আজ ২৬ ফেব্রুয়ারি। আজকের এই দিনে ২০১৫ সালে বই মেলা থেকে ফেরার সময় অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়। সাথে গুরুতর আহত হয় বন্যা আহমেদ। আজকের ব্লগটি অভিজিৎ রায়কে উৎসর্গ করে লেখা।
১৯৪২ সালের ২০শে অগাস্ট বার্লিনে কর্মরত এক সুইডিশ কূটনৈতিক একটি কাজ শেষ করে রাতের ট্রেনে ওয়ারশ থেকে বার্লিনে উদ্দেশে রওয়া হচ্ছিলেন। তিনি যখন রেল স্টেশনে সিগারেট ধরাচ্ছিলেন সেসময় বিধ্বস্ত ও ক্লান্ত এক এসএস-অফিসারের সাথে দেখা হয়। অফিসার তাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন। সেই অফিসারও সেই নৈশ ট্রেনে একজন যাত্রী। সেই ট্রেনের সাক্ষাৎ যে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হবে তা হয়তো সুইডিশ কূটনৈতিক কখনো ভাবেননি। সেই সাক্ষাৎ শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয় পরবর্তীতে সেই সাক্ষাতের তথ্য বাহিরে প্রচার না করায় সুইডিশ সরকারের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কী ছিল সেই ট্রেন বৈঠকের বিষয়? এই নিয়ে সুইডেনে অনেক ডকুমেন্টরি হয়েছে, অনেক লেখালেখি হয়েছে। গত সপ্তাহে সুইডেনের জাতীয় দৈনিক এক্সপ্রেসেন একটা বড় ফিচার প্রকাশ করে তার হেডলাইন ছিল-“লক্ষ লক্ষ মানুষ হলোকাস্টে মারা যাওয়ার কথা সুইডেন জানতো। Miljoner judar dog i Förintelsen – och Sverige visste om det। সুইডিশ শেখার বয়স বেশিদিন হয়নি (এখনও শিক্ষানবিশ) তারপরও ব্যক্তিগত আগ্রহে অনুবাদ করার চেষ্টা করলাম।
“জার্মান এসএস (SS)-অফিসার সুইডিশ কূটনৈতিকের কাছে গ্যাস চেম্বারের কথা উন্মুক্ত করেছিলেন। যে গ্যাস চেম্বারগুলো মূলত ইহুদিদের হত্যার জন্যে ব্যবহার করা হতো। প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি ও গণহত্যার সকল তথ্য থাকা সত্ত্বেও সুইডিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি এবং অন্য কোন দেশকেও জানায়নি। কারণ তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় হিটলারের জার্মানির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ করতে রাজি ছিল না। তৎকালীন রিপোর্টে বলা আছে যে- একজন জার্মান এসএস-অফিসার সরাসরি বলছে যে; মালবোঝাই ট্রেনে করে ইহুদিদের সরাসরি গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ৩২ মিনিটের মধ্যে সকল বন্দি মারা যায়। পরবর্তীতে সুইডেনের এই চেপে যাওয়ার বিষয়টিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইওরান পারসন (Göran Persson) বিশ্বাসঘাতকতা হিসবে উল্লেখ করেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী Levande historia” নামে এক তথ্য প্রকল্পেও কাজ করেছিলেন ”
প্লাটফর্মের সিগারেট বিরতির সময় ইওরান ভন অট্টার জার্মান SS পোশাকের এক অফিসারের দেখা পান। SS- অফিসারকে খুব নার্ভাস ও বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। ইওরান অফিসারকে সিগারেট অফার করেন। জবাবে ধন্যবাদ দিয়ে অফিসারটি সরাসরি বলেন;
-আমি কী আপনার কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে পারি? গতকাল আমি যা দেখেছি তা খুবই ভয়াবহ ছিল!
– ইহুদিদের বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছেন কী? ইওরান জিজ্ঞেস করলেন।
-হা,পূর্ব জার্মানিতে ইহুদিদের উপর গণহত্যা চালানো হচ্ছে। অফিসারটি আর কেউ নন তিনি হলেন এসএস লেফটেন্যান্ট কার্ট জারস্টাইন (Kurt Gerstein), যিনি এখন ইওরানের সাথে বার্লিনের পথে, তিনি ডেথ ক্যাম্প Belzec och Treblinka তার কাজ শেষ করেছেন মাত্র।
যাত্রার ছয় ঘণ্টায় কার্ট জারস্টাইন ইওরানের কাছে গতকাল বেলজেক (Belzec)-এর ক্যাম্পে কী দেখেছেন তার সব কিছু বিশদভাবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলছেন; কীভাবে হাজার হাজার ইহুদিদের বেত্রাঘাত করে, ঘা মেরে, পিটিয়ে গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়। কার্ট-এর ক্যাম্প মিশনের মূল উদ্দেশ ছিল হাইজেন প্রোজেক্ট দেখা। তিনি এসএস হাইজিন ইনস্টিটিউটের আন্ডারে কাজ করতেন। কিন্তু তিনি যা দেখলেন তার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি দেখলেন ইহুদিদের উপর জাইক্লোন বি (Zyklon B) ও হাইড্রোজেন সায়ানাইড প্রয়োগ করা হচ্ছে। কার্ট- বলছেন, ঠিক ৩২ মিনিটে চেম্বারের সবাইকে মেরে ফেলা যায়। শুধু তাই নয় মৃত যাওয়া মানুষের কাছে সোনার দাঁত, কিংবা মূল্যবান কোন জিনিস আছে কিনা তার জন্যে মৃতদেহেও তল্লাসি করা হতো। নৈশ ট্রেনের এমন অনাকাঙ্খিত বৈঠক বিশ্বের ইতিহাসে জায়গা করে নেয়, একই সাথে সুইডিশ রাজনীতিতে এক বিশ্বাসঘাতক অধ্যায় হিসেবেও লিপিবদ্ধ হয়।
জার্মানির কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের গণহত্যার বিষয়টা এভাবে সুইডেন প্রথম জেনেছিল । En svensk tiger নামক এক ডকুমেন্টারিতে লেখক বিরগিত্তা ভন অট্টার (Birgitta von Otter) বর্ণনা করছেন; কীভাবে তার পিতা ট্রেনের প্লাটফর্মে জার্মান অফিসার কার্ট এর সাথে পরিচিত হন। এই সাক্ষাতের ঘটনা পরবর্তীতে তার পিতার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। ”Svensk tiger” শব্দটা সাধারণত সুইডিশ বাঘ কিন্তু অন্য অর্থও আছে তাহলো; চুপ থাকার আহ্বান।
ইওরান জার্মান অফিসার থেকে ক্যাম্পের গণহত্যার সকল তথ্য পাওয়ার পর তা সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে অভিহিত করেন। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় তা জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি, যা ভিকটিম ও তথ্য প্রদানকারীর সাথে শঠতার শামিল। এই শঠতার মাশুল দিতে হয়েছিল সেই জার্মান অফিসারকেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর SS-অফিসার কোর্ট কে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে নিজের সেলে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। অথচ এই এসএস-অফিসার গ্যাসচেম্বারের কথা পৃথিবীর কাছে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক সেই ট্রেন ভ্রমণ ইওরানের জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আফসোস করে গেছেন যে; ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিষেধের কারণে তিনি বিশ্ববাসীর সামনে রিপোর্টটি প্রকাশ করতে পারেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে তাকে সরাসরি রিপোর্ট লিখতে নিষেধ করা হয়। ফলে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দেওয়াল ভেদ করে রিপোর্টটি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। যদিও পরবর্তীতে নাইট ট্রেনের সেই মিটিংয়ের উপর বই, থিয়েটার, সিনেমা এবং আলোচিত তথ্যচিত্র ”En svensk tiger” তৈরি করা হয়েছে।
সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়োরান পারসসন ১৯৯৭ সালে ”Levande listoria” নামে একটা প্রোজেক্ট শুরু করেন। প্রোজেক্ট থেকে একটি বইও বের করা হয় যার নাম ” আমার কথাগুলো তুমি অন্যদেরও বলো” (Om detta må ni berätta)। ১৯৯৮ সাল থেকে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়।
ট্রেনের সেই বৈঠক পরবর্তীতে গবেষণা রিপোর্ট, প্রবন্ধ এমনকি হলোকাস্ট সম্পর্কিত গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জার্মান অফিসারের সাক্ষাৎকারে ইউনিক তথ্যের সমাহার ছিল।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাষায় বলেন; সুইডেনের একটা পজিটিভ আচরণ ছিল এবং হলোকাস্ট বিষয়ে তারা ছিল বধির ও অন্ধ। যা স্পষ্টভাবে প্রতারণার শামিল। তিনি আরও বলেন; সুইডেনের এই মনোভাব পরিবর্তন হতে সময় নিয়েছিল। অন্যরা করেছিল তাই আমিও একই কাজ করেছি এটা কোন অজুহাত নয়। ১৯ শতকের সুইডিশ ও ইউরোপ রাজনীতিতে এটি এক কলঙ্ক হয়ে থাকবে। সুইডিশ অনেক তরুণ-তরুণী হলোকাস্ট সম্পর্কে তেমন কিছু জানে তাই তিনি ”Levande Historia” নামে তথ্যভিত্তিক প্রকল্প শুরু করেন।
সেই ট্রেন মিটিংয়ের তথ্য ইওরানের ভেতর ভীষণভাবে নাড়া দেয়, বলছিলেন তার স্ত্রী আন মারি (Anne-Marie)। পরের দিন সকালে তিনি বার্লিনের অবস্থিত সুইডিশ এম্বাসীতে গিয়ে গত কাল রাতের সেই মিটিংয়ের উপর রিপোর্ট লিখতে শুরু করেন। কিন্তু তার বস এরিক ভন পোস্ট (Eric von Post) তাকে রিপোর্ট লিখতে নিষেধ করেন। বরং বলেন যে ইওরান যখন স্টকহোমে যাবে তখন যেন মৌখিকভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মৌখিক রিপোর্ট করেন।
ইওরান স্টকহোমে আরেকটি বিষয়ে খুব দ্রুত রিপোর্ট করে ফেলেন তাহলো; পোলিশ-সুইডিশ এক ব্যবসায়ী দলকে জার্মান সৈন্যরা আটক করেছে। কারণ তারা কয়েক বছর যাবত পোল্যান্ডের নির্বাসিত সরকার যা কিনা তখন লন্ডনে অবস্থিত, তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগীতা করেছে। এমনকি ইহুদিদের উপর গণহত্যার তথ্যও তারা লন্ডনে পৌঁছে দিয়েছিল। ইওরান মূলত পোলিশ-সুইডিশদের সাহায্য করার জনেই ওয়ারশ শহরে গিয়েছিলেন। আর সেখানে থেকে ফেরার পথেই জার্মান এসএস-অফিসারের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। যিনি তাকে গ্যাস চেম্বারের বিষয়টি সুইডিশ সরকারকে জানাতে অনুরোধ করেন।
জার্মান অফিসার কোর্টের সাথে দেখা হওয়ার পাঁচ মাস পর অর্থাৎ ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে ইওরান যখন স্টকহোমে আসেন তখন তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপক স্টেশন সোডারব্লম (Staffan Söderblom) কে মৌখিকভাবে সেই ট্রেনের সাক্ষাৎকারের বিষয়টি জানান। কিন্তু তার সেই মৌখিক রিপোর্টও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দেওয়াল ছেড়ে বাহিরে আসতে পারেনি। এমনকি নাৎসি বিরোধী জোটকেও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এই বিষয়ে কিছু জানায়নি। ফলে সুইডিশ গণমাধ্যম এই বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি।
অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান অফিসার কার্ট জারস্টাইন যখন নিজেই একটি রিপোর্ট লেখেন তখন তা সবার নজরে আসে। ১৯৪৬ সালে নুরেমবার্গ ট্রায়ালে তা উত্থাপিত হয়। তিনি লিখেছেন; মানুষ গ্যাস চেম্বারে আটক আর বাহির থেকে অন্যরা শুনতে পাচ্ছিল কীভাবে তারা চিৎকার করছে, কীভাবে কাঁদছে…….এরপর দুই ঘণ্টা ৪৯ মিনিট পর ডিজেল ছাড়া হতো।
লেখক ও সাংবাদিক বিরগিত্তা ২০০০ সালে প্রকাশিত এক আর্টিকেলে লিখছেন কোর্টের বয়ান উল্লেখ করছেন এভাবে- “ কিছুক্ষণ পর প্রথম ট্রেনটি আসে লেমবেরি (Lemberg) থেকে। ৪৫টি বগিতে মোট ৬ হাজার ৭০০ মানুষ ছিল। আসার পথে ইতোমধ্যে ১৪৫০ জন মারা যায়। বগির ছোট ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ছোট বাচ্চা, মহিলা ও পুরুষরা সবাই গাদাগাদি করে আটকে আছে। ২০০ ইক্রেনিয়ানকে বলা হল দরকার হলে চাবুক মেরে যেন সবাইকে ট্রেন থেকে নামানো হয়। এখানে বলে রাখা ভাল; এই ট্রেনগুলো সাধারণত পশু কিংবা মালামাল বহনে ব্যবহার করা হতো।
এসএস সার্জেন্ট হেকেনহোল্ট (Lorenz Hackenholt) গ্যাসচেম্বারের ডিজেল ইঞ্জিন চালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ইঞ্জিনটি কিছুতেই চালু হচ্ছিল। না। বাহির থেকে বন্দিদের কান্না, চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। আমার কাজ সব কিছু লিপিবদ্ধ করা। ৫০ মিনিট, ৭০ মিনিট পরও ইঞ্জিন চালু হচ্ছিল না। অতঃপর দুই ঘণ্টা ৪৯ মিনিটে ইঞ্জিন চালু হয়। ইঞ্জিন চালু হওয়ার ২৮ মিনিট পরও কিছু মানুষ হয়তো জীবিত থাকে কিন্তু ৩২ মিনিট পর সবাই নিশ্চিতভাবে মারা যায়।“
প্রায় ছয় মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যা করা হয় জার্মান নাৎসি শাসন আমলে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা গ্রুপকে মৃত্যুপুরীখ্যাত অসয়িৎস ক্যাম্পে নেওয়া হচ্ছে। শুধু ইহুদিই নয়, সমকামী, ভবঘুরে জিপসি, রোমান, এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদেরও ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। Foto: SZ PHOTO / TT
মাঝের ব্যক্তিটির নাম স্টাফান স্যাডারব্লম (Staffan Söderblom), যিনি ১৯৪৪-৪৬ সাল পর্যন্ত মস্কোতে সুইডিশ এম্বাসেডর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অনেক বছর পর ১৯৭৯ সালে জাতীয় পত্রিকায় Aftonbladet কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তখন তথ্য আদান-প্রধান খুব ঝুঁকিপূর্ণ ছিল কারণ জার্মানি সব কিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। তিনি আরও বলেন তখন তথ্য পাচার আমরা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত করেছিলাম। কারণ জার্মানি একদিনকে ছিল সুপার পাওয়ারে ফলে তথ্য পাচারের ফলে সুইডেন ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারতো। Foto: PRESSENS BILD / TT NYHETSBYRÅN
ইওরানকে ১৯৫৫ সালে একজন সাক্ষী হিসেবে ফ্রাংফুটে ডাকা হয়। জার্মান ক্যামিক্যাল কোম্পানি Degesch এর অবস্থান ছিল ফ্রাংফুটে যারা ডেথ ক্যাম্পে Zyklon B সাপ্লাই দিত। যা কিনা ৩৫০, ০০০ ইহুদির মৃত্যুর কারণ হিসেবে ধরা হয়। আর তখনই সুইডিশ পত্রিকাগুলো আবিষ্কার করলো যে সুইডেন অনেক আগেই হলোকাস্ট সম্পর্কে অবহিত ছিল।
১৯৬১ সালে জেরুজালেমে এডলফ আইখম্যান এর শুনানি চলাকালীন সময়ও সুইডেনের এই বিষয়টি আবারও সামনে আসে। এখন সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বলছে যে; সুইডেন ১৯৪২ সালে হলোকাস্ট সম্পর্কে মৌখিক রিপোর্ট পেয়েছিল। কিন্তু অন্য কাউকে সেই তথ্য প্রদান করেনি কারণ তারা ভেবে নিয়েছিল যে, এমন তথ্য অন্যরা ইতোমধ্যে জেনে থাকবে ।
Zykon B গ্যাসচেম্বারে যেন বন্দিদের দ্রুত মৃত্যু নিশ্চিত করা যায় তার জন্যে ব্যবহার করা হয়। Foto: SÜDDEUTSCHE ZEITUNG/IBL, EVERETT COLLECTION/IBL
ছবিটি এডলফ আইখম্যান বিচার শুরু হওয়ার প্রথম দিন, এপ্রিল ১৯৬১। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৬০ সালে তাকে জীবিত অবস্থায় দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা থেকে আটক করা হয়। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এডলফ আইখম্যানকে অপহরণ করে। তারপর তাকে ইসরাইলে ফেরত নিয়ে আসা হয়। সেখানে ষাট লক্ষ লোকের হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। বিচারকমণ্ডলী কর্তৃক তিনি দোষী সাব্যস্ত হন।
শুধু হলোকাস্টে জড়িতদের বিচার করা হয়নি, পরবর্তীতে যারা হলোকাস্ট অস্বীকার করেছে তাদেরও বিচার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়েছে ফ্রান্সে। ১৯৮১ সালে হলোকাস্ট অস্বীকারকারী রবার্ট ফাউরিসনকে (Robert Faurisson) কে বিচারের আওয়তায় আনা হয় আর প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আবার ডাকা হয় ইওরানককে। এক্সপ্রেসেন পত্রিকার সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান আরনে রুথ (Arne Ruth) যিনি সেই শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে এই সাংবাদিক সাংবাদিকতায় পুরষ্কার লাভ করেন। আরনে বলছেন, তিনি সে সময় অনেকক্ষণ ইওরানের সাথে কথা বলার সুযোগ পান। ইওরান হলোকাস্ট শুনানিতে অংশগ্রহণ করাকে এক রকম ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিবাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ক্লাস মার্ক অনেক বছর ধরে নাৎসি জার্মানি এবং হলোকাস্টের সাথে সুইডেনের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলছেন, সে সময় সুইডেনের পররাষ্ট্রদপ্তর সম্ভবত SS-অফিসারের তথ্য অন্যদেরও জানা আছে এমনটা ভেবেছিল। ১৯৪২ সালের ১৭ ডিসেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ইডেন (Anthony Eden) নাৎসিরা হাতে ইহুদিদের গণহত্যার নিন্দা করেন একই দিনে সংসদের নিম্নকক্ষে তার বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন।
তাই ক্লাস মার্ক বলছেন, নিম্নকক্ষে অ্যান্টনি ইডেন এর ভাষণের পর সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সম্ভবত ধরেই নিয়েছিল যে গণহত্যার সম্পর্কে ব্রিটেন আমেরিকা হয়তো কম-বেশি তথ্য জানে। এমনও হতে পারে জার্মানদের সাথে কোন বিরোধে সুইডেন যেতে চায়নি আর এই কারণে ইওরানের রিপোর্ট তারা প্রকাশ করেনি। তবে ইডেনের ভাষণে গণহত্যার কথা থাকলেও SS-অফিসার কোর্ট এর সেই গ্যাসচেম্বারের তথ্য ছিল না। ব্রিটেন সম্ভবত পোলিশ-সুইডিশ ব্যবসায়ীদের থেকে গণহত্যার তথ্য পেয়েছে। কিন্তু SS-অফিসার সুইডিশ কূটনৈতিককে গ্যাসচেম্বারের যে বিশদ বিবরণ দিয়েছে তেমন অনন্য তথ্য তাদের ছিল না।
ক্লাস মার্ক আরও বলেন, সুইডেনের জনগণ গণহত্যার বিষয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে ছিল। তৎকালীন সরকার গণহত্যাকে অনেকটা গুজব বলে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু যার বেশির ভাগই আসলে সত্য ছিল। সে সময় ইওরান বার্লিন এম্বাসেডর আর্ভিড রিচার্ড (Arvid Richert) ও ডেপুটি এরিক ভন পোস্ট (Eric von Post) এর সাথে তথ্য প্রচারের বিষয়ে আলোচনা করেন। এমনকি রিচার্ড চেয়েছিল যে জার্মানি কোন আল্টিমেটাম দেওয়ার আগেই সুইডেন যেন প্রস্তুতি নিয়ে রাখে।
পরবর্তীতে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে এক অফিসসহকারীকে সাজা দেওয়া হয়। মেয়েটি জার্মানির গেস্টাপোর সংস্থার কাছে তথ্য সরবরাহ করেছিল। রিচার্ট গভর্নর হিসাবে তাঁর কেরিয়ার শেষ করেছিলেন। অন্যদিকে ভন পোস্ট পরবর্তীতে রোমের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ক্লাস উল্লেখ করে যেন, কেন জার্মান দূতাবাস গ্যাসচেম্বারের রিপোর্ট লিখিতভাবে সুইডেনে না পাঠাতে বরং সরাসরি স্টকহোমে মৌখিকভাবে রিপোর্ট করতে বলা হয়। তার বড় একটা কারণ ছিল তারা জানতো এম্বাসীর মধ্যেও গেস্টাপোর লোক রয়েছে, যারা তথ্য জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য পাচার করে। যে ভয়টি তারা পাচ্ছিল সেই ভয়টি পরবর্তীতে সত্যি হয়।
১৯৫২ সালে জাতিসংঘের মিটিংয়ে ব্রিটিশ প্রতিনিধির সাথে আলোচনায় ব্যস্ত ইওরান ভন (ডান পাশে বসা)। পরবর্তীতে ইওরান SS-অফিসার কার্ট জারস্টাইন এর কাছে একটি চিঠি লেখে। কিন্তু তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। Foto: TT NYHETSBYRÅN
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জার্মানি যখন আত্মসমর্পণ করে তার ঠিক দুই সপ্তাহ আগে কার্ট জারস্টাইন ফ্রান্সের কাছে নিজেই আত্মসমর্পণ করেন। একজন SS-অফিসার হওয়ার কারণে তাকে যুদ্ধাপরাধী বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। প্রথমে তার সাথে কিছুটা ভাল আচরণ করলেও তাকে প্যারিসে অবস্থিত CHERCHE-MIDI জেল খানায় রাখা হয়। সেখানে তার সাথে অন্য নাৎসি বন্দিদের মতন আচরণ করা হতো। তা হয়তো তিনি মেনে নিতে পারেননি। ইওরানের চিঠি তার এর কাছে পৌঁছানোর আগে তিনি তার সেলে আত্মহত্যা করেন।
বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, কার্ট জারস্টাইন ছিলেন খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। কম বয়সে সে নাৎসি দলে জড়িত হয় এবং পরবর্তীতে এসএস (Schutzstaffel) এ যোগ দান করেন। আবার একই সময় ঘরে নাজি বিরোধী ব্রোশিয়ার রাখার কারণে তাকে গ্রেফতার করে জার্মান সরকার। শুধু তাই নয় তার ভগ্নীপতি মানসিক সমস্যার অভিযোগে নাৎসিদের হাতে Euthanasia চিকিৎসার শিকার হয়। নাৎসি অফিসার হয়েও তার মনের ভেতরে যে উত্থান-পতন তাতে এই ঘটনাগুলোও প্রভাব ছিল।
১৯৬৫ সালে কার্ট জারস্টাইনকে যুদ্ধাপরাধ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২০০২ সালে সেই ঐতিহাসিক ট্রেন ভ্রমণ এবং জার্মান নাৎসিদের চোখ এড়িয়ে কীভাবে ভ্যাটিকান সিটিকে এই গণহত্যা বন্ধ করার জন্যে তথ্য দিতে চেয়েছিলেন সেই সংগ্রামের উপর সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়। নাম- Amen। যেখানে দেখা যায় ইহুদিদের বিষয় হওয়ার কারণে জার্মান ক্যাথলিক যাজক কীভাবে বিষয়টি আমলে নেয়নি। অন্যদিকে নিরপেক্ষতার নামে ভ্যাটিকানের প্রধান যাজককে অন্যরা বিষয়টা জানাতে চায়নি। তবে এটিও দেখানো হয় যে, ইহুদিদের গণহত্যা থামাতে এক তরুণ যাজকের অকৃত্রিম প্রচেষ্টা। শুধু তাই নয়, অনেক বোঝানোর পরও যখন ভ্যাটিকানের পোপ নিরপেক্ষতার খাতিরে ইহুদিদের রক্ষা করতে কোন পদক্ষেপ নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তখন সেই তরুণ যাজক পোপের সামনে নিজের বুকে ইহুদিদের চিহ্ন সেই ডেভিড স্টার লাগিয়ে ভ্যাটিকান ত্যাগ করেন। এই যাজক ইহুদিদের সাথে একই ট্রেনে চেপে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে হাজির হোন। ইহুদিদের সাথে একজন যাজককে দেখে নাৎসিরা ভরকে যায়। পরবর্তীতে তিনি ইহুদিদের সাথে নিজেকে গ্যাসচেম্বারে উৎসর্গ করেন।
”En svensk tiger” ডকুমেন্টারিতে আমরা দেখতে পাই যে, একজন SS অফিসার হয়েও কার্ট জারস্টাইন জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর কূটনৈতিকের সহায়তায় বিশ্ব ও ক্যাথলিক চার্চের কাছে গণহত্যার বিষয়টি উন্মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ডকুমেন্টের আরেক উল্লেখযোগ্য দৃশ্য হল ইওরান ও কার্টের মেয়ের সাক্ষাৎ। তাদের দুইজনই পিতার স্মৃতি ও কর্ম তাদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। জারস্টাইন এর কন্যা বলছেন, বাবা SS অফিসার ও যুদ্ধাপরাধী হওয়ায় পরবর্তীতে তার মা সরকার থেকে কোন ভাতা পান নি। এই কারণে তাদের অনেক ভুগতে হয়েছে। অনেক বছর পর তারা তাদের বাবাকে বিভিন্ন অভিযোগ থেকে পুনরুদ্ধার করতে পেরেছেন।
ইওরানের কন্যা বলছেন, তার পিতার সারা জীবনের আক্ষেপ ছিল চাকরির সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি বেশি কিছু করেত পারেননি। এমনকি কার্ট জারস্টাইনকে লেখা চিঠিও সময় মতন পৌঁছাতে পারেননি। হয়তো সময় মতন সেই চিঠি পৌঁছাতে পারলে জারস্টাইনকে জীবিত অবস্থায় যুদ্ধাপরাধ থেকে মুক্তি দিতে পারতো।
১৯৮৪ সালে Svenska Dagbladet দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইওরান বলেন; উপরের অফিসারদের আদেশ পালন করা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।
কূটনৈতিক Göran von Otter সারা জীবন অপরাধ বোধে জর্জরিত ছিলেন। তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বারণ তিনি কেন শুনেছেন তার জন্যে আক্ষেপ করে গেছেন। Foto: CLAES GÖRAN CARLSSON / TT NYHETSBYRÅN
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিন
* ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯, জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এর দুই দিন পর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
* ১৯৩৯-৪১ সালের মধ্যে জার্মানি ইউরোপের বড় অংশকে নিজের কব্জায় নিয়ে নেয়। এবং ১৯৪১ সালের জুলাই মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ শুরু করে।
* ৭ ডিসেম্বর ১৯৪১, জাপান হাওয়াইয়ের পার্ল হারবারে আমেরিকান নৌঘাঁটি আক্রমণ করে এবং আমেরিকার আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে যোগদান।.
* ২১ অগাস্ট ১৯৪২, এসএস-অফিসার কার্ট জারস্টাইন এর সাথে সুইডিশ কূটনৈতিক ইওরান ভন অট্টার ট্রেন স্টেশনে সাক্ষাৎ। সেই ট্রেন ভ্রমণেই তিনি নাৎসি বাহিনীর গ্যাসচেম্বারের তথ্য বিশ্ববাসীর কাছে ফাঁস করে দিতে তথ্য প্রদান করেন।
* ২২ অগাস্ট ১৯৪২, বার্লিনের সুইডিশ দূতাবাস ইয়োরানকে ট্রেন ভ্রমণের সেই মিটিং এর তথ্য লিখিত আকারে সুইডেনে পাঠাতে নিষেধ করে।
* জানুয়ারি ১৯৪৩, ইয়োরান মৌখিকভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের প্রধানকে সেই এসএস-অফিসারের রিপোর্ট প্রদান করেন।
* ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে স্ট্যালিনগ্রানের যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। জার্মানি সোভিয়েতের কাছে হেরে যায়। ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসেও উত্তর আফ্রিকায় মিত্রবাহীনির কাছে জার্মানের পরাজয় হয়।
* ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫, হিটলার তার বাঙ্কারে আত্মহত্যা করে। এক সপ্তাহ পরে ৮ মে জার্মানি আত্মসমর্পণ করে।
* মে ১৯৪৫, কার্ট জারস্টাইন আত্মসমর্পণ করে এবং সে বিজয়ী দলের কাছে একটা রিপোর্ট প্রদান করে।
* ২৩ জুলাই ১৯৪৫, ইয়োরান জারস্টাইনের পক্ষে একটি চিঠি লেখেন। যা হয়তো তাকে যুদ্ধাপরাধ থেকে মুক্তি দিতে পারতো।
* ২৫ জুলাই ১৯৪৫, জারস্টাইন নিজের সেলে আত্মহত্যা করেন।
হলোকাস্ট নিয়ে আগ্রহীদের জন্যে:
নাৎসি ক্যাম্পঃ মৃত্যু হেঁটে গেছে জীবনের পথ ধরে, পর্ব ১
হিটলার সম্পর্কে লিখলে একটু ভাল হয় । কারণ, তার প্রতি আগ্রহটা সবচেয়ে বেশি…।
কি অসাধারণ একখানা লেখা। এমন আরো চাই। ধন্যবাদ শুভ।
ধন্যবাদ কাজী দা। 🙂
তথ্য সমৃদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হলো।
শুভর এই সিরিজটির জন্য অপেক্ষা করে থাকি। উড়ুক 👌
মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ বিপ্লব ভাই।