জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের একটি শক্তিশালী অংশ পরিচালিত হতো। তখন ব্রাহ্মসমাজের দৃশ্যত তিনটি ভাগের কথা জানা যায়। প্রথমটি, অক্ষয়কুমার দত্তের নেতৃত্বে বেদ-অনুসারী ব্রাহ্মসমাজ, দ্বিতীয়টি, কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে বর্ণপ্রথা বিরোধী প্রগতিশীল ব্রাহ্মসমাজ ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে রক্ষণশীল ব্রাহ্মসমাজ।
রবীন্দ্রনাথের দাদারাও জোড়াসাঁকোর ব্রাহ্মসমাজের হর্তাকর্তা ছিলেন, এ তথ্য আমাদের সবার জানা। রবীন্দ্রনাথও বিলেতে যাওয়ার আগে এবং বিলেত থেকে ফিরে ব্রাহ্মসমাজের নানা অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্তও থাকতেন। কিন্তু ক্রমে ক্রমে তিনি ব্রাহ্মসমাজ থেকে নিজেকে পৃথক ক’রে নেন। শুধু ব্রাহ্মসমাজ কেনো তিনি আর কখনোই কোনো “সাম্প্রদায়িক ধর্মসমাজ”-এর সাথে সম্পর্ক রাখেননি।
বাঙালিদের সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় সমাজ ভাবনা থেকে রবীন্দ্রনাথের এ দূরে থাকাও রবীন্দ্রনাথকে তৎকালীন সভ্যসমাজ , যার ইদানিংকার পরিশীলিত নাম সুশীলসমাজ, তাদের চক্ষুশূলে পরিণত করেছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে এ দু’টো তথ্য আমরা রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখালেখি থেকে জানি। এ কথাগুলো আবারও স্পষ্টভাবে সামনে এলো সদ্যপ্রকাশিত “ অপ্রকাশিত পত্রাবলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -সুকুমার হালদারকে লেখা” প্রবন্ধ থেকে ( শারদীয় সংখ্যা দেশ, ১৪২৬)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা চিঠিগুলোর আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন লেখকের লেখালেখিতে কিন্ত এবারই সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হলো।
সুকুমার হালদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেজোদিদি শরৎকুমারী দেবীর মেয়ে সুপ্রভাসুন্দরীর বর। সে হিসেব রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নিজামাই ছিলেন সুকুমার হালদার। বয়সে মাত্র দু’বছরের ছোট ছিলেন সুকুমার হালদার। কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠি সরকারী আমলা ছিলেন। বাংলাসহ সারা ভারতবর্ষে ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মামাশ্বশুর রবীন্দ্রনাথের সাথে গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল সুপ্রভাদেবী ও সুকুমার হালদার পরিবারের। তাঁদের এগারো সন্তানের সবাইকে শান্তিনিকেতনে রেখেই পাঠদান করিয়েছিলেন তাঁরা। সে সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর ভাগ্নির পরিবারের ছিল সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অপ্রকাশিত পত্রাবলি অনেক অজানা কিংবা জানা তথ্যেরও বস্তুনিষ্ঠ প্রমান।
ব্রাহ্মসমাজ ও রবীন্দ্রনাথ
সুকুমার হালদার নিজেও গুনী মানুষ ছিলেন। ইংরেজিতে অনেক বই লিখেছেন হিন্দু ও ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে। বিশেষকরে ব্রাহ্মসমাজের ক্রম ক্ষয়িষ্ণুতা ও স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাব নিয়ে লেখা তাঁর “ রামমোহন অনুধ্যান” গ্রন্থটি উল্লেখ করার মতো। ইংরেজিতেই লিখেছেন অধিকাংশ গ্রন্থ। উল্লেখ করার মতো,Hinduism: A Retrospect and a Prospect, The Bible Re-Examined, The Divine Love, A Dead Sea Apple, Raja Rammohan Roy and Hinduism.
রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত পত্রাবলি থেকে জানা যায় যে, সুকুমার হালদারের লেখা “Raja Rammohan Roy and Hinduism” গ্রন্থটি প্রকাশের আগে রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন গ্রন্থের ভূমিকা লেখার জন্য। উত্তরে মামাশ্বশুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভাগ্নিজামাইকে নিরাশ ক’রে লিখেছিলেন,
“ তোমার লেখাটি পেলুম। এ বিষয়টি এমন যে, এসম্বন্ধে আমি কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করি না। ব্রাহ্মসম্প্রদায়ের সংগে মত নিয়ে লড়াই করা বা কারো মনে আঘাত দেওয়া আমার দ্বারা হবে না। আদিব্রাহ্মসমাজের সংগেও আমার মতের বা মনের কোনো যোগ নেই”।
শুধু এটুকুই নয়, রবীন্দ্রনাথ এর পরেই প্রকাশ করেছেন তাঁর নিজের অবস্থানটি। অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর যে মনোভাব সেটিও প্রকাশিত হয়েছে এখানে,
“আমি সকল সমাজের বাইরে চলে গেছি। এই জন্যে কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্মসমাজ সম্বন্ধে আমি মত ব্যক্ত করতে ইচ্ছে করিনে। … আমি ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে থাকি বুড়োদের ব্যাপারে আমি জড়িয়ে পড়তে একান্ত অনিচ্ছুক’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ চিঠিটি লিখেছিলেন পৌষ ২৫, ১৩২৬ সালে। এ সময়ের আগে ও পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব এ ধর্মভাবনা থেকে কখনোই সরে আসেননি। এ নিয়ে তাঁর সাথে মহাত্মা গান্ধীর মতপার্থক্য ছিল। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের এ মতপার্থক্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন অনেকেই। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনও তাঁর “ তর্কপ্রিয় ভারতীয়” গ্রন্থে বিশাল একটি প্রবন্ধ লিখেছেন এ নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুর কয়েক মাস আগে কবি অমিয় চক্রবর্তীকে “ডিকটেশন” দিয়ে লিখেছিলেন, “সভ্যতার সঙ্কট” প্রবন্ধটি। সে প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ভারতীয় সমাজ কিভাবে ধর্মের নামে বিভক্ত হয়ে গেছে। তাই রবীন্দ্রনাথ সচেতনভাবেই সাম্প্রদায়িক এ ধর্ম বিভাজন থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন।
সুকুমার হালদারকে লেখা তাঁর এ চিঠি আরেকবার প্রমান করবে যে, রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত ধর্ম ও সাম্প্রদায়িক ভাবনার বাইরে ছিলেন। “হিন্দু রবীন্দ্রনাথ” বা “ ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ” হিসেবে তাঁকে আখ্যায়িত করার প্রচেষ্টা থেকেও নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করবে ভাগ্নিজামাই সুকুমার হালদারকে লেখা তাঁর এ “অপ্রকাশিত পত্রাবলি”।
রবীন্দ্রবিরোধী বাঙালি সমাজ
নোবেলপুরষ্কার রবীন্দ্রসমালোচকদের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছিল সে সময়। ভাগ্নিজামাই সুকুমার হালদার রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানিয়ে যে চিঠি দিয়েছিলেন সেখানেও তিনি এ কথাটি উল্লেখ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশতম জন্মদিনে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একটি কবিতা লিখেছিলেন,
“ জগৎ-কবি সভায় মোরা তোমারি করি গর্ব্ব
বাঙালি আজি গানের রাজা, বাঙালি নহে খর্ব্ব
দর্ভ তব আসনখানি অতুল বলে লইবে মানি
হে গুনী, তব প্রতিভা-গুণে জগৎ-কবি সর্ব্ব’।
১৯১১ সালে লেখা কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এ কবিতাটির বিরুদ্ধে সে সময়ের পত্রপত্রিকায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। “জগৎ-কবি” সভায় রবীন্দ্রনাথকে বসানোর এ কথাটি অনেকেই মানতে পারেননি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কবিবন্ধু দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কবি মোহিতলাল মজুমদার প্রমূখ। অশ্লীলতা এবং দুর্বোধ্যতা ছিল রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা। তাই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসাহিত্যে স্থান ক’রে নিয়েছেন একথাটিতেই আঁতেঘা লেগেছিল রবীন্দ্রবিরোধীদের।
রবীন্দ্রবিরোধী এ মহলটিকে রবীন্দ্রনাথসহ তাঁর স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা জানতেন। জানতেন সুকুমার হালদারও। ছেলের ছোড়া গুলতির আঘাতে সুকুমার হালদারের একটি চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সে সময়ে তিনি কলকাতা হাসপাতালে ছিলেন অনেকদিন। তখনই খবর আসে মামাশ্বশুর রবীন্দ্রনাথকে নোবেলপুরষ্কার দে’য়া হয়েছে। হাসপাতাল থেকে সুকুমার হালদার নভেম্বর ১৫, ১৯১৩ তারিখে লিখেন,
“ রবিমামা, আমার এক চোখ কানা, চিঠি লেখবার অবস্থা নয়, তবে আজ কাগজে আপনার সম্মানের বিষয় যা দেখলুম তাতে চুপকরে থাকতে পারলুম না। ধন্য ইংরেজ। আপনার লেখার সিকি অংশ গুণের আভাস পেয়েই ইংরাজ আপনার কদর বুঝলে। ধিক বাঙ্গালী! বাঙ্গালী মুড়ি মিশ্রির ভেদ কর্তে পারে না”।
“মুড়ি মিশ্রির ভেদ কর্তে” না-পারা বাঙালির সে রবীন্দ্রবিরোধীতা শত বৎসর পেরিয়ে আজও নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলছেই। আজ রবীন্দ্রনাথের রচনা নিয়ে তেমন কোনো বিরোধীতা হয়ত নেই, বাঙালির সামর্থও তেমন নেই রবীন্দ্রনাথকে ডিঙিয়ে যাওয়া, কিন্ত ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মভাবনা নিয়ে আজও ধর্মীয়সাম্প্রদায়িক বাঙালিদের একাংশের মিথ্যে প্রচারণা অব্যাহত আছে। সুকুমার হালদারকে লেখা রবীন্দ্রনাথের “অপ্রকাশিত পত্রাবলি” তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রামান্য দলিল।
( সূত্র ও কৃতজ্ঞতাঃ দেশ পত্রিকা, শারদীয় সংখ্যা ১৪২৬ )
Leave A Comment