ঈশ্বরের ক্ষুধার্ত দাঁতে
স্বর্গের স্তন ছিঁড়ে গেলে
অবারিত আলো এসে এঁকে রাখে
নক্ষত্রের ছবি;
জ্বলন্ত সূর্যের পাপড়িগুলো
খসে পড়ে বলে
অংকুরিত হয় নীলাভ পৃথিবী।
গাঢ় অন্ধকারের গহ্বর থেকে
উঠে এলে আলোর ছোবল
কেঁপে ওঠে ভয়ার্ত রাত্রির বুক
আর স্তরিত ছায়ার মধ্যে
মেঘ ও মাটির অসহ্য স্পন্দনে
জেগে ওঠে রঙের উদ্ভাস।
অন্ধ ঈশ্বরের অসাড় জিহ্বায়
তখনো ছিল না ভাষা,
শুধু ছিল তাঁর জান্তব চিৎকার;
মানুষেরা তাই স্তব্ধতার স্তব করে
আদিম গুহায়,
তখন ঝর্ণারা ভাষার আল্পনা আঁকে
মানুষের সুনিবিড় স্নায়ুকোষে।
-মঈনুল হক কাজী
অসাধারণ লেখনী
ভাল কবিতা পড়লে মন ভাল হয়ে যায়। মনের ভেতরকার বাতাস যেন সেইসব দিনগুলোকে মনে করায়। ভাল থাকুক কবি ও কবিতারা।
ধন্যবাদ। দুঃখিত, কিছুদিন একটু ব্যস্ত ও ক্লান্ত থাকায় সব কিছু থেকে একটু দূরে ছিলাম।
আদ্যিকাল থেকে মানুষ আকাশকে গভীর মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করে আসছে। সেটি শুধু আবহাওয়া বা ঋতুকে বুঝার দৈনন্দিন তাগিদ থেকে নয়। তারা সমস্ত আকাশকে শ্রেণীবিন্যস্ত করতে চেয়েছে, বিভিন্ন ঋতুর সাথে এর অবস্থান নির্ধারণ করতে চেয়েছে, নক্ষত্রপুঞ্জীর নামকরণ করে তাতে দেবত্ব আরোপ করে বিভিন্ন কাহিনী রচনা করেছে। এতে আকাশ শুধু পর্যবেক্ষকদল নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও আপন হয়ে উঠেছে। আর এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে রীতি-নীতি-আচার-ধর্ম। মানুষের সাথে তখন প্রকৃতির গড়ে উঠেছিল নিবিড় ঘনিষ্টতা, তাদের সব উদযাপনগুলো ছিল প্রাকৃতিক বিষয়নির্ভর, কোনো বিশেষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়।
আধুনিককালে নভোবিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর সাথে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা আছে বলে মনে হয় না। আমি মনে করি বিজ্ঞানের সাথে সাধারণ মানুষের এই দূরত্বকে কমিয়ে আনার দায়িত্ব শিল্পীসাহিত্যিকদের উপর বর্তায়। যেমন, এক সময় ইমপ্রেশনিস্টরা বুঝতে চেয়েছে আলো ও রঙের যাদুময়তা, সুরিয়েলিস্টরা অবচেতন জগত থেকে আহরিত শস্যকে বুঝতে চেয়েছে বাস্তবতার নিরিখে। বিপরীতভাবে, আমি যদি দৈনন্দিন বাস্তবতাকে অবচেতনের ভাষায় অনুবাদ করতে চাই তাহলে বিষয়টি কেমন দাঁড়াবে? আমি এই নিরীক্ষা করতে চেয়েছি আমার অনেক কবিতায়। ‘শ্রুতি’ কবিতাটিও এই প্রচেষ্টারই একটি অংশমাত্র। এই কবিতায় আমি বিশ্বসৃষ্টি থেকে মানুষের ভাষার উদ্ভবকে বুঝতে চেয়েছি অবচেতন জগতের উপমা ও প্রতীকের মাধ্যমে।
কবিতাটির শিরোনাম হল শ্রুতি। শ্রুতি মানে হল পুরাকথা, মিথ, বেদ, বেদাঙ্গ, আরণ্যক, উপনিষদ, সংহিতা ইত্যাদি। কবিতার শুরুতে আমি সৃষ্টিতত্ত্বকে উপস্থাপন করতে চেয়েছি। ধর্মগ্রন্থগুলোতে যা কিছু লেখা হয়েছে তা খুব অবোধ্য, অবাস্তব — সেটা কুরআন-বাইবেলের Genesis হোক কিংবা ব্রাহ্মাণ্যবাদের বিষ্ণুর নাভি থেকে উদ্গত পদ্মফুল হোক বা আরো অন্য কিছু হোক। সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বিজ্ঞান কি এই অবাস্তবতা মুক্ত? আমি একবার পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ‘বিগব্যাং’ নিয়ে ভাবছিলাম, আমি গোটা পাহাড়টাকে একটা ‘বিন্দু’ হিসেবে ভাবতে গিয়ে খাবি খাচ্ছিলাম। শুধু এই পাহাড় নয়, গোটা পৃথিবী নয়, সমস্ত সূর্যমণ্ডলী নয়, ছায়াপথ নয় বরং ছায়াপথের মত কয়েকশ’ বিলিয়ন গ্যালাক্সিকে এবার একটা বিন্দুতুল্য চিন্তা করুন। আসলে “বিগব্যাং” বুঝতে হলে আমাদের সেরকম কল্পনা করার ক্ষমতা থাকতে হবে। তবে কি বিজ্ঞান এখানে ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বের মতো অবাস্তবতা নয়? এই কবিতার প্রথম স্তবককে আমি সেই অবাস্তবতা তুলে আনতে চেয়েছিঃ
“ঈশ্বরের ক্ষুধার্ত দাঁতে
স্বর্গের স্তন ছিঁড়ে গেলে
অবারিত আলো এসে এঁকে রাখে
নক্ষত্রের ছবি;”
এবার দ্বিতীয় স্তবকে আসি। আমাদের পৃথিবীতে লোহা, তামা, সোনার মত ভারী মৌলগুলো কিভাবে তৈরি হল? সূর্যে কিন্তু শুধু হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের মত হালকা মৌল ছাড়া আর কিছু আছে বলে মনে হয় না। অথচ পৃথিবী এই সূর্যেরই অংশ। এর উত্তর হল, আজকের সূর্য হল আদিসূর্যের অংশ যা তার সুপারনোভা থেকে উদ্ভূত। সুপারনোভা ঘটাতে গেলে নক্ষত্রকে আগে সংকুচিত হতে হয়। দ্বিতীয় স্তবকে পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাসের উপর আলোকপাত করা হয়েছেঃ
“জ্বলন্ত সূর্যের পাপড়িগুলো
খসে পড়ে বলে
অংকুরিত হয় নীলাভ পৃথিবী।“
তৃতীয় স্তবকে জীবনানন্দের ‘অন্ধকার’ কবিতার হয়ত একটু প্রভাব পড়েছে নিজের অজান্তেঃ অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে/ হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে/বুঝতে পেরেছি আবার;/ভয় পেয়েছি,/পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;”
অন্ধকার ছিল স্বর্গের মত, শান্তির নীড়ের মত। সেখানে সর্পবত শয়তানের মত আলোর হিসহিস শব্দে আমরা স্বর্গচ্যুত, ভয়ার্তঃ
“গাঢ় অন্ধকারের গহ্বর থেকে
উঠে এলে আলোর ছোবল
কেঁপে ওঠে ভয়ার্ত রাত্রির বুক”
চতুর্থ স্তবকে আমি আলো ও রঙের বৈজ্ঞানিক নিয়মকে প্রকাশ করতে চেয়েছি প্রতীকী ভাষায়। আলো হল তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ। এই বিকিরণের ব্যাপক তাপ্পির অল্প অংশের সৌন্দর্য আমাদের চোখ অনুভব করতে পারে রঙের মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের কাছে গ্যামা রে, এক্স-রে, মাইক্রোওয়েভ, রেডিও ওয়েভ, অবলোহিত আলো অবোধ্য থেকে যায়। আলো হল বার্তাবাহক, কোন্ বস্তুতে কি আছে সেই খবর আমাদের কাছে নিয়ে আসে। বস্তু আলোর কিছুটা শোষণ করে আর কিছুটা ছেড়ে দেয় আর তা আমাদের কাছে রঙ হিসেবে প্রতিভাত হয়। আর এই আলো যা শুধু স্পন্দন ছাড়া আর কিছু নয়। এই অন্তর্গত সত্যকে রূপকশোভিত করা হয়েছে এই পর্বেঃ
“আর স্তরিত ছায়ার মধ্যে
মেঘ ও মাটির অসহ্য স্পন্দনে
জেগে ওঠে রঙের উদ্ভাস।“
শেষের দুই পর্বে আমি মানুষের ভাষার নিগূঢ় সুন্দরতার উৎসমূলে যেতে চেয়েছি আলঙ্কারিক ভঙ্গিতে, অবশ্যই আক্ষরিক অর্থে নয়।
“অন্ধ ঈশ্বরের অসাড় জিহ্বায়
তখনো ছিল না ভাষা,
শুধু ছিল তাঁর জান্তব চিৎকার;
মানুষেরা তাই স্তব্ধতার স্তব করে
আদিম গুহায়,
তখন ঝর্ণারা ভাষার আল্পনা আঁকে
মানুষের সুনিবিড় স্নায়ুকোষে। “
ওরেব্বাস, সুবিশাল ব্যাখ্যা। দারুন। এত সুন্দর করে বুঝিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ। বিজ্ঞান কক্ষনো বলে না যে ‘এইটাই শেষ কথা’। বিজ্ঞান তো বারবার পরীক্ষা নিরীক্ষা আর নিজেকে শুধরে নেবার জন্য সব সময়ই উম্মুক্ত নয় কি?
চমৎকার লিখেছেন। আরো লেখা দেখব আশা করছি।
অবশ্যই। বিজ্ঞানে শেষ কথা থাকলে তো বিজ্ঞান থেমে যেত। আমরা যত বেশি জানি তত বেশি অজানা জগত উন্মোচিত হয়।
বাহ্, সাধারণ দেখতে হলেও এইটি অসাধারণ একখানা কবিতা। গভীর ভাবনা থেকে উৎসারিত এমনি অর্থময় কবিতার কাব্য পাঠকদের নাড়িয়ে দিক অবলীলায়। খুলে দিক ভাবনার নতুন নতুন সব জানালা।
শিরোনাম শ্রুতি ঠিক কি অর্থে ব্যবহার করেছেন জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। কবিতাখানি পড়ে মনে হচ্ছে মহাবিশ্ব আর মহাকালের কথা লিখেছেন, দিতে চেয়েছেন অনেকগুলো ভাবনাসূত্র। আমার মনে হয়েছে এই কবিতাটি ভাব সম্প্রসারণ বা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কবি, আপনি কি বলেন?