ষোড়শ শতকেও প্রায় সকল মানুষ বিশ্বাস করত-মানুষের রোগ-শোকের কারণ কোন পাপের ফল বা অশুভ শক্তি। ঈশ্বর বা দেবতা মানুষের কোন পাপে রুষ্ট হয়ে মানুষকে রোগ-মহামারির মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করে।

ফলশ্রুতিতে রোগাক্রান্ত্র মানুষ কেবল ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা এবং ধর্মীয় মোল্লা-পুরোহিত-তান্ত্রিকদের নিকট ধর্ণা দিয়ে দোয়া-তাবিজ-মাদুলীর মাধ্যম রোগমুক্তির কামনা করত।

ষোড়শ শতকে সুইজারল্যাণ্ডের বেসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও ভেষজ বিদ্যার অধ্যাপক ডাক্তার ফিলিপ্রাস অ্যাওরেওলাস প্যারাসেলসেস ঘোষণা করলেন-মানুষের অসুস্থতার কারণ কোন পাপের ফল বা অশুভ শক্তি নয়-রোগের কারণ জীবাণু। পরজীবী এ জীবাণুকে শেষ করতে পারলেই মানুষ আরোগ্য লাভ করবে।

প্যারাসেলসেস এর ঘোষণা শুনেই প্রত্যেক ধর্মের মানুষ রে রে করে তেড়ে আসল। তাদের এতদিনের লালিত ধর্ম বিশ্বাসের বিপরীত এ কথা তারা মানতেই চাইল না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মবেত্তারা যা বলে এসেছেন বা তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্তে যা লেখা আছে-তা কখনো ভুল হতে পারে না।

ধর্মবিরোধী এমন উক্তি করার জন্য প্যারাসেলসেসকে বিচারের মুখোমুখী হতে হল এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হল। সুইজারল্যান্ড থেকে পালিয়ে তিনি জীবন রক্ষা করেন।

আজ কেবল সুইজাল্যাণ্ডবাসী নহে, সারা বিশ্বের মানুষ জানে-যে কোন রোগের মূল কারণ বিশেষ ধরণের জীবাণু বা ভাইরাস। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় মানুষ বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিষেধক আবিস্কার করে মানুষের জীবনকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে।

মানবজাতি শতাব্দী কাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানিক বা বৈশ্বিক মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে নিতান্ত অসহায়ের মত জীবন দিয়েছে। সে সব ঘটনা ইতিহাস থেকে আমরা জানি।

কিভাবে প্লাগ নামক মহামারী, স্পেনীস ফ্লু, বিশ্ব ব্যাপী কোটি কোটি মানুষের প্রাণ সংহার করছে। আমাদের বাল্যকালে কলেরা, গুটি বসন্ত ইত্যাদি রোগে আমাদের দেশে অগুণিত মানুষকে আমরা মরতে দেখেছি। সে মৃত্যুর মিছিলে আমাদের অনেকের অনেক স্বজনও শরীক হয়েছে।

মহামারী কলেরা প্রতিরোধ করতে-আমার এখনো মনে পড়ে-আমরা দল বেধে একজন হুজুরকে সাথে নিয়ে-বাঁশের কঞ্চিতে আরবীতে দোয়া-লেখা কিছু পতাকা নিয়ে-সমস্বরে বিভিন্ন দোয়া পড়তে পড়তে- হুজুরে ফুঁক দেওয়া মাসকলাই ছিটাতে ছিটাতে সারা গ্রাম প্রদক্ষিণ করতাম-আমাদের সাথে একটি কাল রঙের ছাগলও থাকত এবং কিছুদূর পর পর হুজুর আজান দিতেন, আমরা সেখানে পতাকা লাগানো একটি বাঁশের কঞ্চি পুতে দিতাম। সারা গ্রাম চক্রাকারে প্রদক্ষিণ শেষ করে আমাদের সাথে থাকা ছাগলটি জবাই করে সোল্লাসে খেয়ে ফেলতাম-আর এক প্রকার স্বস্তি নিয়ে বাড়ি ফিরতাম-যাক বাবা, পাড়া বন্ধ করে এসেছি-আর এ মহামারি আমাদের গ্রামে প্রবেশ করতে পারবে না।

এভাবে পাড়া বন্ধ করার পর আমরা তরুণেরা মুরুব্বিদের নির্দেশে পাড়ার বিভিন্ন প্রবেশ মুখে পাহারা দিতাম-যাতে বোরকা পড়া কোন মহিলা অন্যগ্রাম থেকে পাড়ায় প্রবেশ করতে না পারে। কারণ মহিলাদের বোরকার অন্তরালে নাকি ঐ রোগ(উলা বিবি) আবার গ্রামে চলে আসতে পারবে।

এতকিছু করেও আমরা বস্তুত: আমাদের গ্রামকে ঐ মহামারি থেকে রক্ষা করতে পারতাম না। শয়ে শয়ে মানুষ-এমনকি কোন পরিবারের একাধিক সদস্য অসহায়ের মত মারা যেত। কবরে কবরে ভরে ওঠত গ্রামের সকল কবরস্থানগুলো। একই রকম আরো একটি রোগ-গুটি বসন্ত-ফি বছর গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ত। অনেক লোক তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে মারা যেত। গুটি বসন্ত হয়ে যারা মারা যেত, তাদের দেখতে ভয়ে আত্মীয় স্বজনেরা কাছে যেতনা। ঝাড়-ফূঁক-দোয়া-তাবিজ-মাদুলী কিংবা শিখড়-পড়া এসব রোগকে ঠেকাতে পারত না।

সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতির ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও নানা আবিস্কার-ঐ সমস্ত রোগের প্রতিষেধক টিকা-ঔষধের বদৌলতে সে সমস্ত রোগ দেশ থেকে নির্মূল হয়েছে-বহু বছর পূর্বেই।

মানুষের সমাজ গতিশীল-সদা পরিবর্তনময়। এ পরিবর্তনের নানা ইতিবাচক-নেতিবাচক প্রভাব পড়ে প্রকৃতিতে-প্রাকৃতিক পরিবেশে। মানুষের জৈবিক আচরণ, প্রকৃতিকে জয় করার দুদর্মনীয় প্রয়াস ও আকাক্সক্ষা নিয়ে বিকাশমান বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ঔরষে জন্ম নেওয়া প্রযুক্তির ব্যবহার-মানুষের কল্যাণে ও অকল্যাণে-রাজনৈতিক স্বার্থে তার অপব্যবহার-ইত্যাদি হাজারো কারণে সৃষ্ট নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিভিন্ন সময়ে মানুষের প্রচণ্ড দুর্ভোগের কারণ হয়ে ওঠে।

যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়াও, সম্পূর্ণ জৈবিক কারণে সৃষ্ট নতুন নতুন জীবাণু বা ভাইরাস কখনো কখনো প্রাণঘাতি হয়ে সারা দুনিয়ার মানুষকে বিপদগ্রস্থ করে তুলেছে।
এটা একটি প্রাকৃতিক জৈবিক প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতি-কারো ইচ্ছা অনিচ্ছার ফল নয়। তবে মানুষের কর্মফলত বটেই। যেমন-আমাদের প্রশাসনিক চরম অদক্ষতার ফলশ্রুতিতে, আমাদের ঘনবসিতপূর্ণ নগরগুলোকে আমরা যখন আমাদের পরিত্যক্ত বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত করেছি-যা ডেঙ্গু মশার উর্ব্বর জন্মক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে-তারই অপরিহার্য ফলশ্রুতিতে জন্ম নেওয়া এডিস মশার কারণে গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু নামক রোগের মর্মান্তিক শিকার হয়ে আমাদের কত লোক জীবন দিল-এর জন্য কাকে দোষ দেব-সৃষ্টি কর্তা ঈশ্বরকে-নাকি আমাদের অদক্ষ-দুর্নীতিপরায়ণ মেয়র সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নটের গুরুদের?

আজ যে জীবনজ্ঞাতি যে ভাইরাস-করোনা-সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলেছে-বিপন্ন করে তুলেছে বিশ্ব মানবতাকে-তার জন্মেরও হাজারো একটি কারণ আছে-যা ভবিষ্যতে গবেষণার বিষয়-কিন্তু এ মুহুর্তে তাকে রুখতে না পারলে বিশ্ব যে মনুষ্যশূণ্য হয়ে যাবে।

এখানেই প্রশ্ন-রুখব কিভাবে? আল্লাহ, ঈশ্বর ভগবানের নিকট প্রার্থনা করে-নাকি এ ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিস্কার করে ?

যারা মনে করেন এবং এখনো প্রচার করেন-করোনা ভাইরাস মহান সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে একটি গজব-তাদের কাছেতো প্রার্থনার কোন বিকল্প নেই। সেখানেওতো বিপদ-এ ভাইরাস এত নির্মম সন্ত্রাসী যে-উপাসনালয়ে গেলেও সংক্রমণ করতে ছাড়ে না। ইতোমধ্যে তার ভূরি ভূরি প্রমান মিলেছে বলে দুনিয়ার তাবৎ দেশে উপসনালয়-মসজিদ-মন্দির-প্যাগোড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহের ঘর নামে আখ্যাত পবিত্র হেরেম শরীফের দরজায়ও তালা পড়েছে।

যারা নানা বয়ানে-মিলাদে করোনাকে আল্লাহের গজব বলে বেড়াচ্ছে-তারা একথা বুঝতে অক্ষম যে, মানুষের সৃষ্ট দুর্ভোগের দায় তারা অবলীলায় নির্দোষ সৃষ্টিকর্তার উপর দিয়ে তাকে বরং খাটো করছে। বলা হয় মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাহলে সৃষ্টিকর্তা তার সেরা সৃষ্টির প্রতি এত নির্মম কেন হবেন?

সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাইরাস-করোনা-আজ চীনের কোন একটি প্রদেশে কোন জৈব রাসায়নিক কারণে জন্ম নিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। এ ভাইরাসটি সম্পূর্ণ নতুন-অত্যন্ত দ্রুত সংক্রামক এবং প্রাণঘাতী। করোনার দুধর্ষ আক্রমনে ইতিমধ্যেই পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ধনী ও ক্ষমতাধর দেশগুলোও নাস্তানাবুদ অবস্থায় পড়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করছে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশ ও অঞ্চলে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও তার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি। বরং শণৈ: শণৈ: আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এক অজানা অদৃশ্যপূর্ব শত্রুর আচমকা আক্রমণে বস্তুত: চিকিৎসা বিজ্ঞান এ মুহুর্তে হতবিহ্বল-তবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় নয়। চিকিৎসক সমাজ যেমন এ অজানা অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে-নিরন্তর-তেমনি বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কারভ্যাকসিন-ঔষধ তৈরীর গবেষণাও শুরু হয়েছে। কিছু কিছু আশার বাণীও শুনা যাচ্ছে ইতোমধ্যেই। অতীতের সকল অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি-এ লড়াইয়েও বিজ্ঞান অবশ্যই জয়ী হবে-তবে ততদিনে হয়ত অনেক জীবন কেড়ে নিবে এ ভাইরাস। তবে ভবিষ্যতের জন্য তাকে রুখে দেওয়া যাবে চিরতরে।

এ মহা বিপর্যয়ের মুখে আমরা বাংলাদেশের মানুষ অন্যদেশের চেয়ে বেশী আতঙ্কের মধ্যে আছি। কারণ আমাদের দেশে বিদ্যমান যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা-চিকিৎসা সামগ্রী-সবকিছু মিলিয়ে আমাদের দেশে যদি এ রোগের বিস্তার পশ্চিমা দেশগুলোর মত ভয়াবহ রূপ লাভ করে-তাহলে আমাদের অবস্থা যে কী মর্মান্তিক হতে পারে-তা ধারণা করতেই শিউরে ওঠতে হয়।

তাই বর্তমান অবস্থায় আমাদের প্রথম করণীয় হচ্ছে-তার সংক্রমণ প্রতিরোধ করা। যার জন্য প্রয়োজন কঠিন-কঠোর ভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত বিজ্ঞান ভিত্তিক স্বাস্থ্য বিধিসমূহ মেনে চলার জন্য আমজনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।

কিন্তু দু:খজনক হল-আমাদের দেশের আমজনগণ যে সকল ব্যক্তিদের কথা বেশী শুনে-মানে-বিশ্বাস করে-তারা হল আমাদের দেশের আলেম সমাজ ও ধর্মীয়গুরু। তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নানা ভাবে তাদের মিলাদে-সমাবেশে সধারণ মানুষকে মারাত্মকভাবে বিভ্রান্ত করছে এটা বলে যে-করোনা ভাইরাস আল্লাহের গজব-অমুসলমান-কাফের কিংবা মুনাফেক মুসলমানদের জন্য আল্লাহ এটা প্রেরণ করেছে। া হুজুর শফির ভাষায়-এটা নাকি আল্লাহের সৈনেক-খাঁটি মুসলমানদের এটা কিছু করবে না। তাদের এজাতীয় বয়ান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেদারসে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা মানুষকে স্বাস্থবিধি মানতে নিরুৎসাহিত করছে। সরকার বা প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।

তাদের বক্তব্য শুনলে বুঝা যায়-তারা এখনো ষোড়শ শতকের পিছনে বসবাস করছে। তাদের এ মুর্খতা ক্ষমার অযোগ্য। তারা মানুষকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে চায়-মানব সভ্যতাকে পেছনে ফিরাতে চায়। তাদের বুঝানো যাবে না-কারণ এক মধ্যযুগীয় বিশ্বাসের ভাইরাসে তাদের মস্তিস্ক আক্রান্ত। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সাথে এসব গণ্ডমুর্খ মোল্লা পুরুহিত ও গুরু বাবাদের বিরুদ্ধে একটি মনস্তাত্ত্বিক লড়াই অত্যাবশ্যক। যা করার দায়িত্ব অবশ্যাম্ভাবীভাবে আজকের প্রজন্মের বিজ্ঞানমনস্ক তরুণদের। তা না হলে সামনে যে মহাবিপদ।