunately, aside from marginal voices like Democratic presidential hopeful Andrew Yang, who advocates that Universal Basic Income be instituted to combat rising automation, public discourse has barely even begun to grasp the significance of these issues on the future of the societies we live in”

ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের মাধ্যমেই যদি সাধারণ্যে যাপিত হয় জীবনের সার্থকতা, তাহলে সেই আদ্যোপান্ত সময়কে শান্তির বার্তাবাহক বলে দাবি করার স্পর্ধা কারও কি আছে, সংশয় হয় । আর শুধু সংশয় কেন, সেখানে অন্তর্নিহিত সত্যের জিঘাংসাবৃত্তিই প্রকৃত ভাব ও ভঙ্গিমার বাস্তবতা ।

মুক্তমনার ব্লগে পাঠতন্ত্র নিয়ে যে কয়েকটি ধারাবাহিক লিখেছি সেই পাঠতন্ত্রই হল এই সময়কে উপলব্ধির স্মারক । কিন্তু ক’জন আগতপ্রায় মুহূর্তলোকে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন ? পাঠের মহিমাও এখন তাই অন্য অর্থে ধীশক্তি লাভ করেছে । রুচি-অরুচির প্রসঙ্গ নয়, কথাটা হল তাকে অনুমান করার ধারণা । এবং সেইমত স্ব-আরোপিত উন্মুক্তমার্গকে শান দেওয়া । বাঙালির পাঠতন্ত্রে ব্রিটিশ প্রভাব সর্বাধিক, সেজন্যেই ফরাসীয় অনুজ্ঞাকে কিছুটা বাধো-বাধো ঠেকে – তাকে এতদিন সযত্নে এড়িয়ে চললেও ক্ষতি হত না – কিন্তু এখন শুধু তা নয় চৈনিক, রুশীয়, আরবিক, স্প্যানিশ, জাপানি ইত্যাদিতে মনঃসংযোগ করাও যথেষ্ট নয়, শিখতে হবে ডিপ লার্নিং, নেটওয়ার্কিং ও কোডিং-এর যুক্তিতন্ত্রকে । সেটাই হল নতুন ভাষার পাঠতন্ত্র যা মানবসভ্যতাকে যন্ত্রমানবের দাসত্ব থেকে পরিখার মাধ্যমে রক্ষা করতে সক্ষমতা দেবে । বিশৃঙ্খলা তত্ত্বের নিয়মকানুনকে – কঠোর হোক বা নৃশংস – অধ্যাবসায়ের দ্বারা উপলব্ধি করতেই হবে । পরিবেশ সচেতনতার সঙ্গে পরিবার সচেতনতার কথাটিকেও জোর দিতে হবে । প্রয়োজনে কর্তা বা কর্ত্রীকেন্দ্রিকতার বাইরে বেরিয়ে এসেই বৈশ্বিক পরিবারের ধারণাতে সম্মতি দিতে হবে । বিস্মৃত হলে চলবে না যে একবিংশ শতাব্দি ভুলিয়ে দিতে চায় যে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, তাকে রুখে দেবার মধ্যেই আছে আদি-প্রবৃত্তির সংরক্ষণ যা প্রকৃতই সুখের পক্ষে বন্ধুত্বর হাত বাড়িয়ে রেখেছে । নইলে এই আপামর বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তিতে মানুষ নিজেই হয়ে উঠবে নিজের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন । মেরি শেলি লিখেছিলেন, “Even broken in spirit as he is, no one can feel more deeply than he does the beauties of nature. The starry sky, the sea, and every sight afforded by these wonderful regions, seems still to have the power of elevating his soul from earth. Such a man has a double existence: he may suffer misery, and be overwhelmed by disappointments; yet, when he has retired into himself, he will be like a celestial spirit that has a halo around him, within whose circle no grief or folly ventures” । আর এই অভিনিবেশের সত্ত্বাটি নিমজ্জিত আছে অপার ও সার্বিক ভালোবাসার সাধনায় যা কিনা গ্যাদগ্যাদে অনুভূতির বিষয় নয়, তা আদতে হল পশ্চিমদিগন্তে যে ধ্বংসের আগুনের হলকা ক্রমে বিস্তারিত হচ্ছে তা থেকে নিজেদের রক্ষা করার উপায়মাত্র । অস্তিত্ববাদই হল সেখানে প্রকৃত মানবতাবাদী সংসাধন যাকে ব্যখ্যা করা যায় এই বলে যে, “If existence really does precede essence, there is no explaining things away by reference to a fixed and given human nature. In other words, there is no determinism, man is free, and man is freedom. On the other hand, God does not exist, we find no values or commands to turn to which legitimize our conduct. So in the bright realm of values, we have no excuse behind us, nor justification before us. We are alone, with no excuses” । তাই অন্তিম কথাখানি হল এই যে, “মনঃপ্রসাদঃ সৌম্যত্বং মৌনমাত্মবিনিগ্রহঃ / ভাবসংশুদ্ধিরিত্যেতৎ তপো মানসমুচ্যতে” – জটিলতার প্রাসাদে এই হল একুশ শতকের মানুষের প্রার্থিত ও কঙ্খিত শান্তির ভাষ্যরূপ । এখন কীভাবে তাকে স্থাপন করা যায় সেটার অনুসন্ধানই হল এই যুগের অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রাম, প্রকৃত পাঠতন্ত্র ।

শেষে বলতে ইচ্ছে হয়, কমলেশ পালের ‘জন্মদাগ’ কবিতার সুরে,

কখনও হারিয়ে গেলে জন্মদাগ দেখে চিনে নিও।

খাড়ি নদী হাতিয়া সন্দীপ গেঁয়োখালি
তরাই চড়াই খাদ সবুজ বর্ণালী
ভুলে যদি অকস্মাৎ ঘরমুখো না হই জননী-
বিজ্ঞাপনে নাম দিও,
উচ্চতা পোশাক দিও, গাত্রবর্ণ দিও
লিখে দিও :

ললাটে মায়ের চুমু অক্ষয় জড়ুল আঁকা আছে-
ছেলেটা বাংলা বলে, বাংলা ভাষা জন্মদাগ তার।

ধন্যবাদ ।

 

 

গ্রন্থসূত্রঃ
Identity The Demand for Dignity and the Politics of Resentment – Francis Fukuyama
Exile And The Kingdom – Albert Camus

তথ্যসূত্রঃ

https://en.wikipedia.org/wiki/Chaos_theory#:~:text=Chaos%20theory%20is%20an%20interdisciplinary,fractals%2C%20and%20self%2Dorganization.

https://en.wikipedia.org/wiki/The_End_of_History_and_the_Last_Man
https://www.scribd.com/book/438437305/The-Age-of-Confusion

https://en.wikipedia.org/wiki/Universal_basic_income