হিন্দুদের মর্মান্তিক বেদনার কাহিনী শুরু করতে হবে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালী গণহত্যার মধ্য দিয়ে। নোয়াখালীর গণহত্যা আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের হিন্দু নিধনের ভূমিকা মাত্র। অক্সফোর্ড কেলগ কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসমিন খান ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০০৮ সালে প্রকাশিত The Great Partition: The Making of India and Pakistan বইতে লিখেছেন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা নোয়াখালীতে ১৯৪৬ সালে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত হয়ে হিন্দুদের উপর নৃশংস গণহত্যা চালায়। গণহত্যার নেপথ্যে জড়িতরা নোয়াখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে হিন্দুদের যাওয়া আসার পথ আগে থেকেই থেকেই বন্ধ করে দেয়। চূড়ান্ত আক্রমণের আগে নোয়াখালীর আশেপাশের এলাকা থেকে জড়ো হতে বিপুল পরিমাণ ধর্মোন্মাদ মুসলিম জনতা। তারা ১০ অক্টোবর কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন একযোগে মহাসমারোহে বাদ্য বাজিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্থানীয় হিন্দুদের উপর। কয়েকদিন ব্যাপী চলমান সেই হামলায় নিহত হয় কমপক্ষে ৫০০০ হাজার হিন্দু, ধর্ষণের শিকার হয় হাজার হাজার হিন্দু নারী, কিশোরী এবং জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয় হাজার হাজার হিন্দুকে। এতসব অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কোন রকমে ভারতে পালিয়ে যায় বিপুল পরিমাণ হিন্দু জনগোষ্ঠী। এমনকি হত্যা নিপীড়ন ঠেকাতে মহাত্মা গান্ধীর নোয়াখালীতে শান্তি মিশনে অবস্থানের সময়েও হিন্দুদের উপর অত্যাচার বন্ধ ছিল না, ফলে তার শান্তি মিশন ব্যর্থ হয়। হতাশ মহাত্মা গান্ধী শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হন যে, “হিন্দুরা নোয়াখালী ছাড়ো অথবা মরে যাও।” (নিউইয়র্ক টাইমস, ৮ এপ্রিল, ১৯৪৭)
হিন্দু জনসংখ্যার ক্রমাবনতি
১৯৪৬ পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত দশকের পর দশক ধরে গান্ধীর সেই কথারই পুনর্মঞ্চায়ন চলেছে বাংলাদেশে। এখানে হিন্দুরা টিকতে পারেনি। হয়ত নিহত হয়েছে, নয়ত বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরিত হয়েছে অথবা ভারতে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। ১৯৪০ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে হিন্দু জনসংখ্যা কমতে কমতে ২৮% থেকে ২০১১ সালে ৮.৯৬% এসে ঠেকেছে। জানিনা ২০২১ সালের আদমশুমারিতে হিন্দুদের জনসংখ্যা কত শতাংশ দাঁড়াবে। বিশেষত দুইটা দশকে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে। প্রথমটা ১৯৪৭ সালের ভারত পাকিস্তান বিভাজনের পরে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। যাইহোক, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পরেও হিন্দুদের দেশত্যাগের অগস্ত্য যাত্রা থামানো সম্ভব হয়নি। ১৯৭৪ সালে হিন্দুদের জনসংখ্যা ছিল ১৩.৫% কিন্তু ২০১১ সালে দেখা গেল হিন্দুদের জনসংখ্যা হয়ে গেছে ৮.৯৬% অর্থাৎ ৩৩% হিন্দু জনসংখ্যা কমে গেছে। ক্রমাগত কমতে থাকা হিন্দু জনসংখ্যা প্রমাণ করে কী পরিমাণ হিন্দু বিদ্বেষী পরিবেশ বিরাজ করছে এদেশে। অদ্ভুত ব্যাপার হল ধর্মান্তরিত হিন্দুরা নব্য মুসলিম হয়ে হিন্দুদের উপর বেশি অত্যাচার শুরু করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারাকাতের ২০১৬ সালে প্রকাশিত The Political Economy of Reforming Agriculture: Land Water Bodies in Bangladesh বইতে উল্লেখ করেছেন, “আগামী ৩০ বছরে হয়ত বাংলাদেশে কোন হিন্দু জনসংখ্যা থাকবে না।” গত ৪৯ বছরে এদেশ থেকে হিন্দু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার হার এবং প্রবণতা বিশ্লেষণ করে তিনি এমন সিদ্ধান্তে আসেন। আবুল বারাকাতের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ধর্মীয় সহিংসতার শিকার হয়ে ১ কোটি ১৩ লাখ বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
১৯৭১’র গণহত্যা
হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে ভয়ানক সময় কেটেছে তখন, তারা নৃশংস গণহত্যার শিকার। ১৯৭১ সালের ১ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটিতে পেশকৃত সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এক রিপোর্টে বলেছেন, “মাঠ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের লেখা, সাংবাদিকদের নিজ চোখে দেখা নির্মমতা, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দলিলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হাতে পৌঁছায় পূর্ব বঙ্গের ধংসযজ্ঞ ও হত্যার ইতিবৃত্ত”। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর স্থানীয় আলবদর, রাজাকার, শান্তি কমিটি হিন্দুদের ঘরবাড়ি, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, টাকাপয়সা লুট করে নেয়, জবর দখল করে তাদের ভূসম্পত্তি। হিন্দুদের নামের তালিকা করে তাদেরকে হত্যা করে, কোথাও কোথাও হিন্দুদের বাড়িতে হলুদ রঙ দিয়ে ‘হিন্দু’ লিখে চিহ্নিত করে রাখে। ইসলামাবাদের সরাসরি নির্দেশে সরকারিভাবে হিন্দুদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক Gary Bass ভিনটেজ প্রকাশনী থেকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত The Blood Telegram বইতে ঢাকার তৎকালীন আমেরিকান কনসাল জেনারেল Archer Blood’র উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের নৈতিক দায়িত্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়কে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে দোষী সাব্যস্ত করা।” বাংলাদেশের গণহত্যার রাজনৈতিক বিতর্ক নিয়ে ৫ এপ্রিল ২০১৬ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে মন্তব্য কলামে সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মী ডেভিড বার্গম্যান হিন্দু গণহত্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন, “কোন সন্দেহ নেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে অসংখ্য মানুষ সহিংসতার শিকার হয়েছে, ধর্ষণ হয়েছে, মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছে, পাইকারি হারে বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে গণহত্যায় স্থানীয়ভাবে সাহায্য করেছে পাকিস্তানপন্থী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ইত্যাদি মিলিশিয়া বাহিনী। এদের মধ্যে কিছু ছিল জামায়তি ইসলামের ছাত্র সংগঠন, যারা এখনো বাংলাদেশের শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে জামায়তি ইসলামের সহিংসতা ছিল বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর।”
৭১-এ বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগের চেয়ে সামান্য বেশি ছিল হিন্দু জনসংখ্যা। কিন্তু ধর্ষিতাদের মধ্যে ৪২ ভাগ ছিল হিন্দু রমণীরা। যাদের মধ্যে ৪৪ ভাগ ছিলেন অবিবাহিত নারী। অর্থাৎ; কুমারী হিন্দু নারীরাই ছিলেন ধর্ষকদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। পাকিস্তানীদের এসব কাজে সাহায্য সহযোগিতা করেছে স্থানীয় দালাল, রাজাকার ও ধর্মীয় নেতারা। (সূত্র- মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর একটি নির্দলীয় ইতিহাস-গোলাম মুরশিদ)
যুদ্ধ পরবর্তীতে পাকিস্তান আর্মির ব্যর্থতার কারণ ও প্রতিকার জানতে চেয়ে পাকিস্তান সরকার প্রধান বিচারপতি হামুদ-উর-রহমানের নেতৃত্বে একটা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিশন গঠনে করে। হামুদ-উর-রহমান কমিশন সরকারের কাছে প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের হতাহতের সংখ্যা উল্লেখ করে মাত্র ২৬০০০ জন, যেটা নিতান্তই হাস্যকর অপলাপ, নির্লজ্জ মিথ্যাচার। যেখানে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ৩০ লাখ মানুষের নিহতের খবর। যদিও ব্রিটিশ ভারতের বিহারে জন্ম নেয়া হামুদ-উর-রহমানের উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে বাংলাদেশে, এমনকি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরও ছিলেন।
বাংলাদেশের হিন্দুদের সাংবিধানিক পরিচয়
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে অবিভক্ত পাকিস্তান বা বাংলাদেশে হিন্দুদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক পরিচয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। পাকিস্তান জন্মের পরেই দেশটির সাংবিধানিক পরিচয় হলো ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা, ফলে হিন্দু জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয়ভাবে সমান নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারেনি, সামাজিকভাবেও এত সূক্ষ্মভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছে যে এটা খালি চোখে দেখা যায় না, শুধু এই অনুভবের জন্য নিজেকে হিন্দু হয়ে দেখতে হয়।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন বাংলাদেশের সংবিধানে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্র প০অরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করেন। কিন্তু সেটা অতি স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী ছিল। ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হলে বাংলাদেশের ধর্ম নিরপেক্ষতা ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশে পরিণত হয়।
সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি ক্ষমতায় এসেই বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভের অন্যতম উপাদান ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করে সংবিধানকে পঞ্চমবারের মত সংশোধন করে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সংবিধানের মুখবন্ধে যুক্ত করে দিলেন দেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হবে ইসলাম। পরবর্তীতে আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসলেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি ক্ষমতায় এসেই সংবিধান কেটেছিঁড়ে ৮ম সংশোধনীতে আর্টিকেল ২(ক) ধারা যুক্ত করে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করলেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যাব্য ধর্মবিশ্বাসীদের জন্য সান্ত্বনার মলম হিসেবে আরেকটা লেজুড় জুড়ে দিলেন, “তবে বাংলাদেশে অন্য ধর্মের লোকেরাও তাদের নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস শান্তি ও সম্প্রীতির সাথে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করতে পারবে”।
পরবর্তীতে ২০১১ সালে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্মের মর্যাদায় বহাল রেখেই ধর্মনিরপেক্ষতার এক অদ্ভুত মিশেল তৈরি করলেন, উপরন্তু সংবিধানের মুখবন্ধেরও কোন পরিবর্তন করলেন না। রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা নির্দিষ্ট ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার কারণে অন্যান্য ধর্মগুলোর চর্চা হয়ে গেল সংকুচিত এবং সেই ধর্মের অনুসারীরা হয়ে গেল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।
শুধু তাই নয়, ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার কিছু বৈষম্যমূলক আইন তৈরি করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয় হিন্দুরা যাতে তাদের ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা তুলতে না পারে এবং ভারতের সাথে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে হিন্দুদেরকে ঋণ দেয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং ধর্মীয় হুমকি
সাংবিধানিকভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর কারণে হিন্দুদের অবস্থা হয়ে পড়ল নাজুক। সংসদ নির্বাচনের সময়, সামাজিক অস্থিরতার দিনে হিন্দুদের উপর সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলা হয়ে দাঁড়াল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানোর সুযোগ।
দেশ স্বাধীনের পর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ভারতে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে। সারাদেশে মুসলিম জনতা প্রতিবাদ মিছিল বের করে, কিন্তু সেই প্রতিবাদী মিছিল প্রতিহিংসায় পরিণত হতে বেশি সময় লাগে না। দেশের প্রতিটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করা হয়, জ্বালিয়ে দেয়া হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ভাঙা হয় মন্দির। পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথের মত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে, কোথাও উন্মত্ত জনতাকে নিবৃত করার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। সেই সহিংসতায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তার নির্ভরযোগ্য খতিয়ান কোনদিন জানা যাবে না। তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বইটিতে চিত্রিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক হামলার ভয়াবহতা কতটা প্রকট। লজ্জা লেখার কারণে মৌলবাদীরা তসলিমা নাসরিনের ফাঁসি দাবী করে এবং বইটিকে নিষিদ্ধ করে।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর বিএনপি সমর্থক সারাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলার বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে দেয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৫০ দিন ক্রমাগত হিন্দুদের উপর হামলা চালায়। বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ১৮০০০ বড় ধরণের অপরাধের প্রতিবেদন পেশ করেন। তখন সহস্রাধিক নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং এরমধ্যে ২০০ জন নারীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে। সেই সময় পূর্ণিমা নামের একটি বাচ্চা মেয়েকে কয়েকজন মিলে ধর্ষণ করে। মেয়ের জীবন বাঁচাতে অসহায় মা ধর্ষকদের পা’চেয়ে ধরে বলেছিল; আমার মেয়েটা ছোট তোমরা একজন একজন করে যাও! ২০০১-এর পর ভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর হামলার বিচার একমাত্র পূর্ণিমা পেয়েছে তাও ১০ বছর পর ৪ মে ২০১১ তে! এরকম হাজারো পূর্ণিমা নির্যাতিত হয়েছেন, নীরবে দেশ ত্যাগ করেছেন। বাবরি মসজিদের সময় বাংলাদেশের পত্রিকা ও সরকার যেহেতু ধামা-চাপা দিয়ে দিয়েছে সেহেতু সেই সময়টা বুঝতে আমাদের সহায়তা করবে ২০০১ সালের ঘটনাগুলি। ২০০১ সালের পর কী হয়েছিল নিম্নে ছবির মাধ্যমে তার ক্ষুদ্র একটি অংশ তুলে ধরা হলা। ২০১১ সালের ২ ডিসেম্বর ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় বিএনপি জামাত জোট সরকার গঠন করার পরে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ৫ লাখ হিন্দু ভিটেমাটি, ঘরবাড়ি, ফসলের জমি, বাজারের দোকান, সহায়সম্পত্তি ফেলে রেখে ভারতে পালিয়ে যায়। (The Daily Star, 2 December 2011; Hindu American Foundation report).
২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার আদালত কয়েকজন জামায়াত নেতাকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত করলে বিএনপি জামায়াত সমর্থক হিন্দুদের উপর হামলা করে প্রতিশোধ নেয়। হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট করে, মেয়েদেরকে অপহরণ করে, ধর্ষণ করে, মন্দির ভেঙে ফেলে। সেই সময় সারাদেশে ৫০টি মন্দির ধ্বংস হয় এবং ১৫০০ বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। হিন্দু ধর্ম চর্চার জন্য সাধু, সেবাইতদেরকে লক্ষ্য করে নিয়মিত হামলা চলতে থাকে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের গৌড়ীয় মঠের সেবাইত ৫৫ বছর বয়স্ক যজ্ঞেশ্বর রায়কে ইসলামিক জঙ্গিরা কুপিয়ে ধড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। হতভাগ্য সাধু তখন পুজোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
হিন্দুদের সম্পত্তি:
বাংলাদেশে হিন্দুদের অনিরাপদ জীবনযাপনের আগুনে ঘি ঢালে সরকারের আইন ব্যবস্থা। তাদের ভঙ্গুর জীবনের মতই তাদের সহায় সম্পত্তিও নিরাপদ নয়। ১৯৬৫ সালের ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পাকিস্তান শত্রু সম্পত্তি নামের এক হিংসাত্মক আইন পাশ করে। ফলে রাতারাতি দেশের হিন্দুদের সম্পত্তি হয়ে গেল শত্রু সম্পত্তি। বাংলাদেশ জন্মের পর শত্রু সম্পত্তি আইনকে নতুন বোতলে পুরনো মদের মত অর্পিত সম্পত্তি নামে পরিবেশন করা হয়। ১৯৬৫ সাল থেকে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে জবরদখল করে নেয়া সম্পত্তি আর হিন্দুদেরকে ফেরত দেয়া হয় না। একটা দেশের আইন কীভাবে নাগরিকের জীবন সংকুচিত দুর্বিসহ করে দিতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ শত্রু সম্পত্তি তথা অর্পিত সম্পত্তি আইন। হিন্দু জনগোষ্ঠী নিজেদের সম্পত্তি নিজেরাই ভোগের ক্ষমতা হারায়।
বাংলাদেশ সরকারের অবসর প্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী এশিয়ান ট্রিবিউন ২৯ মে, ২০০৭ সালে “শত্রু সম্পত্তি থেকে অর্পিত সম্পত্তিতে উত্তরণ” প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “২০০১ সালে আওয়ামীলীগ অর্পিত সম্পত্তি আইন রদ করে হিন্দুদের সম্পত্তি হিন্দুদের ফিরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা করে কিন্তু এটা ছিল নেহাত একটা রাজনৈতিক খেলা এবং ভোটের চালাকি। লোক দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা। অর্পিত সম্পত্তি বেশীরভাগই এখন পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের দখলে। ফলে আইনি জটিলতায় সেই সম্পত্তি আর মালিকের কাছে হস্তান্তর সম্ভব হয় নি। প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ হিন্দু পরিবার শত্রু বা অর্পিত সম্পত্তি আইনের দুর্ভোগের শিকার। হিন্দু জনগোষ্ঠী এদেশে প্রায় ২০ লাখ একর ভূসম্পত্তি হারিয়েছে। সব সরকারের আমলেই হিন্দুদের ভূসম্পত্তি জবরদখল হয়েছে কিন্তু বিএনপির ২০০১ আমলে তার মাত্রা ছিল সীমাহীন”। বর্তমান সরকার যেহেতু মদিনা সনদে দেশ চালাচ্ছে এবং দেশের ধর্মীয় চেহারা এতটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে স্পষ্টতই ১৯৭২ এর সংবিধানে আওয়ামীলীগ নিজেও ফিরে যেতে ইচ্ছুক নয়।
আওয়ামীলীগ পরের মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ২০০১ সালের বিএনপির দমন নিপীড়নের বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে হিন্দুদের কিছুটা আশার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মুনতাসির মামুন, শাহরিয়ার কবির, সুলতানা কামাল এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যান, আক্রান্ত পরিবারের সাথে কথা বলেন এবং প্রতিবেদন পেশ করেন। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের উদ্যোগে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়। কিন্তু হিন্দুদের ভেঙে যাওয়া মনোবল পুন-প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে তেমন ফলপ্রসূ বা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না।
এই ভূখণ্ডে হিন্দুরা ১৯৪৭ সাল থেকেই অকল্পনীয় অত্যাচার সহ্য করে ধুঁকে ধুঁকে এখনও টিকে আছে। তারা চলমান নীরব গণহত্যার শিকার, তাদের সহায় সম্পত্তি অবৈধভাবে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও মন্দির ভাঙা হচ্ছে, তাদের নারীরা যৌন লালসা ও প্রতিহিংসার শিকার। তাদেরকে নিজ ভূমি থেকে উৎখাত করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার হুমকি দেয়া হয়। বাংলাদেশে তাদের দেখার কেউ নেই।
মানবতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জন্য এর চেয়ে দুঃখজনক ও লজ্জাজনক ব্যাপার খুব কমই আছে !! 😢😢
মুসলমান এর % টা যখন বাড়তে থাকবে তখন হিন্দু % টা কমা স্বাভাবিক,,,
% দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে? মোট জনসংখ্যার মধ্যে %?
তথ্যবহুল লেখা। তবে আমি অতোটা হতাশাবাদী মানুষ নই।
ছোট বেলার একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। আমার ছোটবেলায় দেখেছি ছোটদের মধ্যে কোন ব্যাপারে ঝগড়া হলে সেটা যখন আরও বেড়ে যাবার উপক্রম হয় তখন পাড়ার কাকুদের দ্বারস্থ হতে হত। কখনবা কাকুরাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে আসত ছোটদের ঝগড়া মিটিয়ে দেওয়ার জন্য। এবং এই ক্ষেত্রে দেখতে পেতাম কাকুরা সাধারণত ছোটদের মধ্যে ঝগড়া মিটিয়ে দিতেন এই বলে যে “বন্ধু বন্ধু ঝগড়া করতে নেই, যা তোরা।” অনেক সময় দুই ঝগড়া কৃত বন্ধুর হাতে হাত মিলিয়ে দিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ভাবে ঝগড়া মিটে যেত। যদিও বোধকরি অনেকের মধ্যেই সুবিচার না পাওয়ার ব্যাথা মনে লেগে থাকত।
এর পরে যে বিষয়টা লক্ষ্য করেছি যে কয়েকজন ‘বুদ্ধিমান’ ছোট (সাধারণত তারা ছোটদের মধ্যে থেকেও একটু বয়েসে বড় হত) বিষয়টা ধরে ফেলেছে। একদিন একজনকে ঝগড়ার সময় একটু আড়াল থেকে বলতে শুনেছি – “মাইরা দে মাইরা দে, কাকুরা আইসা মিটমাট কইরা দিব।” অর্থাৎ তার কাছে মিটমাট কথাটার অর্থ হল আগে ভাগে মেরে দিতে পারলে পরে এর কোন সুবিচার হবে না । কাকুরা শুধু দুজনার মধ্যে আর কেউ কাউকে না মারার অঙ্গিকার করিয়ে নেবে। অথএব এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে আগে ভাগে কাউকে মেরে দিতে হবে।
জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রেও এর সুযোগ নিতে দেখেছি। বিশেষ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতি বিদ্বেষ ও জাতি দাঙ্গার সময় এক দল লোক এই কৌশলের সুযোগ নিয়েছে। এই অবস্থা দেখা গেছে দেশ ভাগের সময় এবং তার পরবর্তী সময়ও। আগে ভাগে অত্যাচার করে পরে ঐ “মিটমাট কাকু” দের ডাক পড়ে “মিটমাট” করে দেওয়ার জন্য।
বাংলাদেশে হিন্দুদের এই অবস্থার জন্য এই মিটমাট কাকুদের দায় অনেক খানি। সমস্ত সাহিত্যিক, কবি, চিত্রপরিচালক। সঙ্গীতকার এরা সবাই এই মিটমাট কাকুদের দায়িত্ব পালন করে গেছে।
বাঙালি হিন্দু সাহিত্যিকরা কখনও বাঙালি হিন্দুদের এই দুর্দশার কাহিনী পাঠকদের জানায়নি। কবিরা এই নিয়ে কবিতা বিশেষ লেখেনি, চিত্র পরিচালকরা এই বিষয় নিয়ে ছবি করে নি। যদিও জার্মানিতে ইহুদিদের উপর অত্যাচার নিয়ে করা অনেক সিনেমাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছে। রাজনিতিকরা এই বিষয়টা কখন সামনে আসতে দেয় নি। আসলে এরা সবাই মিটমাট কাকুর ভুমিকা পালন করেছে। একটু আশার কথা এই যে ইন্টারনেট আসার পর মুক্তমনার মত ব্লগ এই ঘটনাগুলো পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে পারছে। ইন্টারনেট বিপ্লব না হলে এগুলো চিরদিনের মত মাটির নিচে চাপা থাকতো।
বুদ্ধিমান মুসলিম মৌলবাদীরা এই অবস্থার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে শুধু তাই না এই মিটমাট কাকুদের সাদরে প্রশংসা করেছে এবং সমাজের সর্বস্তরে এই মিটমাট কাকুদের আমন্ত্রন করেছে। বাংলাদেশের নাটকে হিন্দুদের কি ভাবে চিত্রিত করা হয় সে বিষয়ে আমি আগেও লিখেছি। এক সময় হলিউড চলচ্চিত্রে কালো মানুষদের ক্রিমিনাল হিসাবে দেখান হত। অনেক প্রতিবাদের পর এটা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোন সংগঠন নেই যারা বাংলাদেশের নাটকে হিন্দুদের এইভাবে নিকৃষ্ট ভাবে দেখানোর এবং হিন্দু মেয়েদের “দুশ্চরিত্রা ” , পরকিয়া সম্পর্কে জরিয়ে পরা দেখানোর বিরোধিতা করে।
আমি উপসংহার এই ভাবেই টানতে চাই যে এই ভাবেই চলবে এবং এটাকে মুসলমান মৌলবাদীদের ও সার্বিক ভাবে ইসলামের বিজয় এবং সাফল্য হিসেবেই দেখছি।