লিখেছেন: নার্গিস রশীদ

নতুন প্রজন্মের মেয়েরা অনেক এগিয়েছে। বিয়েটা তাদের কাছে এখন আর মুখ্য নয়। তাদের চিন্তা চেতনা, মনোভাবে এখন এসেছে আমূল পরিবর্তন। তাঁরা লেখাপড়া করে চাকরী করছে, ব্যবসা বাণিজ্য করছে, আয় করছে। জীবনটাকে বদলে নিয়েছে। তারা পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা অনেকটাই শিখেছে উন্নত দেশগুলোর নারীদের দেখে, যেখানে নারী একটু একটু করে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিয়েছে। বুঝতে শিখেছে যে শিক্ষার অভাবে, আয়ের পথ না জানার কারণে নারী হয়ে পড়ে দুর্বল, নৈতিক শক্তি তার কমে যায়, তারা দুর্বল হয়ে পড়ে মানসিক ভাবে ।আজকের প্রজন্মের মেয়েরা নবম শ্রেণীতে পড়তে পড়তে বিয়ের কথা চিন্তাও করতে পারবেনা কারন তারা এখন জানে যে এ’টা বাল্য বিবাহ । তাঁরা প্রতিবাদ করে। তাঁদের মা খালাদের সেই বয়সে স্কুল ফাইনাল না দিয়েই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত। তার পরপরই তাঁদের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া, একের পর এক চার পাঁচ দশটা সন্তানের জন্ম দেওয়া, স্বাস্থ্য হারিয়ে আজীবনের রুগী হয়ে পড়া, সেইসব হারাবার আর অসহায়ত্বের ব্যাথার সত্যি গল্প আজকের প্রজন্মের অনেক মেয়েই জেনেছে এখন। এই সবের খারাপ দিক বুঝে গেছে অনেকটাই। উন্নত বিশ্বেও এক সময় নারীকে ভাবা হত সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবেই। কোন মূল্য দেয়া হত না তাঁকে। তাদের হাতেও টাকা পয়সাও থাকত না তেমন। তবে প্রচুর সংগ্রাম করেই তারা তাদের অধিকার আদায় করেছে, আজ তাঁরা তাদের সম্মান সুরক্ষিত করেছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের মেয়েরা কম যাবে কেন?

সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব পালন করাটা একটা সার্বক্ষণিক বিশাল কাজ। একটা মেয়ে যদি সারাদিন ঘরের অন্যসব কাজ করে চলে তবে তার সময় কোথায় সন্তান লালনের? পুরুষরা কোন বাধা নিষেধ ছাড়াই তাদের পেশাগত কাজকর্ম করে যেতে পারে স্বাধীন ভাবে অন্য দিকে মেয়েদের জন্য অপেক্ষা করে সমাজের নানাবিধ বাধা। খন্ডকালীন শিশু লালন কেন্দ্র ভাড়ায় পাওয়া যায় বটে কিন্তু তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সংসারের আয়ের সবটাই প্রায় চলে যায় ওতে। দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা যেন একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে যে মেয়েরা শ্বশুর বাড়ী যাবে, ঘরের সব দায়িত্ব নিবে; কিন্তু ক্ষমতা থাকবে না কোন কিছুতে। অন্যায় এই ভাবনাটা স্বাভাবিক একটা ব্যপারে পরিণত হয়েছে যা থেকে বের হওয়া খুবই কঠিন।

ঘরের ভেতরে পারিবারিক নির্যাতন শুধু শারীরিকই নয়, অসম্মান অপমান করে মানসিক ভাবে নির্যাতন করে, অযথা পুরুষতান্ত্রিক অহঙ্কার দেখিয়ে নানা অনুশাসন ইত্যাদি ইত্যাদি করে অনেক ভাবেই করা হয় নারী নির্যাতন। বিয়ের সময়ে মেয়েপক্ষ থেকে বরপক্ষকে যৌতুক দেওয়া না দেওয়া নিয়ে অত্যাচার এ’সব তো আছেই।একটি মেয়ের বিয়ে যেন তাঁর পরিবারের নিজেদের টাকা পয়সা, সম্মান সম্পদ সবকিছু বরপক্ষকে উৎসর্গ করে আপন কন্যাকেই তাদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া।

উন্নত দেশগুলোর সমাজব্যবস্থায়ও মেয়েদের যন্ত্রনা খুব একটা কম নয়। পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতে স্বামী স্ত্রী দুই জন মিলে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খোলে সাধারণতঃ, দুই জন মিলেই সংসার চালায়, ঘরবাড়ীও কেনে দু’জন মিলেই। তবে সন্তানাদি হলে তাকে লালন পালন করতে যেয়ে সাধারণতঃ মায়ের যায় রোজগার বন্ধ হয়ে, গণ্ডগোল আরম্ভ হয় তখন । আমাদের উপমহাদেশের যারা বিদেশে আছে তাদের ব্যাপার অনেকটা এই রকম যে, স্ত্রীর আয় স্বামীরই আয়, স্ত্রীর সমস্ত আয় স্বামীকে দিয়ে দিতে হবে। তাঁকে বাচ্চা পালতে হবে, প্রতিদিন টাটকা রাঁধতে হবে, সকালে হাতে করা ফ্রেশ রুটি বানাতে হবে নাস্তার জন্য। ঘরের কাজে স্বামী হাত দিবে না । উপরন্ত যৌতুকও দিতে হবে । দেশ থেকে নারী, আমরা যারা প্রথবারের মত বিদেশে থাকতে এসেছি তাদের বেশিরভাগই হয়ত এসব মুখ বুজে সহ্য করেছে, কিন্তু নতুন প্রজন্মের মেয়েরা অথবা বিদেশে জন্ম নেওয়া আমাদের সন্তানরা তাদের মা’র সাথে হওয়া অন্যায়গুলো সহ্য করবে না। গণ্ডগোলও তখন অবধারিত।

আমাদের উপমহাদেশে, চীন, সাউথ এশিয়া আফ্রিকা এই সব এলাকার সামাজিক নিয়ম হল বাবা মা বুড়ো হলে তাদের ছেলের দায়িত্ব বুড়ো বাবা মা’কে দেখাশোনার। উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোতে সেটা কিন্তু ঘটে না সাধারণত। পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতে যারা আয় রোজকার করে, চাকরি করে, তারা বেতন নেবার সময় বিভিন্ন খাতে ট্যাক্স ছেড়ে দিয়ে তারপর বেতন নেয়। এই খাতগুলোর মধ্যে একটা হল সামাজিক নিরাপত্তা বা সামাজিক কল্যাণকল্প। বুড়ো বয়সে বা অবসরের পর খরচ করবার জন্য একটু একটু করে করা সঞ্চয় এখানেই জমা পড়ে। যারা অবসর জীবনে আরো ভালো থাকতে চায় তারা আলাদা করে অবসর তহবিলে আরো একটু একটু করে টাকা জমায়, উদ্বৃত্ব টাকা থাকলে ইন্সুরেন্স বা বীমা কেনে অবসর জীবনের জন্য। বুড়ো-বুড়ি বয়সে নিজের জন্য খরচ করবার টাকা কম বেশি কিছুটা জমা থাকায় আর চিকিৎসা, কম খরচে খাবার, বাসস্থানের মত সরকারি আরো কিছু সুযোগ সুবিধা থাকায় বুড়ো-বুড়িদের তাদের সন্তানদের উপর নির্ভর করতে হয় না। এখানকার সমাজও এমন ব্যবস্থা অনুসরণ করে আর তেমন আচরণও আশা করে। আমাদের জন্মভূমিতে এই রকম ব্যবস্থা থাকলে ছেলের দয়া দাক্ষিণ্য দরকার হত না। আমাদের দেশে যদি সবার জন্য এমন সামাজিক বাবস্থা থাকত তা’হলে কারো উপরেই নির্ভর করতে হত না। ছেলে সন্তানের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত একজন নারীকে বার বার সন্তান প্রসবের মত বিপজ্জনক কষ্টকর কাজটাও করতে হত না। এখন তো চীন জাপান পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও নানান ধরণের সামাজিক নিরাপত্তা বা সামাজিক কল্যাণকল্প হয়েছে, তারাও চাচ্ছে সুন্দর ছোট সংসার।

আমাদের দেশে বিয়ে মানেই মেয়েটির জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা। দেশে একটা মেয়েকে শারীরিক আর মানসিক ভাবে বড় হওয়ার আগেই বিয়ের মত এতো বড় একটা ব্যপারে ঠেলে দেয়া। বর মানুষ’টা যদি মন্দ হয় তখন মেয়েটার জীবন হয়ে যায় দু:সহ। স্বামী হয় আগুনে পুড়িয়ে মারবে , গলা টিপে মারবে, এসিড দিয়ে ঝলসে দেবে, কুপিয়ে মারবে আর না হয় ফাঁসিতে লটকে দিবে, নয়তো এসব থেকে বাঁচতে অপমানে লজ্জায় মেয়েটিই হয়ত আত্মহত্যা করবে। মেয়েদের শৈশব, কৈশোর লেখাপড়া আনন্দ সবটাই কেড়ে নেওয়া হয় তার কাছ থেকে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেওয়া হয়না তাঁকে, পর করে দেওয়া হয় মা বাবাকে, এই-ই তো আমাদের সমাজ। এটাই গড়পড়তা একটি সাধারণ মেয়ের জীবন সেখানে। বিপদে সে কোথাও যেতে পারে না, সমাজ তাকে গ্রহণ করে না, সব দোষ সেই নারীর ঘাড়ে এসে পড়ে। আমাদের জন্মভূমিতে মেয়ে হয়ে জন্মানো আজও এক আজন্ম পাপ।

আমাদের দেশে অনেকেই মনে করে পশ্চিমা দেশের মেয়েরা সংসারী নয়। সামান্য কারণে ঘটে বিবাহ বিচ্ছেদ। সত্যি নয় সেটা। সংসার কেউ সহজে ভেঙে দিতে চায় না। পেশী শক্তিতে অনেক পুরুষই সব দেশে একই রকম। আগে এখানকার মেয়েরাও আমাদের দেশের নারীদের মতোই অসহায় ছিল। ধীরে ধীরে তাঁরা শক্তি অর্জন করেছে। তাই পুরুষরা তাদের স্বভাবজাত কারণে বাড়াবাড়ি করলে মেয়েরাও ছেড়ে কথা বলে না। ঘটে বিবাহ বিচ্ছেদ। তবে মেয়েরা যে এদিক সেদিক কিছু কান্ড ঘটায় না সেটাও সত্যি নয়। এখানে সাধারণত সবাই সমান অধিকারের চর্চা করে।

বিলাত, ইউরোপ আমেরিকায় বা উন্নত দেশে এসে বসবাস করতে হলে, মূলধারার পেশায় চাকরি পেতে হলে বা সমাজের সত্যিকারের কার্যকর কেউ হতে হলে জানতে সে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। জানতে হবে সেখানকার রাজনৈতিক কাঠামো ও বুঝতে হবে রাষ্ট্র ব্যবস্থা। নানান জাতের মানুষ, তাঁদের ধর্ম বর্ণ সহনশীলতা সহমর্মিতা ভাল করে বুঝতে হবে। ভাষা যথাসম্ভব জানতে হবে। অন্যকে ছোট করলে চলবে না । দূর বিদেশে আমাদের বংশোদ্ভূত নতুন প্রজন্ম একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ধারনা নিয়ে বড় হচ্ছে, বসবাস করছে, তাদেরকে বাংলার বা বাংলাদেশের গোঁড়া ধ্যানধারণা নিয়ে সেই চোখে দেখলে হবে না। তাদের চিন্তা চেতনা মনন সবকিছুই অন্য রকম, শুধু দেশি কথা দিয়ে ধর্মের হেদায়েত দিলে সেটা হাস্যকর ও অকার্যকর হবে। জোর খাটালে তাঁরা দেশি প্রায় সবকিছু থেকেই দূরে সরে পড়বে। গোঁড়া অভিভাবক যারা দেশ থেকে এক ধরণের পূর্ব ধারণা বা ভাবনা নিয়ে উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোতে আসেন তারা তাদের সেই ভাবনা দিয়ে ছেলেমেয়ে চালাতে চাইলে বিপদ হবে। মেয়েরা তাদের অধিকার জানে। শেখে তারা। স্কুল থেকেই শেখানো হয় ছেলে মেয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। সমান অধিকার, সমান সুযোগ ইত্যাদি শিখতে শিখতে বড় হয় ওরা। ছেলে মেয়েরা মা বাবার অন্যায় জোর খাটানো বা যুক্তিহীন কথা মেনে নিবে না, পুলিশ ডাকতে পারে তারা, আর আইন তাঁদের দেবে আশ্রয়।

বাংলাদেশের সামাজিক নিয়ম নীতি হল মেয়ের ঘরের সন্তানরা মেয়েটির বা নানা’র বংশের নয় অথচ ছেলের ঘরে জন্মানো সন্তানরা ছেলেটির বা দাদা’র বংশের হয়। এক অদ্ভুত নিয়ম। বাবার সম্পতিতে মেয়ের অংশ ছেলের অংশের অর্ধেক বা আরো কম, অথচ সন্তানরা মা বাবা’র আধাধধি ডিএনএ নিয়ে জন্মায়। তবু নারীদের সাথে করা হয় এসব অন্যায়। সম্পত্তি ভাগের এই ব্যবস্থাও একটা মেয়েকে অসম্মানের সাথে নিচু করে দেয়। এটা কোন ধরনের বিচার? এ রীতিমতো অবিচার । সামাজিক অন্যায়গুলো মেয়েদেরকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেই চলে।

উন্নত পৃথিবী সমাজ আরও বদলে গেছে, অবিরাম উন্নতি করছে, তাঁদেরও মানসিকতায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আমাদের দেশের সমাজকে, মানুষকে, নারীকেও বদলাতে হবে। মানসিকতা পরিবর্তন করতেই হবে। মানুষ এখন ভাল করেই ভাবতে শিখেছে।

উন্নত দেশগুলোতে আছে স্বামী-স্ত্রীর আধাআধি অংশীদারিত্ব আর ভারতীয় উপমহাদেশে আছে যৌতুক সমস্যা জর্জরিত সংসার।বিদেশে, এখানে সংসার অনেকটা যেন এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। বিয়েটা সেই প্রতিষ্ঠানের চুক্তিনামা। এই সব দেশগুলোতে বিয়ে নামের চুক্তি ব্যবস্থায় যে সংসার, সেইটা থেকে মেয়েরা এখন দূরে থাকতে চাইছে। স্বাধীন থাকতে চাইছে নারী, কারণ এখানে একজন নারী পুরুষদের তুলনায় কোন অংশেই কম নয়। বিয়ে অনেকটাই যেন অপ্রয়োজনীয়। এইটা একবিংশ শতাব্দী । নারী এখন অগ্রসর, তাঁরা পুরোনো ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছে। উন্নত দেশগুলোতে নারী তাঁদের অধিকার সম্মন্ধে এখন অনেকটাই সচেতন। এই দেশগুলো নারীবান্ধব, নারী রক্ষায় এখানে আইন আছে, আইনের প্রয়োগ আছে। মেয়েরা বহুলাংশে শিক্ষিত, প্রচুর আয় করতে পারে, আত্মসম্মানে উজ্জীবিত তাঁরা এবং পরমুখাপেক্ষী নয়।